ডাক্তার মিস পর্ব-০২

0
706

#ডাক্তার_মিস [০২]
কলমেঃ Hasin Rehana

বিভিন্ন রকমের গ্রামীণ পিঠা খেতে খেতে বুশরা বলল, “দোস্ত আমি হঠাত করে এসে খুব আন্টিকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম না রে?”

প্রাণের বান্ধবীর মাথায় একটা গাট্টা মেরে রুকাইয়া বলল, “খুউউব।”

তারপর সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, “দেখ আম্মা তার একমাত্র মেয়েকে ঢাকায় পাঠিয়ে ম্যালা কান্নাকাটি করে প্রতিদিন। আমি তো এসে থাকতে পারি না। তুই দেখবি আম্মা তুই থাকলে আম্মার মেয়ের অভাবটা পূরণ হবে। আম্মা কোনমতেই তোকে বাসা খুঁজতে দিবে না। এইটা আমি লিখে দিতে পারি।”

“কিন্তু তাই বলে অতিথি হয়ে এসে একটা বাসায় পার্মানেন্টলি থাকা আমার খুব অস্বস্তি হবে দোস্ত। তুই বুঝতে পারছিস না আমার অবস্থাটা।”

“বুশরা, তুই দুইটা দিন এই বাড়িতে থাকলে দেখবি, এত বড় বাড়িতে মানুষের খুব অভাব। আমি তো থাকি না। সারা বাড়ি জুড়ে আব্বা আর আম্মা। ভাইয়া তো আউট অফ সিলেবাস। উনার দিন কাটে মাঠে ঘাটে। আব্বাও বেশিরভাগ সময় মসজিদে পড়ে থাকে।”

কিছুক্ষণ থেমে বলল,

“দেখ তুই তো থাকবি আমার ঘরে। সো থাকার যায়গার চিন্তা নাই। আর খাওয়ার অভাব গ্রামে কোনও বাড়িতে হয়না। আমি আসলে বিছানায় আমাকে দয়া করে একটু যায়গা দিস তাহলেই হবে।”

রুকাইয়ার কাঁচুমাচু করার ধরন দেখে হেসে ফেলল বুশরা। এই বান্ধবীটিকে বিশ্বাস করে এখানে আসাটাই যে মস্ত বড় ভুল হয়েছে সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ বাকি নাই।

“তাহলে আমি সাবলেট থাকব, এই বাসায়ই।

“সরি দোস্ত। আমার এই ঘর আমি ভাড়া দিমু না।”

“এবার কিন্তু মাইর খাবি রুকু।”

“আচ্ছা শোন। গ্রামে একটা কমন কনসেপ্ট হচ্ছে জায়গীর থাকা। সাবলেটের মতই ব্যাপারটা। থাকা খাওয়া বাড়ির মানুষের মধ্যেই। বিনিময়ে সন্ধ্যাবেলা বাড়ির বাচ্চাকাচ্চাদের পড়াশুনা করানো লাগে।”

এবার কিছুটা আশ্বস্ত হল বুশরা।

“ঠিক আছে, তোর ভাইয়ের বাচ্চাকাচ্চাকে পড়াবো আমি তাহলে কাল থেকেই।”

“সে জন্যতো তোকে ভাইয়ার বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে সোনামণি।”

“ তাহলে?”

“তুই হচ্ছিস ডাক্তার মানুষ। মাস্টারি করার এত শখ ক্যান? বাসায় পোলাপান নাই, রোগী তো আছে। তা ও দুই দুই টা। সারা মাস ফ্রিতে চিকিৎসা করে দিবি, ব্যাস। প্রতিমাসে কয়বার গঞ্জ থেকে ডাক্তার আনা লাগে জানিস? আব্বার লাভই হবে। পুরাই উইন হুইন সিচুয়েশন।”

হাল ছেড়ে দিল বুশরা। রাতের খাবার খেতে ডাক পড়ল তখনই। ও ভেবেছিল মেঝেতে পাটি বিছিয়ে হয়ত খাওয়ার ব্যাবস্থা হবে। কিন্তু দেখা গেল, বিশাল একটা ডাইনিং টেবিলে নানান পদের খাবার সাজানো। রুকাইয়ার বাবা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছেন। পরিচয়পর্ব শেষে খাওয়া শুরু করল সবাই।

গম্ভীড়কন্ঠে রুস্তম শেখ বললেন, “রুকাইয়ার মুখে তোমার অনেক প্রশংসা শুনেছি। তা তুমি তো অনেক ভাল ছাত্রী। গ্রামের হসপিটাল তোমাকে টানবে তো মা?”

“তোমার আগে যে ডাক্তার ছিল সে হসপিটালের চেয়ে গঞ্জের চেম্বারেই বেশি বসত। একটু কিছু হলেই গঞ্জের ক্লিনিকে পাঠাতো রোগীদের। তাও তো ভাল। সে চলে যাওয়ার পরে ভাল কোন ডাক্তার এসে থাকতেই চায় না।”

“আঙ্কেল আমি আসলে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সেবা করার প্রতিজ্ঞা নিয়েই এই পেশায় আসছি। আমার কোনও গ্রামের বাড়ি নাই, থাকলে সেখানেই পোস্টিং নিতাম চেষ্টা ততবির করে।”

“খুব খুশি হলাম মা শুনে। আমাদের হসপিটালটা যদি এবার একটু জাতে ফিরে।”

“রুকাইয়ার আব্বা, তুমি কিন্তু মেয়েটাকে খাইতে দিচ্ছ না।”

“খাও মা খাও। মাঝে মাঝে গল্প করে বিরক্ত করব। ছেলেমেয়ে দুইটাকে তো কাছে পাই না।”

“জি আঙ্কেল, অবশ্যই গল্প করবেন।”

খাওয়াদাওয়া শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিল দুই বান্ধবী। অপরিচিত ঘরে ঘুমাতে বেশ বেগ পেতে হবে বলে ভেবেছিল ও। কিন্তু কিসের কি। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি কিংবা গ্রামীণ নীরবতা, যে কারণেই হোক না কেন, দুচোখে ঘুম নেমে আসতে সময় লাগল না বুশরার।

পাশেই একটা মসজিদে আজান হচ্ছে। শহরে যেমন পাশাপাশি অন্তত চারপাঁচটা আজান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তেমন নয়। মাইক ছাড়া একদম খালি গলার একটাই আজান। রাতে নির্বিঘ্ন ঘুম হওয়ায় আজানের সুমধুর কন্ঠে ঘুম ভাংল বুশরার। কলপাড় থেকে ওজু করে এসে কায়ামনোবাক্যে নামাজ পড়ল ও। স্রষ্টার কাছে দুহাত তুলে চাইল, চাকরীজীবনের শুরুটা যেন সুন্দর হয়। মানুষের সেবায় যেন কখনো পিছপা না হয়। তারপর একটা জানালার ধারে গিয়ে বসল। গ্রামের দোতালার জানালাগুলো মেঝের সাথে লাগানো হয়। জানালার অদূরে একটা পুকুর, একপাশে বাশঝাড়। এই ভোরবেলায়ও পুকুরঘাটে কেউ একজন বসে আছে। পেছন থেকে বয়স বুঝার উপায় নেই। শ্বেতশুভ্র পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, দৃষ্টি পুকুরের দিকে নিবদ্ধ।

বুশরা কিছুক্ষন মূর্তিমান মানুষটার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে আসল। ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট পকেট নোটবুক বের করে আবার আগের যায়গায় এসে বসল।

“আজ থেকে জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছি। প্রত্যন্ত এক পাড়াগ্রামে। অতীত থেকে লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। অল দ্য বেস্ট টু মি।”

সকালের নাস্তা সেরে রুকাইয়া আর বুশরা বেরিয়ে পড়ল হাসপাতালের দিকে। হাসপাতালের চেহারা দেখে হতাশ হল না বুশরা। পাড়াগ্রামে কাজ চালানোর মত হসপিটাল আছে এটাই অনেক বেশি। তবে হাসপাতালের ভেতরে ঘন্টাখানেক ঘুরে ফিরে একটু অবাকই হল সে। দক্ষ লোকবলের অভাব থাকলেও প্রয়োজনীয় মেডিকেল সরঞ্জামাদির খুব একটা কমতি নেই এখানে। হসপাতালের জন্য বরাদ্দ বাজেট যে খুব ভালমত ব্যাবহার হয় সেটা হাসপাতালে একটা চক্কর দিলেই বুঝা যায়।

পুরো হাসপাতালে বুশরা ছাড়া আরেকজন ডাক্তার আছে, ইকবাল হোসেন নাম। আউটডোরে রোগী দেখতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। দেরি না করে নিজের দায়িত্ব বুঝে নিল ও। রুকুকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে রোগী দেখায় মন দিল। বেশিরভাগ রোগীই সাধারন জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া এসব নিয়ে এসেছে। বর্ষা বাদলের শুরু বলে কথা। দুজন এসেছে মারামারি করে, পুরা ফাটাফাটি অবস্থা। ওদিকে দুদলের বন্ধুবান্ধব এসে ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিয়েছে, কাকে আগে চিকিৎসা দেওয়া হবে সেটা নিয়ে। সদ্য জয়েন করা ডাক্তার আপার উপর ভরসা করতে পারছে না দুই রোগীর বাড়ির লোকেরাই। সবাইকে বাইরে ঠেলে দিয়ে বুশরা আর ইকবাল ব্যাস্ত হয়ে গেল দুজনকে পরীক্ষা নিরিক্ষা করতে। কপাল ভালো যে মাথায় আঘাত লাগেনি কারোরই।

রাউন্ড শেষ করে চেম্বারে ফিরে এসে বুশরা দেখল ডেস্কের উপর একটা টিফিনবক্স রাখা। সাথে একটা চিরকুট।
“দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে নিস।”

চলবে…