#ডাক্তার_মিস
পর্ব ১৪ঃ
রুকাইয়া বাড়িতে এসেছে দুপুরের একটু পরে। এসেই ব্যাগটা রেখে বান্ধবীর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। চেম্বারে পাওয়া যাবেনা জেনেও একবার ঢু মারলো।
টেবিলের উপির টিফিনবক্সটা আধাখোলা করে রাখা। ঢাকনা উঠিয়ে দেখলো ভাতে ঝোল মাখানো। তবে দুইএক লোকমার বেশি খায়নি সেটা নিশ্চিত। হয়ত খেতে বসার সাথে সাথে ইমারজেন্সি রোগী এসেছে।
ফোনটা পড়ে আছে টেবিলের এক কোনায়। অগত্যা অপেক্ষা করতে লাগল বুশরা ফেরার। সময় কাটানোর জন্য এটা ওটা নাড়াচাড়া করতে লাগলো রুকু।
পিরামিড আকারের পেপারওয়েটটা দেখে মনে পড়ল এটা বুশরাকে গিফট করেছিল কয়েক বছর আগের জন্মদিনে। এখনো কি সুন্দর যত্ন করে রেখেছে মেয়েটা। পেপারওয়েটটা এমনিতে দেখতে সাধারণ কিন্তু আলোর দিকে ধরলে ঠিক মাঝখানে জ্বলজ্বল করে একটা শব্দ “Hope”। ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু কত শক্তিশালী।
মৃদু হেসে পেপারওয়েটটা হাতে নিলো রুকাইয়া। আলোর দিকে ধরবে তাই। কিন্তু তার আগেই এক টুকরো কাগজ উড়ে গেল। মনেয়হয় ওটা দিয়ে চাপা দেওয়া ছিল। জরুরি কিছু হবে ভেবে রুকাইয়া মেঝে থেকে উঠালো ওটা। কিন্তু একি। এটাতো একটা মানুষের স্কেচ। অবশ্য ডাক্তারের আঁকিবুকি যে কতখানি স্কেচ আর কতখানি কার্টুন সেটা পাঠকই বুঝে নিন। তবে শারীরিক গঠন, চশমা আর জামাকাপড়ের ধরন দেখে রুকাইয়ার মুখ থেকে একটাই কথা বের হল “আরে এটা তো… ”
কথা শেষ করার আগেই বুশরার ফোনটা বেরসিকের মত বেজে উঠলো। স্ক্রিণের উপর ভাসছে “Chairman Strange”। একটা ছবিও সেট করা। জুম করে তোলা মনেহয়, ফেটে গেছে একদম। ছবিতে একটা ছেলে পেছন দিক ফিরে বসে আছে পুকুরপাড়ে। ছেলেটা যে ওর ভাই এটা বুঝতে অসুবিধা হল না রুকাইয়ার।
মনে মনে বলল, “এই ছবি কখন তুলল মেয়েটা? আর কেনই বা রায়হান বুশরাকে ফোন করছে? আর ওই স্কেচটা? ওদের মধ্যে কি কিছু চলে?”
নিজের মাথায় নিজেই চাপড় মারে রুকু। এসব কি ভাবছে তাই। রায়হান যে সম্পর্ক বিয়ে এসব থেকে যোজন যোজন দূরে থাকার চেষ্টা করে সেটা তো ও খুব ভাল করেই জানে। আর কারনটাও।
এসব ভাবনাচিন্তার মাঝেই ফোনটা কেটে গেল। কিছুক্ষণ বাদে আবার রিং হলো। ধরতে দিয়ে রুকু খেয়াল করল বুশরার ফোনে কল আসেনি। এবার আসলে ওর নিজের ফোনটা বাজছে।
স্ক্রিণে ভাইয়ের হাসিখুশি চেহারা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। অনেক পুরোনো হলেও এই ছবিটা বদলায় না রুকু। মনে মনে চিন্তা করে, ” ইশ.. ভাইয়া কত হাসিখুশি ছিল।”
“হ্যালো ভাইয়া”
“রুকু, কবে আসবি? জরুরি কথা ছিল।”
“আমি তো আসছি ভাইয়া। হাসপাতালে আসছি। আসেপাশে থাকলে চলে আসো।”
“হাসপাতালে না। বাড়িতে আয়।”
রায়হানের কন্ঠে কিছু একটা ছিল। তাই কোন প্রশ্ন করলনা রুকাইয়া। হ্যান্ডব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
রুকাইয়া বাড়িতে ঢুকেই মায়ের কাছে রায়হানের খোঁজ করলো। ঘরেই আছে শুনে সোজা ওখানে চলে গেল।
রায়হান ডায়েরিতে কিছু লেখালেখি করছিল। দরজাটা আধখোলা করে রাখা। রুকু এসেই ধপ করে ভাইয়ের বিছানায় বসে পড়ল।
“বলো। কিসের জরুরি তলব?”
“কেমন আছিস?”
“ভালো। আরো ভালো থাকতাম যদি জানতাম তুমি ভালো আছো।”
একটু হেসে রায়হান বলল,
“পাগলী। আমি কি খারাপ আছি?”
“তাই? এক কাজ করো। আমার নম্বরে একটা কল দাও।”
“কেন?”
“দাও আগে।”
প্রশ্ন করে লাভ নেই তাই বোনের কথামত কাজ করল রায়হান। রুকু ফোনের স্ক্রিণটা ওর দিকে দেখিয়ে বলল,
“আই মিস হিম।”
চোরপুলিশ খেলায় হার মানলো রায়হান। মাথা নিচু করে চুপ করে থাকলো।
“এবার বলো।”
“তোর বান্ধবীকে বল ট্রান্সফার নিয়ে শহরে চলে যেতে।”
“কেন?”
“গ্রামের চা স্টলের আড্ডায় মুখোরোচক কথা হচ্ছে। আমি চাচ্ছিনা এসব কথা বাড়ুক।”
অবাক চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো রুকাইয়া। ছোট্ট করে জিজ্ঞাসা করলো, “কি করেছে বুশরা?”
“আমি কি একবারো বলেছি ডাক্তার মিস কিছু করেছে?”
“তাহলে?”
একই বাড়িতে থাকা, দুই একবার রাস্তাঘাটে একসাথে হওয়া, আর ওইদিন রাতের ইমারজেন্সি, সব মিলিয়ে কিছু মানুষজন যে বাযে কথা বলছে, এসব খুলে বলল রায়হান।
“আমার খুবই লজ্জা লাগছে আমার এলাকার মানুষজন এটা সম্মানিত ডাক্তারের নামে এরকম কথা বলছে। কি না করছে উনি এলাকার রোগীদের জন্য।”
রুকাইয়া কিছু বলল না। স্তব্ধ হয়ে শুধু শুনছে। কিছুক্ষন পরে বলল,
“কিছু না করেও পালাবে মেয়েটা?”
“আমি নিজের সম্মানের ভয় পাইনা। কিন্তু তুই তো জানিস, গ্রামে একবার যে কথা ছড়ানো শুরু হয় সেটা সহজে বন্ধ হয় না। উনি মেয়ে, উনার জন্যই কঠিন হবে সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করে। যাদের জন্য কষ্ট করে গ্রামে থাকছে তারা যদি অকৃতজ্ঞ হয় তাহলে কি দরকার?”
“আমি ওর সাথে কথা বলব ভাইয়া। টায়ার্ড লাগছে। যাই। ”
বিষন্ন মন নিয়ে অন্ধকার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল রুকাইয়া। বান্ধবীর কাছে গ্রামের মানুষ নিয়ে করা হাজারো প্রশংসা কানে বাজতে লাগলো ওর। কোন মুখে বলবে বুশরাকে যে চলে যা?
চলবে…
#ডাক্তার_মিস
পর্ব ১৫
সন্ধ্যাবেলা ঠিক হাসপাতাল থেকে হওয়ার মুহুর্তে একটা ভ্যান থামলো হাসপাতাল গেইটে। ভ্যানের উপর শোয়া একটা কিশোরী মেয়ে তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদছে। মেয়েটা সন্তানসম্ভবা। বয়স কত হবে? ষোল? বড়জোর সতেরো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উলটোপথে ছুটলো বুশরা, আমাদের ডাক্তার মিস। বাচ্চা মেয়েটার ত্রাণকর্তা হয়ে যুদ্ধে নামতে হবে যে।
গর্ভের সন্তানের বয়স মাত্র সাড়ে ছয় মাস। স্বাভাবিক প্রসববেদনা ওঠার সময় হতে এখনো বেশ দেরী। ঠিক কি করায় এত আগেভাগে ব্যাথা উঠলো জিজ্ঞাসা করলে মেয়েটার সাথে আসা চল্লিশোর্ধ বড় জা বললেন,
“এই মাইয়ার ঢং বেশি। নড়তে চড়তেও মনে হয় কষ্ট লাগে। আমরা বাচ্চা জন্ম দিছি না গন্ডায় গন্ডায়? লজ্জা শরমের মাথা খাইয়া এমুন চিল্লাচিল্লি করছি নি?
একে তো বাচ্চা মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে তার উপর এই মহিলার উলটা পালটা কথা শুনে ধৈর্যচ্যুতি ঘটার দায় বুশরার।
মেয়েটার সাথে আসা সমবয়সী একটা মেয়ে মিনমিন করে বললো,
” ভাবী সকাল থেকেই বলতেছিলো শরীরটা ভালো লাগতেছেনা। তার উপ্রে এতগুলান চাল ঢেকিত দেওয়ার কি দরকার আছিল। তোমার ছাওয়াল পিঠা খাবার চাইছে, তুমি চাল কুটলেই তো হইতো। ভাইয়া শহর থেকে আইসা যদি শুনে তার ছাওয়ালের কিছু হইছে তাইলে আগুন লাগায়ে দিবে। বুইঝো ঠেলা।”
মহিলা কাঁকিয়ে উঠলেন, “ধান উশানোর দিন তো কিছু হলো না। আইজকা সমিস্যা হবে আমি জানি?” (ধান থেকে চাল করার জন্য গ্রামে বড় বড় চুলায় বড় ডেকচিতে করে ধান শেদ্ধ করা হয়। এটাকে বলা হয় উশানো)
এক মুহুর্ত দাড়ালো না বুশরা। এদের কথা শুনে মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো ওর। সাড়ে ছয় মাসের গর্ভবতী একটা পিচ্চি মেয়েকে দিয়ে ধান উশায়? ঢেকিতে পাট দিতে দেয়? এই মহিলা কি মানুষ?
পাক্কা চার ঘন্টা পর যমে মানুষে টানাটানি শেষ হলো। রিনরিনে গলার চিৎকারে ছোট্ট শিশুটা জানান দিলো তার আগমনীবার্তা। বুশরা ভেবেছিল প্রিম্যাচ্যুরিটির কারনে বাচ্চাটার চোখ হয়তো ফোটে নি এখনো। এনআইসিউতে রাখতে হলে হয়ত বেঁকে বসবে পরিবার।
ছোট্ট ছোট্ট চোখদুটো মেলে পিচ্চিটা যখন পিটপিট করে তাকালো তা দেখে টুপ করে একফোটা জল গড়িয়ে এল বুশরার চোখের কোন বেয়ে। বাচ্চাটা একদম ওর মায়ের মত হয়েছে। যোদ্ধা মায়ের মত।
নার্স বাচ্চাটাকে পরিষ্কার করে কিশোরী মেয়েটার ডান হাতের উপর শুইয়ে দিল। তুলতুলে আংগুল দিয়ে মায়ের শরীর খামচে ধরল পিচ্চিটা। মুখে হাসি চোখে জল নিয়ে মেয়েটা বুশরার হাত চেপে ধরলোম নিরবে জানালো, ধন্যবাদ।
চেম্বারে এসে ভ্যানওয়ালা মামাকে ফোন করল বুশরা। সবসময় ওই বাড়ির মানুষদের সাহায্য নিতে মন সায় দেয়না বুশরার। তাই চেষ্টা করে ভ্যান দিয়েই কাজ সারতে। লোকটা হাসপাতালের আসেপাশেই ছিল। আসতে বেশিক্ষণ লাগল না। তবে বুশরাকে নিয়ে ভ্যান কিছুদুর যেতেই চেইনটা পড়ে গেল।
ঠিক তার পাশের চায়ের দোকানে বাইকে ভর দিয়ে দাঁড়ানো একটা ছেলে প্রায় শুনিয়ে শুনিয়েই বলল,
“চেয়ারম্যান সাহেব গ্রামে নাই নাকি?”
সাথের ছেলেটা বলল, “তাই তো মনে হইতাছে, ভাই।”
“আহারে, আহারে, রাত বিরাতে একা একা…. ”
“হ ভাই, কোন চ্যালারে পাঠায়ে দিলেও তো পারতো। নাইলে আমাদেরই বলত। আমরাওতো মানুষ খারাপ না। তাই না বলেন?”
ফিচেল হাসি হাসলো দুজনেই।
বুশরা শুরুতে খেয়াল করেনি। তবে আবছা আলোতেও ওদের অঙ্গভঙ্গি আর কথাবার্তার ধরন শুনে বুঝলো ওকে নিয়েই কথা বলছে ছেলেগুলো। অস্বস্তিতে কানদুটো গরম হয়ে উঠলো ওর। ঠিক তখনই চলতে শুরু করলো ভ্যান। বাড়ি পৌঁছাতেও দেরি হলো না খুব একটা।
বাড়িতে ঢুকেই শিউলি বেগমের সামনে পড়লো বুশরা।
“কতদিন বলছি রাত হলে একটা ফোন করবা, আমি কাউরে পাঠায়ে দিবো। কে শোনে কার কথা।”
অপরাধী মুখ করে বুশরা বলল, ” বেশি রাত হয়নি তো চাচিআম্মা।”
“চাচিআম্মা বলেই এই কথা বলতে পারতেছো। আম্মা হলে পারতে না।”, রাগ করে বললেন শিউলি বেগম।
এবার কান ধরে বুশরা বলল, “আমার কি আর আম্মা আছে? তুমিই চাচী, তুমিই আম্মা। ভুল হয়ে গেছে চাচীআম্মা। মাফ করো এবারের মত।”
বুশরার কাঁদো কাদোঁ চেহারা দেখে হেসে ফেললেন মমতাময়ী মহিলাটি। বললেন,
“থাক আর ঢং করতে হবে না। আপনার কলিজার টুকরা বান্ধবী আসছে। ঘরে যান।”
“সত্যিইইই???”
তড়িঘড়ি দৌড় দিলো বুশরা। ফলাফল, আধোআলো সিড়িতে খেল ধাক্কা। কি ভাবছেন? রায়হানের সাথে? তাহলে তো বেশ রোমান্টিক হতো ব্যাপারটা। কিন্তু না, বুশরা হোচট খেয়ে ধাক্কা খেল সিড়ির দেয়ালে। ব্যাথার চোটে ধপ করে বসে পড়লো। তখনি সিড়ি দিয়ে নামছিল রায়হান। বুশরাকে পা চেপে বসে থাকতে দেখে আস্তে করে বলল,
“আপনি আসলেই একটা অন্ধ।”
রায়হানের শ্লেষাত্মক কন্ঠ শুনে যখন মুখ তুলে তাকালো বুশরা, ততক্ষনে ঘরে ফিরে গেছে রায়হান। আপাতত বুশরার মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না ও। এদিকে বুশরা ভাবলো হয়ত মনের ভুলে রায়হানের কন্ঠ শুনেছে ও।
হ্যালুসিনেশন।