#ডাক্তার_মিস
পর্ব ২৪
#শুভ_বিবাহ
রাত পেরোলেই ওদের বিয়ে। সারা রাত উত্তেজনায় ঘুমাতে পারলো না বুশরা। অবশ্য হলুদের অনুষ্ঠান শেষে বুশরা আর রুকাইয়ার বান্ধবীদের যায়গা হয়েছে ওদের ঘরেই। তাই ঘুমানোর মত পরিস্থিতিও তেমন নেই।
অনেক দিন পর কাছের বান্ধবীরা এক যায়গায় হওয়ায় গল্প আড্ডা চলছে সমান তালে। বুশরার হাতে মেহেদী দেওয়া শেষ হয়েছে আগেই। এখন রুকাইয়া আর অন্যরা একে অপরের হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষাজীবনের গল্প করছে। আলাদা হয়ে যাওয়ার পরের জীবনের গল্প করছে।
এত হই হুল্লোড়ের মধ্যেও বুশরা কিছুটা আনমনা। সবার অলক্ষ্যে উঠে গিয়ে বসলো জানালার পাশে। বাইরে তাকাতেই চোখে পড়লো কাঙ্খিত দৃশ্য। চাঁদের আলোয় পুকুরঘাটে বসে থাকা অবয়বটা চিনতে ভুল হলো না ওর। আজকের রাতেও মানুষটা ওখানে।
তাহলে কি বিয়েটা মনের বিরুদ্ধে গিয়ে করছেন? ইচ্ছে হলো একটা ফোন করতে। দ্বিধা নিয়ে জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু করাটা বোকামি। কিন্তু এখন কথা বলার মত পরিস্থিতি নেই।
হাতের কাঁচা মেহেদী অসহ্য লাগছে বুশরার। রুকুকে বললে ডায়াল করে দিবে, কিন্তু সবাই মিলে ঠাট্টা করতে শুরু করবে।
অধৈর্য হয়ে বলল, “আর কতক্ষণ পর মেহেদী তোলা যাবে?”
রুবি ফিচেলচাবে হেসে বললো, “এত তাড়া কিসের দোস্ত। মেহেদীর রঙ যত গাড় হবে, দুলাভাই তত বউসোগাহা হবে।”
হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। সে হাসিতে যোগ দিতে পারলো না রুকু। বান্ধবীর অসহায় চেহারা দেখে কাছে এসে আস্তে করে প্রশ্ন করলো, “ঘুম আসছে? শুয়ে পড় মেহেদী শুকায়ে গেছে প্রায়, মাখামাখি হবে না।”
“বিছানা নষ্ট হবে তো।”
“হলে হবে, য়্রাপিং পেপারে মুড়ে গিফট করবো বিয়েতে।”
মুচকি হাসলো রুকু।
সাথী বললো, “ঘুমায়ে পড়, কাল সুন্দর লাগবে না নাহলে। এমনিই তোর জায়েরা একেকটা আগুন।”
কথার পিঠে হৃদি বললো, “ঘুমা দোস্ত, আবার কবে ঘুমাতে পারবি কে জানে?”
হা হা হি হি চলতে থাকলো ননস্টপ। বুশরা ডান হাতের মেহেদি ডিজাইন খুঁটে খুঁটে দেখতে লাগলো। ডিজাইনের ভাঁজে ভাঁজে রায়হানের নামের অক্ষরগুলো ছড়ানো ছিটানো ভাবে লুকানো। “এন” খুঁজে পাচ্ছনা ও। জানালা দিয়ে আরেকবার বাইরে তাকালো। রায়হান এখনো পুকুরপাড়ে বসে আছে।
সাবধানে ফোনটা হাতে নিল বুশরা। ছোট্ট করে ম্যাসেজ লিখলো, “R u really ready for it?”
ওপাশ থেকে কোন উত্তর এলো না। আবার নিজের হাতের মেহেদীতে মনযোগ দিল বুশরা। এবার “এন” খুজে পেয়েছে। রায়হানের সাথে সম্পর্ক সহজ হলে আগামীকাল রাতে হয়ত দুহাত মেলে ধরে বলতো, নিজের নাম খুঁজে বের করুন দেখি। কিন্তু সেটা সম্ভব না।
নিজের আকাঙ্খিত পুরুষের জীবনের পুরোটা জুড়ে অন্য কেউ থাকার কষ্ট সূক্ষ্মভাবে বুকে বাজছে বুশরার। সব জেনেশুনেই সামনে এগিয়েছে ও। তাই অহেতুক অনুভূতিদের পাশ কাটাতে বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো বুশরা।
আরো ঘন্টাখানেক পর একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো।
ভোর সকালে শেখবাড়ি গমগম করে উঠলো উৎসবের আমেজে। আরেকদফা গায়ে হলুদ হলো একদম গ্রাম্য নিয়মে। পুরুষদের গোসলখানায় রায়হানের গায়ে হলুদ লাগানো হলো স্বল্প পরিসরে। তারপর সেই একই হলুদ ছোঁয়ানো হলো বুশরাকেও, মেয়েদের গোসলখানায়।
আজকের হলুদ পর্বে বিবাহিত মহিলারাই অংশ নিল মূলত। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে চললো হলুদ মাখামাখি, শেষ হলো কাদা মাখামাখি দিয়ে। ভয় পাবেন না। এটাও গ্রামীন আনন্দ।
বিয়ে পড়ানো হলো বাদ যোহর। এর মাঝে একবার ফোন হাত্র নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল বুশরা। ইনবক্সে ঢুকে দেখলো রায়হান রিপ্লাই দিয়েছে। “আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন, হুজুগে না।”
রায়হানের কথার উপর ভরসা করে এক অন্যরকম ঘোরের মধ্যে কিচ্ছু না দেখে কাবিননামায় সিগনেচার করলো বুশরা। পরপর তিনবার “কবুল” বলে ফেললো।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর দীর্ঘ সময় স্টেজে পাশাপাশি বসে ছিল বর কনে দুজনে। একে একে সবাই এসে পরিচিত হলো, ছবি তুললো ওদের সাথে। দোয়া করলো নতুন জীবনের জন্য।
এলাকায় রায়হান আর বুশরার শুভাকাঙ্ক্ষীর পরিমান হাতে গোনা নয়। বিয়েতে তাই প্রচুর মানুষজন দাওয়াত করা হয়েছে, তারা এসেছেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তাছাড়া বউ নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার তাড়া নেই। তাই ঘন্টার পর ঘন্টা স্টেজে বসে সবার সাথে হাসিমুখে ছবি তুলতে হলো ওদের। এত সময় একসাথে থাকলেও একে অপরের দিকে তাকানো বা কথা বলা হয়নি একদমই।
সন্ধ্যার পরে বুশরাকে শিউলি বেগমের ঘরে নেওয়া হলেও মেয়ে বউরা ঘিরে রাখলো বুশরাকে। একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পেলো না ও।
এর মধ্যে একটা প্লেটে ভাত মাখিয়ে নিয়ে আসলেন শিউলি বেগম, কারন উনি ভালো করেই জানেন বিয়ের টেনশনে সারাদিন বুশরা কিছুই খেতে পারেনি, তাছাড়া ও বিরিয়ানি খেতে পারেনা।
এত মহিলার মাঝে খেতে ইতঃস্তত করছিল বুশরা। তবে শিউলি বেগমের জোরাজুরিতে কয়েক লোকমা খেতে বাধ্য হলো। রায়হানকে পছন্দ করলেও এই মানুষটার আদরের লোভেই তো আজ জীবন নিয়ে জুয়া খেললো আজ।
ছেলের বউয়ের প্রতি এত ভালবাসা দেখে কেউ কেউ চোখ পাকাতে ভুললো না, তাদের কাছে এসব আলগা আদিখ্যেতা। তবে কালকের ঘটনার পর, অপমানিত হওয়ার ভয়ে মুখে কিছু বললো না।
একে একে সবাই বিদায় নিলে বুশরাকে রায়হানের ঘরে নিয়ে গেল রুকু, ওদের বান্ধবীরা, আর বোন, ভাবীরা। ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো, সাদা গোলাপ দিয়ে। বিছানার উপর কিছু পাপড়ি ছড়ানো, তা ও সাদা।
রায়হান রাশভারি মানুষ। বোন আর ভাইয়ের বউরা বেশ সমীহ করেই চলে ওকে। তাই বাসর ঘরের গেইট ধরার মত কলিজা তাদের কারো নেই। তবে বুশরার বান্ধবীরা এই সুযোগ ছাড়লো না। তাদের একমাত্র দুলাভাই ও। বিনাযুদ্ধে ময়দান ছাড়বে না তারা। রায়হান উচ্যবাচ্য না করে জানতে চাইলো কত চায় তারা।
“দশ হাজার মাত্র, ভাইয়ায়ায়া..”
রায়হানের ভাই, দুলাভাইরা হই হই করে উঠলো এটা শুনে।
রায়হান বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু আমার পকেটে তো এত টাকা নেই এখন।”
হৃদি বললো, “এ কথা বললে তো হবে না ভাইয়া। বাকির কাজ ফাঁকি।”
সবাই হৃদিকে সাপোর্ট দিলো। রায়হান রুকুর হাতে একটা চাবি দিয়ে বলল, আলমারি থেকে টাকা নিয়ে আসতে। পাওনা বুঝে পেতে দরজা ছেড়ে দিল ওরা। রুকু চলে গেল ওদের নিয়ে। ঘরে ঢুকেই বিছানায় নজর গেল রায়হানের। সাদা বিছানায় সাদা ফুলের গালিচার মাঝখানে গুটিশুটি মেরে বসে আছে লাল টুকটুকে শাড়ি পরা বুশরা।
রায়হানকে দেখে নেমে আসলো বিছানা ছেড়ে। ঝুকে সালাম করতে চাইলো রায়হানকে। তবে ওকে থামিয়ে দিল রায়হান। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা শরীয়তসম্মত নয়, মনে করিয়ে দিল। লজ্জিতমুখে মাথা নিচু করলো বুশরা। সেটা উপেক্ষা করে রায়হান আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। ড্রয়ার থেকে কিছু একটা বের করে ফিরে এল সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর কাছে।
“হাতটা বাড়ান।”
বিয়ের পরের প্রথম কিছু বললো রায়হান ওকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত হাত বাড়ালো বুশরা।
একটা খাম আর দুটো চাবির গোছা।
“কি এগুলো?”, অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো বুশরা।
“একটা চাবির গোছা এ ঘরের দরজা, আলমারির ড্রয়ার থেকে শুরু করে সবকিছুর চাবি। খামটা দেনমোহর।”
খাম খুলতেই একটা দলিল বের হয়ে এল। দলিল দস্তাবেজ বোঝেনা বুশরা। আবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকালো ও।
আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙিতে রায়হান বলল, “আমার তেমন কোন সেভিংস নাই। আছে বলতে একটা ছোট্ট বাড়ি, দুইগ্রাম পরে, ধলতা নদীর তীর ঘেঁষে। এই বাড়ির তুলনায় কুড়েঘর বললেই ঠিক হবে। শেষ বয়সটা ওখানেই একলা কাটাতে চেয়েছিলাম বলে বানিয়েছিলাম। ওটা আজ থেকে আমার স্ত্রীর। আরেকটা চাবি ওই বাড়ির। ”
অবাক চোখে রায়হানের দিকে তাকালো বুশরা। কানের মধ্যে একটা শব্দই বাজতে থাকলো “স্ত্রী”।
” ঘুমিয়ে পড়ুন মিস। রাত হয়েছে। ”
বিছানায় উঠে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে রায়হান। কিছুক্ষণ স্থানুর মত দাড়িয়ে থেকে ড্রেসিংটেবিলের দিকে এগুলো বুশরা। একে একে গহনাগুলো খুলে রাখলো। লাইট অফ করে ডিম লাইট জ্বালালো। শড়িটা পালটে একটা হালকা শাড়ি পরে নিল। তারপর বিছানায় গিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। অনেকক্ষন এপাশ ওপাশ করে ঘুম আসলো না। রায়হান ঘুমিয়েছে কি না বুঝা যাচ্ছে না। কিছুক্ষন পর আলতো করে বললো,
“আমি তো আর মিস নেই চেয়ারম্যান সাহেব। আর হ্যা, আপনার স্ত্রী তো শেষ বয়সে তার কুড়েঘরে আপনার একা থাকা এলাউ করবেনা।”
কয়েকমুহুর্ত পরেও যখন উত্তর আসলো না ও ভাবলো লোকটা হয়ত ঘুমিয়ে গেছে। ওকে ভুল প্রমান করে পুরুষালি কন্ঠে রায়হান বলল,
“আচ্ছা।”
চলবে??????