ডেভিল পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

0
793

#ডেভিল
#জয়ন্ত_কুমার_জয়

[অন্তিম_পর্ব]

নিচে এসে সকালের নাশতা করলাম।এখন ঘরে কাপর গোছাচ্ছি হঠাৎ কি যেন খুজতে ড্রয়ারটা খুললাম,খুলতেই সেখানে কিছু চিরকুট ছিল,সাথে কয়েকটা কার্ড।আরে এই কার্ডেই তো আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ছিল সেই লোকটা।কার্ডগুলা এখনো আমার কাছে আছে।এমনকি ওই চিরকুট গুলাও রেখেছি।জন্মদিনের দেওয়া কার্ডের সাথে মিলিয়ে দেখলাম।একদম সেম টু সেম,এই কার্ডগুলার ওপর লিখেই তো আমায় শুভেচ্ছা জানিয়ে ছিল। এ কার্ডগুলা এখানে আসলো কিভাবে?ওখানে আর কি কি আছে সেগুলা খুজতে লাগলাম। আরেহ এটা তো একটা মুখোশ, এই মুখোশটা পড়েই তো!

তার মানে কি ওই লোকটা উনি ? নাহ্ তা কি করে সম্ভব,উনি চুপিচুপি এরকম কেনো করতে যাবে।কিছুই বুজতে পারছি না।তখন উনি বাসায় ছিলো না। ওনার বন্ধুদের সাথে গেছে।রাতে আসবে বলেছে।তাই সব প্রশ্নের উত্তর রাতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করলাম।

রাত আটটা বেজে গেলো এখনো উনার আসার কোনো নাম নেই। বারবার ফোন করছি কিন্তু ফোন বন্ধ। আমার টেনশন আরো বেড়ে গেলো।বেলকনিতে দারিয়ে আছি এমন সময় গাড়ির হর্ন শুনলাম।তার মানে উনি এসে গেছে। এরপর ওনাকে খেতে দিলাম,উনি নিজে আর আমাকেও খাইয়ে দিলেন।যদিও আমি না করেছিলাম।

এখন বাজে রাত ১১টা।উনি বিছানায় বসে গেম খেলছে। আমি একটা সাওয়ার নিয়ে ভেজা চুল আয়নায় সামনে গিয়ে মুছতেছি।মাথায় আমার সে প্রশ্নগুলা এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে।আর ভাবতে পারছিনা, এবার বলেই ফেলি

এই যে শুনুন

হুম বলো

গেম খেলা বাদ দিন,আমি একটা কথা জিগ্যেস করবো

হুম করো আমি শুনছি

না,মনোযোগ না দিলে বলবো না

আচ্ছা ঠিক আছে। বলো

এই কার্ডগুলা এখানে কেন? (কার্ডগুলা দেখিয়ে বললাম)

ও ওগুলা নীলার জন্মদিনে কিনেছিলাম এ কয়টা বেশি হয়েছিলো তাই রেখে দিয়েছি

ওও,আর এই মুখোশটা?

এটা কোথায় পেলে

সেটা বড় কথা নয়,এটা দিয়ে কি করেন আপনি?

আমি জোকারের ওপর একটু বেশি ইন্টারেস্টিং,তাই মুখোশটা কিনেছিলাম, কিন্তু এগুলা আমায় বলছো কেন?

তার মানে আমি যা ভাবছি সেটাই ঠিক

কি ভাবছো?

না কিছু না,

উনি এখন সব বলবেন না বুঝতে পারছি।তাই আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।একটু পর উনি আমায় জরিয়ে ধরলো।ওনার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম।

আমি জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,আচ্ছা ঠিক আছে,সত্যিটা বলেই দিই

মানে?

মানেটা হলো সেই লোকটা আমি ছিলাম

আপনি ছিলেন? কিন্তু কেন? কেনো আসতেন এতো রাতে?

কি করবো বলো,তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করতো,তাই তো ছুটে চলে যেতাম তোমায় দেখতে

তা না হয় বুঝলাম।আচ্ছা এটা বলুন তো আমার জন্মদিনের সেই সারা ঘরে বেলুন দিয়ে আপনি সাজিয়েছেন? গিফটটা আপনি দিয়েছিলেন?

হুম

আর সেদিন কলেজে যে আদনানের সাথে পার্কে গিয়েছিলাম ওখান থেকে ওকে আপনি নি..

হুম।তোমার দিকে কেউ তাকালেই আমার সহ্য হতো না,সেখানে ও তোমায় নিয়ে পার্কে গিয়েছিল এটা কি করে মেনে নিতাম,তাই জয়কে বলে ওকে কিডনাফ করেছিলাম।

ও মাই গড! আপনি এতো

তো কি করতাম? ইচ্ছে করছিলো ওখানেই ওকে মেরে ফেলতে, শুধু মাত্র জয়ের কথায় ওকে একটা চান্স দিয়েছিলাম।কিন্তু সেদিন যখন ও আমায় কিডনাফ করলো তারপর আর মাফ করতে পারিনি ডিরেক্ট

আপনার যাকে ভালো লাগবে না তাকেই এভাবে।আমি ভাবতেই পারছি না

কি করবো বলো,একটু বেশিই ভালোবাসি।যাই হোক আর কিছু জানার আছে?

হুম,আপনি আড়াল থেকে কেনো এসব করলেন?

সেটা না হয় না জানাই থাক

আপনি যান,আমি রাগ করছি

কেনো? কি হলো আবার?

কি হবে মানে?বুঝলাম আপনি আমায় দেখতে এসছিলেন কিন্তু কিস কেনো করেছিলেন

তোমার ওই গোলাপি ঠোঁট গুলার জন্যই তো করছি।যখন যেতাম তখন তোমার ঠোঁট বলতো ওর নাকি অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে তাই আমি অক্সিজেন দিতাম।আমি কি ভুল করেছিলাম? তুমিই বলো

এতোদিন আপনি অক্সিজেন দিছেন আমি চুপচাপ নিছি,আর আজ আমি দিবো আপনি নেবেন বুঝলেন।

বলে ওনার ওপর ঝাপিয়ে পড়লাম।ওনার ঠোঁট আমার ঠোঁটের দখলে নিয়ে নিলাম।হারিয়ে গেলাম ভালোবাসার সমুদ্রে।যেখান থেকে চাইলেও ফিরতে পারবো না,আর ফিরতে চাই ও না।

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে।দরজার শব্দে নীলকে ছেড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে নেহা দরজা খুলতেই ৫ জন পুলিশকে দেখে ভয়ে দুকদম পিছিয়ে যায়।ওদের সামনে যিনি দারিয়ে আছে সে গম্ভীর গলায় বললো

‘মিঃ নীল,চলুন’

‘কোথায় যাবে ও? কি করেছে নীল?’ নেহা বললো

‘উনার নামে খুনের অভিযোগ আছে।আদনান নামের একজনকে উনি খুন করেছে।তদন্ত চলছে।আপাতত ওনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে’

কথাগুলি যেনো নেহার বুকে বুলেটের মতো বাঁধলো।অজানা ভয়ে হুহু করে কেঁদে ফেললো।নীল কিছু না বলে শার্টটা গায়ে দিয়ে তাদের সাথে নিচে নামলো।নীলের বাবা রেগেমেগে নিজের মান সম্মান হারানোর ক্ষোপে যেনো ফেটে পড়ছে।তিনি চুপ করে সোফায় বসে আছে কনুই য়ে ভর করে।নীলের মা নীলকে জরিয়ে কান্না করছে।নেহা দারিয়ে আছে হতবাক হয়ে।বর্তমান তার কিছুই করার নেই।

হাতে হাতকড়া পড়িয়ে অফিসার নিয়ে যাচ্ছে নীলকে।সবার চোখে হতাশার ছাপ।বিষন্নতা ঘিরে ধরেছে।নেহা শেষ বারের মতো নীলের সাথে কথা বললো

‘তোমায় কতবার বলেছি এসব মারপিট না করতে,এখন কি হলো দেখছো?আমি কিভাবে থাকবো তোমায় ছাড়া?বাবা-মা সবাই কতোটা কষ্ট পাচ্ছেন দেখছো তুমি?’

‘চিন্তা করোনা নেহা।আমি ফিরে আসবো।এসব জেল আমায় আটকে রাখতে পারবে না।তুমি বাবা,মায়ের খেয়াল রেখো’

‘আমি পারছি না, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।তোমার যদি কিছু হয়ে যায় আমি বাঁচবো না নীল,আমি বাঁচবো না’

বলে নীলকে জরিয়ে ধরে কেঁদে ফেললো নেহা।নেহাকে শান্তনা দিয়ে নীলকে নিয়ে অফিসার জিপে তুললো।নীল যাওয়ার সময় শুধু একটা কথা বললো।আমায় মাফ করে দিও।

নীলের মা ছেলের চিন্তায় প্রায় আধমরা হয়ে বিছানার পড়ে আছেন।স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।নেহা বাকরুদ্ধ হয়ে ছাদের কার্নিশ ধরে দারিয়ে আছে যেদিকে নীলকে নিয়ে অফিসারের জিপটা চলে গেলো সেদিকে।রাত পেরিয়ে সকাল হতেই নীলের বাবা উপস্থিত হলেন থানায়।থানায় যেতেই অফিসার তাকে বসতে বললেন।

‘স্যার কি খাবেন? কপি,চা কি খাবেন?’

‘কিছু খেতে আসিনি আমি।রিপোর্ট এসেছে?’

‘হ্যা স্যার,এসেছে।খুনটা উনিই করেছে তার প্রমান আমাদের হাতে’

কথাটা বলে টেবিলের ওপর থেকে একটা ফাইল বেড় করে নীলের বাবার সম্মুখে এগিয়ে দিলেন।তিনি হাতে নিয়ে দেখলেন সত্যিই নীলকে খুনি হিসেবে প্রমানিত করা হয়েছে।

‘অফিসার ‘

‘জি বলুন’

‘আমি কখনো দূর্নীতি করিনি।আজ করতে হচ্ছে নিজের ছেলের জন্য।আপনার যত টাকা লাগে আমি দিবো।কেইচটা এখানেই ক্লোজ করুন’

‘সরি স্যার।এটা এখন আদালতের পর্যায়ে চলে গেছে।আমাদের কিছুই করার নেই’

নীলের বাবা চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন।কিছুক্ষণ মৌন থেকে টেবিল থেকে চশমাটা পড়ে বললেন

‘অফিসার,ওর এই খুনের দায়ে কিরুপ শাস্তি হতে পারে?’

‘শুধু খুনের দায় হলে কথা ছিলো,মিঃনীলের নামে আরো অনেক কেইচ উঠে এসেছে।যেমন মার-পিট।এরসঙ্গে নারী জনিত কেইচ ও দেওয়া হয়েছে।যদিও এটা একদম মিথ্যা। তবুও কেইচ কার সময় সত্য মিথ্যা সব মিলিয়ে কয়েকটা কেইচ একসাথে দেওয়া হয়’

‘তবুও কিরুপ শাস্তি ওর হতে পারে?’

‘অন্তত ১০ বছরের জেল তো হবেই।এর থেকেও ভয়ংকর শাস্তিও হওয়ার আশংকা বেশি’

‘কেইচটা আদালতে উঠবে কবে? ‘

‘আগামী পরশু।আপনারা ভালো একজন উকিল ঠিক করুন।নইলে মিঃনীল কে ছাড়ানো সম্ভব হবে না’

তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলের সাথে দেখা না করেই থানা থেকে বেড় হয়ে গেলেন।নীল জেলের ভেতর থেকে সবটা শুনতে পেলেও তার এখন করার কিছুই নেই।সে এখন আশামিতে পরিণত হয়েছে। এটাই তার প্রাপ্য ছিলো হয়তো।

তিনি কয়েকজন উকিলের সাথে পরামর্শ করে রাতে বাসায় যেতেই দেখলো নেহা সোফায় কাঠ বসে আছে।উনাকে দেখে নেহা কাছে গিয়ে করুন স্বরে বললো

‘বাবা,নীল ছাড়া পাবে তো?জানো আমার না দম বন্ধ লাগছে,কিচ্ছু ভালোলাগছে না।মনে হচ্ছে আমার সবটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। অফিসার কি বললো? বাবা চুপ করে আছো কেন বলো না কি বললো অফিসার?’

‘কিচ্ছু করার নেই রে মা।আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না’

‘পারলে না মানে?তুমি নীলকে নিয়ে আসতে পারলে না? আমি যে ওর জন্য অপেক্ষা করছি,বাবা তুমি কিছু একটা করো,ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে বাবা,ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে’

নেহা কান্নায় ভেঙে পড়লো।নীলের বাবা তাকে শান্তনা দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন।নেহা অনবরত কেঁদেই চলেছে।একসময় সে নিজের রুমে গেলো।রুমে গিয়ে নীলের চিহ্নগুলি দেখে নিজেকে সামলাতে না পেরে আবারো হুহু করে কাঁদতে লাগলো।

নীল তুমি না বলেছিলে সারাজীবন আমার কাছে থাকবে? কেনো এমনটা হলো? তোমায় একটি দিন কাছে পেলাম না আমি,তোমায় ছাড়া কিভাবে থাকবো আমি?আমার কষ্ট হচ্ছে নীল,প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে,আমি পারছি না।আমি আর পারছি না’

নেহা ছাদের কার্নিশ ধরে দারিয়ে কখন যে ভোরের আলো অন্ধকারকে ভেদ করে তার মুখে ছিটে আসলো সেদিকে তার খেয়াল নেই।বিষন্ন মনে সে তাকিয়ে আছে রাস্তার পানে।বিবাহের ২য় রজনীতে তাকে এরকম একটি মূহুর্ত পার করতে হবে সেটা ভাবতেও পারেনি নেহা।হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নিচে নেমে আসলো।যত্ন করে নীলের জন্য পর পছন্দের লুচি আর খাসির কসা মাংস রান্না করে টিফিনবাক্সে ভরলো।এতো ভোরে তখনো বাইরে কেউ ছিলো না।নেহা তার শ্বশুরের ঘরের দিকে উঁকি দিতেই দেখলো ঘরের দরজা খোলা।তিনি মাথায় হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন।তাদের কিছু না জানিয়েই নেহা রওনা হলো থানার অভিমুখে।

এখন বাজে সকাল ১০ টা।রিক্সা না পাওয়ায় হেটেই চলে এসেছে নেহা।থানায় আসতেই বুকটা কেমন ধুক করে উঠলো।এর আগে কখনো থাকায় আসতে হয়নি।জীবনের প্রথম সে থানায় এসেছে।চোখের নোনা জলের সমুদ্র আঁচল দিয়ে মুছে ভেতরে ঢুকলো।ওসি সাহেব তখন বসে ঝিমাচ্ছেন।নেহা তার সামনে গিয়ে হলা খাকারির শব্দ করে তাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করলো।ওসি সাহেব বিরক্তির চোখে নেহার দিকে তাকিয়ে বললেন

‘কি সমস্যা? ‘

‘জি আমি এসেছি আমার স্বামীর কাছে,ওনার জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছি’

‘কে আপনার স্বামি’

‘ওনার নাম নীল’

ওসি সাহেব একজন হাবিলদারকে বললেন নেহাকে নীলের কাছে নিয়ে যেতে।নীল জেলের আলোআঁধারি ঘরে হাটু মুড়ে বসে আছে।নেহা নীলকে দেখেই হুহু করে কেঁদে ফেললো।নীল চমকে উঠে জেলের রেলিং ধরে দারালো।নেহা নীলের হাত শক্ত করে ধরে অনবরত কেঁদেই চলেছে।

‘এই পাগলি কাঁদছো কেন?এভাবে কেউ কাদে নাকি?’

‘তোমায় এভাবে দেখবো কখনো ভাবতেও পারিনি,আমি তোমার জন্য কিচ্ছু করতে পারছি না’

‘কানা থামাও নেহা,আমার কিচ্ছু হবে না দেখে নিও’

‘তোমার কিচ্ছু হবে না।কিভাবে হয় হোক আমরা তোমায় বেড় করিয়ে নিয়ে যাবোই।তোমায় ছাড়া আমার এক মূহুর্তও বিষের সমতূল্য লাগছে।আমি পারছি না নীল,তোমায় ছাড়া থাকতে পারছি না’

‘তোমার হাতে কি নেহা? ‘

‘তোমার জন্য লুচি আর কসা মাংস নিয়ে এসেছি। তোমার পছন্দের খাবার।তোমার অনেক ক্ষিদে পেয়েছে না?

‘তা তো পেয়েছে একটু একটু’

‘তুমি হা করো আমি খাইয়ে দিই’

নেহা নিজ হাতে খাওয়াচ্ছে,নীল বাধ্য ছেলের খাচ্ছে আর নেহার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘নেহা,রাতপ ঘুমোওনি তাই না?’

‘নিশ্চুপ’

‘দেখো পাগলামি করো না।এরকম করলে তো শরীর খারাপ করবে’

‘করুক,তোমায় ছাড়া এই শরীর দিয়ে আমি করবো টাই বা কি’

ওসি সাহেব কিছুক্ষন পর এসে নেহাকে সময় শপষ বলে যেতে বললে নেহা কাঁদো কাঁদো চোখে নীলের দিকে তাকায়।নীলের চোখ থেকে ২ফোটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।এ যেনো এক স্তব্ধ মুহূর্ত।যেখানে ভালোবাসা অসীম,আছে হারানোর তীব্র ভয়।

নেহা বাড়িতে ঢুকতেই দেখতে পেলো কেউ একজন বসে আছে।সামনে বসে আছেন তার শ্বশুর।নেহা মাথা নামিয়ে যেতেই তাকে উদ্দেশ্য করে নীলের বাবা বললেন

‘নেহা মা,এদিকে আয় তো,বস এখানে’

নেহা এসে সোফায় বসলো।

‘ইনি হলেন বেরিষ্টার সাজিদ।আমার ছোটো বেলার বন্ধু।নীলের হয়ে এ লেইচ লরবে।তোর থেকে কিছু শুনতে চায়’

‘জি বলুন, ‘

‘আপনি নীলের স্ত্রী? ‘

‘জি’

‘সেদিন সাথে আপনিও ছিলেন তাই না? ‘

‘জি’

‘কি ঘটেছিলো ঘটনাটা বলুন তো।একটা তিল ও যেনো বাদ না পড়ে।’

নেহা সেদিনের ঘটনাটা পুরোটাই বললো।বেরিষ্টার সাজিদ বললেন,

‘সেই ফ্যাক্টরিটার ঠিকানা আমায় মেইল করে দিন’

‘তোর কি মনে হয়? নীল ছাড়া পাবে তো?’নীলের বাবা

‘দেখ এসব একটু ভিন্ন ব্যাপার।খুন যেহেতু হয়েছে সেহেতু বেড় করিয়ে আনা তেমন কিছুই না।মুশকিল হলো যে খুন করেনি তাকে বেড় করা’

‘মানে?’

‘মানে বুঝতে হবে না তোর।কিছু তদন্ত করতে হবে।আজ উঠি।কাল কোর্টে দেখা হবে’

বলে তিনি চলে গেলেন।পরেরদিন সকালে নীলকে আদালতে হাজির করানো হলো।নীলের বিপরীতে থাকা উকিল তার মন্তব্য পেশ করছেন।

‘মহামান্য আদালত, এই যে দারিয়ে আছেন মিঃনীল।যিনি কুকুরের মতো গুকি করে আমার মক্কেল কে গুলি করে।আমার মক্কেল সেই স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই যে রিপোর্ট।এবং মহামান্য আদালত আমি একজন সাক্ষীকে আনতে চাই’

বিচারপতি অনুমতি প্রদান করলে বিপক্ষে থাকা উকিল কাঠগড়ায় নেহাকে ডাকলেন।নেহা কাঠগড়ায় দারাতেই

‘মিস নেহা,কেমন আছেন? ‘

‘নিশ্চুপ’

‘আপনি তো তখন ওখানেই ছিলেন,যখন মিঃনীল আমার মক্কেল আদনানকে গুকি করে’

নেহা ভয়ার্ত কন্ঠে কাপাকাপা কন্ঠে বললো ‘জি’

‘আপনার চোখের সামনেই তো গুলি করেছে তাই না? ‘

নেহা হ্যা সূচক মাথা নাড়লো।

‘গুলি করামাত্রই আমার মক্কেল মাটিতে পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।এটাও তো আপনার সামনেই ঘটেছে তাই না?

‘জি’

‘মহামান্য আদালত, আমার আর কিছুই জিগ্যেস করার নেই।তার স্ত্রী যেখানে নিজেই স্বীকারোক্তি দিলেন সেখানপ বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকে না যে খুনটা মিঃনীল করেনি।মহামান্য আদালত,এই খুনের তীব্র বিচার আশা করছি।মহামান্য আদালত, মিঃনীলকে ফাঁসির আদেশ দাবী করছি’

বিচারপতি বললেন-

‘সমস্থ সাক্ষ্য,প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে আসামী নীল কে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে মৃত্যুদন্ডের…

বিচারপতির কথা শেষ না হতেই নেহা চিৎকার দিয়ে ‘না’ বলেই অজ্ঞান হয়ে কাঠগড়াতেই পড়ে যায়।

বিচারপতির মুখে মৃত্যুদন্ড শব্দটি শুনা মাত্রই নেহা কাঠগড়ায় চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়।এদিকে ঘড়ির কাটা টিক টিক শব্দ হচ্ছে। অর্থাৎ আজকের আদালত এই পর্যন্তই।রায় দেওয়া হবে সামনের দিন।নীল বিপরীত কাঠগড়া থেকে লাফ দিয়ে নেহার কাছে আসে।তাকে তিন-চারটা পুলিশ আটকাতে ধরলেও নীল তাদের ঝটকে ফেলে দিয়ে কাড়গড়ার ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে নেহার কাছে এসে নেহার মাথা তার কোলে নেয়।

‘নেহা,এই নেহা,কি হয়েছে তোমার? নেহা চোখ খুলছো না কেন? এই নেহা’

সেখানকার কর্মকর্তা জলের বোতল এগিয়ে দিলো।নীল সেই বোতল থেকে জল নেহার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিতেই নেহা পিটপিট করে চোখ মেললো।এটা দেখে নীল ওকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।তারা এজনই এখন প্রচুর কাঁদছে।

সেদিন রাত ১১ টা বাজে।পুরোনো সেই ফ্যাক্টরিতে তদন্তের জন্য আবারো রওনা হলো সাজিদ।নীলের বিষয়ে সকল প্রমান চাক্ষুষ, যার কারনে সে কিছুই করতে পারেনি।কিন্তু সেও হেরে যাওয়ার পাত্র না।রাত ১২ টা।সে পৌঁছে গেলো পুরনো সেই বিল্ডিংটায় যেখানে নীল খুল করেছিলো।সেখানে নীলকে বাঁচাতে এরকম কোনো তথ্যই সে পেলো না।মুখ গম্ভীর করে যখন ফ্যাক্টরি থেকে বেড় হবে এমন সময় পায়ে লেগে কি যেনো একটা টুংটুং শব্দ করে কংক্রিটের মেঝেতে গড়িয়ে গেলো। টর্চ দিয়ে দেখতেই সে দেখতে পেলো একটি বুলেট।পাশের কাঠের ভাঙা চেয়ারটায় আরো একটি বুলেট পাওয়া গেলো।সেগুলিকে সাথে নিয়ে সে চলে আসলো ওখান থেকে।এই বুলেট হয়তো নীলের হয়ে কিছু বলতে সাহায্যে করবে।

রাতে নীলের সাথে দেখা করার জন্য নেহা,নীলের বাবা অনেক চেষ্টা করলেও দেখা করার কোনো সুযোগ পায়নি।নেহা সারাদিন ঘরে নিজেকে আটকে রাখে।খাওয়া দাওয়া সব একদম বন্ধ। শুধু সে নয়।তাদের পরিবারের কেউ এখন আর স্বাভাবিক নেই।নীলের মা কে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে অজ্ঞান করে।কেননা জেগে থাকলে সে কান্না করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

এদিকে বেরিষ্টার সাজিদ সেই বুলেট দুটি নিয়ে পরিক্ষা করতে দিলেন।যদি সেখান থেকে কোনো তথ্য বেড়িয়ে আসে,যেটা নীলকে বাঁচাতে পারে।এবং সে রাতেই সে আরো কিছু খোঁজ খবর নেয়।

পরেরদিন কোর্টে নির্ঘুম,তৈলাক্ত,বিষন্ন মুখে নেহা বসে আছে।নীল দারিয়ে আছে অসহায়ের মতো।সাজিদকে দেখে বিপরীতপক্ষ উকিল মুচকে হাসছেন।বিচারপতি আসতেই সবাই দারিয়ে যায়।তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,”কোর্ট শুরু করা হোক”।সাজিদ বলে উঠলেন-

“মহামান্য আদালত,আমার মক্কেল মিঃনীল।সে পুরোপুরি নির্দোষ” কথাটি শুনে কোর্টে উপস্থিত সবার চেহারা বিগড়ে যায়। নেহা তার আচল দিয়ে মুখ ঢেকে আৎকে উঠলো।নীল একবার অসহায় দৃষ্টিতে সাজিদের দিকে তাকাতেই সাজিদ মুচকি হেসে বিচারপতিকে একটি প্লাস্টিক প্যাকেটে ২টা বুলেট দেখিয়ে বললো-

‘মহামান্য আদালত,এই সেই বুলেট,যেগুলি ব্যাবহার করা হয়েছিলো সেই রাতে।এই বুলেটটি স্পেশালভাবে অ্যামেরিকা থেকে আনা হয়েছে।এই বুলেটটা এমন ভাবে তৈরী যে এটি শরীরে লাগলে সেই জায়গাটা অন্তত কিছুটা কেটে যাবে।কখনোই কোনো ব্যাক্তি মারা যাবে না।বুলেটটির রিপোর্ট আদালতে পেশ করছি’

বিচারপতি রিপোর্টটা হাতে নিলো।বিপরীতপক্ষ বলে উঠলেন,

‘মহামান্য আদালত, এই বিষয়টি নিশ্চিত তা কিভাবে মানবো?হতে পারে বুলেটটা সে নিজেই এনেছে’

‘অবজেকশন মাই লট,আমার বক্তব্যর মাঝে তার কথা বলার কোনো অধিকার নেই’ সাজিদ বললো

‘আপনাকে বলার সুযোগ দেওয়া হবে।’বিচারপতি কথাটি সাজিদের বিপরীতপক্ষকে বললেন।সাজিদের উদ্দেশ্য বললেন ‘আপনি বলুন’

‘ধন্যবাদ মাই লট।যখন পুলিশ প্রথমে তদন্ত করে তখন যে রিবালবারটা পেয়েছিলো সেটার সাথে এই বুলেটটির পরিক্ষা করে জানা গেছে এই বুলেটটি ওই রিবালবার থেকে ছোড়া হয়েছে’

সবাই সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।নেহা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।নীলের মুখে এখন কিছুটা স্বস্তির আভাস।নীলের বাবা উৎসুক দৃষ্টিতে সব দেখছেন।

‘মাই লট,আমার বিপরীতপক্ষের মতে আদনানের খুনটা হয়েছিলো ১৫ তারিখ।কিন্তু মাই লট আমি যখন খোঁজ নিলাম তখন দেখলাম ১৬ তারিখ মিঃআদনানের নম্বর অনুযায়ী সে তখন ছিলো লন্ডনে।টিকিট কাউন্টারে গিয়ে জানতে পারলাম পরেরদিন সকালের ফ্লাইটেই সে চলে গিয়েছিলো লন্ডনে।এই যে রিপোর্ট। ‘ বলেই বিচারপতির নিকট একটি রিপোর্ট পেশ করলো সাজিদ।

‘মহামান্য আদালত,এই উক্ত বিষয়টি সাজানো হয়েছে।সে রাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আননান মারা যায় নি।তদন্তে যে পুলিশ গিয়েছিলো তাদের ঘুস দিয়ে এসব চক্রান্ত করা হয়েছে।’

বিচারপতি বিপরীতপক্ষ উকিলকে উদ্দেশ্য করে বললো ‘আপনার কিছু বলার আছে?’ উত্তরে সে চুপ করে রইলো।বিচারপতি আগের রায়টি কেটে নতুন রায় লিখলেন।বললেন

‘সমস্ত সাক্ষ,অভিযোগের ভিত্তিতে কোর্ট আসামি নীলকে সম্পুর্ন নির্দোষ প্রমান করে বেখাসুর খালাস করছে।সেই সঙ্গে উক্ত তদন্তে যে পুলিশ ছিলো তাদের চাকরি থেকে অবসর করার আদেশ দিচ্ছে।আজকের কোর্ট এই পর্যন্তই’

সাজিদ নীলের কাছে গিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বললো,”কনগ্রাচুলেশনস ইয়ং ম্যান”। নীল কাঠ গড়া থেকে বেড়িয়ে এসে সাজিদের সাথে হ্যান্ডসেক করলো।নেহা দূরে দারিয়ে হুহু করে কেঁদেই চলেছে।আজ তার সুখের কান্না।তার শরীরে যেন প্রান ফিরেছে।নীলের বাবার চোখ থেকেও অনবরত জল ঝরছে।নীল দৌড়ে গিয়ে তাদের জরিয়ে ধরে সে নিজেও খুব কাদলো।আজ তাদের সুখের কান্না।নীলের বাবা ফোন করে সেই খবর সবাইকে দিতে লাগলো।এদিকে নেহার কপালে চুমু একে দিয়ে নীল বললো “আই লাভ ইউ পাগলি,আজ থেকে আমরা নতুন জীবন শুরু করবো,যেখানে থাকবে না কোনো মারামারি, হানাহানি।সারাজীবন তোমার সাথেই থেকে যেতে চাই।উত্তরে নেহা কেঁদে কেঁদে বললো ” আই লাভ ইউ টু পাগল”

একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে নীল এবং নেহা।আনন্দভরা চোখ নিয়ে নীলের বাবা দেখছে।সাজিদ ওদের কাছে এস বললো “ভালোবাসা সুন্দর,অনেক সুন্দর”।

_____________________সমাপ্ত_______________________