তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-২৪+২৫

0
503

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২৪

গাড়ি ছুটছে ঢাকার দিকে। আমি তাজ ভাইয়ের ওপর প্রচন্ড বিরক্ত। মনে হচ্ছে আজ বিরক্তির পরিমাণ বাকি দিনগুলোর থেকে একটু বেশিই। ঐ বাড়ি থেকে চলে আসার সময় নানুর মুখটা চুপসে ছিল। মামা আর বাকি সবার মনও খারাপ ছিল। আবার আগামী মাস ছাড়া আর আসা হবে না, বিধায় আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে উঠে হতে আমি গাল ফুলিয়ে বসে আছি। জেমি আমার মুখের অবস্থা দেখে পেছনের সিটে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ইচ্ছা করছে তাজ ভাইয়ের ওপর নিজের সমস্ত রাগ উপড়ে দিতে। কিন্তু বেল্টের সাথে যে আস্ত এক মৃত্যুদূত আছে, তার ভয়েই মুখ তালাবন্ধ করে রেখেছি। প্রায় বিশ মিনিট স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকার পর হঠাৎ আমার খেয়াল হলো গাড়ির স্পীড একদম কম। তাজ ভাই তো কখনও এতটা কম স্পীডে গাড়ি চালান না। উনি কি ইচ্ছে করেই আমাকে খেপাতে চাইছেন? আমি রাগত কন্ঠে বলে উঠলাম,“ঠেলাগাড়ি চালাচ্ছেন?”

তাজ ভাই ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে আমার দিকে তাকিয়েই গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিলেন। এবার মনে হচ্ছে গাড়ি উল্কার বেগে ছুটে চলেছে। আমি আবার বললাম,“ঘোড়া ছুটিয়েছেন?”

তাজ ভাই এবার ধমকে উঠে বললেন,“গাড়ি-ঘোড়া কিছুই না, নৌকা বাইছি। রাগ দেখাচ্ছিস কাকে? এক ধাক্কায় রাস্তায় ফেলে দিব বেয়াদব মেয়ে।”

আমি গাল ফুলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফিরালাম। উনি এক হাতে স্টেয়ারিং সামলে আরেক হাতে আমার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে শক্ত মুখে বললেন,“রেজার সাথে ভালোভাবে ঘুরতে পারিসনি বলে এত দুঃখ হচ্ছে? ওহ্! আজ তো আবার রেজা হাত ধরে রাস্তা পার করিয়েছিল, তাই না? আহা! কত্ত সুন্দর মুহুর্ত! খুব ভালো লাগে পরপুরুষের ছোঁয়া?”

তাজ ভাই শক্ত মুখে কথাগুলো বললেও আমার রাগে গা রি-রি করে উঠল। সবসময় ওনার এসব অসভ্যের মতো কথা মেনে নেয়া সম্ভব না। আমি এক ঝটকায় ওনার হাত সরিয়ে খেকিয়ে উঠলাম,“একদম বাজে কথা বলবেন না। সব ছেলেদের আপনার মতো মনে করেন? রেজা ভাইয়া আমাকে ছোটো বেলা থেকে নিজের বোনের থেকে কম মনে করে না। আজেবাজে ভাবনা ছাড়া ভালো ভাবনা আপনার মাথায় আসে না?”

উনি রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,“নাহ্। এখন একদম চুপ থাকবি। তোর সাথে কথা বলে আমার ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছে।”

“সবাই তো আপনাকে মাথায় তুলে নাচছিল। খাবার তো কম দেয়নি, পেটভরে খেতে নিষেধ করেছে কে?”

“তোর সাংঘাতিক মামার সামনে খেতে ভয় পেয়েছিলাম, বুঝলি? লোকটা না আবার নজর দিয়ে বসে।”

“মামা আপনাকে দেখে কত খুশি হয়েছে। ওনার মতো মানুষকে দুচোখের বিষ মনে করা কেবল আপনার পক্ষেই সম্ভব।”

“কী করব বল? আমি আবার অত তেল দিয়ে কথা বলতে পারি না।”

“মামার সামনে তো খুব হেসে হেসে কথা বললেন।”

“সে তো আমি নিতান্তই ভদ্র ছেলে বলে।”

“ভদ্র না ছাই!” বলেই আমি ভেংচি কাটলাম।

ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা বাজল। বাড়িতে ঢুকেই আমি নিজের লাগেজ নিয়ে সোজা রুমে চলে গেলাম। বাবা হয়তো কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল ছিল না। লাগেজ একপাশে ফেলে রেখে আমি হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। জার্নি করার পর সবসময় আমি এমন ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মিতা এসে লাগেজের জামা-কাপড় বের করতে করতে বলল,“আপু, আবার তো লাগেজ গোছাতেই হবে। বিয়েতে যাবে না? কোন কোন জামা-কাপড় নিবে বলো, আমি বরং এখনই গুছিয়ে রাখি। কাল সকালেই তো রওনা দিবে।”

আমি শুয়ে থেকেই মিতাকে বললাম কী কী লাগবে। ও একে একে সবকিছু লাগেজে গুছিয়ে রাখল। তারপর আমাকে প্রশ্ন করল,“আপু, জামা পালটাবে না?”

আমি অলস ভঙ্গিতে বললাম,“হুম, একটু কফি খাওয়াতে পারিস?”

মিতা বলল,“এখন কফি খাবে? ভাইয়া তো বলল এখন ভাত খাওয়ার কথা।”

আমি কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললাম,“তোর ভাইয়াকে গিয়ে ভাত খাওয়া। আমাকে বলছিস কেন? আমি ভাত খাব না। আমার মাথা ধরেছে, কফি খাব।”

“আচ্ছা, আনছি।”

মিতা চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে ধীরে ধীরে উঠে জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলাম তাজ ভাই আমার বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। এক হাতে ফোন আর অপর হাতে কফি মগ নিয়ে দিব্যি আরামে আছেন। আমি বেড সাইড টেবিলের দিকে তাকালাম। কারণ ওয়াশরুমে থাকাকালীন মিতা এসে কফি রেখে গিয়েছিল। আমাকে ডাকতেই আমি ওয়াশরুম থেকে বলেছিলাম বেড সাইড টেবিলে রেখে যেতে। কিন্তু সেখানে কফি নেই। আমি তাজ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম,“আপনি আমার কফি খাচ্ছেন কেন?”

উনি ফোন থেকে চোখ উঠিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু না বুঝার ভান করে বললেন,“তোর কফি?”

আমি তেতে উঠে বললাম,“ঢং করছেন? কফি খেতে ইচ্ছে করলে নিজে গিয়ে বানিয়ে খেতে পারেননি? আমারটা খেলেন কেন?”

উনি বার দুয়েক চোখ ঝাপটা দিয়ে বললেন,“এই কফি তুই বানিয়েছিস?”

“মিতা বানিয়েছে।”

“তাহলে এটা তোর হয় কীভাবে?”

“উফ্! আপনি আসলেই একটা অসহ্য লোক! যান তো এখান থেকে।”

তাজ ভাই কফি শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,“ডিনার করতে চল।”

আমি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললাম,“আমি খাব না। আপনি তো খেতে পারেননি আমার মামার জন্য। আপনিই পেটভরে খান গিয়ে।”

“বাড়তি কথা বলতে বলিনি। কাল সকালে আবার জার্নি করতে হবে। এখন ঘুম দরকার। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়বি। চল তাড়াতাড়ি।”

“বললাম না খাব না? আপনাকে অযথা চিন্তা করতে হবে না আমার জন্য।”

“আবার বল।” কথাটা বলতে বলতে তাজ ভাই শার্ট উঁচিয়ে কোমরের বেল্টে হাত রাখলেন। আমি চোখ বড়ো করে ঢোক গিললাম। রাগের বশে এই গানের কথা তো আমি ভুলেই বসেছিলাম। উনি দু’পা এগিয়ে এসে বললেন,“কী হলো? বল।”

আমি মেকি হাসার চেষ্টা করে বললাম,“কী বলব?”

“এইমাত্র যা বললি।”

“ভুলে গেছি।”

“গুড, চলে আয় এবার।”

আমি চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে তাজ ভাইকে রেখেই ধুপধাপ পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।

_____________________________

সকাল দশটায় আবার শুরু হলো জার্নি। বাসা থেকে বেরোনোর সময় বাবা একগাদা উপদেশ দিয়ে দিয়েছেন। মূলকথা, এক মুহুর্তের জন্যও তাজ ভাইয়ের নজরের বাইরে না যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে আমার ওপর। এদিকে আমি বরাবরের মতোই বিরক্ত। খুব সুন্দর মনের একজন সঙ্গী থাকলে জার্নিটা জমে ওঠে। অথচ আমার কপাল দেখ! কপালের কথা আর কী-ই বা বলব? এই লোক আসার পর থেকেই তো আমার কপাল ফেটেছে। কিছুদূর গিয়ে তাজ ভাই হঠাৎ ব্রেক কষলেন। আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালাম। কিন্তু পরক্ষণেই বিস্মিত হলাম শ্রেয়ান ভাইয়া আর আরেকটা লোককে গাড়িতে উঠতে দেখে। লোকটার দিকে ভালোভাবে তাকাতেই চিনতে পারলাম। এই লোককে আমি এর আগে আরও দুইবার দেখেছিলাম। প্রথমবার এক মধ্যরাতে রাস্তায় তাজ ভাই লোকটার ওপর চেঁচামেচি করছিল। দ্বিতীয়বার গ্রামে তাজ ভাইয়ের সাথে লোকটা চায়ের দোকানে বসে ছিল। শ্রেয়ান ভাইয়া একগাল হেসে হাত নেড়ে বললেন,“হাই ইলোমিলো। কেমন আছো?”

আমি বললাম,“ভালো। আপনারা কি আমাদের সাথে যাচ্ছেন?”

শ্রেয়ান ভাইয়া মাথা দোলালেন। শ্রেয়ান ভাইয়ার যাওয়ার কথা শুনে আমি বেশ খুশিই হলাম। তাহলে এই বিপজ্জনক লোকটাকে আমার সহ্য করতে হবে না। কিন্তু ঐ লোকটাকে আমি ঠিক মানতে পারছি না। আমাদের সাথে ঐ লোক কেন যাচ্ছেন? আবার ভাবলাম, লোকটা হয়তো তাজ ভাইয়ের দলের লোক। কিন্তু তাতেই কী? এসব গুন্ডা-পান্ডা নিয়ে দাদা বাড়ি যাবেন না-কি উনি? আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য শ্রেয়ান ভাইয়াকে বললাম,“ইনি কে? আপনাদের দলের কেউ?”

শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো উনি একটু ইতস্তত করছেন। আমার পাশ থেকে তাজ ভাই বললেন,“ও নাসের, আমাদের টিমেরই।”

আমার সন্দেহই সত্যি হলো। আজকের জার্নিটা যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম তার চেয়ে ভালোই হলো। সারাটা পথ আমি শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে বকবক করেছি। মাঝে আবার শ্রেয়ান ভাইয়া গাড়ি থামিয়ে অনেক খাবার কিনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ চার ঘন্টা জার্নির পর আমরা দুপুর দুইটায় গন্তব্যে পৌঁছুলাম। তাজ ভাইয়ের দাদা বাড়ি এসেছিলাম খুব ছোটো বেলায়। তাই তেমন কিছুই মনে নেই। বাড়িটা দোতলা। খুব বেশি বড়ো না হলেও বাড়ি দেখে খুব মজবুত বলে মনে হচ্ছে। হয়তো অনেক আগের বাড়ি। তাজ ভাইয়ের দাদা-দাদি কেউ নেই। বাড়িতে দুই কাকা আর তাদের পরিবার থাকেন। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ আমার জানামতে তাজ ভাইয়ের দুই কাকার পরিবার খুব বেশি বড়ো না। বড়ো কাকার দুই যমজ ছেলে আফনান, আদনান। আর ছোটো কাকার এক ছেলে এক মেয়ে মাহিন, সায়মা। সায়মারই বিয়ে। তাহলে বাড়িতে এত মানুষ এল কোত্থেকে? তারপর মাথায় এল, বিয়ে বাড়িতে তো অনেক আত্মীয়-স্বজন আসে। আমরা বাড়িতে প্রবেশ করতেই বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গেল। দীর্ঘ আট বছর পর ভাগনেকে দেখে তাজ ভাইয়ের দুই কাকা তাকে পারলে মাথায় তুলে রাখেন। আমাদের বসিয়ে বেশ আপ্যায়ন করা হলো। সবার সাথে পরিচয় হতে হতে বুঝতে পারলাম তাজ ভাইয়ের আসার খবর শুনে তার ফুপুর পরিবারও এসেছেন। আর এত জনসংখ্যার কারণ হচ্ছে তাজ ভাইয়ের ফুপুর দুই ছেলে, দুই মেয়ে। বড়ো ছেলে জায়েদ বিবাহিত আর তার এক বছরের একটা বাচ্চা মেয়েও আছে। ছোটো ছেলে জুম্মান তাজ ভাইয়ের সমবয়সী। আর বড়ো মেয়ে মিনহা মাহিন ভাইয়ার সমবয়সী, ছোটো মেয়ে আমিরা আমার থেকে দুই এক বছরের বড়ো হবে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর আমি ছাড় পেলাম। তাজ ভাইয়ের ফুপু আমাকে দোতলার একটা রুমে নিয়ে গেলেন। রুমটা বেশি বড়ো না হলেও বেশ পরিপাটি। আমি লাগেজ খুলে জামা বের করলাম। এ বাড়ির মানুষদের এতটাই তাড়া ছিল যে বেশি দেরি হবে বলে ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ না দিয়ে আগেই দুপুরের খাবার খাইয়েছেন। এখন একটা লম্বা শাওয়ার নেয়া নিতান্ত জরুরী।

_________________________

আজ দুদিন হলো তাজ ভাইয়ের দাদা বাড়ি এসেছি। এরমধ্যে বাড়ির প্রায় অনেকের সাথেই আমার বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাজ ভাইয়ের ছোটো কাকি আর ফুপির ছোটো মেয়ে আমিরার কথাবার্তার ধরণে আমি ইতোমধ্যে বুঝতে পারছি তারা আমার প্রতি খুব একটা সন্তুষ্ট নন। কিন্তু অসন্তুষ্টির কারণটাও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবু আমি বিষয়টাকে একদমই পাত্তা দিলাম না। কারণ আমি এ বাড়িতে দুদিনের অতিথি মাত্র।

আজ সন্ধ্যায় বাড়ির ছাদে সব কাজিনদের আড্ডা বসেছে। ছাদের মাঝ বরাবর বড়ো একটা পাটি বিছিয়ে সবাই বৃত্তাকারভাবে বসেছে। সাথে কড়া ঝালের ঝালমুড়ি আর ফলমূল। অনেকক্ষণ বিভিন্ন আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো ট্রুথ অর ডেয়ার খেলা হবে। ট্রুথ নিলে তাকে যে প্রশ্ন করা হবে তার সঠিক উত্তর দিতে হবে। মিথ্যা বলা চলবে না। আর ডেয়ার নিলে তাকে যা করতে বলা হবে তা-ই করতে হবে। সিদ্ধান্ত মতো খেলা শুরু হলো। এদিকে আমি তাজ ভাইয়ের পাশে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। মাঝে মাঝে ঝালমুড়ি চিবোচ্ছি। তাজ ভাই একেক জনকে ট্রুথ-ডেয়ার দিয়ে নাস্তানাবুদ করতে ব্যস্ত। এই যেমন আদনান ভাইয়াকে ডেয়ার দিলেন, তার গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করে সবার সামনে ভালোবাসা নিবেদন করতে হবে। বেচারা লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন। কিন্তু ডেয়ার রক্ষার্থে গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করে প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে একগাদা বকা শুনলেন। কারণ তার গার্লফ্রেন্ড আজ কোনো এক কারণে তার ওপর প্রচন্ড বিরক্ত। এই নিয়ে সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছে, আর বেচারা আদনান ভাইয়া অসহায় মুখে বসে ছিলেন। জায়েদ ভাইয়াকে প্রশ্ন করলেন, বিয়ের আগে সে কতবার তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটে গিয়েছেন। জায়েদ ভাইয়া এই প্রশ্ন শুনে পারলে সবার মাঝ থেকে উঠে চলে যান। কিন্তু এতগুলো বিচ্ছুর সাথে বেচারা পেরে উঠলেন না। শেষমেষ নিজের বউয়ের সামনে স্বীকার করলেন বিয়ের আগে উনি তিনবার তিন গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটে গিয়েছিলেন। এ কথা শুনে তার বউ অর্নি রেগেমেগে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলেন। জায়েদ ভাইয়ার চেহারার অবস্থা যা হয়েছিল! অর্নি ভাবিকে অবশ্য অনেক বুঝিয়ে সবাই শান্ত করতে পারল। মিনহা আপুকে প্রশ্ন করা হলো, সে বর্তমানে কার সাথে রিলেশনে আছে। এটা ছিল আজকের খেলার বেশ উপভোগ্য অংশ। কারণ অনেক জোরাজুরির পর জানা গেল মিনহা তার মামাতো ভাইদের বেস্ট ফ্রেন্ড মৃদুলের সাথে রিলেশনে আছে। এ কথা শুনে আফনান আর আদনান ভাইয়া রক্তচক্ষু নিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। বেচারি মিনহা তখন ভয়ে কেঁদেই ফেলল। কিন্তু তাজ ভাই ব্যাপারটা খুব সহজভাবেই মিটিয়ে দিলেন। মাহিন ভাইয়া আমিরা আপুকে প্রশ্ন করলেন, তার ক্রাশ কে। আমিরা আপুর সোজাসাপ্টা উত্তর,“তাজ ভাইয়া।” তার উত্তর শুনে সবাই মিলে তাজ ভাইকে বেশ খেপানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাজ ভাই দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,“আরে ও আমার ছোটো বোন। মাথায় বোধ হয় এখনও বুদ্ধি খোলেনি, তাই ভুল দিকে এন্ট্রি নিয়ে ফেলেছে।”

আমিরা আপুর মন‌ ভঙ্গ হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল। আমিরা আপু শ্রেয়ান ভাইয়াকে ডেয়ার দিলো, তাকে মেয়েদের মতো মেকআপ করতে হবে। শ্রেয়ান ভাইয়া চোখ রসগোল্লার মতো করে সঙ্গে সঙ্গে না বলে দিলেন। কিন্তু খেলার নিয়ম তো ভঙ্গ করা চলবে না। তাই শ্রেয়ান ভাইয়াকে ধরে-বেঁধে জোরপূর্বক মেকআপ করানো হলো। শ্রেয়ান ভাইয়াকে মেকআপ লুকে দেখে হাসতে হাসতে আমাদের পেট ব্যথা হবার জোগাড়। কিন্তু সবাই ছবি তোলতে উদ্যত হতেই শ্রেয়ান ভাইয়া উঠেপড়ে দৌড়ে ছাদ থেকে পালিয়েছেন। তারপর অবশ্য ফ্রেশ হয়ে দ্রুতই চলে এসেছেন। অর্নি ভাবি মাহিন ভাইয়াকে ডেয়ার দিলেন, এক গ্লাস তেঁতুল গোলা পানি খেতে হবে। আমিরা ছুটে গিয়ে নিচ থেকে এক গ্লাস তেঁতুল গোলা পানি নিয়ে এল। তা গলধঃকরণ করতে গিয়ে মাহিন ভাইয়ার মুখের এক্সপ্রেশন এমন ছিল যে, তাকে ছাদ থেকে লাফ দিতে বললেও সে তা নির্দ্বিধায় করতেন। কারণ মাহিন ভাইয়া টক জাতীয় জিনিস একদমই পছন্দ করেন না। আর তেঁতুল তো তার দুচোখের বিষ‌! আদনান ভাইয়া নাসের ভাইয়াকে ডেয়ার দিলেন, যেকোনো একটা মেয়ের মাথায় গাঁট্টা মারতে হবে। এটা শোনামাত্র সব মেয়েরা এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। অর্থাৎ এতে কোনো মেয়েই রাজি নয়। নাসের ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো সেও বিষয়টা হজম করতে পারছেন না। কিন্তু তাজ ভাই আর আফনান ভাইয়ার ধমক শুনে আমরা বাধ্য মেয়ের মতো পুনরায় বসে পড়লাম। নাসের ভাইয়াও অনেকক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে হঠাৎ করেই আমিরা আপুর মাথায় এক গাঁট্টা মেরে বসলেন। আমিরা আপু এমন একটা ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না, বিধায় গাঁট্টা মারার সাথে সাথে সে চিৎকার দিয়ে উলটে পড়ল অর্নি ভাবির গায়ের ওপর। এহেন ঘটনায় সবার সাথে নাসের ভাইয়াও হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই আমিরা আপুর গগন কাঁপানো ধমক শুনে চুপ মেরে গেলেন। আমিরা আপু আবার মাহিন ভাইয়ার ধমকিতে চুপ মেরে গেল। আমিরা আপু আমাকে প্রশ্ন করল, প্রথম দেখায় আমি কার ওপর ক্রাশ খেয়েছি। পড়লাম বিপাকে। জীবনে আমি একজনের ওপরই ক্রাশ খেয়েছি। আর সেই বান্দা স্বয়ং আমার পাশে বসা। কিন্তু সেই ক্রাশ খাওয়াটা আমার মস্ত বড়ো ভুল ছিল, তাই এটা বলা চলবে না। কিন্তু নিয়ম রক্ষার্থে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে উত্তর দিতে হবে। আমি গলা ঝেড়ে জবাব দিলাম,“আমাদের এক আত্মীয় আছে। আপনারা চিনবেন না। ওই ভাইয়াটাকে প্রথম দেখেই ক্রাশ খেয়েছিলাম।”

আমার উত্তর শুনে তাজ ভাই ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আর বাকি সবাই প্রশ্ন করে বসল আমার ক্রাশের নাম কী, বাড়ি কোথায়, কী করে, সে এখনও আমার ক্রাশ কি না। কিন্তু আমি মেকি হেসে বললাম,“একের অধিক প্রশ্ন করা কিন্তু খেলার নিয়মে নেই। সো আমি এসবের উত্তরও দিব না। শুধু এটুকু বলছি যে সে এখন আর আমার ক্রাশ নেই।”

আমার মুখ থেকে আর কোনো কথা বের করতে না পেরে সবাই দমে গেল। জুম্মান ভাইয়া আর আফনান ভাইয়াকে তাজ ভাই ডেয়ার দিলেন, তাদের একে অপরকে চুমু খেতে হবে। এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আফনান ভাইয়া আর জুম্মান ভাইয়া পালানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। অনেকক্ষণ জোর জবরদস্তি করার পর অবশেষে তাদের রাজি করানো গেল। দুজন ইয়াক ইয়াক করতে করতে নাক-মুখ কুঁচকে একে অপরকে চুমু খেল। তারপর দুজনেই লজ্জায় পড়ে গেল। জুম্মান ভাইয়া সায়মা আপুকে প্রশ্ন করলেন, তার প্রাক্তনের নাম কী। কিন্তু অনেক গবেষণার মাধ্যমে জানা গেল সায়মা আপুর কোনো প্রাক্তনই ছিল না। সে স্বভাবতই খুব চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। সবার শেষে এল তাজ ভাইয়ের পালা। তাজ ভাই বেশ সাহস নিয়ে ডেয়ার নিলেন। এবার সবাই কোমর বেঁধে ভাবতে নামল তাজ ভাইকে ঠিক কী ডেয়ার দিয়ে দমানো যাবে। কিন্তু সবার ভবনায় ইতি টেনে জায়েদ ভাইয়া বলে বসলেন,“এখানকার যেকোনো একজন মেয়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাত ধরে বল, আই রিয়েলি লাভ ইউ মাই ড্রিম গার্ল। উইল ইউ ম্যারি মি?”

জায়েদ ভাইয়ার ডেয়ারটা সবারই বেশ পছন্দ হলো। কারণ সবার ধারণা তাজ ভাই এটা নিয়ে খুব দ্বিধায় ভুগবেন। আমিও মনে মনে বেশ খুশি হলাম। এতক্ষণ সবাইকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে, এবার ঠেলা সামলাক। জায়েদ ভাইয়া সব মেয়েদের এক লাইনে দাঁড় করালেন। আমি আর অর্নি ভাবিও বাদ পড়লাম না। তাজ ভাইকে সবার সামনে দাঁড় করানো হলো। ছেলেরা সবাই একেকটা বলছে আর পেট চেপে ধরে হাসছে। তাজ ভাই দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ভ্রু বাঁকিয়ে সবার দিকে তাকাচ্ছে আর চিন্তা করছে। এদিকে আমিরা আপু মিটমিট করে হাসছে আর হেলেদুলে তাজ ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছে। আমার ধারণা তাজ ভাই এই মেয়েকে দিয়েই ডেয়ার পূরণ করবেন। কিন্তু হলো তার উলটোটাটা। তাজ ভাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। আমার ডান হাতটা নিজের ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,“আই রিয়েলি লাভ ইউ মাই ড্রিম গার্ল। উইল ইউ ম্যারি মি?”

ব্যাপারটা এতটাই দ্রুত ঘটল যে উপস্থিত সবাই হা হয়ে গেল। এদিকে আমি স্থির হয়ে আছি। ওনার গভীর দৃষ্টি আর এই মুহূর্তে বলা কথাটা কর্ণগুহরে পৌঁছাতেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি থমকে গেলাম। হারিয়ে গেলাম গভীর দুটো চোখে। পরক্ষণেই সবার চিৎকার কানে আসতেই নিজেকে সামলে নিলাম। তাজ ভাই ততক্ষণে আমার হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। এদিকে সবাই মিলে নানা কথা বলে তাজ ভাই আর আমাকে খেপানো শুরু করেছে। কিন্তু তাজ ভাই তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“স্টপ গাইস। আগে আমার কথা শোন। এখানে অর্নি ভাবি আমার বড়ো ভাবি। সো আমি তাকে বিয়ে করতে পারি না। সায়মার অলরেডি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মিনহার বয়ফ্রেন্ড আছে। আর আমিরা তো আমার ছোটো বোন।”

মাহিন ভাইয়া কটাক্ষ করে বললেন,“ইলোও তো তোর ছোটো বোন। তাহলে?”

তাজ ভাই মুখ কুঁচকে বললেন,“ভাই রে, এই মাথামোটার সম্পর্কে যদি জানতি তাহলে এটা বলতে পারতি না। না জানে বড়োদের রেসপেক্ট করতে, আর না জানে বড়োদের সাথে সুন্দর করে কথা বলতে। কথায় কথায় পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে নেমে পড়ে। অথচ আমিরাকে দেখ, এই মাথামোটার তো আমাদের আমিরার থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ওর মতো মেয়ের তো আমার বোন হবারই যোগ্যতা নেই। আর বউ তো বহু দূরের কথা। কিন্তু এখানে ও ছাড়া কোনো অপশন নেই। তাই খেলার নিয়ম রক্ষার্থে ওকেই বেছে নিলাম। নাউ, দ্যা গেইম ইজ ওভার। ওকে বাই।”

তাজ ভাই এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই দ্রুত পায়ে হেঁটে ছাদ থেকে চলে গেলেন। এদিকে তাজ ভাইয়ের কথা শুনে উপস্থিত সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। আমিরা আপু তো আমার দিকে তাকিয়ে জয়ের হাসি হাসছে। এদিকে আমি নির্বোধের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি। কেন জানি তাজ ভাইয়ের বলা কথাগুলো আমার মস্তিষ্কে আঘাত হানতে পারেনি। হয়তো এতদিনে আমার মস্তিষ্ক ওনার সব রকমের বিদ্রুপ আর তাচ্ছিল্যের কথা সহ্য করতে শিখে গেছে। সবই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বললেন,“ইলোমিলো, মন খারাপ কোরো না প্লিজ। তাজ ওসব কথা মন থেকে বলেনি। জানোই তো ও সবসময় তোমাকে খেপানোর জন্য কত কথাই বলে। আমার মনে হয় ঐ আমিরাকে ওর সুবিধার মনে হয়নি, তাই বাধ্য হয়ে তোমাকেই বেছে নিয়েছে। আর এটা তো জাস্ট একটা গেইম ছিল। ফরগেট ইট এন্ড স্মাইল প্লিজ।”

আমি মাথাটা হালকা ঝাঁকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসার চেষ্টা করলাম। বিড়বিড় করে বললাম,“আমি এতটাও বোকা নই যে সত্য মিথ্যার পার্থক্য বুঝব না।”

চলবে……………………🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব: ২৫

সায়মা আপুর গায়ে হলুদে সবাই হলুদ শাড়ি পরবে। শাড়ি পরা ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগে। ভালো লাগা থেকেই আমি এই পর্যন্ত অনেক শাড়ি কিনেছি। কিন্তু সেগুলো পরা আর হয়ে ওঠে না। হলুদে যে মেয়েরা শাড়ি পরবে, এই ধারণা আমার ছিল। কিন্তু কেন জানি আমার শাড়ি পরতে ইচ্ছে হয়নি, তাই আনিয়োনি। হলুদে পরার জন্য হলুদ আর লাল রঙের মিশেল একটা থ্রি-পিস এনেছি। থ্রি-পিসটা পরে, চুলগুলো বেঁধে, ঠোঁটে হালকা একটু লিপস্টিক আর কানে দুল পরে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়ির সামনের ফাঁকা উঠোনে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। আজ সারাদিন ধরে পুরো বাড়ি ডেকোরেশন চলেছে। বাড়ি এখন মানুষজনে ভর্তি। এত মানুষের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনকেই আমি চিনি। সর্বপ্রথম পড়লাম শ্রেয়ান ভাইয়ার সামনে। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে দেখে আগাগোড়া নিরীক্ষণ করে বললেন,“আজ তো সবাই হলুদ শাড়ি পরেছে। তুমি পরোনি কেন ইলোমিলো?”

আমি বললাম,“আমার ইচ্ছে করছে না ভাইয়া।”

“কেন?”

“এমনিতেই।”

“ওহ্! যাক, তোমাকে এই সাজেও কিন্তু কম সুন্দর লাগছে না।”

আমি মৃদু হাসলাম। শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে বাড়ির সামনের উঠোনে চললাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম বাড়ির মেয়েরা সবাই হলুদ শাড়ি আর ভারী মেকআপ করে সেলফিতে মগ্ন। আমি সেখানে যেতেই সবাই শ্রেয়ান ভাইয়ার মতো একই প্রশ্ন করল, আমি শাড়ি পারিনি কেন? আমি সবাইকেই উত্তর দিলাম, আমার ইচ্ছে করছে না তাই পারিনি। তাজ ভাই তার কাজিনদের সাথে হলুদের স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। শ্রেয়ান ভাইয়াও সেখানে চলে গেছেন। তাজ ভাইয়ের সাথে আমার শুধু একবার চোখাচোখি হলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। গতকালের ট্রুথ অর ডেয়ার খেলার পর থেকে আমি ওনার থেকে ইচ্ছে করেই দূরে দূরে থাকছি। বিয়ে বাড়ি বলে উনিও খুব একটা জ্বালাচ্ছেন না। কিন্তু যতবারই চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে ততবারই ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছি। ভুলে যেতে চাইলেও বারবার ঐ কথাটাই মস্তিষ্কে কড়া নাড়ে,‘আই রিয়েলি লাভ ইউ মাই ড্রিম গার্ল। উইল ইউ ম্যারি মি?’ আমি জানি এটা নিছকই একটা খেলা ছিল। কিন্তু কেন জানি আমার মন এটাকে শুধুই খেলা ভাবতে পারছে না। মনে হচ্ছে খেলার ছলেই মনের অপ্রকাশিত কথা প্রকাশ করা হয়েছে। মনে হবে না-ই বা কেন? এতদিনে আমি এটুকু তো নিশ্চিত হয়েছি যে আমাকে নিয়ে ওনার মনে কিছু অনুভূতি আছে। কিন্তু উনি তা প্রকাশ করছেন না কেন এটাই আমার বড়ো প্রশ্ন। সায়মা আপুকে এখনও পার্লারের মেয়েরা সাজাচ্ছে। তাকে স্টেজে আনা হয়নি বলে যে যার মতো ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমার বিরক্তি এসে গেলেও চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। অপরিচিত জায়গায় এলে যা হয় আরকি। ফোনটা বের করতেই পাশ থেকে কেউ বলে উঠল,“হাই কিউটি।”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম জুম্মান ভাইয়া হাসিমুখে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তার গলায় ডিএসএলআর ঝুলানো। আমি তাকাতেই উনি আবার বললেন,“একা একা দাঁড়িয়ে আছো যে? সবার সাথে এনজয় করো।”

“সবাই তো ব্যস্ত।”

“সবাই সাজগোজ করেছে, ছবি তো তুলতেই হয়। ছবি তুলতে ভালো লাগে না তোমার?”

“যখন-তখন ভালো লাগে না।”

জুম্মান ভাইয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,“তাহলে আমি তুলছি, তুমি সুন্দর করে দাঁড়াও তো।”

আমি ইতস্তত করে বললাম,“না ভাইয়া, দরকার নেই।”

“আমার দরকার আছে। একটু হাসো তো।”

জুম্মান ভাইয়ার জোরাজুরিতে আমি ছবি তুলতে রাজি হলাম। কিন্তু যখনই ছবি তোলার জন্য সুন্দর করে দাঁড়িয়ে একটু হাসতে যাব তখনই কোত্থেকে অর্নি ভাবি এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,“আরে ইলোরা, তোমার শাড়ি কোথায়?”

জুম্মান ভাইয়া বিরক্তি নিয়ে বলল,“ভাবি, দিলে তো ছবির বারোটা বাজিয়ে?”

অর্নি ভাবি একবার জুম্মান ভাইয়া আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“ওহ্! তুমি যে ছবি তুলছিলে তা তো খেয়াল করিনি ভাই। আচ্ছা ছবি পরে তোলা যাবে। এই ইলোরা, তুমি শাড়ি পরোনি কেন?”

আমি বললাম,“আমার ইচ্ছে করছে না ভাবি।”

“ইচ্ছে করছে না মানে? সব মেয়েরা আজ শাড়ি পরেছে, আর তুমি থ্রি-পিস পরে ঘুরছো? দেখো আমিও তো শাড়ি পরেছি। চলো এখনই শাড়ি পরবে।”

“না ভাবি। সবাই তো পরেছে, আমি একা না পরলে কী হবে?”

“অনেক কিছু হবে। চলো তুমি, আমি হেল্প করছি তোমাকে।”

অর্নি ভাবি আমার হাত ধরে টানতে শুরু করলেন। আমি ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,“ভাবি, আমি আসলে হলুদে শাড়ি পরব না ভেবে শাড়ি আনিনি।”

“আরে এটা কোনো প্রবলেম হলো? আমার শাড়ি পরবে, চলো।”

আমি ইতস্তত করে বললাম,“থাক না ভাবি।”

ভাবি হার মানলেন না। উনি হয়তো পণ করেছেন আমাকে শাড়ি পরিয়েই ছাড়বেন। ভাবির সাথে জুম্মান ভাইয়াও এবার বলতে শুরু করলেন,“যাও ইলোরা, না কোরো না আর। সবাই যেহেতু পরেছে, মাঝখান থেকে তুমি কেন বাদ যাবে?”

শেষমেষ আমি হার মেনে নিয়ে ভাবির সাথে তার রুমে এলাম। ভাবি তার লাগেজ থেকে হলুদের মধ্যে সাদা সংমিশ্রণে জর্জেট একটা শাড়ি বের করলেন। তার একটা ব্লাউজ আর পেটিকোট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন পরে নিতে। বাধ্য হয়েই আমি ওয়াশরুমে গিয়ে ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে এলাম। ভাবির ব্লাউজ আমার পরনে কিছুটা ঢিলেঢালা হলেও তেমন অসুবিধা হয়নি। যদিও আমি নিজে শাড়ি পরতে পারি, কিন্তু তাড়াতাড়ি করার জন্য ভাবি নিজেই আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। দ্রুত শাড়ি পরিয়ে দিয়ে তার থেকে কিছু গহনা আর মেকআপ বের করে আমাকে সাজাতে বসালেন। আমি মেকআপ করতে রাজি হলাম না, তাই ভাবিও জোর করলেন না। আমার চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে একপাশে ছেড়ে দিলেন। গহনা হাতে নিতেই মিনহা আপু রুমে এল। সে এসেই ব্যস্ত হয়ে বলল,“ভাবি, ওদিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। তোমাকে সবাই খুঁজছে। ইলোরাকে সাজানো হয়নি এখনও?”

অর্নি ভাবি বললেন,“এইতো হয়ে গেছে। ইলোরা, তুমি গহনাগুলো পরে চলে এসো।”

অর্নি ভাবি আমার হাতে গহনাগুলো ধরিয়ে দিলেন। আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালাম। অর্নি ভাবি মিনহা আপুর সাথে চলে গেলেন। আমি ঝটপট গহনা পরে নিলাম। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে বিধায় শাড়ির কুঁচি ধরে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। রুম থেকে বেরোতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তাজ ভাই আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ওনাকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। উনি আমার দিকেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছেন। আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে পাশ কেটে চলে যেতে নিতেই উনি পেছন থেকে খপ করে আমার ডান হাতটা মুঠোবন্দী করলেন। হাতে টান পড়তেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। পেছন ফিরে না তাকিয়েই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে ঢোক গিললাম। কিন্তু ওনার মুঠো থেকে হাত ছাড়ানোর মতো শক্তি আমার হয়ে ওঠেনি। আমি বলতে চাইলাম, হাত ছাড়ুন। কিন্তু কেন জানি গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না। একটু পানি হলে ভালো হত। গলাটা একটু ভিজিয়ে নেয়া দরকার। উনি আমাকে আবার হেঁচকা টানে নিজের দিকে ঘুরালেন। আমি ওনার দিকে তাকালাম না। মাথা নিচু করে অপর হাত দিয়ে ওনার মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে চললাম। না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারলাম উনি এখনও একইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ উনি এক হাত এগিয়ে এনে আমার বাঁ পাশে ছড়িয়ে থাকা চুলে হাত রাখলেন। আমি চকিত চাহনিতে ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার থমকালাম। উনি আমার চুলগুলো ঠেলে পিঠে ছড়িয়ে দেওয়ার সময় গলায় ওনার হাতের স্পর্শে আমি কেঁপে উঠলাম। সাহস জুগিয়ে কাঁপা গলায় আমতা-আমতা করে বললাম,“হাত ছাড়ুন।”

উনি ততক্ষণে আমার চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে কিছুটা নিচু স্বরে বললেন,“কেন? অস্বস্তি লাগছে? অন্য ছেলেদের সামনে স্টাইল করে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময় অস্বস্তি লাগেনি?”

আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ফেললাম। কোন কথার সাথে কোন কথার খিচুড়ি পাকায় লোকটা! তাছাড়া আমি তো ছবি তুলিনি। তার আগেই অর্না ভাবি শাড়ি পরাতে নিয়ে এসেছেন। আমি বললাম,“আমি ছবি তুলিনি।”

“জুম্মান জোর করছিল, তাই না? তুই নিষেধ করার পরও ও জোর করল কীভাবে?”

আমি আবার হাত মোচড়াতে মোচড়াতে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,“এত কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি। হাত ছাড়ুন। লজ্জা-শরম নেই আপনার?”

উনি আমার হাত তো ছাড়লেনই না, উলটো আমার কথা শুনে হাতের বন্ধন শক্ত করলেন। এবার আমি হাতে একটু ব্যথা পেয়ে মুখটা কালো করে ফেললাম। উনি আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে শাসনের সুরে বললেন,“মামু বলেছিল না আমার সাথে সাথে থাকতে? আর তুই কী করছিস? সারাদিনে তোর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি পেকে গেছিস? এখন থেকে আমার পাশ থেকে এক পা নড়লে একদম শুট করে দিব।”

আবার গান! বিপজ্জনক লোকটা এই এক ব্ল্যাকমেইল করে করে আমার জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে দিলো। তবু তো জীবনের মায়া আমারও আছে। আমি গানের কথা শুনে চুপ মেরে গেলাম। তাজ ভাই আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে উলটো দিক ঘুরে সামনে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন,“চল।”

অগত্যা আমি মনে মনে ওনাকে হাজারটা বকা দিতে দিতে ওনার পেছন পেছন হাঁটা দিলাম। হলুদের স্টেজের দিকে যেতেই কোত্থেকে জুম্মান ভাইয়া এসে উপস্থিত। আমার সামনে দাঁড়িয়ে উনি অবাক হয়ে বললেন,“ওয়াও ইলোরা! তোমাকে তো শাড়িতে দারুণ মানিয়েছে। এবার খুব সুন্দর ছবি আসবে। চলো, সুন্দর করে দাঁড়াও তো।”

জুম্মান ভাইয়া আমার দিকে ডিএসএলআর তাক করতেই আমি আড়চোখে পাশে দাঁড়ানো যমরাজের দিকে তাকালাম। উনি চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে জুম্মান ভাইয়াকে বললাম,“ভাইয়া, আমার এখন ছবি তুলতে ইচ্ছে করছে না। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।”

জুম্মান ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো উনি আমার কথায় অসন্তুষ্ট হলেন। উনি ফের কোনো প্রশ্ন করার আগেই আমি স্টেজের পাশে মেয়েদের কাছে চলে গেলাম। সবাই আমার সৌন্দর্যের বেশ প্রশংসা করলেও আমিরা আপু মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি সায়মা আপুকে হলুদ ছুঁইয়ে স্টেজ থেকে নেমে আসতেই শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে ডাকলেন। তার পাশে তাজ ভাই, আদনান ভাইয়া আর নাসের ভাইয়াও আছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বললেন,“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে ইলোমিলো।”

বিনিময়ে আমিও একটু হেসে বললাম,“ধন্যবাদ ভাইয়া।”

পেছন থেকে হঠাৎ কেউ একজন বলে উঠল,“আমাকে কেমন লাগছে তা তো কেউ বলল না।”

আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম আমিরা আপু হেলেদুলে এগিয়ে আসছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে সে বেশ আকর্ষণীয়ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে বলল,“তাজ ভাইয়া, আমাকে কেমন লাগছে বললেন না তো?”

তাজ ভাই মিষ্টি হেসে বললেন,“ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মুখের ওপরের আবর্জনাগুলো আগে পরিষ্কার করে আয়, তাহলে হয়তো বলতে পারব।”

আমিরা আপুর মুখটা চুপসে গেল। বাকিরা সবাই মুখ টিপে হাসছেন। আমিরা আপু কপট অহংকার নিয়ে বলল,“ফাজলামি করছেন কেন ভাইয়া? কী জানেন? সবাই আবার সব কিছুতে অভ্যস্ত হয় না। অনেক মেয়েরা তো ক্ষ্যাতের মতো মেকআপ করতেই জানে না। নিজেকে নেচারাল বুঝাতে প্রোগ্রামেও মেকআপ ছাড়া আসে।”

কথাটা যে আমাকে খোঁচা মেরে বলা হয়েছে তা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হলো না। আদনান ভাইয়া হেসে বললেন,“যারা সত্যিকারের সুন্দর তাদের তোর মতো কয়েক কেজি আটা, ময়দা, সুজি মাখাতে হয় না। এসব আস্তরণ ধুয়ে আয়, নইলে পঁচা দুর্গন্ধ ছড়াবে।”

আদনান ভাইয়ার কথাটা আমিরার গায়ে লাগল। কিন্তু বড়ো ভাই বলে মুখ বুজে সহ্য করতে হলো বেচারিকে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে আমার দিকে এক পলক অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করেই ধুপধাপ পা ফেলে প্রস্থান করল। সঙ্গে সঙ্গে আদনান ভাইয়া শব্দ করে হেসে উঠলেন।

সবাই সবাইকে হলুদ লাগাচ্ছে, আমিও ছাড় পাইনি। অথচ তাজ ভাইয়ের পাশে হলুদ নিয়ে গেলেই উনি একেকজনকে ধমকে সরিয়ে দিচ্ছেন। শেষে এই নিয়ে বাজি ধরা হলো। জায়েদ ভাইয়া ঘোষণা দিলেন তাজ ভাইকে যে হলুদ ছোঁয়াতে পারবে তাকে পাঁচ হাজার টাকা পুরষ্কার দেওয়া হবে। ঘোষণা শুনে সবাই তাজ ভাইয়ের পেছনে উঠেপড়ে লেগে পড়ল। কিন্তু কেউই হলুদ ছোঁয়াতে সক্ষম হলো না। মাহিন ভাইয়া আর আফনান ভাইয়া এই নিয়ে মেয়েদের ‘হেরো’ বলে খেপিয়ে চলেছেন। এভাবে চলতে চলতে একসময় তাজ ভাই রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। সবাই দরজা ধাক্কাধাক্কি করে শেষমেষ হাল ছেড়ে দিলে অর্নি ভাবি আমার পাশে এসে ফিসফিস করে বললেন,“এই ইলোরা, তুমি চেষ্টা করছো না কেন?”

আমি মেকি হেসে বললাম,“ওনার গগন কাঁপানো ধমক শোনার শখ নেই আমার।”

“আরে একবার চেষ্টা করে দেখই না। আমার মনে হয় তুমি পারবে।”

“নাহ্।”

“পাঁচ হাজার টাকা পাবে।”

“তার থেকে আমার জীবনের মূল্য বহুগুণ বেশি।”

অর্নি ভাবি হাসতে হাসতে আমাকে ঠেলেঠুলে তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে নিয়ে গেলেন। আমি তাকে আটকাতে পারলাম না। তাজ ভাইয়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অর্নি ভাবি বললেন,“ডাকো তাড়াতাড়ি।”

আমি মাথা নেড়ে বললাম,“না ভাবি। আমার টাকা লাগবে না।”

অর্নি ভাবি নিজেই দরজায় টোকা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে তাজ ভাই কড়া গলায় বললেন,“আর একবার দরজা ধাক্কলে সবকটাকে হলুদ গুলিয়ে খাওয়াব।”

অর্নি ভাবি মুখ টিপে হেসে উঁচু গলায় বললেন,“সে না হয় পরে দেখা যাবে। আগে দরজা খোলো। দেখি মহারানিকে হলুদ গোলা কীভাবে খাওয়াও।”

এক মিনিটের মাথায় দরজা খুলে গেল, কিন্তু তাজ ভাইকে দেখলাম না। সঙ্গে সঙ্গে অর্নি ভাবি তার হাতের হলুদের বাটিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঠেলে রুমের ভেতর পাঠিয়ে দিলেন। আমি গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সামনে জলজ্যান্ত শয়তানকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি ঢোক গিললাম। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মেকি হেসে বললাম,“আমি আসতে চাইনি। ঐ, ভাবি আমাকে জোর করে পাঠিয়েছেন। এখনই চলে যাচ্ছি।”

আমি ঘুরে দাঁড়াতেই উনি চোখের পলকে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ফেললেন। আমি চোখ বড়ো বড়ো করে চকিত চাহনিতে তাকাতেই উনি বাঁকা হেসে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। ওনাকে এগোতে দেখেই আমি দ্রুত পিছিয়ে যেতে যেতে ভীতু কন্ঠে বললাম,“দরজা বন্ধ করলেন কেন? বলছি তো আমি ইচ্ছে করে আসিনি। হলুদ লাগাব না আপনাকে। সত্যি বলছি। যেতে দিন না আমাকে।”

উনি আমার কথায় কান না দিয়ে আমার কাছাকাছি চলে এলেন। আমি পিছিয়ে যেতে যেতে দেয়ালের সাথে ধাক্কা লাগতে যেতেই তাজ ভাই দ্রুত এগিয়ে এসে আমার মাথার পেছনের দেয়ালে হাত রাখলেন। আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকলেও মাথাটা ওনার হাতে ঠেকল। ফলস্বরূপ মাথাটা একটা বড়োসড়ো ধাক্কা থেকে বেঁচে গেল। তাজ ভাইকে এতটা কাছে দেখে মুহূর্তে আমার গলাটা শুকিয়ে গেল‌। এই লোকের থেকে আমি যতই দূরে থাকতে চাই ততই কাছে চলে আসে। হঠাৎ করে আমার হাত-পায়ে কম্পন ধরে গেল। সাথে আমার হাতের হলুদের বাটিটাও পড়ে যাওয়ার জোগাড় হলো। তাজ ভাই ধমকের সুরে বললেন,“একশ বছরের বুড়ির মতো কাঁপছিস কেন? হলুদ লাগাবি না?”

আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম,“না। আমি বাইরে যাব।”

“যে কারনে এসেছিস আগে তা করে নে।”

“আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে।”

তাজ ভাই সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার হাতের হলুদের বাটি থেকে অনেকটা হলুদ হাতে নিয়ে আমার বাঁ গালে মাখিয়ে দিলেন। আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললাম। পরক্ষণেই গালে কিছুর খোঁচা খেয়ে ফট করে চোখ খুলতেই আমার চোখ চড়কগাছ। তাজ ভাই ততক্ষণে আমার গালের হলুদ নিজের গালে নিয়ে নিয়েছেন। ফলস্বরূপ আমার গালে ওনার খোঁচা খোঁচা দাড়ির গুঁতো খেয়ে গালটা জ্বলে গেল। আমি এতটাই চমকে উঠলাম যে আমার হাতের বাটিটা স্বশব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। তাজ ভাই তখন আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসছেন। ওনার এই ছোঁয়াটা আমি ঠিক নিতে পারলাম না। রাগে-দুঃখে দুহাতে ওনাকে জোরেশোরে এক ধাক্কা মারলাম। হঠাৎ এমন ধাক্কা খাওয়ায় উনি কিছুটা পিছিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলেন। কিন্তু আমি আর ওনার দিকে ফিরেও তাকালাম না। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই সামনে পুরো গ্যাং সামনে পড়ল। তাজ ভাইয়ের দরজার সামনে জায়েদ ভাইয়া, অর্নি ভাবি, আদনান ভাইয়া, আফনান ভাইয়া, মাহিন ভাইয়া, জুম্মান ভাইয়া, শ্রেয়ান ভাইয়া, নাসের ভাইয়া, মিনহা আপু, আমিরা আপু আরও কয়েকজন বেশ আগ্রহী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাদের দেখে একটু থমকে গেলেও পরক্ষণেই আবার ছুটে সেখান থেকে চলে এলাম। আমার জন্য বরাদ্দকৃত রুমটায় এসেই দরজা লাগালাম। হঠাৎ হঠাৎ ওনার এই ছুঁয়ে দেয়ার ব্যাপারটা আমাকে বিরক্ত করে তুলল। ওনার প্রতি ক্ষোভ থেকে চোখের কোণে পানিও জমে গেল। ধপ করে বিছানার কোণে জড়োসড়ো হয়ে সেই যে বসলাম, এরপর অনেকে এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি করার পরও সাড়াশব্দ করলাম না। শেষে যখন তাজ ভাইয়ের বড়ো কাকা এসে ডাকলেন তখন আর বসে থাকতে পারলাম না। দরজা খুলতেই উনি খেতে যেতে বললেন। কিন্তু আমি বলে দিলাম আমার ক্ষুধা নেই। তবু কাকা কয়েকবার ডাকাডাকি করে চলে গেলেন। আমি গায়ের গহনাগুলো খুলে রেখে লাগেজ খুলে থ্রি-পিস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। শাড়িটা চেঞ্জ করে ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই আবার রাগ উঠে গেল। বরাবরের মতোই তাজ ভাই আমার বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ফোন চাপছেন। আমি ওনাকে দেখেও না দেখার ভান করে শাড়িটা নিয়ে বিছানায় রাখলাম। তাজ ভাই আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,“খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে আবার অসুস্থ হওয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে?”

আমি গাল ফুলিয়ে বিছানার পাশ থেকে সরে দরজার দিকে হাঁটা দিলাম। তাজ ভাই দৌড়ে এসে আমার হাত টেনে ধরে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। আমি রাগত স্বরে বললাম,“সমস্যা কী আপনার? ছোঁয়া-ছুঁয়ির ব্যারামে পেয়েছে? এটা বাংলাদেশ, সুইডেন না যে মেয়েদের ছুঁয়ে দিলেও সেটা স্বাভাবিক বলে চালিয়ে দেওয়া হবে। সম্পর্কে আপনি আমার ফুপাতো ভাই। আমাকে ছোঁয়ার নূন্যতম অধিকারও আপনার নেই। দয়া করে দূরে থাকুন আমার থেকে। আমি আপনার ওপর সত্যিই বিরক্ত।”

কথাগুলো বলতে বলতে আমার চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। উনি স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মিনিট দুয়েক চুপচাপ বসে
থেকে উনি উঠে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলেন। আমি চুপচাপ এক জায়গায় ঠাঁয় বসে রইলাম। মিনিট দুয়েক পর তাজ ভাই আবার এসে আমার সামনে বসলেন। এবার ওনার হাতে খাবারের প্লেট দেখলাম। এতক্ষণ বোধ হয় টেবিলে রাখা ছিল। উনি খাবার মাখিয়ে আমার মুখের সামনে তুলে ধরে নরম কন্ঠে বললেন,“হা কর। না খেয়ে থাকলে তোর শরীরের ক্ষতি হবে। ডক্টর কী বলেছে শুনিসনি? খাবারে অনিয়ম একদম চলবে না।”

আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। উনি আবার বললেন,“তুই অসুস্থ হলে মামু আমাকে কী ভাববে বল তো? ভববে আমি তোর খেয়াল রাখিনি। আচ্ছা আমি সরি। এবার হা কর।”

আমি থমথমে মুখে ওনার দিকে তাকালেও হা করলাম না। উনি এবার বাঁ হাতে নিজের এক কান ধরে অসহায় মুখে বললেন,“সরি বলছি তো। আমার ওপর রাগ করলেও খাবারের ওপর করিস না। খেয়ে নে প্লিজ। আমারও তো ক্ষুধা পেয়েছে। সেই কখন থেকে না খেয়ে আছি। হা কর।”

কেন জানি এবার আমি পালটা উত্তর দিতে পারলাম না। ফের রাগও দেখাতে পারলাম না। একবার বলতে চাইলাম যে আমি নিজের হাতে খাব। কিন্তু কন্ঠনালি বাঁধ সাধল। এমনটা কেন হচ্ছে? ওনার হাতে খাওয়াটা কি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে? হতেও পারে। কিন্তু আমি চাই না উনি আমার অভ্যাস হোক। অথচ এই প্রথম ওনার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মায়া হলো। অজানা কারণে রাগটাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। রোবটের মতো আমি ওনার কথামতো ওনার হাতেই খাবার খেতে লাগলাম।

চলবে………..…..….…….🍁