তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-৩০+৩১

0
441

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩০

আজ তিনদিন হলো আফরা আপু আমাদের বাসায় আছে। দুদিন আগে আমি তাজ ভাইকে বলেছিলাম, সে যেন এখন থেকে দোতলায় গিয়ে থাকে। অথচ মহাশয় আমাকে উলটো ধমক দিয়ে বসিয়ে রেখেছেন। এই তিনদিনে আফরা আপু আমার সাথে ঠিকমতো কথাও বলেনি। আমাকে দেখলেই তার মুখের রং বদলে যায়। বিশেষ করে তাজ ভাই আমার সাথে কথা বলার সময় আপুর মুখটা চুপসে যায়। কেন জানি এখন আর তাজ ভাইকে পটানোর কৌশল বলতে ইচ্ছে করে না আপুকে। যদিও সে কয়েকবার তাজ ভাইয়ের ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু আমিই সুযোগ দিইনি। কিন্তু আজ আপু নাছোড়বান্দা। দুপুরের খাবারের পর তাজ ভাই বাইরে বেরিয়েছেন। আমি রুমে বসে ফেসবুকিং করছিলাম। তখনই আপু এসে বলল,“ইলো শোন, আমি একটা প্ল্যানিং করেছি।”

আমি প্রশ্ন করলাম,“কিসের প্ল্যানিং?”

“আমি তাজ ভাইয়াকে প্রপোজ করব।”

আমি চোখ দুটো ছানাবড়া করে বলে উঠলাম,“কিহ্!”

“হ্যাঁ, কিন্তু তার আগে ওনাকে ইমপ্রেস করব।”

“আগেরবারও তো চেষ্টা করেছিলে, কোনো লাভ তো হলো না।”

আপু দৃঢ় কন্ঠে বলল,“এবার হবে। তুই শুধু আমাকে একটু হেল্প করবি।”

আমি আমতা-আমতা করে বললাম,“আমি?”

“হ্যাঁ। আগেরবার তো তোর প্ল্যানেই চেষ্টা করেছিলাম। এবারের প্ল্যান আমার। তুই তো বলেছিলি তুই আমার হেল্পিং হ্যান্ড। ভুলে গেলি?”

আমি মেকি হেসে বললাম,“না, না। ভুলব কেন? বলো, কী করতে হবে?”

আপু উৎফুল্ল হয়ে বলল,“আমি ওনার সাথে লং ড্রাইভে যাব। আলাদা করে সময় কাটাব আর কী। ঘুরব-ফিরব, রেস্টুরেন্টে খাব-দাব, অনেক গল্প করব। তারপর দেখবি আস্তে আস্তে উনি আমার প্রতি আকৃষ্ট হবেন। আর তারপর সুযোগ বুঝে আমি প্রপোজ করব। তোর কাজ হচ্ছে ওনাকে রাজি করানো। যেভাবে হোক ওনাকে আমার সাথে লং ড্রাইভে যেতে রাজি করবি।”

আমি আমতা-আমতা করে বললাম,“কিন্তু আপু, আমি বললেই কি উনি রাজি হবেন? তুমি বলো না।”

“কী যে বলিস! দেখ, আমি আর তুই দুজনেই তো ওনার কাজিন। কিন্তু তফাৎ দেখেছিস? তোর প্রতি ওনার আলাদা টান আছে। প্রতিদিন খাবার মুখে তুলে দেওয়া, ভার্সিটিতে দিয়ে-নিয়ে আসা, পড়তে বসানো, এসব কখনও উনি আমার বেলায় করেন? করেন না। বাই দা ওয়ে, তুই আমাকে হেল্প করতে পারবি না?”

কথাটা বলতে বলতে আপুর চোখ-মুখের ভাব পালটে গেল। আমার প্রতি তাজ ভাইয়ের আলাদা কেয়ারিং দেখে হয়তো সে মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। আমার কোমল মনে মায়ার উদয় হলো। কিছু না ভেবেই হুট করে বলে বসলাম,“তুমি চিন্তা কোরো না আপু। উনি এলে আমি বলে দেখব।”

আপুর চোখে-মুখে খুশি উপচে পড়ল। মিষ্টি হেসে বলল,“এলেই বলবি কিন্তু। রাজি করতে পারলে স্পেশাল ট্রিট পাবি।”

আমি মাথা ঝাঁকালাম। একবারও ভাবলাম না যে, তাজ ভাইয়ের মতো উন্নতমানের ঘাড়ত্যাড়াকে এসব কাজে রাজি করানো আমার মতো চুনোপুঁটির কর্ম নয়। তাজ ভাই বাড়িতে এলেন মাগরিবের নামাজের পর। সঙ্গে সঙ্গে আফরা আপু আমাকে ঠেলেঠুলে তাজ ভাইয়ের রুমে পাঠালেন। মনে বেশ সাহস জুগিয়ে আমি ধীর পায়ে তাজ ভাইয়ের রুমে ঢুকলাম। দেখলাম তাজ ভাই বিছানায় পা গোল করে বসে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে একটা ফাইল দেখছে। আমি এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন না। আমি বিছানায় পা ঝুলিয়ে ওনার মুখোমুখি বসলাম। তবু ওনার মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। উনি যে ইচ্ছে করেই মুখ তুলে তাকাচ্ছেন না, তা বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না। অথচ আমি কিছু বলতে গিয়েও পারছি না। কন্ঠনালি দিয়ে শব্দ বের করতে চাইলেই সব সাহস ফুস করে উড়ে যাচ্ছে। আমি ঠোঁট উলটে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, কখন উনি মুখ তুলবেন সেই আশায়। অবশেষে প্রায় পাঁচ-ছয় মিনিট পর আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মহারাজ মুখ তুলে তাকালেন। সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখেই গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,“বলে ফেল।”

তার মানে উনি বুঝতে পেরেছেন আমি কিছু বলার জন্য বসে আছি। কিন্তু এখন কিছু বলার সাহসটাই তো পাচ্ছি না। তবু আমতা-আমতা করে বললাম,“একটা কথা বলার ছিল।”

“কী কথা সেটাই জানতে চাইছি।”

আমি ঠোঁট উলটে বললাম,“আপনি মাইন্ড রিড করে জেনে নিন না, আমি কী বলতে চাইছি।”

তাজ ভাই ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বললেন,“বললে দ্রুত বল, তা না হলে যা এখান থেকে। আমার কাজ আছে।”

“শুনুন না।”

তাজ ভাই এবার চোখ পাকালেন। আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“প্রথমেই এমন করলে বলব কীভাবে? ধুর!”

তাজ ভাই মুখ দিয়ে ফুস করে একটা বিরক্তিকর শব্দ করে বললেন,“বল, শুনছি।”

আমি আমতা-আমতা করে বলেই ফেললাম,“আফরা আপু আপনার সাথে লং ড্রাইভে যেতে চাইছে।”

কথাটা বলে আমি ওনার উত্তরের আশায় উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। অথচ উনি মিনিট খানেক কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে পুনরায় ফাইলে মুখ গুঁজলেন। আমি অধৈর্য হয়ে বললাম,“কী হলো? কিছু বলবেন না? যাবেন না লং ড্রাইভে?”

তাজ ভাই আমার কথায় কান দিলেন না। আমি আবার বললাম,“আরে যান না। গেলে কী হয়? একটু ঘোরাঘুরি করবেন, খাবেন-দাবেন, তারপর চলে আসবেন। আফরা আপু আপনাকে কত্ত পছন্দ করে বোঝেন না?”

তাজ ভাই আবার মুখ তুলে শক্ত মুখে বললেন,“বলিস তো আজই বিয়ে করে ফেলি?”

আমি লাফিয়ে উঠে বললাম,“আররে, এটা ভালো বলেছেন তো। আপনার ওই আমিরার থেকে আফরা আপু অনেক ভালো। আফরা আপু যে আপনাকে কত ভালোবাসে, তা তার কথায় বুঝা যায়। এজন্যই তো বলছি, আপুকে নিয়ে লং ড্রাইভে যান। কিছু সময়ের মধ্যে এমনিতেই বুঝে যাবেন তার মনের কথা।”

তাজ ভাই আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুরো কথাটা শুনলেন। তারপর ধমকের সুরে বললেন,“আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়াবি না, যা এখান থেকে।”

আমি মন খারাপের ভান করে বললাম,“কেন? আমি কি খারাপ কিছু বলেছি?”

“ইলু, আমার মেজাজ খারাপ করবি না এখন। এমনিতেই কাজের চাপে আছি। আমার রাগ তো এখনও দেখিসনি। যেচে রাগ উঠালে পরে সামলাতে পারবি না। ভালোয় ভালোয় বলছি, চলে যা।”

আমি ত্যাড়াভাবে বললাম,“যাব না। আগে বলুন, আপনি আপুকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাবেন।”

তাজ ভাই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,“যেতে বলেছি তোকে।”

আমি মুখ ভার করে উঠে দাঁড়ালাম। উনি সঙ্গে সঙ্গেই আবার ফাইলে মুখ গুঁজলেন। বুঝলাম আর লাভ হবে না কিছু বলে। ভুল সময়ে এসেছি। শয়তানটার মাথা আগে থেকেই গরম ছিল। গাল ফুলিয়ে আমি দ্রুত পায়ে ওনার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। সঙ্গে সঙ্গে আফরা আপু এসে প্রশ্ন করা শুরু করল, তাজ ভাই কী বলেছেন। আমি বললাম তাজ ভাইয়ের মেজাজ খারাপ, তাই আমাকে ধমকে বের করে দিয়েছেন। আপুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। এদিকে রুমে ফেরার পর আমার মনটা কেমন উস-খুশ করতে লাগল। তাজ ভাইয়ের এত রাগ কিসের, মাথার মধ্যে এটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। না চাইতেও ওনাকে নিয়ে ভাবনা চলে আসে। অনেকক্ষণ ধরে ভাবাভাবির পর রুম থেকে বেরিয়ে বাবার রুমে উঁকি দিলাম। বাবা এইমাত্র ফিরেছে। আমি চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে চলে গেলাম। মিতা আমাকে দেখেই প্রশ্ন করল,“চা বানাবে না কি?”

আমি ওপর নিচে মাথা ঝাঁকালাম। মিতা সবকিছু এগিয়ে দিলো। আমি চা করে মিতাকে দিয়ে বাবা আর আফরা আপুর জন্য পাঠিয়ে দিলাম। তারপর দু কাপ চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। রুমে ঢুকে দেখলাম তাজ ভাই ফাইল রেখে এখন ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন। আমি এগিয়ে যেতেই এবার ফিরে তাকালেন। কোনো কথা না বলে আমি চায়ের কাপটা বাড়িয়ে ধরলাম। তাজ ভাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ওনার বিস্ময়ের কারণ বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না। ইতিপূর্বে কখনও আমি যেচে ওনার জন্য চা করে আনিনি। সবসময়ই উনি ধমকে চা করতে পাঠান। আশ্চর্যজনকভাবে তাজ ভাই আজ চায়ের কাপ সামনে দেখেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,“কী হলো? খাবেন না?”

উনি গম্ভীর মুখে উত্তর দিলেন,“না।”

“কেন?”

উনি নিশ্চুপ। মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখনও রেগে আছেন। আমি চায়ের কাপ সমেত হাতটা বাড়িয়েই রাখলাম। পুনরায় বললাম,“নিন। এত রেগে আছেন কেন?”

উনি ভ্রুকুটি করে বললেন,“আমি বলেছি রেগে আছি?”

“রাগলে আবার বলতে হয় না কি? আপনার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে রেগে আছেন।”

“আচ্ছা? মুখ দেখে এতকিছু বুঝতে পারিস না কি তুই?”

“চা-টা নিন।”

“আফরাকে বল চা করে আনতে।”

“আমি তো করেছি, আবার আপু করবে কেন?”

“সেকি! আমার বউ হবে, তো চা করে খাওয়াবে না?”

আমি অধৈর্য হয়ে চায়ের কাপটা ওনার সামনে রেখে দিয়ে বললাম,“কালকে থেকে খাওয়াতে বলব। এখন এটাই খান।”

“খাব না।”

“প্রতিদিন তো ধমকে চা করতে পাঠান। আজ ইচ্ছে করে করেছি বলে খাবেন না?”

“করতে বলেছে কে?

“আপনি কি খাবেন?”

“না।”

“আচ্ছা, না খেলে ফেলে দিন।” বলে আমি উলটো দিক ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে উনি উঠে এসে আমার হাত টেনে ধরলেন। আমি ওনার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই উনি আমার হাতটা পিছমোড়া করে মুচড়ে ধরে শক্তপোক্ত মুখে বললেন,“শ্রেয়ানের সাথে কিসের এত কথা তোর?”

আমি হাতের ব্যথায় মুখ কুঁচকে অবাক হয়ে বললাম,“মানে?”

“মানে ও আমার কিছুদূর দাঁড়িয়ে টানা আধঘণ্টা তোর সাথে ফোনালাপ করেছে। কী এত কথা হলো ওর সাথে?”

আমি অবাক হলেও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,“হাতে লাগছে, ছাড়ুন।”

“কী কথা বলেছিস?”

আমি অসহায় মুখে বললাম,“শ্রেয়ান ভাইয়া তো এমনিতেই ফোন করেছিলেন, ওনার না কি কাজ ছিল না। তারপর ওনার ফ্যামিলি নিয়ে গল্প করলেন।”

তাজ ভাই কপাল কুঁচকে বললেন,“ওর ফ্যামিলির গল্প তোর সাথে করে কেন?”

আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। একে তো হাতে ব্যথা পাচ্ছি, তার ওপর আবার ওনার আবোল-তাবোল কথা। হুট করে বলে বসলাম,“উনি আমার জামাই হবেন তো, সেজন্য আগে থেকেই ওনার ফ্যামিলির ব্যাপারে জানিয়ে দিলেন।”

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই আমার মুচড়ে ধরা হাতটা আরও চেপে ধরলেন। এবার আমি ব্যথাতুর শব্দ করে উঠলাম। চোখ জোড়া ছলছল করে উঠতেই তাজ ভাই আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। এক পা পিছিয়ে গিয়ে পুনরায় শক্ত মুখে বললেন,“নেক্সট টাইম যেন এসব না দেখি। শ্রেয়ানের থেকে মেপে মেপে বিশ হাত দূরে থাকবি।”

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম। আজ বিকেলে শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি প্রথমে চিনতে পারিনি, কারণ তার নাম্বার আমার ফোনে ছিল না। পরে শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন উনি না কি তাজ ভাইয়ের থেকে আমার নাম্বার নিয়েছেন। ফ্রী আছেন বলে আমাকে ফোন করে অনেকক্ষণ অবধি কথা বলেছেন। তো এতে আমার দোষটা কোথায়? আর শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে কথা বলেছি বলে এই শয়তানটা এত রেগে গেল কেন? মানুষ কী পরিমাণ হিংসুটে হলে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে এমন হিংসা করতে পারে! আমার ভাবনার মাঝেই তাজ ভাই এগিয়ে গিয়ে বিছানা থেকে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলেন। আমি বললাম,“এখন তো ঠান্ডাই হয়ে গেছে।”

“জিজ্ঞেস করিনি।” বলেই পুনরায় কাপে চুমুক দিলেন। আমি মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,“ভালো কথাও ভালো লাগে না।”

তাজ ভাই শরবতের মতো পুরো চা-টা শেষ করে কাপটা আমার দিকে এগিয়ে ধরলেন। আমি ওনার হাত থেকে কাপটা নিতেই উনি বললেন,“তোর রেজাল্ট কবে দিবে?”

আমি না বুঝার ভান করে উলটো প্রশ্ন করলাম,“কিসের রেজাল্ট?”

“কদিন আগে যে এক্সাম দিলি, তার রেজাল্ট।”

“জানি না।”

“জানিস না মানে? প্রত্যেকদিন ভার্সিটিতে যাস, আর রেজাল্ট কবে দিবে তা-ই জানিস না?”

আমি মেকি হেসে বললাম,“কাল জেনে আসব।”

তাজ ভাই মাথা দুলিয়ে বললেন,“শোন, কাল সকালে আমি গ্রামে যাব।”

আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,“আবার?”

“হ্যাঁ, কাজ আছে।”

“আফরা আপুও যাবে না কি?”

তাজ ভাই আমার মাথায় মৃদু চাটি মেরে বললেন,“কথায় কথায় আফরা আপু, আফরা আপু জপিস কেন? আমি বলেছি ওকে নিয়ে যাব?”

“আপনার মাফিয়া পার্টনার যাবেন না?”

তাজ ভাই ভ্রু কুঁচকালেন। আমি ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বললাম,“শ্রেয়ান ভাইয়া।”

“না। আমি একা যাব।”

“ও, কদিনের জন্য যাবেন?”

“দুই বা তিন দিন। শিওর না। আমি যতদিন গ্রামে থাকব, ততদিন মামু তোকে ভার্সিটিতে দিয়ে-নিয়ে আসবে।”

“আচ্ছা।”

“আরেকটা কথা। শ্রেয়ান হয়তো ভার্সিটিতে দিয়ে-নিয়ে আসতে চাইতে পারে। ওর সাথে যাবি না। মামুকে বলে রেখেছি, তার সাথেই যাবি।”

হঠাৎ করে আমার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি কড়া নাড়ল। আমি হেসে বললাম,“আরে, তাহলে আর বাবার কষ্ট করার কী দরকার? আমি শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথেই যাব।”

তাজ ভাই ধমকের সুরে বললেন,“বললাম না শ্রেয়ানের থেকে মেপে মেপে বিশ হাত দূরে থাকবি?”

আমি ত্যাড়াভাবে বললাম,“আমি ওনার সাথেই যাব। এক্ষুনি গিয়ে আমি ওনাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি।”

সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই আমার বাঁ হাতের কব্জি চেপে ধরে কাছে টেনে, মাথায় গান চেপে ধরলেন। মুহূর্তের মধ্যে কোমর থেকে গান কীভাবে বের করলেন টেরও পেলাম না। ভয়ে আমার ডান হাতের চায়ের কাপটা কাঁপতে শুরু করল। আমি চোখ-মুখ খিঁচে কিছুটা জোরেই বলে উঠলাম,“এইইইইইই, না না না না না, শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে যাব না।”

উনি গানটা আরেকটু চেপে ধরে বললেন,“কেন? কী যেন বলছিলি? শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথেই যাব, আবার বল, আবার বল।”

“না না, বলেছি বাবার সাথেই যাব।”

“মনে থাকবে?”

আমি দ্রুত গতিতে ওপর নিচে মাথা দোলালাম। উনি গানটা হালকা করে ধরে প্রশ্ন করলেন,“যদি না থাকে?”

আমি অসহায়ের মতো বললাম,“সব শাস্তি মাথা পেতে নিব।”

উনি বাঁকা হেসে বললেন,“মাইন্ড ইট।”

মাথা থেকে গান সরাতেই আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। উনি গানটা পুনরায় কোমরে গুঁজে সরে দাঁড়ালেন। আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“কথায় কথায় মাথায় গান ধরেন কেন? আমি যদি পুলিশে কমপ্লেইন করি?”

উনি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন,“এক্ষুনি কর, যা। আমিও তোর প্রাণপ্রিয় নেহালের চিঠি আর ছবি মামুর হাতে ট্রান্সফার করব।”

“আপনি কি জীবনে ভালো হবেন না?”

উনি চোখ দুটো বড়ো করে বললেন,“আমি ভালো না? এই তোর মতো কিছু মেয়েদের জন্যই ছেলেরা উঠতে-বসতে অপমানিত হয়। তোরা ভালো ছেলেদের ভালো বলতে জানিস না। নিজেরা গর্দভ বলে, ছেলেদেরও তাই ভাবিস। না না, আমি এত শান্তশিষ্ট, কর্তব্যপরায়ণ ছেলে হয়ে এমন অপমান কিছুতেই সহ্য করব না। তোদের মতো মেয়েদের বেছে বেছে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করব।”

আমি বার তিনেক চোখ ঝাপটে বললাম,“ভাষণ থামান মাননীয় স্পীকার। আপনি কত শান্তশিষ্ট, লেজ বিশিষ্ট ছেলে, তা আমার জানা আছে।”

তাজ ভাই ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে ধপাস করে বিছানায় সটান শুয়ে পড়লেন। পা দোলাতে দোলাতে হুকুম করলেন,“আমার লাগেজটা গুছিয়ে রাখ।”

আমি ত্যাড়াভাবে বললাম,“আমি করব কেন? নিজের কাজ নিজে করুন।”

“কারণ তুই আমার এসিস্ট্যান্ট। কথা না বাড়িয়ে কাজে লেগে পড়।”

“পারব না।” বলেই আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। কয়েক পা এগোতেই আমার মনে পড়ল, উনি এ বাড়িতে আসার পর থেকে আমি কোথাও গেলে উনি আগে থেকেই লাগেজ গুছিয়ে রাখেন। অথচ আমি মুখের ওপর ‘পারব না’ বলে দিলাম! এখন কি আমার উচিত আবার গিয়ে লাগেজ গুছিয়ে দেওয়া? ধুর! যেচে আবার গিয়ে শয়তানটার জ্বালাতন সহ্য করার কোনো মানেই হয় না। নিজেরটা নিজেই গুছিয়ে নিক।

চলবে………………..🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩১

বনলতা,
গোলাপের স্নিগ্ধ রূপ দেখেছ কখনও? সচরাচর যে ফুটপাতে ফুল বিক্রেতাদের কাছে গোলাপ দেখো, সেগুলো নয়। ওসব তো শুষ্ক গোলাপ। আমি বলছি গাছে সদ্য ফোটা গোলাপের কথা। সদ্য ফোটা গোলাপে বৃষ্টি কণা মেশানো গোলাপ। বৃষ্টিস্নাত গোলাপে একরাশ স্নিগ্ধতা মেশানো থাকে। বহুদিন আমি বৃষ্টিস্নাত গোলাপের স্নিগ্ধতা দেখিনি, কিন্তু প্রেয়সীর ঘুমন্ত মুখের স্নিগ্ধতা দেখেছি। তার ঘুমন্ত মুখটা যেন বৃষ্টিস্নাত গোলাপের স্নিগ্ধতা মাখানো। ওই স্নিগ্ধতাভরা মুখটা এতটা নেশাময় যে, তাতে আমি বারংবার অসক্ত হয়ে পড়ি। আগামী তিন-চার দিন ওই মুখটা দেখতে পারব না, ভেবেই বুকের বাঁ পাশটা কেমন উতলা হয়ে আছে। তবে মুখোমুখি দেখা না হলেও, সময় করে আমি ঠিকই তার মুখ দর্শন করব। তাকে বলে রাখা হলো, ফোন করলে যেন সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হয়। কথার হেরফের হলে, পানিশমেন্ট উইল বি মেটেড আউট।

ঘুম থেকে উঠেই শিয়রের পাশে চিরকুট পেয়ে দ্রুত পড়ে নিলাম। প্রথম দিকে বেশ মুগ্ধতা কাজ করেছে। কিন্তু শেষের লাইনটা পড়ে পুরো চিরকুটের মুগ্ধতাই কেটে গেল। প্রথম থেকে প্রত্যেকটা লাইন এত সুন্দর করে লিখে, শেষের লাইনে এসে এমন গন্ডগোল বাঁধানো একমাত্র তাজ ভাইয়ের দ্বারাই সম্ভব। এত সুন্দর চিরকুটের মধ্যেও হুমকি, ভাবা যায়! ‌মনে মনে ওনাকে একগাদা বকা দিয়ে বিছানা থেকে নামতেই আমার টনক নড়ল। এত ভোরে উনি চলে গেছেন না কি? কিন্তু এই ভোরবেলা যাবেন কেন? না কি চিরকুটটা আগে থেকেই রেখে গেলেন? আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এগিয়ে গিয়ে তাজ ভাইয়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম দরজা বাইরে থেকে লক করা। লক খোলার জন্য হাত বাড়াতেই পেছন থেকে বাবা বলে উঠল,“কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে।”

আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে উঠলাম,“এত ভোরে!”

বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,“গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। নামাজ পড়ে ওখান থেকেই চলে যাবে। দ্রুত না কি পৌঁছাতে হবে। তুমি এখানে কেন?”

আমি মেকি হেসে বললাম,“আজ তাজ ভাই নামাজের জন্য ডাকলেন না, আমি ভেবেছি উনি এখনও ওঠেননি। তাই ডাকতে এসেছিলাম। তুমি কি মসজিদে যাচ্ছ?”

“হ্যাঁ। তুমিও নামাজ পড়ে নাও আম্মা।”

“আচ্ছা।”

বাবা মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতেই আমি রুমে ফিরে এলাম। এতদিনে এমন এক অভ্যাস হয়ে গেছে যে, এখন বারবার শুধু মনে হচ্ছে, এই বুঝি তাজ ভাই এসে নামাজের জন্য ঘুম থেকে ডেকে তুলবেন। উঠতে না চাইলে মুখে পানির ঝাপটা দিবেন। না চাইতেও বারবার ওনার নামটাই মথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। উনি ডাকতে দেরি করাতেই হয়তো আজ এমনিতেই ঘুম ভেঙে গেছে। আপাতত সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নামাজের প্রস্তুতি নিলাম।

সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বাবার সাথে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হতেই শ্রেয়ান ভাইয়া এসে উপস্থিত হলেন। এসেই বললেন উনি আমাকে ভার্সিটিতে নিয়ে যেতে এসেছেন। শুনেই আমি নাকচ করে বললাম,“না ভাইয়া, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি বাবার সাথে যাচ্ছি তো।”

“কী যে বলো! আমি থাকতে আঙ্কেল কেন কষ্ট করবেন? তাজ নেই বলে আমি আরও তাড়াহুড়ো করে চলে এলাম।”

আমি পুনরায় বাঁধা দিতে গিয়েও পারলাম না। তার আগেই বাবা বলে বসল,“আরে না করছিস কেন? ওর সাথেই যা। তুই তাজের সাথে থাকলে আমি যতটা নিশ্চিন্তে থাকি, শ্রেয়ানের সাথে থাকলেও ততটাই নিশ্চিন্তে থাকব।”

কী আর করা? শ্রেয়ান ভাইয়া আর বাবার কথার চাপে পড়ে শেষমেষ শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথেই ভার্সিটি রওয়ানা দিলাম। তাজ ভাই এসে এটা শুনলে, না জানি কী হয়!

ব্রেক টাইমে বান্ধবীদের সাথে গিয়ে ক্যান্টিনে বসলাম। আড্ডার মাঝে আনহা বলে উঠল,“তো ইলো, তোর রোমিওর কী খবর?”

আনহা তাজ ভাইকে ‘রোমিও’ বলে ডাকে। তবে সেটা পেছনে পেছনেই। সামনে ভাইয়া ভাইয়া করে মরে যায়। আমি স্বাভাবিকভাবেই বললাম,“সবসময় যেমন থাকে, তেমনই।”

মোহনা ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,“মিশন কত লেভেলে?”

আমি ঠোঁট জোড়া জোরপূর্বক প্রসারিত করে বললাম,“ওয়ান লেভেলেই আটকে আছে।”

ফারহা কপাল চাপড়ে বলল,“তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। দিন, মাস, বছর চলে গেলেও তুই ওই ওয়ান লেভেলেই আটকে থাকবি, গাধি!”

মোহনা গালে হাত দিয়ে আফসোসের সুরে বলল,“ইশ্! বাবা-মা কেন যে আমার বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি ঠিক করল? আর একটু সুযোগ পেলে আমি তাজ ভাইয়াকে প্রপোজ করতে পারতাম। তার থেকে বড়ো আফসোস হচ্ছে, ওনার চোখ একজনের ওপরেই আটকে আছে।”

আনহা মোহনার মাথায় হালকা চাটি মেরে বলল,“তোর ফালতু বকবক রেখে হবু জামাইয়ের সাথে প্রেম কর, যাহ্। এই ইলো, বিস্তারিত বল তো।”

আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,“ধুর! আর বিস্তারিত! ওই যে বললাম, ওয়ান লেভেলেই আটকে আছে। ওনার লুকোচুরি আর আমার কনফিউশন। জীবনটা কনফিউশনময় হয়ে গেছে।”

আনহা সিঙাড়ায় কামড় দিয়ে বলল,“তোর প্রতি যে ভাইয়ার মনে একটা সফট কর্নার আছে। এটায় তো কোনো সন্দেহ নেই?”

“তা তো অনেকদিন থেকেই নেই। ওই ওনার লুকোচুরির ব্যাপারেই সব কনফিউশন। চেষ্টা করলেও বরাবরই রেজাল্ট আসে জিরো।”

ফারহা বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল,“এই রহস্যের গোডাউনকে বাদ দিয়ে, তার ওই হ্যান্ডসাম ফ্রেন্ডের সাথে প্রেম কর তো ইলো।”

ঐশী প্রায় আর্তনাদ করে উঠল,“এই না, না, না। একদম না। ওই হ্যান্ডসাম আমার। আগেই বলছি ওর দিকে কেউ নজর দিবি না, খবরদার।”

আমি বললাম,“তোর হ্যান্ডসাম শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে প্রেমের কথা মাথায় আনলে, আমার জায়গা হবে ম্যানহোলের অতলে। তা-ও আবার জীবিত না, মৃত।”

ঐশি আগ্রহী হয়ে প্রশ্ন করল,“কেন কেন?”

আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“মেপে মেপে বিশ হাত দূরে থাকতে বলেছে ওনার থেকে। নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডকেও জেলাস করে শয়তানটা।”

আনহা হাত তালি দিয়ে বলল,“আরে বাহ্! প্রেম একদম জমে উঠেছে। এবার দেখবি তোর মিশনের লেভেল আপনা-আপনি এক লাফে ওয়ান থেকে টেনে উঠে যাবে।”

আমি ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলাম,“কীভাবে?”

“উনি যেটা নিষেধ করেছে, সেটাই তুই বেশি বেশি করবি। মানে ওনার কানের কাছে সারাক্ষণ শ্রেয়ান ভাইয়া, শ্রেয়ান ভাইয়া জপতে থাকবি। বাকি কাজ উনি নিজ দায়িত্বে করে ফেলবে। দেখবি রাগে-দুঃখে গড়গড় করে সব সত্যি কথা বলে দিবে।”

আনহার কতা শুনে আমি ঠোঁট উলটে বললাম,“আমার ভয় লাগে বইন।”

এবার মোহনা বিরক্তি নিয়ে বলল,“কেন? তোকে কি খেয়ে ফেলবে? ভয় পাওয়ার কি আছে?”

আমি চুপচাপ সিঙাড়ায় কামড় বসালাম। কিসের ভয় তা তো কেবল আমিই জানি। শ্রেয়ান ভাইয়ার নাম নিলেই বিপজ্জনক লোকটা আমার মাথায় গান চেপে ধরবে। তাজ ভাইয়ের দাদা বাড়ি যাওয়ার আগেই আমি আমার বান্ধবীদের সাথে ওনার ব্যাপারে পাকাপোক্ত এক আলোচনায় বসেছিলাম। কারণ আমি নিশ্চিত তাজ ভাই আমাকে খুব পছন্দ করেন। কিন্তু উনি ওনার মনের কোনো কথা প্রকাশ করেন না কেন, এটাই আমার আসল কনফিউশন। বান্ধবীদের বলার পর ওরা আমাকে বলেছিল তাজ ভাইয়ের ভিতরকার রহস্য উদঘাটন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে। যদিও তাজ ভাইয়ের মাফিয়া বিষয়ক কথাবার্তা ওদের থেকে গোপন রেখেছিলাম। তারপর থেকেই আমার মিশন ছিল তাজ ভাইয়ের রহস্য জানা। কিন্তু আজও আমি সফল হতে পারিনি। পারব কি না তা-ও জানা নেই। আজকাল যেন ওনার ভিতরকার রহস্য জানার ইচ্ছেটা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। আমার প্রতি ওনার মনের গোপন অনুভূতিগুলো মুখে প্রকাশ করাতে ইচ্ছে করছে। তার সাথে সাথে আমার মস্তিষ্কও আঁচ করতে পারছে, না চাইতেও ওনার প্রতি আমার কোনো এক অজানা অনুভূতি তৈরি হয়েছে। এই অনুভূতির শুরু কবে, কখন, কীভাবে হলো, সে বিষয়ে আমি নিজেও নিশ্চিত না।

_____________________________________

রাত প্রায় এগারোটা। আফরা আপু আর আমি বসে বসে টিভি দেখছি। সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে একটা হিন্দি মুভি দেখছি। এরইমধ্যে আমার পাশে থাকা ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। আমি আর আফরা আপু একসঙ্গে চমকে উঠলাম। ফোনের দিকে তাকিয়ে আমি আরও চমকালাম। আর আফরা আপু ভ্রুকুটি করল। ফোনের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে ফোন কেটে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এমনিতেই আপুর সামনে কথা বলতে আমার অস্বস্তি হবে। কিন্তু স্বস্তিটুকুও বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ফোনটা আবারও বেজে উঠল। এবার ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলাম রিসিভ করব, না কি করব না?”

পাশ থেকে আফরা আপু বলে উঠল,“রিসিভ করছিস না কেন?”

আমি রিসিভ করতে যেতেই ফোনটা কেটে গেল। এবারও খুশি হয়ে ফোন রেখে দিতে যেতেই আবার বেজে উঠল। এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আল্লাহর নাম নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে সামনে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গে ফোনের স্ক্রিনে তাজ ভাইয়ের গম্ভীর মুখটা ভেসে উঠল। ওনার চোখে চোখ পড়তেই চট করে আমার মাথায় এল, উনি কি জেনে গেছেন আমি শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে ভার্সিটি গিয়েছি? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কিন্তু মিনিট খানিক কেটে যাওয়ার পরও উনি একইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। দৃষ্টি তো ফেরালেনই না, উলটো আরও গভীর হলো। আমি কিছু বলতেও পারছি না। আড়চোখে একবার আফরা আপুর চুপসানো মুখের দিকে তাকালাম। আপু থমথমে গলায় বললেন,“কথা বলছিস না যে?”

আমি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,“কিছু বলবেন?”

উনি প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করলেন,“ডিনার করেছিস?”

এবার আফরা আপুর মতো আমার মুখটাও ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। এই প্রশ্নটাই কেন আগে করতে হলো ওনাকে? দুনিয়াতে এছাড়া কি অন্য কোনো কথা নেই? আমি তো ডিনার করিনি। বাবা আর আফরা আপু যখন করেছিল তখন বলেছি আমি পরে করব। কিন্তু পরে আর করতে ইচ্ছে হয়নি। আমাকে নিরুত্তর দেখে তাজ ভাই ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বললেন,“করিসনি, তাই তো? এক্ষুনি ডিনার কর গিয়ে।”

ওনার হুকুম শুনে আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“আপনার মতো আমি রাক্ষস না। এত কীভাবে খাব?”

“এত কী খেয়েছিস তুই? খেতে যেতে বলেছি না তোকে?”

“আরে সন্ধ্যায়ই তো এত্তগুলো ফুসকা খেলাম।” কথাটা বলেই বাঁ হাতে নিজের মুখ চেপে ধরলাম। আহাম্মকের মতো কাজ করে ফেলেছি, বুঝতে পেরে চোরা চোখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি যে এখন কী বলবেন তা আমি ভালো করেই আঁচ করতে পারছি। আমার ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে উনি প্রশ্ন করলেন,“সন্ধ্যায় ফুসকা এনে দিলো কে?”

আমি আবারও আফরা আপুর দিকে তাকালাম। বেচারি থমথমে মুখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি মুখ থেকে হাত নামাতেই তাজ ভাই আবার ধমকের সুরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“বলছিস না কেন?”

আমি অসহায়ের মতো মুখ করে মিনমিনে গলায় বললাম,“শ্রেয়ান ভাইয়া।”

“শ্রেয়ান এসেছিল?”

আমি ওপর নিচে মাথা ঝাঁকালাম। সঙ্গে সঙ্গে উনি সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,“এই, তোকে আজ ভার্সিটি নিয়ে গেছে কে রে?”

আমি ওনার কথা এড়িয়ে ফট করে বলে উঠলাম,“আপু আপনাকে খুব মিস করছে। নিন কথা বলুন। আমি ডিনার করতে যাচ্ছি।”

কথাটা বলেই আমি আফরা আপুর হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে এক ছুটে প্রস্থান করলাম। নিজের রুমে এসে তবেই বড়ো করে দম নিলাম। এত বড়ো একটা বোকামি করায় নিজের মাথা নিজেরই দেয়ালে ঠুকতে ইচ্ছে করছে। আজ তো শ্রেয়ান ভাইয়াই আমাকে ভার্সিটি দিয়ে-নিয়ে এসেছিলেন। তারপর আবার সন্ধ্যায় অনেকগুলো ফুসকা নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন। আফরা আপু আর আমার সাথে টানা দেড় ঘন্টা জমিয়ে আড্ডা দিয়ে, ফুসকা খেয়ে তবেই বিদায় নিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম এসবের কোনো কথাই তাজ ভাইয়ের কানে পৌঁছাতে দিব না। অথচ পেটের কথা মুখ ফসকে সেই বেরিয়েই গেল। যেচে নিজের পায়ে নিজেই কুঠার মারলাম। না বাবা, আমি আর ওনার ফোন রিসিভ করব না। তাতে পরে যা হবার হবে। আল্লাহ্ জানে শয়তানটা এখন কতটা রাগে ফুঁসছে। সামনে থাকলে নিশ্চয়ই সঙ্গে সঙ্গে মাথায় গান চেপে ধরত। গ্রাম থেকে ফিরলে না জানি আমার কপালে কী আছে!

চলবে…..…..…………🍁