তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব-২৬

0
1779

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২৬

ইয়াদ কোনো উত্তর দিলো না, সে এক দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। ইমা ইয়াদের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই ভয়ে পিছিয়ে গেলো।

ইমা ভয়ে কাঁপা গলায় বললো, এই ছবি,,, কারা উনারা ?

ইয়াদ রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে বললো, আমার বাবা-মা।

ভয়ে ইমার মুখ কালো হয়ে গেছে। ইয়াদের কথা শুনে ইমা ছবিতে থাকা মহিলার দিকে ভালো করে তাকালে বুঝতে পারলো এটা মিসেস রুবিনা কবির। ছবিতে সোফায় বসা ইয়াসির হামিদের গলায় দড়ি জাতীয় কিছু পেঁচিয়ে ধরে আছে রুবিনা আর একজন পুরুষ যাকে ইমা চিনতে পারলো না।

ইমা আগের মতোই বললো, আপনার মা আপনার বাবাকে খুন করার চেষ্টা করেছিলো কেনো ? আর আপনি এই ছবি কোথায় পেলেন ? এটা তো দেখে মনে হচ্ছে অনেক আগের ছবি।

ইয়াদ চাপা কষ্ট নিয়ে বললো, আমার বাবাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়নি বরং তাকে খুন করা হয়েছে আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে।

ইমা চমকে উঠে বললো, আপনার বাবা খুন হয়ে থাকলে এই বাড়িতে আপনার বাবার পরিচয়ে যিনি আছেন তিনি কে ?

ইয়াদের চোখে পানি টলমল করছে। প্রতিদিন দেখা স্বপ্নটা আজ চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠলো।

ইয়াদ ধরা গলায় বললো, মিসেস রুবিনা কবিরের পাশে যাকে দেখতে পাচ্ছো, সেই আজকের মুখোশধারী ইয়াসির হামিদ। আমার বাবাকে খুন করে আমার বাবার পরিচয় নিয়ে এই ভদ্র সমাজে ভদ্রলোক সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ইমা কিছুই বুঝতে পারছে না সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইমা ইয়াদের থেকে একটু দূরত্ব রেখে ধপ করে বসে পড়লো বেডে। ইয়াদ কিছু একটা ভেবে ছবিটা রেখে ভালো করে এলবাম খুঁজে দেখতে লাগলো। ইমা এতক্ষণ ইয়াদের কাছে থাকা নিজের এলবামটা খেয়ালই করেনি।

এলবাম দেখে ইমা বললো, আপনি এটা কোথায় পেলেন আর এটাতে কী খুঁজছেন ?

ইয়াদ ব্যস্ত গলায় বললো, ছবিটা এই এলবাম থেকেই বের হয়েছে। তার মানে এটাতে আরো ছবি আছে।

ইমা যেনো আকাশ থেকে পড়লো ইয়াদের কথা শুনে। তার এলবাম থেকে এই ছবি কীভাবে সম্ভব ?

ইমা বলে উঠলো, আপনি পাগল হয়ে গেছেন এটা আমার বাবা-মায়ের এলবাম। এটাতে এই ছবি কোথা থেকে আসবে ?

এটা আমার বাবা-মায়ের এলবাম কথাটা বারবার ইয়াদের কানে বাজতে লাগলো৷ ইয়াদের হাত থেমে গেছে ইমার কথা শুনে। তাতে ইমার বলাও বন্ধ হয়ে গেছে। ইয়াদ হঠাৎ ইমার দিকে তাকালো।

গম্ভীর গলায় বললো, তোমার বাবার নাম কী ?

ইমা অবাক হয়ে বললো, আপনি আমার বাবার নাম জানেন না ? বিয়ের সময় শুনেছিলেন না ?

ইয়াদ রেগে ধমক দিয়ে বললো, যেটা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও।

ইমা ভয়ে কেঁপে উঠলো ইয়াদের ধমকে, কাঁপা গলায় বললো, ইমরুল আবিয়াত।

ইমার একটা কথায় ইয়াদের সব হিসাব মিলে গেলো এক ঝটকায়। ইমার বাবার নাম আগে শুনলেও কখনো অতোটা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেনি। যাকে খুঁজছে সে ইয়াদের নিজের কাছেই ছিলো কখনো ভেবেই দেখেনি। নিজের আশেপাশে রেখে সারা দুনিয়া খোঁজে মরছে। ইয়াদ আবার এলবামটা এলোমেলো করে খুঁজতে লাগলো।

ইমা বলে উঠলো, কী হলো আপনি আবার এটাতে কী খুঁজছেন এভাবে। এই ছবি এখানে কী করে আসবে ?

ইয়াদ কঠিন গলায় বললো, এখানে না থাকলে আর কোথায় থাকবে। ছবিগুলো এখানেই থাকা উচিত আর,,,

ইয়াদ কথা শেষ করার আগেই আরো বেশ কিছু ছবি বের হয়ে এলো এলবামের কভার পেইজের ভেতর থেকে। ইমা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ছবিগুলোর দিকে।

বেশ কিছুটা সময় পর ইমা রেগে বললো, কী হচ্ছে এসব বলবেন প্লিজ ? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার বাবার খুনের ছবি আমার বাবা-মায়ের এলবামে কোথা থেকে এলো ?

ইয়াদ কষ্ট চেপে মুচকি হেঁসে বললো, তোমার বাবা নিজে চলে গেলেও এই জঘন্য মানুষগুলোর শাস্তির ব্যবস্থা ঠিক করে গেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা সব সত্যি সামনে আসার। সময় হয়ে গেছে মিস্টার এন্ড মিসেস কবির আপনাদের পাপ পাহাড় ছুঁয়ে গেছে। এবার শাস্তি পাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যান আপনারা।

ইমা হা করে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে ইয়াদের কথা শুনছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না তার মাথা ভন ভন করে ঘুরছে।

২৮.
ভার্সিটির করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ানা। আজ বৃষ্টি দেখতে নয় আরমানের অপেক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিনের পর ইয়াদের অসুস্থতার জন্য ইয়ানা বা ইশান কেউ ভার্সিটিতে আসেনি। কারো পায়ের শব্দ শুনে ইয়ানা তাকিয়ে দেখলো আরমান আসছে, তার দৃষ্টি সামনে থাকলেও মনোযোগ অন্য কোথাও আছে, তা বেশ ভালো করে বুঝা যাচ্ছে। ইয়ানা আরমানকে দেখে মনে মনে গুছিয়ে নিলো কী বলবে ? আরমান সামনে আসতেই ইয়ানা হালকা কাশি দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো কিন্তু আরমানের সেদিকে কোনো মনোযোগই নেই। ইয়ানা আরো একবার কাশি দিলো তাতেও লাভ হলো না আরমাব নিজের মতো এগিয়ে যাচ্ছে।

ইয়ানা এবার বিরক্ত হয়ে একটু উচু গলায় বললো, স্যার আপনার সাথে একটু কথা ছিলো।

কারো গলার আওয়াজে আরমানের পা অটোমেটিক নিজের জায়গায় থেমে গেলো। আরমান আস্তে করে ঘুরে তাকালো শব্দের উৎস খোঁজার জন্য।

ইয়ানাকে দেখে এগিয়ে এসে বললো, ইয়ানা তুমি ?

ইয়ানা মুচকি হেঁসে বললো, জী স্যার আমি ?

আরমান ভাবলেশহীন ভাবে বললো, সে ঘটনার পরে আজ দুদিন পর ভার্সিটি এলে। আমি তো মনে করেছিলাম ভয়ে তোমরা ভাইবোন আর এদিকে আসবেই না।

আরমানের কথায় ইয়ানার রাগ হলো তাই বললো, ভয় পাবো কেনো ? ভয় তারা পায় যারা অন্যায় করে আর আমি বা আমার ভাই কোনো অন্যায় করিনি যে ভার্সিটি আসবো না।

আরমান নিজের দু’হাত ক্রশ আকাড়ে বুকে রেখে বললো, তাহলে দুদিন এলে না কেনো ?

ইয়ানা আহত গলায় বললো, ভাইয়া প্রচন্ড অসুস্থ ছিলো, গত দু’দিন ভাইয়ার সাথে হসপিটালে দৌড়াতে হয়েছে তাই আসতে পারিনি।

আরমান ছোট করে বললো, ওহ্,,,, তাহলে আজ যখন এসেছো ক্লাসে না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো ?

ইয়ানা মুচকি হেঁসে বললো, আপনার জন্য ?

আরমান তাতে ভ্রু কুঁচকে বললো, আমার জন্য মানে বুঝতে পারলাম না।

ইয়ানা হাসিটা বজায় রেখে বললো, আসলে সেদিন আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। তাই সেদিনের সেই ধন্যবাদ দিতে আপনার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

আরমান মুচকি হেঁসে বললো, ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। তোমরা আমার স্টুডেন্ট তাই তোমাদের ভালো খারাপ সবই আমাদের দ্বায়িত্ব। আমি শুধু আমার দ্বায়িত্ব পালন করেছি। তাহলে ঠিক আছে, এখন ক্লাসে যাও আমারও ক্লাসে লেট হচ্ছে।

আরমান আর না দাঁড়িয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলো। ইয়ানা সেদিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে আছে।

বিড়বিড় করে বললো, এই ব্যাটা কী ফর্মাল কথা ছাড়া কোনো কথা বলতে পারে না। আজব লোক একটা, সবসময় সিরিয়াস হয়ে থাকতে হবে।

ইয়ানা নিজের মতো বকবক করে ক্লাসের দিকে চলে গেলো।

—-
সামনে পরীক্ষা পড়াশোনার প্রচন্ড চাপে আছে কথা। ইমার সাথে চার-পাঁচদিন হলো কথা বলা হয় না। ইমার মায়ের মৃত্যুর পর কথা সবসময় ইমার খোঁজখবর রাখতো ফোনে। তবে চার-পাঁচ দিন হলো ইমাও কল দেয় না আর কথারও দেওয়া হয়ে উঠে না। কলেজ থেকে বের হয়ে ইমাকে কল দেওয়ার জন্য ফোন বের করে রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই একটা গাড়ি এসে থামলো কথার সামনে। গাড়িটা এতোদিনে ভালো করে চিনে গেছে কথা। ইশানের সাথে প্রায় দেখা হয় কথার। গাড়িটা সবসময় সাথেই থাকে ইশানের। কথা ভ্রু কুঁচকে গাড়ির দিকে তাকাতেই ইশান বের হয়ে এলো স্টাইল নিয়ে।

ইশান কথার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেঁসে বললো, কেমন আছেন মিস তোতাপাখি ?

কথা ভ্রু কুঁচকে বললো, আপনি আমাকে তোতাপাখি বলেন কেনো সবসময় ? আমার সুন্দর একটা নাম আছে বলতে পারলে বলেন নাহলে চুপ করে থাকেন। তবু আবোলতাবোল নামে ডাকবেন না। শুধু আপুর দেবর হন বলে এতো ভদ্রভাবে কথা বলি নাহলে,,,,

কথা পুরোটা বলার আগেই ইশান কথার দিকে হালকা ঝুঁকে বললো, নাহলে কী করতে পিচ্চি ?

কথা একটু পিছনে সরে গিয়ে বললো, ওফ সেকেন্ডে সেকেন্ডে আমার নাম চেঞ্জ না করলে আপনার হয় না ?

ইশান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললো, না হয় না, তোমাকে দেখলে আমার বিভিন্ন নাম মাথায় আসে বুঝছো ?

কথা জানে এর সাথে যত কথা বলা হবে এ ততই কথা পেঁচাবে তাই প্রসঙ্গ চেঞ্জ করার জন্য বললো, হঠাৎ করে এমন ভূতের মতো সামনে আসার কারণ জানতে পারি ?

ইশান মুচকি হেঁসে বললো, অবশ্যই জানতে পারেন তবে তার আগে গাড়িতে উঠে বসুন।

কথা অবাক হয়ে বললো, আমি আপনার গাড়িতে কেনো বসবো ?

ইশান আগের ভঙ্গিতে বললো, ভাইয়া অসুস্থ তুমি জানো না ? একবার দেখতেও গেলে না। ভাবি তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে আমার সাথে।

কথা চমকে উঠে বললো, কীহ,,,,, ইয়াদ ভাইয়া অসুস্থ ? আপু তো আমাকে কিছু বলেই নি, চলুন চলুন।

ইশান কথাকে গাড়ির দরজা খোলে দিলো আর নিজেও ভেতরে বসে পড়লো। মনে মনে বললো, সরি তোতাপাখি মিথ্যা বলার জন্য। ভাবির কথা না বললে তুমি যেতে না, তাই বাঁধ্য হয়ে মিথ্যাটা বললাম। জানি না তুমি কীভাবে নেবে তবে আজ আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।

—–
ইমা বেডে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। ইয়াদ ছবিগুলো নিয়ে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বের হয়ে গেছে। সারাদিন পেড়িয়ে গেলো তার খোঁজ খবর নেই। ইমার টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। একে তো তখন কিছুই খোলে বললো না। ইমার মাথায় প্রশ্ন আর ইয়াদের চিন্তায় খারাপ অবস্থা।

বৌমা রুমে আছো ?

গলার আওয়াজ শুনে ইমার কাছে মনে হলো রুবিনার গলা। আজ রুবিনার আওয়াজ কানে যেতেই ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে উঠলো ইমার। মানুষ কতো সুন্দর নিখুঁত অভিনয় দিয়ে নিজের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখে সেটাই ইমা ভাবছে। এই মানুষটার মুখ দেখে মনে হয় কত নিষ্পাপ আর সে নিজের হাতে একজনকে খুন করেছে। ভাবতেই ইমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।

তখনই রুবিনা আবার বললো, বৌমা তুমি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছো ?

ইমা ভয়ে একটা ঢোক গিললো। রুবিনাকে এখন তার প্রচন্ড ভয় করছে। কখনো সে ইমাকে খোঁজে না আজ কেনো খোঁজছে সেটা ভেবে ইমার গলা শুকিয়ে আসছে বারবার।

চলবে,,,,,