তিলকপুরের মিঞা বাড়ি পর্ব-০১

0
168

#তিলকপুরের_মিঞা_বাড়ি
Sumon Al-Farabi
১ম পর্ব

রাত তখন প্রায় ২ টা। চলন্ত ট্রেনটা হঠাৎই থেমে যাওয়ায় জানালা দিয়ে চারপাশটা দেখছিলাম। এটা তো একটা পরিত্যক্ত স্টেশন মনে হচ্ছে। এখানে আবার কে নামবে! এদিকে মারুফ একটু পরপরই জিজ্ঞেস করছে এখন কোন জায়গায় আছি। হঠাৎই চোখ পড়লো ট্রেনের মাঝে খাবার পরিবেশন করে এমন এক জনের সাথে।
– ভাইয়া এটা কোন জায়গা!
– এই স্টেশনের নাম তিলকপুর।
– এখানে কি কেউ নামার আছে!
– এটা তো অনেক দিন বন্ধ এখানে আবার কে নামবে! সামনে থেকে একটা ট্রেন আসছে সেটা ক্রসিং করলেই এটা আবার চলা শুরু হবে।
– কতক্ষণ লাগতে পারে!
– তা তো প্রায় ঘন্টাখানেক লাগবেই।

লোকটা চলে গেলো। আমি মারুফকে ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়ে দিলাম আমি এখন তিলকপুর স্টেশনে আছি। ফোনটা পকেটে রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। পুরো স্টেশনে এক কোনায় একটা হলুদ বাতি জ্বলছে শুধু। সেটার নিচে কয়েকজন আবার জুয়া খেলতে ব্যাস্ত।

একটু পরেই একজন একজন করে নামতে শুরু করলো। তাদের নামতে দেখে আমিও নেমে পড়লাম। অনেকটা সময় বসে আছি কোমড়ে খিল ধরে গেছে।

সবাই উত্তরের দিকে যাচ্ছে দেখে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম – আংকেল সবাই এদিকে কোথায় যাচ্ছে!
– দুই মিনিট হাঁটলে নাকি একটা ছোট বাজার পাওয়া যাবে। সবাই সেখানেই যাচ্ছে সেহেরি করতে। ট্রেনের খাবারের যা দাম।

লোকটা চলে গেলো। আমারও ওদিকে যাওয়া দরকার কিন্তু আমায় আগে সিগারেট ফুঁকতে হবে। সেই সন্ধ্যারাতে একটা ধরিয়েছি। আমি চারদিকে একটু ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলাম। দক্ষিণে কিছুটা দূরে নিভু নিভু বাতি দেখা যাচ্ছে মনে তো হচ্ছে একটা দোকানেই হবে। সেখানে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে তারপর এসে কিছু খাওয়া যাবে।

দোকানে একজন বয়স্ক লোক বসে বসে ঝিমাচ্ছে।
– দাদু! দাদু কি ঘুমাচ্ছেন!
আমার ডাকে তার তন্দ্রা কেটে গেলো।
– ঘুমাই নি। চোখ লেগে আসছে। কিছু নিবেন!
-চা হবে!
– দুধ চা হবে না।
– লেবু থাকলে এক কাপ লেবু চা দেন আর সাথে একটা গোল্ডিফ দেন।

আমার হাতে গোল্ডিফ ধরিয়ে দিয়ে উনি চা বানাতে শুরু করলো। আমি সিগারেট ধরিয়ে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম – দাদু এখানে তো কোনো মানুষ নেই এতো রাতে আপনি এখনো দোকান খুলে বসে আছেন কেন?
– এই যে আপনার মতো যে দুই একজন আসে তাদের জন্যই বসে থাকি।
– ট্রেন তো রোজ থামে না এখানে। তাহলে আপনি কেন না ঘুমিয়ে জেগে থাকেন শুধু!
দাদু চায়ের কাপটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো – আশায় বসে থাকি কেউ একজন আসবে আমার সাথে এসে গল্প করবে। টুকটাক মানুষ আসে এদিকে কেউ কেউ তো দেখেও দেখেনা এই বুড়োর দোকানটাকে। তবে একসময় খুব জনপ্রিয় ছিলো আমার দোকান অনেক লোকের সমাগম ছিলো। এখন আর তেমন নাই।
– আপনার বাসা কি কাছেই কোথাও নাকি দূরে!
– দোকানের পিছনেই আমার বাসা।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটে বেজে গেছে। তাড়াহুড়ো করে চায়ের কাপটা রেখে টাকা দিচ্ছি তখন দাদু জিজ্ঞেস করলো- এতো তাড়াহুড়ো করতে হবে না ট্রেন ছাড়ার এখনো অনেক দেরি আছে।
– সেহরি করতে হবে দাদু। সামনের ঐ বাজারটাতে গিয়ে খাবো। ট্রেনে তো বলে কয়ে ডাকাতি করে।
– আমিও তো সেহেরি করবো। কিছু মনে না করলে আপনি আমার বাসায় সেহেরি করতে পারেন। যা ডাল ভর্তা হয়।
– না দাদু। আমি বরং বাজারের দিকেই যাই। শুধু শুধু আপনার বাসার মানুষের কষ্টের কারণ কেন হতে যাবো।
– কষ্ট কেন হবে! আমরাও একটু সওয়াব কামাই করি আপনার উছিলায়। আমি দোকান বন্ধ করছি আপনি একটু অপেক্ষা করুন।

দাদুর বয়স হইছে আর এটা তেমন শহর এলাকাও না তবুও ওনার ভাষা কতো মার্জিত।

দাদু দোকান বন্ধ করতে সময় আমায় জিজ্ঞেস করলো- পড়ালেখা করেন!
– হ্যাঁ।
– কিসে পড়েন!
– অনার্স প্রথম বর্ষ।
– আমার নাতনীটাও এইবার অনার্সে উঠতো। তা এইসব খান কেন! জানেন না এগুলো ক্ষতি করে!
– ক্ষতি জেনেও তো আমরা অনেক কিছুই করি। আর এটা আমার নেশা না যে না খেতে পারলে খুব অসুবিধা হয়ে যাবে। ছোটখাটো অভ্যাস বলতে পারেন বন্ধুদের সাথে থাকতে থাকতে একটু আধটু।
– চলুন আমার কাজ শেষ।

একটু হাঁটতেই বাসার গেইটের সামনে চলে আসলাম। দুই বার দরজায় নক করতেই একজন বয়স্ক মহিলা দরজা খুললো। আমায় দেখা মাত্রই আমি সালাম দিলাম।
– উনি ট্রেনের যাত্রী আমার দোকানে আসছে তাই নিয়ে আসলাম সেহেরি একসাথেই করি।
– ভালো করছেন আজ বাসায় তরকারি ও ভালোই আছে ।
আমায় ফ্রেশ হবার জন্য নলকূপের পাশে দিয়ে আসলো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসার পর একটা ঘরে বসতে দিলো। একটু পরেই একটা মেয়ে রুমে এসেই বললো- দাদু তুমি এসে আমায় ডাকোনি কেন!
এরপর হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু আমায় দেখে একদম চুপসে গেলো।
– সাথে মেহমান ছিলো তাই ডাকিনি। এসো খাবো।

মেয়েটা আমার বয়সীই। অসম্ভব সুন্দরী। যে কোনো পুরুষ একবার দেখলেই তার জন্য উন্মাদ হয়ে যাবে। মন চাচ্ছে তার দিকে তাকাতে কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি।

খাওয়া শেষ করেই আমি দাদুকে বললাম – আমি তাহলে এখন আসি!
– মাত্রই তো খাওয়া শেষ হলো কিছুক্ষণ বসে রেষ্ট করেন।
– ট্রেন ছেড়ে দিলে বিপাকে পড়ে যাবো। আমি বরং ট্রেনেই বসে রেষ্ট করনো। তবে আপনার গিন্নির রান্নার কিন্তু তুলনা হয় না। অসাধারণ হয়েছে।
– এগুলো আমার ছোট গিন্নির রান্না।
দাদুর একথা শুনতেই মেয়েটা দাদীর আড়ালে মুখ লুকানোর চেষ্টা করলো।

আমি এখন বের হবো।
– দাদু কখনো ঐদিকে গেলে অবশ্যই আমায় জানাবেন আমার নাম্বার দিয়ে গেলাম।
– সেটার দরকার হবে না দাদু। আমরা এই বাড়ির মাঝেই সীমাবদ্ধ। কবে যে এই বাড়ি থেকে মুক্তি পাবো।
– পৃথিবীটা দেখতে হয় ঘুরে ঘুরে। দাদী আসবেন ঘুরতে আপনিও। আমি এখন আসি।

দাদু ঐ মেয়েটাকে আমাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য পাঠালো।

দু’জনেই পাশাপাশি হাঁটছি।
– আপনি কিন্তু অসম্ভব সুন্দর রান্না করেন।
– একটু আগেই বলছেন।
– হুম। আপনার তো নামটাই জানা হলো না ।
– হাসনাহেনা।
– বাহ্। রাতের ফুল। রাতে ফুটে সারা এলাকা সৌরভে মাতিয়ে তোলে। আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই কেন!
– বেশ কিছুদিন আগে এক পরিবারের সবাইকে কয়েকজন শয়তান লোক মেরে ফেলে তারপর থেকে সবাই নাকি এদিকে ভুত দেখতে শুরু করছে তাই অনেকে বাসা সরিয়ে নিয়েছে। তবে ঐদিকে কিছু বাড়ি আছে। দিনের বেলা মাঝে মাঝে দুই একজন এদিকে এলেও রাতে কেউ আসতে চায় না।
– লোকগুলোর শাস্তি হয়নি?
– এখনো হয়নি তাদের শাস্তির আশায় তো দিন গুনে বসে থাকি।
– আপনারা বাসা সরিয়ে নেন নি কেন? আপনাদের ভুত ভয় লাগে না!
– আমাদের বাসা ছেড়ে আমরা কোথায় যাবো।
– আচ্ছা আপনাকে আর ঐদিকে যেতে হবে না। শুধু শুধু এতটা কষ্ট দিলাম । তবে আপনি কিন্তু অনেক মায়াবী।
– এইজন্য বুঝি চুপি চুপি তাকাচ্ছিলেন!
– দেখতে মন চাইছিলো। আজ আসি দাদুর কাছে তো নাম্বার ছিলোই মন চাইলে কল দিয়েন। আল্লাহ হাফিজ।

বিদায় দিয়ে কিছুটা এসে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই হয়তো চলে গেছে অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। তাই আমি আর পিছনে না তাকিয়ে সোজা এসে আমার সিটে বসে পড়লাম। কিন্তু এই কিছুটা সময়ের যে অনুভূতি সেটা মনের কোনে থেকেই গেলো।

To be continue….