তীব্রস্রোত পর্ব-০২

0
138

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#তীব্রস্রোত
#পর্ব ২
.
.
সুপ্তির আব্বু বেরিয়ে যেতেই সুপ্তির আম্মু সুপ্তির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠল।

……তুই সব জানিস তাইনা?

সুপ্তি ভয় পেয়ে চমকে উঠল তার মায়ের হঠাৎ এমন কথায়। সুপ্তি ভয়ার্ত স্বরে, নিচের দিকে চোখ রেখে বলে উঠল।

……আম্মু আমি কীভাবে জানব? আমি তো পাশের রুমে ছিলাম।

……তুই কালই তো সকালে আমাকে এরকম কিছু জিজ্ঞেস করে ছিলি? তাই তুই নিশ্চয়ই কিছু জানিস। দ্যাখ আমাকে সত্যিটা বল, আমি তোর আব্বুকে বুঝিয়ে বলব।

……আম্মু আমার তো একটু সন্দেহ হয়েছিল আপুর হালচাল দেখে তাই আমি কাল তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। এর থেকে বেশি কিছু না। (ভয়ে ভয়ে)

…….সন্দেহ শুধুই? তুই তো ওর সাথেই থাকতি, তবে তুই কীভাবে না জেনে পারিস?

…….আম্মু কারো কিছু করার হলে সে কী বলে করে? বা কাউকে দেখিয়ে করে? আচ্ছা আপু তো সারাদিন বাসায় থাকত, তবে তুমি কী করে জানতে পারলে না কিছু? আমি তো পড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম ইদানীং, তারপরও সেদিন আপুকে ফোনে কথা বলতে দেখেছিলাম কারো সাথে, আমাকে দেখে ফোন কেটে দিয়েছিল তাই সন্দেহ হয়েছে আর তোমার সাথে শেয়ার করেছিলাম। যেহেতু আমি শিওর ছিলাম না তাই তোমাকে এই বিষয় বলিনি। কারণ আমার ধারণা মিথ্যেও তো হতে পারত।

সুপ্তির আম্মু সুপ্তির কথা শুনে সেখান থেকে হেটে নিজের রুমে চলে গেল। আর সুপ্তি হাপ ছেড়ে বাঁচল। সে সোপায় বসে পড়ে দু-হাতে মুখ গুঁজে আস্তে আস্তে বলে উঠল।

……স্যরি আম্মু মিথ্যে বলার জন্য। আমার যে কিচ্ছু করার নেই।

সুপ্তি নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে ফোন হাতে ওয়াশ রুমে চলে গেল। সুপ্রিয়ার নাম্বার উঠিয়ে নিয়ে মুঠো ফোনে, ফোন দিলো সুপ্রিয়া কে। রিং হচ্ছে।

……হ্যালো আপু?

……হ্যা সুপ্তি বল, ওদিকের কী খবর?

…..আপু এদিকে………।

সুপ্তি সব কিছু খুলে বলল সুপ্রিয়া কে। যা শুনে সুপ্রিয়া কিছু না বলে চুপ করে রইল।

……এখন বল তোরা পৌঁছে গিয়েছিস? তুই ঠিক আছিস তো?

……হ্যা আমি ঠিক আছি। পৌঁছে ও গেছি। আচ্ছা এখন কিন্তু তোর উপর অনেক বড় দায়িত্ব, আম্মু আব্বুর খেয়াল রাখিস, সাথে নিজেরও।

…….হ্যা তুই ও ভালো থাকিস। আচ্ছা রাখছি তবে।

……আচ্ছা।

ফোন রেখে দিলো সুপ্রিয়া। আজ আর সুপ্তি কোথাও বের হলো না। সে আজ বাসায়ই রইল।

রাতে সুপ্তির আব্বু বাসায় ফিরল, তখন রাত প্রায় ১১ টা, সুপ্তি তার আব্বুকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। সুপ্তির আম্মুও চুপচাপ খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে দিলো।

প্রায় আধাঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পড়েও যখন সুপ্তির আব্বু খাবার খেতে এলো না। তখন সুপ্তির আম্মু এগিয়ে গেল তাকে ডেকে আনতে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সুপ্তির আম্মু একাই রুম থেকে বেরিয়ে এলো, যা দেখে সুপ্তি তার আম্মুকে জিজ্ঞেস করে উঠল।

……আম্মু আব্বু আসে নি?

……নাহ। তুই খেতে শুরু করে দে।

……আব্বু?

……সে খাবে না। খাওয়ার মতো মন মানষিকতা রেখেছিস তোরা, যে খাবে?

……আম্মু তোরা কেনো বলছ? আমি কী করেছি?

……আজ করিস নি কাল তো করেই ফেলবি, বোনের থেকে শিখে তো নিয়েছিসই। সুপ্রিয়া একবার ও ভাবল না ও চলে গেলে আমাদের কেমন লাগবে? আচ্ছা সুপ্তি ওর কী আমাদের কথা মনে হয়নি? আমরা সে ছোট্ট থেকে তোদের লালন পালন করে বড় করেছি, শুধু তাই নয়, নিজেদের কতো সুখ, আনন্দ, চাহিদা, কতো কিছুই না বিসর্জন দিয়ে তোদের এত ভালোবাসা দিয়ে, তোদের সব চাহিদা পূরণ করে তোদের এত্ত বড় করে তুলেছি যে এখন তোরা নিজেদের খেয়াল রাখতে পারিস, নিজেদের ভালো বুঝতে পারিস, একটু ভালোবাসার জন্য আমাদের এত বছরের ভালোবাসা ত্যাগ করতে পারিস, তোদের কী একটুও মনে হয়না, আমরাও তোদের ভালোই চাই, কারণ একটা সন্তান কে এতবড় করে কেউ চায়না সেই সন্তান কে কষ্টের মধ্যে ঠেলে দিতে। সবাই চায় যাতে আমাদের সন্তান ভালো থাকুক, সে তার মনের মতো জীবন সঙ্গী পাক। তাই বলে কিছু দিনের ভালোবাসার জন্য কী করে সুপ্রিয়া পারল এত বছরের ভালোবাসা বিসর্জন দিতে? ও তো ভালো করেই জানত, আমরা আর ওকে ক্ষমা করব না, তারপরও ও চলে গেল একবার বলতে ইচ্ছেও করল না, আম্মু আমি চিরদিনের জন্য তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি কিছু দিনের ভালোবাসার জন্য। বলার কী ইচ্ছে হয়নি ওর? নাকি ও আমাদের কখনো ভালোই বাসেনি? যার জন্য ও আমাদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্টই অনুভব করতে পারেনি? হয়ত ভুল তোদের নয়, আমাদের মধ্যেই ছিলো আমরা তোদের সেভাবে ভালোই বাসতে পারিনি। সেই শিক্ষা দিতেই পারিনি কখনো। যার জন্য আজ সুপ্রিয়া কাল হয়ত তুই চলে যাবি আমাদের ছেড়ে, একটা বারের জন্যেও ভাববি না, আমাদের কথা, আমাদের মান-সম্মানের কথা?

এই কথা বলে সুপ্তির আম্মু আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে চলে গেল না খেয়েই, সুপ্তি তার আম্মুর কথা শুনে নিজেও কাঁদল কিছুক্ষণ, এরপর সেও আর খেলো না, না খেয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সে ভাবছে তার মা তো খারাপ কিছু বলে নি? সে তো ঠিকই বলেছে। হয়ত সুপ্তি কাউকে ভালো বাসেনি বলে এটা তার মনে হচ্ছে? হয়ত সুপ্তি এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই বলে তার মনে হচ্ছে? কিন্তু সে এমন ভালোবাসা জীবনে চায়ই না, যে ভালোবাসার জন্য তাকে তার ফ্যামিলি বিসর্জন দিতে হবে। সুপ্তি তার প্রভুর কাছে দু-হাত জোর করে চাইছে এমন প্রেম জানো তার জীবনে বিয়ের আগে না আসে, যার জন্য তার মাতা পিতাকে কষ্ট দিতে হবে। তাদের সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। চায়না সুপ্তি এমন প্রেম, এমন অনুভূতি।

আজ দু-দিন পরে সুপ্তি ইউনিভার্সিটিতে যাবে বলে রেডি হয়ে বের হতে নিচ্ছিল। সুপ্তির আম্মু তা দেখে বলে উঠল।

……কোথায় যাচ্ছিস তুই?

……আম্মু ইউনিভার্সিটিতে।

……কোথাও যেতে হবে না তোর। একজন এত পড়াশোনা করে কী হয়েছে? তোর আজ থেকে আর কোথাও যেতে হবে না। ড্রেস চেঞ্জ করে রান্নাঘরে আয়, রান্না শিখবি।

……আম্মু এটা কেমন কথা? আপুর ভুলের শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছ?

……হ্যা কারণ একজন কে তো পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে ছিলাম, সে পড়াশোনা না করে চুটিয়ে প্রেম করেছে, আর আপনি যে কী করবেন তাও আমি বুঝে গিয়েছি, তাই আপনার আর এই প্রেম করতে হবে না। নাকি অল রেডি পড়ে ফেলেছেন আপনিও এই পড়া?

……আম্মু তুমি আপুর জন্য এখন আমাকেও সন্দেহ করছ?

……হ্যা করছি, কারণ তোর আপুকে সন্দেহ না করেই আজ এই পর্যায় সে পৌঁছাতে পেরেছে যদি সন্দেহ করে তাকে কড়া শাসনে রাখতাম তবে আর এমনটা হতো না।

……আম্মু প্লিজ আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিওনা। প্লিজ আম্মু আমি কথা দিচ্ছি আমি এমন কিছু করব না প্লিজ আম্মু।

……আমি কিছুই শুনতে চাই না, যা বলছি তাই কর গিয়ে।

সুপ্তি অনেক সময় তার আম্মুকে বোঝানোর চেষ্টা করে যখন সফল হতে পারল না। তখন সে কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে চলে গেল।

দুপুর দিকে সুপ্তি বিছানায় শুয়ে ছিলো মন খারাপ করে, তার মন আজ প্রচুর খারাপ, এমনিতেই বোন দূরে তার মধ্যে সে আজ ক্লাসেও যেতে পারল না, তাই সে চুপ করে শুয়ে ছিলো, ঠিক সেই সময়ই তার আম্মু রুমে এসে তাকে খাবারের জন্য ডাকল।

……সুপ্তি খাবার খেতে আয়।

……আমার ক্ষুধা নেই।

…….কেনো কী এমন খেয়েছিস?

……তা জেনে তুমি কী করবে? তার থেকে বরং তোমরা গিয়ে খেয়ে নাও।

……সুপ্তি ভালোর দিকে চাইলে খেতে আয় বলছি।

…..বললাম তো খাবো না।

……সুপ্তি আমি কিন্তু তোর আব্বু কে বলব।

……তোমার যা ইচ্ছে করো গিয়ে।

সুপ্তির আম্মু রাগ করে চলে গেল রুম থেকে। সুপ্তিও খাওয়া দাওয়া না করেই শুয়ে রইল।

সন্ধ্যায় সুপ্তি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল, ঠিক তখনই তার রুমের দরজায় কেউ নক করে উঠল। সুপ্তি গিয়ে দরজা খুলে দেখল তার আব্বু দাঁড়িয়ে আছে, সে খুব ভয় পেয়ে গেল তার আব্বু কে দেখে, সে ভাবছে নিশ্চয়ই তার মায়ের কথা শুনে তার আব্বু এখানে আসছে, নিশ্চয়ই সে এখন সুপ্তির সাথে রাগারাগি করবে? সুপ্তি প্রচুর ভয় নিয়ে রুমের ভেতর চলে এসে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। সুপ্তির আব্বুও ভেতরে চলে এলো।

…….শুনলাম তুই নাকি সারাদিন কিছু খাস নাই?

…..(কোনো কথা বলল না)

……কী রে এখন তুই ও কথা বলবি না বুঝি?

সুপ্তি তার আব্বুর কথা শুনে তার আব্বুর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল, তার আব্বুর চোখে পানি ছলছল করছিলো। যা দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

……সুপ্রিয়া তো আমার মান-সম্মানের কথা তো দূরে থাক আমার কথাই ভাবল না। তুইও এখন খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে কথা বলাও ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবি? ঠিক আছে তোদের যা ইচ্ছে তোরা কর আমার কথা আর তোদের ভাবতে হবে না। আমি যদি এসব সহ্য করতে না পেরে মরেও যাই তবেও তোদের আমার কথা ভাবতে হবে না। আমারই হয়ত তোদের বাবা হওয়ার যোগ্যতা নেই।

এই কথা বলে সুপ্তির আব্বু চলে যেতে নিলো, যা দেখে সুপ্তি ছুটে গিয়ে তার আব্বুর সামনে দাঁড়িয়ে গেল। সুপ্তি তার আব্বুর হাত ধরে বলে উঠল।

……স্যরি আব্বু, আমি আর এই ভুল করব না কখনো। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও আব্বু।

সুপ্তির আব্বু সুপ্তির মাথায় হাত রেখে বলে উঠল।

…….হুম ঠিক আছে। খেতে চল তোর আম্মুও হয়ত না খেয়ে বসে আছে।

……আম্মু এখনো খায়নি?

……তোরা না খেলে কী তোর আম্মু খেতে পারে?

……হুম চলো তবে।

এই বলে সুপ্তি তার আব্বুর সাথে ড্রইং রুমে গিয়ে দেখল, তার আম্মু সোপায় বসে বসে কান্না করছিল। তাই সুপ্তি গিয়ে তার মায়ের সামনে বসে পড়ে বলে উঠল।

……স্যরি আম্মু।

সুপ্তির আম্মু কিছুক্ষণ এদিক সেদিক তাকিয়ে, নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না নিজেকে শান্ত করতে, তাই সুপ্তিকে নিজের বুকে নিয়ে শক্ত করে ধরে শব্দ করেই কেঁদে উঠল সুপ্তিও কাঁদতে লাগল।

সকালে সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট করছিল, ঠিক তখনই সুপ্তির আব্বু বলে উঠল।

…..কাল তোর স্যার ফোন দিয়েছিল, তুই নাকি কয়েক দিন ধরে ভার্সিটিতে যাচ্ছিস না? আজ তোকে যেতেই বলেছে।

…….কিন্তু আম্মু……..।

…….হুম তোর আম্মু?

……আসলে আম্মু যেতে বারণ করেছে ভার্সিটিতে।

……কেনো সুপ্তির আম্মু?

……হুম আমি বলেছি ওর আর পড়াশোনা করতে হবে না।

……এটা কিন্তু তুমি মোটেও ঠিক করো নি। সুপ্তি যা রেডি হয়ে আয় আমি তোকে নামিয়ে দিয়ে যাবো।

সুপ্তি তার আম্মুর দিকে তাকিয়ে দেখল, তার আম্মু নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সে তার আব্বুর দিকে তাকিয়ে দেখল তার আব্বু ইশারায় যেতে বলছে। তাই সে হালকা হেঁসে রেডি হতে চলে গেল।



চলবে………।