তীব্রস্রোত পর্ব-০৫

0
112

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#তীব্রস্রোত
#পর্ব ৫
.
.
দুপুরের খাবার খেতে সবাই এক হলো ডাইনিং টেবিলে। সুপ্তি তার বোনের পাশে চুপটি করে বসে রইল, তার জন্য সব কিছুই নতুন তাই তার কাছে একটু আন ইজি লাগছে সব কিছু।

কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার টেবিলে সেই সুদর্শন যুবক এসে হাজির সুপ্তির চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ টিপ দিয়ে, দুষ্ট হাসি দিলো, সুপ্তি বিরক্তি নিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো অন্য দিকে।

…….ভাবী আমাদের বাড়িতে অতিথি পাখি এলো কোথা থেকে?

…….ওহ তীব্র তোমাকে তো পরিচয় করিয়ে দিতেই ভুলে গিয়েছি। ও আমার এক মাত্র ছোট বোন সুপ্তি।

……ওহ তিনি আমার একমাত্র বেয়াইন সাহেবা?

……হ্যা, আর সুপ্তি ও তীব্র আমার দেবর। তীব্র, স্রোত কোথায়?

……ভাবী স্রোত তো আজ ওর এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে গেছে সন্ধ্যায় চলে আসবে। ও তো আর জানে না বাড়িতে অতিথি পাখি এসেছে, তবে না হয় আজ বাড়িতেই থাকত।

……সুপ্তি স্রোত ছোট, আর তীব্র স্রোতের থেকে গুনে গুনে ১৫ মিনিটের বড়, তাই না তীব্র?

…….হ্যা তাই বেয়াইন সাহেবা।

এরপর সবাই মিলে খাবার শেষ করে যার যার রুমে চলে গেল।

সুপ্তি, সুপ্রিয়ার সাথে রুমে এসে বিছানায় শুয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছিল।

বিকেল দিকে ঘুম আসছিল না দেখে সুপ্তি ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে গোধূলি বিকেলের আকাশ দেখছিল, নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ ভাসছে, কত রকমের পাখি আকাশে উড়ছে। দূরে কয়েকটা ঘুড়ি উড়ছে, সুপ্তির চোখ খানা সেই ঘুড়ির দিকেই আঁটকে আছে। সোনালী রোদ্র এসে পড়েছে সুপ্তির চুল গুলোতে যার জন্য চুল গুলো ঝিকমিক করছে।

কারো হাঁটার শব্দে সুপ্তি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল তীব্র সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে, তীব্রর চোখ সুপ্তির দিকে পড়তেই বাকা হাসি দিয়ে বলে উঠল।

……আমাদের অতিথি পাখিটা ছাদে একা একা কী করছে?

সুপ্তি কিছু না বলে আবার আকাশ পানে তাকিয়ে রইল।

……কী মিস বেয়াইন কথা বলতে এত কৃপণতা কেনো? নাকি বেয়াই পছন্দ হয়নি?

সুপ্তি কথা না বলেই পিছু ফিরে চলে যেতে নিলো, যা দেখে তীব্র বলে উঠল।

……যা সবে মাত্র এক বেয়াইনের দেখা মিলল, তাও কথা বলতে চাইছে না, নাকি দাঁতে সমস্যার জন্য দাঁত বের করতে লজ্জা পাচ্ছে বুজতে পারছি না।

সুপ্তি চুপ করেই ছাদ থেকে চলে আসলো তার ইচ্ছে নেই এমন গায়ে পড়ে কথা বলতে চায় সেই মানুষের সাথে কথা বলার। তাই সে চলে এলো বোনের রুমে কিন্তু সেখানে এসে দরজা খুলতে যাবে ঠিক তখনই কানে এলো দুলাভাই আর বোনের কথার শব্দ, সে বুঝতে পারছে তারা দুজন রুমে কথা বলছে, তাই আর তাদের ডিস্টার্ব না করে সে বসার রুমে গিয়ে ফোন হাতে বসে ভিডিওতে রেসিপি দেখতে লাগল।

সন্ধ্যার দিকে সবার থেকে বিদায় নিয়ে ফারাবী চলে গেল।

সুপ্রিয়া মন খারাপ করে নিজের রুমে বসে আছে, সে কান্নাও করছে মাঝে মাঝে। সুপ্তি তার বোনের পাশে বসে বোনকে শান্তনা দিচ্ছে। সুপ্তি খুব গম্ভীর স্বভাবের মেয়ে, সে সচারাচর কারো সাথে মিশে যেতে পারে না, তবে যারা মিশুক তাদের সাথে মিশে যেতে তার সময় লাগেনা। সুপ্তি এমনিতে কথা বলতে খুব ভালোবাসে, কিন্তু ছেলেদের সাথে সে তেমন একটা মেশে না, ছেলেদের থেকে দূরে থাকতে সে পছন্দ করে, কারণ সে আল্লাহর বাণীতে খুব বিশ্বাসী, সে জানে পর-পুরুষের সাথে মিষ্টি কথা বলা যাবে না। তাই সে পর পুরুষ থেকে একটু দূরেই থাকে।

বোনকে সামলে নিয়ে সুপ্তি বোনের রুমের বারান্দায় উঁকি দিলো, এখান থেকে আকাশটা বেশ পরিষ্কার, মিটিমিটি তারা গুলো জ্বলজ্বল করছে ওই দূর আকাশে, যা দেখে সুপ্তির চোখ আঁটকে গেল, ঠান্ডা বাতাস এসে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে সুপ্তিকে, হঠাৎ কানে এলো পুরুষ কন্ঠস্বর। পাশেই তাকিয়ে দেখল, একটা ছেলে ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোতে চেহারা বোঝা দায়, তবে ছেলেটা যে তীব্র নয় এটা সে নিশ্চিত। কিন্তু এই বাড়িতে তো সে শুধু তিন জন পুরুষের সাথেই পরিচিত, একে দেখেনি এর আগে কখনো। ছেলেটা দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে একটা ডায়েরির পাতায় কলমের আঁচে কিছু লিখতে ব্যস্ত, আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে আর লিখছে, কিছুক্ষণ কলমটা তার ঠোঁট স্পর্শ করছে আবার ডায়েরির বুকে তার দাগ ফেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। তবে যা লিখছে তা সাথে সাথে আওড়াচ্ছেন লোকটা, যা ছিলো

……খুলে দাও ওই রেশমি চুলের
বাঁধন সে উড়ুক মাতাল হাওয়ায়,
সাথে ভাসুক তোমার ওই শাড়ির আঁচল।
না হয় উড়েই যাবে সাথে তোমার প্রিয়ার ব্যাকুল হৃদয়ের সুখ।

সুপ্তির কবিতাটা বেশ লাগল, সে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিলো, এর মধ্যে সেই লোকটার পাশের দরজায় অন্য একটা ছেলে এসে উকি দিলো, যাকে সুপ্তি চেনে, হ্যা এটা তীব্র, তবে কী এটা স্রোত? হয়ত, আবার নাও হতে পারে। তাই সুপ্তি আর দাঁড়িয়ে না থেকে সেখান থেকে চলে এলো রুমে, রুমে এসে দেখল সুপ্রিয়া চুপচাপ বসে আছে মন খারাপ করে।

……আপু তোর কিছু লাগবে? তুই সেই কখন থেকে কিছু না খেয়ে বসে আছিস। চল বসার রুমে গিয়ে বসবি আর কিছু খাবি।

……এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না রে।

……আমি কিছু শুনতে চাইছি না, চল বলছি।

সুপ্তি জোর করে সুপ্রিয়া কে বসার রুমে নিয়ে গেল। সোপায় সুপ্রিয়া কে বসিয়ে দিয়ে সুপ্তি রান্নাঘরে গিয়ে কিছু ফল কেঁটে নিয়ে আসলো।

……আপু চুপ করে এগুলো খেয়ে নে।

……এত্তগুলা আমি খাবো কীভাবে?

……চুপ করে খাবি তুই।

……তুই আমার বড় বোন, নাকি আমি তোর বড় বোন?

……যতদিন বেবি না আসবে ততদিন আমিই তোর বড় বোন, আর তুই ছোট। এখন চুপ করে খেয়ে নে।

সুপ্রিয়া চুপ করেই খেতে লাগল ফল গুলো, আর সুপ্তি ফোন টিপছে, সুপ্রিয়া খেতে খেতে বলে উঠল।

……তুইও নে।

…….আমার নয় এখন এগুলো তোর প্রয়োজন, তাই চুপ করে শেষ কর ওগুলো।

সুপ্রিয়া আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করেই ফল গুলো খাওয়া শেষ করতে লাগল।

……ভাবী তোমার বোন বোবা নাকি?

কারো কথা শুনে ওরা দুজন পেছনে তাকিয়ে দেখল তীব্র সাথে একটা ছেলে, যাকে দেখে সুপ্তির মনে হচ্ছে সম্ভবত সেই ছেলেটাই। ছেলেটার সাথে সুপ্তির চোখাচোখি হতেই সুপ্তি চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। ছেলেটার চেহারার সাথে তীব্রর চেহারার মিল আছে অনেক। কিন্তু একেবারে সেইম নয়। লম্বা চওড়া প্রায় সেইম শুধু তীব্রর চোখে চশমা নেই, ছেলেটার চোখে চশমা আছে। সুপ্রিয়া তার দেবর তীব্রর কথার উত্তরে বলে উঠল।

…….কেনো তীব্র?

……নাহ এত কথা বলছি বাট তোমার বোন উত্তরই তো দিচ্ছে না, তাই মনে হচ্ছে বোবা হতে পারে।

……কীরে সুপ্তি কী বলছে তীব্র?

……আপু তুই তো জানিস আমি হঠাৎ করেই ফ্রী হয়ে যেতে পারি না কারো সাথে, সময় লাগে আমার।

……হ্যা ভাই ও আসলে চট করেই কারো সাথে কথা বলে না। আর ছেলেদের থেকে তো একটু দূরেই থাকে। তুমি কিছু মনে করো না, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

……হুম এখন অপেক্ষা করতে হবে তাই তো, তোমার বোন কবে ফ্রী হবে আর কবে কথা বলবে সেই আশায়?

……তীব্র তুইও না, সবারই নিজের ইচ্ছে বলতে কিছু আছে, তার ইচ্ছে হলে সে নিজ থেকেই কথা বলবে। তুই যা এখন।

……তীব্র কোথাও যাচ্ছ বুঝি?

…….নাহ আসলে ভাবী কিছু খেতে ইচ্ছে করছে, আম্মুকে এখন বলেও কোনো লাব হবে না। আর তোমাকে দিয়ে কাজ করাবো এতটা খারাপও কিন্তু আমি নই, তাই দেখি বাহিরে গিয়ে কিছু পাওয়া যায় কিনা খাবারের জন্য, আর বেয়াইন কথা বলুক আর না বলুক তার জন্যেও তো কিছু করতে হয়। তোমরা বসো আমি দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা?

……(ফিসফিস করে) তুই পারবি কিছু রান্না করতে?

……আমি? আমি তো ঠিক মতো জানিও না কোথায় কী রাখা আছে?

……আমি দেখিয়ে দেবো নে।

……আজ থাক তোর দেবর যখন আনতে চাইছে বাহির থেকে আজ সে নিয়ে আসুক কাল থেকে করে দেবো।

……হুম ঠিক আছে।

তীব্র চলে গেল, আর ওই লোকটা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুপ্রিয়া বলে উঠল।

……আরে স্রোত বসো দাঁড়িয়ে আছো যে? সুপ্তি তোকে তো ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি, ও স্রোত দুপুরে বলে ছিলাম না?

……আসসালামু আলাইকুম।

……ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছেন আপনি?

……জ্বি আলহামদুলিল্লাহ আপনি?

……জ্বি আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি।

…….সুপ্তি তুই জানিস স্রোত ও কিন্তু প্রায় তোর মতই, একটু গম্ভীর স্বভাবের।

……হুম বুঝতে পারছি।

……ভাবীর কাছে শুনলাম আপনি পড়াশোনা করছেন? তা কেমন চলছে পড়াশোনা?

……জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।

এরপর সুপ্রিয়ার সাথে আরও কথা বলল স্রোত মাঝে মধ্যে সুপ্তির সাথেও বলছে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে তীব্র এলো কলিং বেল বেজে উঠতেই স্রোত গিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসলো তীব্রকে। সুপ্তি খাবার গুলো প্লেটে বেরে নিয়ে আসলো, সুপ্রিয়ার শাশুড়ী কেও ডেকে আনা হলো এরপর সবাই এক সাথে খাবার গুলো শেষ করল।

তীব্রর আম্মু চলে গেল কিছুক্ষণ পরে। তাই তীব্র বলে উঠল সবাইকে উদ্দেশ্য করে।

…..আচ্ছা এভাবে বসে থাকলে হবে? চলো সবাই মিলে গেইম খেলি।

……কী গেইম?

……ভাবী লুডু খেলি?

…..হ্যা ঠিক আছে নিয়ে এসো।

…..(তীব্র চলে যেতেই) জানিস সুপ্তি? আমরা রোজ লুডু খেলি ৪ জন মিলে, আজ তোর দুলাভাই চলে গেছে দেখে ভাবলাম আজ বুঝি খেলা হবে না, কিন্তু তুই আছিস তো, খেলবি তো আমাদের সাথে?

…… ঠিক আছে।

এরপর তীব্র লুডু নিয়ে আসতেই সবাই শুরু হয়ে গেল।

রাতে সবাই খেতে বসল, আজাদ রহমানের সাথেও তখন সুপ্তির দেখা হলো, অনেক কথা বলল তিনি সুপ্তির সাথে, সুপ্তির বাবা মায়ের কথা জিজ্ঞেস করল।

খাবার শেষ করে রুমে যাচ্ছিল সুপ্তি তখন স্রোতের সাথে চোখাচোখি হতেই দুজনেই হালকা হাসল। এখন #তীব্রস্রোত দুজনের সাথেই সুপ্তি অনেকটা ফ্রী হয়ে গেছে, লুডু খেলতে গিয়ে অনেক হাসি-ঠাট্টার মাঝে আন-ইজি ভাব অনেকটা কেটে গেল।



চলবে………।