তীব্রস্রোত পর্ব-০৬

0
101

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#তীব্রস্রোত
#পর্ব ৬
.
.
খুব সকাল সকাল ঘুম ভাঙল। যেহেতু নতুন জায়গা তাই তেমন একটা ঘুম হলো না সুপ্তির। সুপ্তি রুম থেকে বের হয়ে দেখল সবার দরজা আঁটকানো, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তাই সে ফোনের টর্চ জ্বেলে আস্তে আস্তে ছাদের দিকে পা বাড়াল।

ছাদে যেতেই তার চোখ পড়ল ছাদের এক পাশে সেখানে স্রোত দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসে ছিলো এক পা গুছিয়ে, অন্য এক পা মেলে, মাথাটা দেয়ালে লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবছে, সাথে কুচকুচে কালো একটা কলম তার দু ঠোঁটের মাঝে আঁটকে আছে, হাতে ডায়েরি যা রাখা ছিলো হাটুর সাথে ঠেস দিয়ে। হয়ত কিছু লেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। এখন বেশ জোর ৬:৩০ মিনিট ঘড়িতে, এত সকাল সকাল বেয়াই মশাই ছাদে চলে আসছে, সুপ্তি একটু হাসল স্রোতের এমন অবস্থা দেখে।

সুপ্তির সেখানে গিয়ে আর স্রোত কে ডিস্টার্ব করার ইচ্ছে জাগলো না মনে তাই সুপ্তি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভোরের নিস্তব্ধতা উপভোগ করছিল।

সকালের পাখি গুলোর কিচিরমিচির শব্দে সুপ্তির বেশ লাগছে, তার উপর শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, সুপ্তির ওড়নার আঁচলটা উড়ছে বাতাসে, চুল গুলো ও বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, অনেক বাতাস বইছে আজ।

কিছুক্ষণ পরে একটা কোকিল এসে সুপ্তির সামনে থাকা কৃষ্ণচূড়ার ডালে বসে পড়ল, সাথে কুউ কুউ করে ডাকতে শুরু করে দিলো, যা সুপ্তির খুব পছন্দের, তার ও ইচ্ছে করছে আজ কোকিল হয়ে যেতে, তার ও ইচ্ছে করছে কোকিলের মতো করে গান গাইতে, যখন কোকিল রেগে গিয়ে অনেক শব্দ করতে লাগল, তখন সুপ্তির হাঁসি চলে এলো, ভাবতেই যে কোকিল এবার রেগে আগুন প্রায়। সুপ্তি একটু শব্দ করেই খিলখিল করে হেঁসে উঠল। যার শব্দ স্রোতের কান এড়ালো না, স্রোত হটাৎ একটা মেয়েলি কন্ঠে হাসি শুনে রীতি মতো ভয়ে আঁতকে উঠল, চারিদিকে তাকিয়ে একটু এগিয়ে এসে দেখতে পেলো সুপ্তি মুখে হাত দিয়ে হাসছে, যার কারণে সুপ্তির গালে হালকা টোল পড়েছে, সুপ্তির চুল গুলো খোলা বাতাসে উড়ছে যা দেখে স্রোতের কালকের সেই কবিতা মনে পড়ে গেল, স্রোত এক ধ্যানে সুপ্তির পানে তাকিয়ে ছিলো, সে এভাবে কখনো কোনো মেয়ের সৌর্ন্দয্য পর্যবেক্ষণ করেনি তার চোখ দুটো আঁটকে গেল সুপ্তির দিকে।

সুপ্তির মনে হচ্ছে তার দিকে কেউ তাকিয়ে আছে, তাই সে পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখল স্রোত তার দিকেই তাকিয়ে আছে, তাই সুপ্তি একটু লজ্জা পেয়ে চুলে হাত বুলিয়ে ছাদ থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, বাট তার নজর আবার স্রোতের দিকে পড়ল, সুপ্তি তো সরে গেছে কিন্তু স্রোত এখনো সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে, যা দেখে সুপ্তি আবার একটু হাসল। এরপর সুপ্তি স্রোতের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে স্রোতের চোখের সামনে হাত নিয়ে একটু শব্দ করেই তুড়ি বাজালো, যার জন্য স্রোত কিছুটা চমকে উঠে সরে দাঁড়িয়ে গেল, স্রোত কে এভাবে চমকে উঠতে দেখে সুপ্তি আবার খিলখিল করে হেঁসে উঠল, যা দেখে স্রোত ভ্রু কুচকে চোখ দুটো ছোট ছোট করে সুপ্তির দিকে তাকাল, সুপ্তি এখনো হাসছে, স্রোতের এমন চাউনি দেখে সুপ্তি নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সুপ্তি নিজেকে কিছুটা কন্ট্রোল করল, কিন্তু তার হাসি এখনো কমেনি, সে এখনো মুচকি মুচকি হাসছে। যা দেখে স্রোত বলে উঠল।

……বেশ মজা লাগছে তাইনা?

……না লাগার কী আছে? এভাবে কেউ মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে?

……হুম কবি’রা থাকে।

……কবি’রা? বাট কেনো?

……নতুন এক কবিতা লেখার জন্য।

…..তা এভাবে তাকিয়ে থেকে কী কবিতা ভাবনায় আসছে মিস্টার বেয়াই মশাই?

……আসছে, ডায়েরির বুকে আগে তাকে নিক্ষেপ করে তারপর না হয় আপনাকে জানান দেবো।

……তাই, বাট আগে কেনো জানানো যাবে না?

…..বলার মাঝে ভুল হতে পারে, তাতে তো আপনি আবার হাঁসতে শুরু করে দিবেন।

…..ওহ আচ্ছা। তাও তো ভালো আবার নতুন কিছু ভাবনায় চলে আসবে। (যেতে নিলো)

…..চলে যাচ্ছেন?

…..হুম তবে কী করব?

…..না কিছু নয়। তবে আমাদের বাসার সবাই এত জলদি উঠবে না, তাদের উঠতে আরও ৩০ মিনিট দেরি হবে।

…..ওহ তাই?

……চা খাবেন?

…..খালি পেটে?

…..নাহ বিস্কিট থাকবে সাথে।

….. হুম মন্দ হয়না তবে। বাট আপনি বানাবেন?

…..আমি আর চা? তবে আর মুখে দিতে হবে না।

…..কেনো?

…..বানাইনি তো কখনো।

…..ওহ আচ্ছা। তবে?

…..কেনো আপনি বানাতে পারবেন না?

…..(সুপ্তি হাঁসল) হুম ঠিক আছে।

এই বলে সুপ্তি নিচে চলে এলো। রান্নাঘরে গিয়ে সুপ্তি চায়ের পানি বসালো চুলায়। এর মধ্যে হঠাৎ করে পেছন থেকে কারো কথার আওয়াজে সুপ্তি চমকে উঠল।

……অতিথি পাখি কী করছে?

…..(বুকে ফুঁ দিয়ে) এভাবে হঠাৎ করে কেউ কথা বলে?

……এমা তবে কীভাবে বলে?

……একটু শব্দ করে নিতে হয় কথা বলার আগে।

……তাই ওকে ম্যাডার এর পর থেকে তাই হবে। কিন্তু আপনি কী করছেন একা একা?

……ওই চা করছিলাম।

…..ওহ আচ্ছা তবে তো ভালোই, আমার জন্য এক কাপ করা যাবে?

…..আপনিও খাবেন?

…..খাবো না মানে? বেয়াইন প্রথম কিছু বানাচ্ছে আমাদের বাড়িতে এসে আমি না খেয়ে পারি?

……হুম যদি ভালো না হয়?

…..না হলে না হবে, কিন্তু আমিতো খাবো ই

…..আচ্ছা ঠিক আছে।

সুপ্তি চায়ের জন্য পানি বাড়িয়ে দিয়ে বিস্কুট, কাপ সব কিছু গুছিয়ে নিলো। ততক্ষণ তীব্র দাঁড়িয়ে রইল কিছুটা দূরে।

…..আপনি শুধু শুধু দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আপনি ছাদে চলে যান আমি চা নিয়ে আসছি।

…..ছাদে কেনো?

…..ছোট বেয়াই ছাদে আছে, তার ইচ্ছেতেই চা বানাতে এলাম। তাই আপনি যান আমি আসছি।

……সমস্যা নেই এক সাথেই না হয় যাবো। আপনি একা একা এখানে, যদি ভয় লাগে আপনার? নতুন জায়গা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই আমি আছি এখানে।

সুপ্তি মুচকি হেঁসে তার কাজে মন দিলো, সত্যিই তো সুপ্তির এতক্ষণ কিছুটা ভয় লাগছিল, তাই তো তীব্রর কথায় সে চমকে উঠেছিল। ভালোই হলো তাকে বলতে হলো না মুখ ফুটে কিছু।

তিন জন মিলে ছাদে চায়ের আড্ডা দিচ্ছিল, এখন সুপ্তি অনেকটা ফ্রী ওদের সাথে তারপরও একটা আন-ইজি ফিল করছে সে, কারণ ছেলেদের সাথে কথা বলতে গেলে তার কথা আঁটকে আঁটকে আসে সব সময়ই। এখনো তার ব্যাতিক্রম কিছু নয়।

সবাই ঘুম থেকে উঠে ড্রইং রুমে বসে ছিলো, সুপ্তিও ছাদ থেকে এসে বসার রুমে বসে পড়ল।

……কেমন লাগছে মামণি আমাদের এখানটা?

…..জ্বি আঙ্কেল ভালো লাগছে।

…..এটা তো খুব ভালো কথা।

এরপর সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট করে নিলো। #তীব্রস্রোত বেরিয়ে গেল বাসা থেকে, আজাদ রহমান ও বের হলো তাদের সাথেই। সুপ্তি তার বোন কে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হলো, বাড়ি থেকে একটু দূরেই একটা বিশাল মাঠ রয়েছে, সেখানে হাঁটতে গেল দু-বোন, বাড়িতে যেহেতু কাজের লোক আছে তারাই সব করে শুধু রান্নাবান্না ফারাবীর আম্মু করে, তাই সেই নিয়ে চিন্তা নেই কারো। বিকেলের পড়ে অবশ্য কেউ থাকে কাজের লোক যারা, আর সুপ্রিয়া সারাদিন একা একা থাকবে? তাই তো সুপ্তিকে এখানে নিয়ে আসা হলো।

দু-বোন অনেক সময় এই মাঠে ঘুরাঘুরি করল, হালকা খাবার খেলো, অনেক হাসি-ঠাট্টা করল। বিয়ের আগের মূহুর্ত গুলো মনে করে হাসছে দুজন, অনেক সময় থেকে দুপুরের আগে আগে দুজন বাসায় চলে এলো।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে সুপ্রিয়া একটু রেস্ট নিতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সুপ্তি বসার রুমে এসে তার বোনের শাশুড়ি কে জিজ্ঞেস করল।

…..আন্টি আমি কী সাহায্য করব আপনাকে?

…..না মামণি তেমন কাজ তো নেই সব ওরাই করে দিয়েছে, বাকি রান্নাও হয়ে গেছে। এখন শুধু সবজি রান্না বাকি আছে আমি করে নেবো, তুমি বরং বউ মা কে কিছু ফল দিয়ে আসো, তাহলে অনেকটা উপকার হবে।

……জ্বি আন্টি ঠিক আছে।

সুপ্তি কিছু ফল কেটে প্লেটে করে তার বোনের জন্য নিয়ে গেল জোর করে তার বোন কে ফল গুলো খাওয়াল।

বিকেল দিকে সুপ্তি ছাদে দাঁড়িয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলছিল, এমন সময় তীব্র এসে সুপ্তি কে ভয় দেখাল, সুপ্তি বুকে হাত রেখে চোখ বড় বড় করে তীব্রর দিকে তাকাল, এরপর নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে সুপ্তি, তীব্র কে চুপ থাকতে বলে তার মায়ের সাথে কথা শেষ করল। ফোন রেখে সুপ্তি, তীব্রকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল।

……আপনি কী পাগল?

…..আপনার আমাকে পাগল মনে হচ্ছে?

…..তবে এভাবে কেউ করে? আপনি দেখছেন আমি কথা বলছি তাও এমন কেনো করলেন?

…..স্যরি আসলে খেয়াল করিনি, ফোন ওপাশে ছিলো তো তাই।

…..হুম ঠিক আছে।

…..আচ্ছা এটা নিন আপনার জন্য।

…..আচার? তাও আমার জন্য?

…..হ্যা আসলে আজ ক্লাস শেষে ফেরার সময় দেখলাম একজন লোক গাড়ীতে করে বিক্রি করছে, ভাবলাম আপনার আর ভাবীর জন্য নিয়ে আশি। শুনেছি মেয়েরা নাকি আচার খুব পছন্দ করে।

…..হুম ধন্যবাদ। আপনিও নিন।

…..জ্বি ধন্যবাদ।

এরপর সুপ্তি, তীব্র আচার খেতে লাগল।

সন্ধ্যায় রুমে বসে দু-বোন কথা বলছিল ভিডিও কলে ফারাবীর সাথে। ঠিক তখনই স্রোত দরজা নক করে ভেতরে প্রবেশ করল। একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

…..কী হলো বেয়াই মশাই আপনি একা যে?

…..তবে কাকে নিয়ে আসবো বেয়াইন সাহেবা?

…..আরেক বেয়াই মশাই কোথায় হারিয়ে গেল?

…..ওহ তীব্র আসছে।

…..ওহ আচ্ছা।

ফোন রেখে দিতেই স্রোত তার হাতে নিয়ে আসা ব্যাগটা বিছানায় সুপ্রিয়ার সামনে রেখে বলে উঠল।

…..এই নাও ভাবী।

…..এগুলো কী?

…..সন্ধ্যার নাস্তা।

……আরে এগুলো কেনো আনতে গেলে, বাসায় কিছু করে নিতাম।

…..থাক তোমার কষ্ট করতে হবে না।

…..সুপ্তি আছে তো ও করে নিতো।

…..বেয়াইন দু-দিনের জন্য বেড়াতে আসছে তাকে দিয়ে এত কাজ করানো ঠিক হবে না।

…..হ্যা ভাবী তুমি আমাদের অতিথি পাখি কে দিয়ে এত কাজ করিও না, তবে কিন্তু সে উড়ে যাবে তার নীড়ে।

তীব্র প্লেট চামচ নিয়ে চলে আসতেই ওরা খাবার বেরে সবাই মিলে খেতে খেতে লুডু খেলতে শুরু করে দিলো। আজ আরও মজা করল সবাই মিলে।

এভাবেই চলতে শুরু করে দিলো দিন গুলো। প্রায় সপ্তাহ চলে গেল। হঠাৎ ফারাবী ফোন দিয়ে জানালো তার আসতে আরও কিছুদিন লাগবে। যার জন্য সুপ্তির আরও কিছুদিন থাকতে হবে। তবে তো এভাবে থাকতে সমস্যা হবে, কারণ সুপ্তির ক্লাস চলছে স্যার কে বলে কয়েক দিনের ছুটি নিয়েছিল যা অল রেডি শেষ এখন আর সম্ভব নয়। তাই সুপ্রিয়া বলল।

…..তুই বরং এখান থেকেই ক্লাসে যা, #তীব্রস্রোত তো রোজ যায় তোকে নামিয়ে দিয়ে যাবে ইউনিভার্সিটিতে।

……কিন্তু আপু আম্মু ও তো বাসায় একা আছে।

……আম্মুর সাথে রিপা আছে তো? (কাজের মেয়ে)

…..হ্যা কিন্তু সে কী আম্মুর খেয়াল আমাদের মতো করে রাখতে পারবে? আপু তুই দুলাভাই কে বল জলদি আসতে, আমার ভালো লাগছে না এখানে।

……হুম ঠিক আছে।

সুপ্তি এখান থেকেই ভার্সিটিতে যেতে শুরু করে দিলো। সুপ্তি ওদের সাথে যেতে চাচ্ছিল না, বাট সুপ্রিয়া বলল, ওরাও জোর করছে তাই না করতে পারলো না। #তীব্রস্রোত এর সাথে সুপ্তির বন্ধুত্ব পূর্ণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, ওরা সুপ্তি কে নামিয়ে দিয়ে নিজেদের ভার্সিটিতে চলে যায়। আর বিকেলের আড্ডা তো আছেই সবার।



চলবে…….।