তুই আমার কাব্য পর্ব-১৯

0
1662

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 19
.
🍁
.

মেঘলা রাগে গটগট করতে কাব্যর রুম থেকে নিজের রুমে এসে পাইচারি করতে করতে নিজে নিজেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই শাসন করতে থাকে,

– কি দরকার ছিলো হ্যা? খুব ভালো হয়েছে না এবার? যাও এখন ধোঁয়ে দাও বুইড়া খাটাশটার শার্টগুলো। এমনি এমনি তো তোর ভালো লাগছিলো না। আরেম আয়েশে ছিলি। সুখে থাকলে যে ভুতে কিলায় তুই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। দুর! ভালো লাগে না। শালার বজ্জাত এনাকন্ডা। একটুও দয়া মায়া নাই মনে। অসুস্থ একজন মানুষকে দিয়ে খাটাতে লজ্জা করে না? বউ পাবি না বউ পাবি না। চির কুমার থাকবি বলে দিলাম।

মেঘলা কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লো। তারপর সাথে সাথেই ওঠে পড়ে কারণ তার শাস্তির কথা ভুললে চলবে না। হন হন করে কাব্যর রুমের দিকে যাওয়ার সময় কুসুমের( কাজের মেয়ে) সাথে ধাক্কা খায়। নিজেকে সামলে নিয়ে মেঘলা দেখলো কুসুমের কাছে কাব্যর কয়েকটা শার্ট। মেঘলাকে যেগুলো ধুয়ে দিতে বলেছিলো সেগুলোর মধ্যে এগুলো ছিলো মেঘলার স্পষ্ট মনে আছে। তবে এগুলো এই কুসুম কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কাব্যকে না জানিয়ে কুসুম যদি ধোয়ার জন্য নিয়ে যায় আর কাব্য যদি পড়ে জানতে পারে এগুলো মেঘলা ধুয়ে দেয় নি তখন যদি সবাইকে বলে দেয়? ভাবতেই মেঘলার বুক ধুক করে ওঠে। ভিষণ অপমানের ব্যপারটা হবে। কিভাবে যে জিজ্ঞাসা করবে কুসুমকে তা নিয়ে মেঘলা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলে যদি কিছু মনে করে। তাই মেঘলা সাবধানে জিজ্ঞাসা করে,

– এই এই কোথায় যাচ্ছো গো তুমি?

– কই আর যামু কন আফা? আমার কি কামের অভাব? এই যে সবার রুমের ময়লা জামা কাপড় ডি আনতে গেছিলাম। ধুয়ে দিতে হইবো।

– ও আচ্ছা! এই সবগুলো তুমি একাই ধুতে পারবে? তোমার কষ্ট হবে না? কার কার এতো জামা? সবার জামা কি তুমিই ধুয়ে দাও?

– আর কি করমু কও? আমার তো কামই এইডা। এহানে শুধু বাড়ির বেটা মানুষগো আছে। মাইয়া গোডা ধুইয়া দিছি আগে।

– আহারে কতগুলা জামা কাপড় একাই ধুতে হয়। তোমার তো এগুলো পরিষ্কার করতে করতে বিকেল হয়ে যাবে।

– তা হইবো না। ফটাফট ধুয়ে দিমু। আর কইয়ো না। কাব্য দাদাবাবু ডাকছে। দাদা বাবুর রুমে গিয়ে তো আমি অজ্ঞানই হয়ে গেছিলাম এতো জামা কাপড় দেখে। মেলা ডি জামা সোফার ওপরে রেখে দিছে। ভাবছিলাম সবগুলা মনে হয় ধুয়ে দেওনের লিগা ডাকছে। পড়ে দেখলাম নাহ্। আমারে কয়েকটা জামা হাতে ধরায়ে দিয়া কইলো এডি ধুইয়া দিতে আর ওগুলা নাকি এমনি। কি বাঁচা যে বাঁচছি গো কি কমু।

– হ্যা! তোমাকে নিজে ডেকেছে এই জামা কাপড় ধুয়ে দিতে?

– তো আর কারে কবে কও?

– হুম সেটাই। আচ্চা যাও তুমি। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

– আইচ্ছা।

কুসুম চলে যেতেই মেঘলা কুসুমের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে কোমরে এক হাত দিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকে,

– সাদা মুরগটা কুসুমকে জামা ধুয়ে দেওয়ার জন্য বলছে তবে তখন যে আমাকে বললো শাস্তিস্বরূপ আমাকে ধুয়ে দিতে। তবে কি খারুশটায় সবাইকে বলে দেবে? না না দা কেনো? আমি তো শাস্তি পেতে রাজি হয়েছি। তবে?

.

ঘড়িতে রাত এগোরাটা বেজে তিন মিনিট। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। মেঘলা ধীর গতিতে পানসে মুখ নিয়ে কাব্যর দরজায় এসে দাঁড়ায়। কাব্য পড়ার টেবিলে গভীর মনোযোগ দিয়ে বসে আছে । যেহেতু ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট সেহেতু পরীক্ষার চাপ বেশি। আর সামনেই পরীক্ষা। তাই পড়াশুনা নিয়ে বেশ ব্যস্ত। মেঘলা দরজার সামনে এসে দাড়াতেই কাব্য ভেদরে আসতে বলে। এতো মনোযোগের মধ্যেও মেঘলার উপস্থিতি ঠিকই সে বুঝে গেছে। মেঘলা মুখ ভার করে কাব্য রুমের ভেতরে এসে দাঁড়ায়। কাব্য বইয়ে মুখ গুজেই মেঘলাকে বলে,

– দাঁড়িয়ে না থেকে ওই যে সোফায় শার্টগুলো রাখা আছে, কাজ শুরু করো।

মেঘলা সোফায় বসে একটা শার্ট হাতে নিয়ে সুইয়ের জন্য খোঁজ করতে থাকে। পাশের ছোট্ট টেবিলে দেখে একটা বক্সে সবই রাখা। কাব্য যে আগে থেকে সব গুছিয়ে রেখে দিয়েছে তা বুঝতে পারছে বেশ। মেঘলা বোতাম লাগাচ্ছে তখনই কাব্য বইয়ের দিকে তাকিয়েই বলে,

– শাস্তি কিন্তু পুরোপুরি পাওয়া হলো না তোমার। কুসুম বাঁচিয়ে দিলো তোমাকে।

– কিভাবে?

– শার্টগুলো ধুঁয়ে দিয়ে। আমি একটু বাহিরে গিয়েছিলাম তখন এসে দেখি কুসুম জামাগুলো নিয়ে ধুয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে গেছে। ও হয়তো ভেবেছিলো ওর জন্যই বের করে রেখেছি। আগে জানলে না করে রাখতাম। বাট যখন ধুয়ে দিছে তখন তো আর কিছু করার নেই। ওইটুকে তোলা থাকলো।

মেঘলা কাব্যর কথা শুনে অবাক। কারণ কাব্য তো মিথ্যা বলছে। কুসুমকে তো কাব্যই ডেকেছিলো আর এগুলো সবগুলো তো ধুতে দেয়ও নি। তবে মিথ্যা কেনো বলছে? মেঘলাকে কি কাব্য বাচাচ্ছে? এইটা ভাবতেই মেঘলার মনে বড় একটা প্রশ্নবোধকের চিহ্ন আসলো ‘ কেনো? ‘

প্রায় একটা বাজে। কাব্যর পড়াশুনা শেষে টেবিল থেকে ওঠতে যাবে তখনই চোখ যায় মেঘলার দিকে। সোফায় দু পা এক দিকে ভাজ করে উঠিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মাথাটা সোফার একটা কোণায় হেলানো আর হাতটা পায়ের উপর পড়ে আছে, সুইটা শার্টে গেথে এক হাত দিয়ে ধরে আছে ঘুমের মধ্যেই। বেবি পিংক কালার একটা থ্রি পিছ পড়ে আছে। জামাটার রং টা মেঘলার মুখে প্রতিফলিত হয়ে বেশ নরম নরম ভাব আসছে। ঘাড় বেয়ে কয়েকটা চুল সামনে এসে রয়েছে। কাব্যর চোখ যেন ফেবিকলের মতো আটকে আছে মেঘলার দিকে। চোখ সড়ানো অসম্ভব এমন একটা পরিস্থিতিতে আছে। কাব্য চেয়ারের ওল্টা দিকে করে বসে চেয়ারের পেছনে দুই হাত রেখে মুখটা হাতের ওপর ভর করে মেঘলাকে দেখেই যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ছুয়ে দিতে। কিন্তু পারছে কোথায় ? অদম্য ইচ্ছা চম্বুকের মতো টানলে তাকে যে বিকর্ষণ করে বিপরীত দিকে চলে আসতে হবে। কাব্য চেয়ার থেকে ওঠে মেঘলার সামনে হাটু গেড়ে বসে সোফার হাতায় মুখ রেখে মনে মনে ভাবে,

– এমন করে হাজার হাজার দিবস রাত্রি পার করতে আমি নিঃশর্তে রাজি। কবে বলতো তোকে এভাবে দেখার সামাজিক অধিকার আমি পাবো? কবে তোর ওপর আমার যে অধিকার তা সবার সামনে দেখাতে পারবো? কবে আড়ালে – সম্মুখে সব সময় তোকে আগালে রাখার অধিকার পাবো? কবে বলতে পারবো জীবনের অলিখিত গল্পগুলো মিলে কতবড় কাব্য গড়ে ওঠছে তোকে ঘিরে। তুই কি জানিস #তুই_আমার_কাব্য। কত বছর আগে এ কাব্যর সূচনা হয়েছে জানিস?

ঘুমের ঘোরে মেঘলার মাথাটা পড়ে যাচ্ছিলো। কাব্য তা দেখার সাথে সাথে মেঘলার মাথা ধরর ফেলে। গড়িতে তাকিয়ে দেখে বেশ অনেক রাত হয়েছে। পাশে তাকিয়ে দেখে সব শার্ট শেষ শুধু হাতেরটাই বাকি। মুচকি একটা হাসি দিয়ে আলতো ভাবে মেঘলাকে কোলে নিয়ে মেঘলার রুমে গিয়ে সুয়ে কাথাটা টেনে কপালে খুবই নরম ভাবে ঠোঁট স্পর্শ করে চলে আসলো।

খোলা পর্দাটা ভেদ করে মেঘলার চোখ স্পর্শ করে ভোরের রোদটা। চোখটা কুচকে পাশ ফিরে ঘুমালো আবার। কিন্তু ঘুম আর টিকলো না চোখে। মিট মিট করে চোখটা খুলে আড়মোড়া করে ওঠে রুমে দিকে চোখ বুলাতেই দেখে সে নিজের রুমে। এইটা কি করে সম্ভব? ও তো কালকে রাতে কাব্যর রুমে ছিলো। তবে এখানে কি করে এলো? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হেটে চলে আসছে? কিন্তু ঘুমিয়ে হাটার অভ্যাস তো নেই। তবে কি কেউ দিয়ে গেলো? ভাবতে ভাবতে মাথায় দুই হাত চেপে বসে থাকে মেঘলা। হঠাৎই চোখ যায় সোফার দিকে । সোফার নিচে চোখ পড়তেই খুশিতে মনটা ভরে ওঠে মেঘলার। ঘুড়ি! তারমানে আরেকটা চিরকুট। মেঘলা খুবই মিস করছিলো চিরকুটা। কেনো সেইটা তার জানা নেই। ঘুড়িটার সুতো জানালা বেয়ে সোফার নিচে পড়ে আছে। মেঘলা লাফিয়ে ওঠে ঘুড়িটা ওঠিয়ে চিরকুটা হাতে নিয়ে পড়ে। তাতে লেখা,

– মেঘাবতী! ছাদে যাও। উপহার আছে একটা।

মেঘলার ভেবেছিলো এতোদিনপর যেহেতু একটা চিরকুট এলো সেহেতু নিশ্চয়ই অনেক কিছু লেখা আছে। কিন্তু তেমন কিছু না পেয়ে মুখটা ছোট হয়ে গেলো। কিন্তু তবুও খুব ভালো লাগছে কেনো জেনো তার। ছাদে কেনো যেতে বলছে ভেবে কিছুটা চিন্তিত হলেও তারপর পরই দ্রুত ছাদে চলে যায়। ছাদে গিয়ে এদিক ওদিকে তাকিয়ে কিছুই পেলো না। অবশেষে দেখলো চিলেকোঠার ওপরের ছাদে আরেকটা ঘুড়ি। মেঘলা দৌড়ে সেই ছাদে ওঠে বসে ঘুড়িটা সড়িয়ে দেখলো পাশে একটা কাগজের ঠোঙা। খুবই আগ্রহ নিয়ে ঠোঙা টা খুলতেই মুগ্ধ মেঘলা। একটা বেলি ও একটা বকুলের মালা আর দুটো সাদা গোলাপ। প্রত্যেকটা ফুল একদম সতেজ। যেনো কেবলই গাছ থেকে ছিড়ে নিয়ে এসেছে। বেলি ফুলের গন্ধে মেঘলার চারপাশের বাতাস যেনো মাতাল হয়ে ওঠেছে। মেঘলা বেলি ফুলের মালাটা নিয়ে বসে আসে কারণ তার বেলিফুল খুবই প্রিয়। সাদা গোলাপ বেলির পর তার পছন্দের। মেঘলার চুল খোলা ছিলো। বেলিফুলগুলো পেয়ে হাতখোপা করে তাতে বেলিফুল পেচিয়ে দিলো। আর হাতে নিয়ে গোলাপগুলো বারবার দেখছিলো। কি শুভ্র! কি স্বচ্ছ! সাদা গোলাপ দেখলেই মন ভরে ওঠে তাই সাদা গোলাপ এতো ভালো লাগে মেঘলার। সাদা গোলাপ আর বেলি মেঘলার পছন্দের। বকুলটাও পছন্দ করে তবে ততটাও না। কিন্তু এই বকুলফুলগুলোও খুবই নেশাযুক্ত। মুঠোয় নিয়ে এক নিঃশ্বাস ঘ্রাণ নেয় মেঘলা। তখনই মাথায় ঘুরে একটা প্রশ্ন,

– ” আমার যে এই ফুলগুলো প্রিয় সেগুলো ওনি জানেন কিবাবে? ওনি আমার সম্পর্কের এতো তথ্য কিভাবে পান? ”

বকুল ফুলের মালার নিচে একটা চিরকুট আবিষ্কার করলো মেঘলা। বকুলফুলটা হাতে পেচিয়ে চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো,

– জানি অবাক হচ্ছো কিভাবে তোমার প্রিয় ফুল কি আমি জানি? যে আমার প্রিয় তার প্রিয় সম্পর্কে খোঁজ রাখবো না তা কি হয়? আমার সম্পর্কে খোঁজ করার অনেক চেষ্টা করছো কিন্তু পাও নি জানি। আর পাবেও না। আমার সম্পর্কে জানার খুবই আগ্রহ তোমার। তাই একটা জিনিস পাঠালাম। ওই যে বকুল ফুলের মালা। কাছে রেখো সব সময়। বকুল আমার প্রিয় ফুল। আগলে রেখো কিন্তু।

চিঠিটা পড়ে মেঘলা হাতে পেচানো বকুল ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে তাতে ঠোঁট ছুঁয়ে ছাদ থেকে নেমে এলো। কাব্যর রুম ক্রস করতেই খেয়াল করলো রুমের দরজাটা খানিকটা খোলা। দরজাটা ভালো করে আটকাতে গিয়ে রুমে দিকে ওকি দিয়ে দেখে কাব্য ওপাশ ফিরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মুখ ফিরিয়ে আনতে গিয়ে একদিকে চোখ পড়তেই মেঘলা চোখ ছানাবড়া। মেঘলা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না ব্যপারটা একদমই তা নয়। সে চাচ্ছে না বিশ্বাস করতে। মেঘলা একদম অনড় সেদিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবছে এটা যেনো তার ভ্রম হয়।

চলবে…… ❤

ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন। হ্যপি রিডিং।