তুই আমার কাব্য পর্ব-৪১

0
1556

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 41
.
🍁
.

কানে দীর্ঘ সময় যাবৎ ইয়ারফোন গুজে রাখা ব্রেন ও কানের জন্য বেশ ক্ষতিকর। কিন্তু মাঝে মাঝে এই ক্ষতিকারক দ্রব্যটি বেশ উপকারে আসে। যেমন এখন এই মুহুর্তে মেঘলার কাছে এর বিকল্প কোনো দ্রব্যই নেই। কাব্যকে হয়রানি করে নিজে ছুটির পর হাওয়া লাগিয়ে গল্প করার জন্য সে অনেক কথা শুনছে। তবে সবগুলো শুনে নি। কিছুটা মানে প্রথম দিকের গুলো। পরেরগুলো ইয়ারফোনের জন্য কান অব্দি পৌঁছাতেই পারে নি। কাব্য জিনিসটা এতোক্ষণ খেয়াল করে নি। অবশ্য তার বকা অনেক আগেই শেষ হয়েগিয়েছিলো। দীর্ঘ সময় যাবৎ বকে কথা খরচ করার মতো ব্যক্তি কাব্য নয়। অনেকক্ষণ চুপ থাকতে দেখে মূলত কাব্যর এক খটকা লাগে। গাড়িটা থামিয়ে মেঘলার দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘলা চোখ বন্ধ করে গান শুনছে আর মাথা দুলাচ্ছে। কাব্য মাথাটা মেঘলার মুখের কাছে এনে চুপ করে আছে। খুবই কাছে কারো উপস্থিতি পেয়ে মেঘলা চোখ খুলে ফেলে। কাব্যকে এতো কাছে আবিষ্কার করে বুকের ভেতরে ধুক করে ওঠে। মেঘলা একটা মেকি হাসি দিয়ে দুই হাত দিয়ে কাব্যকে পুশ করে বলে,

– চলে এসেছি? আরে আগে বলবেন না। শুধু শুধু বসে আছেন। আচ্ছা ভালো থাকবেন। আবার দেখা হবে। টাটা

ব্যাগ কাঁধে ওঠিয়ে তাড়াহুড়া করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো মেঘলা। কাব্য হালকা হেসে সাইড হয়ে বসে আছে। মাথায় হাত ঠেকানো। দৃষ্টি পাশের দরজা। মেঘলা চলে যাওয়ার ঠিক এগারো সেকেন্ডের মাথায় আবার দরজা খুলে গেলো। কাব্য এখনো সেভাবেই স্থির। মেঘলা গাড়ির দরজা খুলেই আবারো বেশ বড় করে মেকি হাসি দিয়ে ধুম করে বসে স্ট্রেট বসে পড়লো। ভয় ভয় মুখে আড় চোখে কাব্যর দিকে তাকাচ্ছে। কাব্য সেইরকমভাবে বসেই মেঘলার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই মেঘলা সাথে সাথে চোখ সরিয়ে ফেললো। জোরপূর্বক হাসি হাসি মুখে বলে,

– আসলে আমি ভেবেছিলাম চলে এসেছি বলে গাড়ি থামানো। হে হে বুঝতে পারি নি।…. আব চচচলুন । যাবেন না?

কাব্য নিঃশব্দে ধীরে ধীরে মেঘলার কাছে আসছে। মেঘলার ভয়ে বুকে ড্রাম বাজানো শুরু করেছে। হালকা হালকা মেঘলাও পেছনে হেলিয়ে যাচ্ছে। আবার সকালের মতো কিছু করবে নাকি? মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে শুরু করেছে চোখ বুজে। কাব্য নিশ্বাসের শব্দ জোড়ালো হয়ে আসছে মেঘলার কাছে। এক হাত দিয়ে খামচে সিট আরেক হাত দিয়ে ওড়না ধরে আছে।

কাব্য মেঘলার মাথার ওড়নাটা সযত্নে নামিয়ে দিলো। কানের কাছের চুলগুলো আলত করে ছুঁয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিলো। মেঘলার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসে যাচ্ছে।

এদিকে মেঘলার প্রাণ যায় যায়। চোখ খিচে বন্ধ করে আছে। কানের কাছে কাব্যর আঙ্গুলের ছোঁয়া, কাঁধে নিশ্বাসের অস্তিত্ব পেয়ে জলোচ্ছ্বাস, আমফান, নার্গিস সব একসাথে শুরু হয়ে গেছে। মারা যাবে যাবে অবস্থা, এই বুঝি অজ্ঞান হয়ে গেলো। মনে মনে শুধু দোঁয়া করছে যেনো এ যাত্রায় মারা না যায়। কেবল বিয়ে হয়েছে, সংসারই হলো না তার আগেই মারা গেলে অতৃপ্ত আত্মায় পরিণত হয়ে যাবে। হঠাৎ অপরপাশের কানেও স্পর্শ অনুভব করছে। আরো কিছু বোঝার আগেই কানের ব্লুটুথ ইয়ারফোন টান দিয়ে খুলে নিজের সিটে ফিরে গেলো কাব্য। সাথে সাথে চোখ খুলে কাব্যর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ইয়ারফোন খুলতে এতো কাহিনী? হুহ! রিডিকোলাস!

কাব্য ইয়ারফোনটা ঘোরাচ্ছ আর মেঘলাকে গম্ভীর মুখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করছে,

– কি এইটা?

– ওমা! আপনি জানেন না এইটা কি? এইটা ইয়ারফোন। শুধু ইয়ারফোন না। ব্লুটুথ ইয়ার ফোন। এইটা অনেক জোস জানেন। এইটা দিয়ে ফুল স্পিডে ভলিউম ছেড়ে গান ছাড়লে পুরো বক্স বক্স ফিলিংস আসে। আর কোয়ালিটি এতো ভাআআ…….

কাব্যর তাকিয়ে থাকা দেখে মেঘলা কথার মাঝখানেই আটকিয়ে গেলো। কাব্যর হাত থেকে ছু মেরে ইয়ারফোনটা আনতে যাবে তখনই কাব্য হাতটা উঁচু করে ইয়ারফোনটাকে বাকা করে মুঠোয় নেয়।

ইয়ারফোনের কঠোর অবস্থা দেখে মেঘলা অসহায় দৃষ্টিতে কর্দন কন্ঠে বলে,

– প্লিজ ওইটা দিয়ে দেন। প্লিজ প্লিজ ওভাবে মোড়াবেন না। আমার এতো সাধের ইয়ারফোনটা মারা যাচ্ছে। আহ্! কি কষ্ট পাচ্ছে। একটু তো দয়া করেন। আমার জমানো টাকা থেকে কিনেছি। পুরা চকচোকা বাইশশো টাকা দিয়ে কিনছি। মোহনার কাছ থেকে কত কষ্টে লুকায়ে, আগলে, যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আপনি এমন করতে পারেন না। আহ্! আমি মারা যাবোওওও… ওমমমমমমমমমমমমম

কয়েক সেকেন্ড পর কাব্যর অনাকাঙ্ক্ষিত কাজটা থেকে মুক্ত পেয়ে মেঘলার প্রায় কেঁদে দেয়ার অভিপ্রায় ঘটেছে। কাব্য এবার ইয়ারফোনটা দিয়ে কাছে গিয়ে গালটা টেনে মিষ্টি হেসে বলে,

– এখন নাও তোমার ইয়ারফোন। উন্নত মানের ইয়ারফোন। আমার কথাগুলোর শুধু শুধু অপচয় ঘটানোর ছোট্ট একটা উপহার।

– কি করলেন এইটা আআআআআআ ?? বদমাইশ লোওওওক।

– কি করেছি? আমার হালাল একমাত্র বউকে একটু শিক্ষামূলক আদর দিয়েছি। কোনো সমস্যা তোমার?

– খুন করে দেবো আপনাকে।

– কেনো কেনো? ভালো লাগে নি?

– জঘন্যওওওওওওো!

– তাই! তাহলে ভালো মতো দেই

– আই না না না। অনেক ভালো ভালো।

– তারমানে তুমি ইনজয় করেছো?

– হ্যা হ্যা…… নাআআআআাআাাআ

মেঘলা ব্যাগ দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়। কাব্য হাসি আর আটকিয়ে রাখতে পারছে না। চমৎকার ভাবে হেসে গাড়ি স্টার্ট দেওয়া শুরু করলো। আর মেঘলা ব্যাগ চেপে বসেই রইলো। বাসার কাছে এসেও ব্যাগ চেপে সাইড দিয়ে একটু একটু তাকিয়ে বাসায় ভো দৌড়। কাব্য মেঘলার কান্ড দেখে একদফা হেসে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

🍁

সকাল বেলা ওঠেই ব্রেনে বালির মতো বুদ্ধির উপস্থিতি অনুভব করছে মেঘলা। বুদ্ধি কম শয়তানি কুবুদ্ধিই বেশি। সেদিনের পর থেকে আজ সাতদিনের মধ্যে মাত্র তিনদিন ভার্সিটিতে গিয়েছে সে। বাকিদিন বাহানা দিয়ে বাড়িতেই আয়েশ করছে। গতকাল রাতে ভেবেছে আজকেও যাবে না কিন্তু সকাল বেলা ওঠে অন্য বুদ্ধি আটছে। সকাল সকাল কাব্যকে এসএমএস দিলো প্রথম ক্লাস করবে না। তাই দশটায় ভার্সিটিতে যাবে। কিন্তু করেছে আরেকটা।

সাতটা পঞ্চান্ন বাজে। ভার্সিটিতে এসে উপস্থিত মেঘলারাণি। কাব্য দশটায় ওর বাসার সামনে গিয়ে অপেক্ষা করবে, তারপর ওকে না পেয়ে হুদাই ঘুরে আসবে। ভার্সিটিতে এসে খুঁজবে কিন্তু পাবে না কারণ প্ল্যান করেছে তনু আর ও আজকে সিটি মার্কেটের দই ফুসকা খেতে যাবে তারপর শপিং করবে। কাব্যকে ঘোরাবে ভেবেই আনন্দে আটখানা হয়ে গেছে মেঘলা। খুশি যেনো ধরছে না। যেনো ঈদের চাঁদ দেখেছে সে। আহা! সে কি খুশি।

তনুর জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে ভাজা বুট চাবাচ্ছে। তারমধ্য না খেয়ে আসাতে পেটে ক্ষিদে ক্ষিদে মেঘ ডাকছে। কখন তনু আসবে আর দুজনে বসে ব্রেক ফাষ্ট করবে।

বারবার ঘড়ি দেখছে। সাড়ে আটটায় ক্লাসে যেতে হবে। প্রথম ক্লাসটা করে সাড়ে নয়টায় বের হয়ে যেতে হবে ভার্সিটি হবে যে করেই। বাই এনি চান্স কাব্যর সামনে যদি পড়ে তাহলে কাবাব বানাবে।
আটটা সাত বাজে। গেটে তনুকে দেখতে পেয়ে যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। উঠে তনুর কাছে যাবে তখনই আরেক মুসিবত ক্রিয়েট বাই দা গঙ্গা ঘাটের পেত্নী তনু।

মেঘলাকে দেখেই তনুও খুশি হয়ে বেখেয়ালিভাবে আসছে। আশে পাশে খেয়াল না করে সোজা হাটতে গিয়ে এক ইটের খন্ডের সাথে উষ্টা খেতে খেতে বেঁচে গেলো। বেশ রাগ হচ্ছে দেখে। রেগে ইটের খন্ডটা হাতে তুলে পাশে নিজের সব শক্তি দিয়ে ঢিল দিয়ে দিলো। মেঘলা দুরে থেকে না করতে করতেই তা গিয়ে একজনের কপালে পাশ কেটে কোনো রকমের চলে গেলো। মেঘলা ইচের খন্ডকে লক্ষ করে তাকাতে তাকাতে আহতকারীকে দেখে চোখ চড়কগাছ।

আবির! খুশি হবে নাকি এই মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে তা নিয়ে দোটনায় পড়লো। বেশ কয়েকদিন পর আবিরের দেখা মিললো। এর মাঝে কয়েকবার আবিরের কথা বেশ মনে হয়েছে মেঘলার। ফোনও করেছিলো একবার। কিন্তু বন্ধ পেয়েছিলো। তাই বেশ কিছুদিন পর আবিরকে দেখ একটু খুশি হয়ে যায় মেঘলা।

আবির বাইক চালিয়ে কেবলই গেইট ক্রশ করেছে। বাইক চালানোর ফলে ইটটা কপাল ছুঁয়ে চলে গেছে। কিছুটা ছুলে গেছে। আবির সাথে সাথে বাইকটা থামিয়ে দাড়িয়ে পড়ে। তনু পেছন মেঘলার দৃষ্টি ফলো করে পেছন ঘুরে তাকাতেই মুখের সব হাওয়া ফুস হয়ে যায়। কেঁদে দিলো বলে। আবির তাকিয়েই আছে বিরক্ত চোখে। এতদিন পর এসেই এমন একটা পরিস্থিতির শিকার হতে হবে তা আশাহত। তনু মাথা নিচু করে আবিরের সামনে গিয়েই কেঁদে একদমে বলে উঠলো,

– সরি সরি ভাইয়া। আমি দেখে দেই নি। প্লিজ ক্ষমা করে দিন। ইস্! ছুলে গিয়েছে। রক্তও জমে গেছে। এখন আপনার চেলারা এসে আমাকে ঘিরে ধরবে। এতো এতো কথা শুনাবে। সবাই জড়ো হবে। আমাকে এইটা ওইটা বলবে। আমাকে শাস্তি দেবে। টেনে স্যারদের কাছে নিয়ে যাবে। বিচার করবে। এ্য এ্য এ্য। আমি সত্যি দেখে দেই নি। বুঝতেই পারি নি আপনার মাথায় গিয়ে পড়বে। দুনিয়ায় এতো মানুষ থাকতে আপনার কপালে লাগবে জানলে আগে নিজেই নিজের মাথা ফাটাতাম তাও ঢিল দিতাম না। সত্যি বলছি। আপনার কসম। আমার তুর্কি ক্রাশের কসম। আপনি বললে আপনাকে নিজ হাতে সেবা করে দেবো। তাও প্লিজ ওদের আমাকে শাস্তি দিতে না করেন। আমি আর ভার্সিটিতেই আসবো না প্রয়োজনে। শুধু এক্সাম দিয়ে চলে যাবো। সত্যি বলছি। মেঘলআআআআ প্লিজ হেল্প মি।

মেঘলা তনুর কাছে এসে ওকে শান্তনা দিতে গিয়ে ফিক করে হেসে দেয়। আর আবির শাসন কি করবে তনুর কথা শুনে, আকাশ কুসুম চিন্তা দেখে নিজেই হতবাক হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। মেঘলার হাসির শব্দ শুনে আবিরও মুচকি হেসে দেয়। আবিরের হাসি দেখে মেঘলা এবার জোড়ে জোড়ে হেসে বসেই পড়ে। আর তনু দুজনের দিকে কাঁদো কাঁদো মুখেই বোকা হয়ে তাকিয়ে আছে রইলো। লাইক আ কার্টুন।

চলবে……. ❤