তুই আমার কাব্য পর্ব-৪৩

0
1565

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 43
.
🍁
.

– এই যে দুইটা পাঁচটা কাব্য ভাইয়া, শুনছেন? এদিকে তাকান না। এই এই তাকান না..

গভীর মনোযোগে ড্রাইভ করার মাঝে পাশ থেকে মেঘলার এমন অদ্ভুত ধরনের ডাকেও কাব্যর কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা গেলো না। একবারের জন্য শুধুমাত্র চোখটা ঘুড়িয়ো আবার সামনে তাকালো। মেঘলা একটা আঙ্গুল দিয়ে কাব্যর বাহুতে খোঁচা দিয়ে আবার বলে,

– এই! তাকান না একটু আমার দিকে। সুন্দর বউয়ের দিকে একটু তাকাতে হয় না হলে বউ মারা যায়। আমি মারা গেলে আপনি বিধবা হয়ে যাবেন তখন বুজবেন কেমন মজা।

গাড়ির হঠাৎ ব্রেক করে মেঘলার দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে চোখটা সরু করে বলে,

– এতোসব আজগুবি কথা কোথা থেকে আসে তোমার মাথায়? সুন্দরী বউয়ের দিকে না তাকালে মারা যায় কোথায় পেয়েছো এইটা? আর ছেলেরা কখনও বিধবা হয়?

– হ্যা হয় তো। মেয়েরা যদি হয় তাহলে ছেলেরাও তো হয়।

– কোথায় লেখা আছে এইটা?

– আসলে লেখা নেই। লেখক লিখতে ভুলে গেছে। ওই যে মাঝে মাঝে আমরা যেমন লিখতে ভুলে যাই তেমনই। আমি শুনেছি এইটা।

– আচ্ছা তাই! কে বললো শুনি তোমায়?

– বাতাস! লেখক লিখার জন্য ভেবেছিল, মুখে বলেওছিলো। তখনই বাতাস উড়ে উড়ে উড়ে উড়ে, মানে অনেক আগেরদিনের কথা বুঝতেই পারছেন। একটা জিনিস আসতে অনেক দেরি হয়েছে। তো উড়ে উড়ে ওই জামানা থেকে এই জামানায় আমার কানে এসে পৌঁছিয়েছে। আর বলেছ আমি জেনো সবাইকে এইটা জানিয়ে দেই।

কাব্য ওর হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারলো না। যতবার ভাবছে রাগ করবে এইবার ততবারই মেঘলার কথায় হেসে ওঠছে। হেসে ওঠে মেঘলার দুই গাল ধরে বলে,

– দুষ্টুর পাঠরাণী

মেঘলা একগাল হেসে দিলো। মেঘলার হাসিতে কাব্যও হেসে ওঠলো। মেঘলাও একটু এগিয়ে কাব্যর দুই গাল ধরে টেনে বলে,

– আমার কুটু কুটু জামাই।

বলেই গালে কিস করে আগের জায়গায় বসে আবারো একগাল হেসে দিলো। মেঘলার অপ্রত্যাশিত এই কাজে কাব্য মূর্তিপ্রায়। মেঘলার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে গেলো কাব্য। মেঘলাকে কোলে করে নিয়ে সাবধানে বাড়ির ভেতরে ডুকছে। সিঁড়ি কাছে যেতেই ফোন বেজে ওঠলো কাব্যর। বেজ চমকিয়ে ওঠে ফোনের শব্দে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শুভ বলে ওঠে,

– বাড়ি গিয়েছিস?

– হ্যা ভাইয়া। এইতো আসলাম।

– সাবধানে। আর টেনশন করিস না আমরা রাতের আগে আসবো না। তার আগেই মেঝো গিন্নিকে স্বাভাবিক করে বাসায় পাঠাবি।

– আমি না পাগল হয়ে যাবো ভাইয়া এর পাল্লায়।

– বউয়ের জন্য একটু আকটু পাগল না হলে চলে না জুনিয়র।

– একটু আকটু বলছিস? তোর শালি আজকে আমাকে নাজেহাল করেছে। আল্লাহ জানে আর কতকিছু জীবনে বাকি আছে। নিজের পরিবারের কাছে মান সম্মান থাকলে হয়।

– আরে চিল! আমি সামলে নিচ্ছি সব। তুই ওদিকটা খেয়াল রাখ।

– হুম! মেহভিন কে দেখে রাখিস। এতো রাতে বাহিরে থাকতে হবে এই মেয়েটার জন্য।

– কাব্য! একদম রাগ করবি না। ভালোভাবে সুস্থ করে বাড়ি পাঠাবি। কোনো বকা ঝকা না। ক্লিয়ার!

– হুম।

ফোনটা রেখে গেস্ট রুমে মেঘলাকে নিয়ে বসিয়ে দিলো। মেঘলা শুধু তাকিয়েই আছে। মেঘলার তাকিয়ে থাকা দেখে কাব্য জিজ্ঞাসা করলো,

– ওভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?

– আমার জামাই কত সুন্দর, কত্ত কিউট, কত্ত হ্যন্ডসাম ! কিন্তু সমস্যা একটাই।

– কি?

– ব্যাটা খারুশ, খাটাইস, ব্রিটিস রাজাকার, পানের দোকানের মালিকের মতো সব সময় চিল্লায়।

– হোয়াট! আমি পানের দোকানের মালিক? তোমাকে আমি..

মেঘলা ভয়ে খাটের কোণায় গিয়ে জোড়ে সর গয়ে বসে পড়ে। কাব্যর রাগান্বিত মুখ দেখে ভয় পেয়ে গেছে। কাব্য ব্যপারটা বুঝতে পেরে নিজেকে কন্ট্রোল করে খাটে বসে পড়ে। মেঘলা আস্তে আস্তে খাটের এপাশ থেকে ওপাশে গিয়ে নিচে নেমে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিল্লিয়ে ওঠে। কাব্য ঘাবড়ে ওঠে পেছন ঘুরে তাকাতেই মেঘলা নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ফেলে। এই মেয়েটা পারেও। স্থির হয়ে বসার নাম নেই। নিজেও পাগল আশে পাশে যারা থাকবে তাদেরও পাগল বানাবে। মেঘলার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

– কি হয়েছে? চিৎকার করলে কেনো ওভাবে?

– দেখুন আয়নায়।

– কি আয়নায়!

– কত্তগুলো আমি! প্রথমে কত্তগুলো আপনি ছিলেন। এখন কত্তগুলো আমি হয়ে গেছি। যাক ভালোই হয়েছে। ভেবেছিলাম এতোগুলো আপনার মাঝে একটা আমি কি করে থাকবো। এখন তো আমিও এতোগুলো। এত্তোগুলো মেঘলার সাথে এত্তোগুলো কাব্য।

খুশি হয়ে কাব্যকে জড়িয়ে ধরে। কাব্য মেঘলার একের পর এক কাজে হতবাক হয়ে ওঠছে। খুব শক্ত করে জড়িয়ে আছে মেঘলা। কাব্যও মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দিয়ে হেসে ওঠে। মেঘলা মাথাটা একটু উঁচু করে আস্তে আস্তে ঢেকে বলে,

– এই এই! আপনি কি আমায় ভালোবাসেন?

কাব্য এক হাত দিয়ে নাক টেনে আবার কোমর জড়িয়ে কোমরটা টেনে বলে,

– এরকম পাগলকে ভালো না বেসে উপায় আছে কোনো?

– সত্যি ভালোবাসেন? এত্তগুলা ভালোবাসেন?

মেঘলার মুখ খুশিতে আটখানা হয়ে ওঠেছে। খুশি যেনো ওতড়ে পড়ছে। কাব্য হাসি হাসি মুখে উত্তর দিলো,

– অনেকগুলো ভালোবাসি

– না এত্তগুলা বাসতে হবে

– আচ্ছা ঠিক আছে এত্তগুলাই বাসি।

– আমিও এত্তগুলা বাসি। চকলেটের চেয়েও বেশি। ফুসকার চেয়েও বেশি। চিপসের থেকে বেশি। কোল্ড কফির থেকেও বেশি।

কথা গুলো বলেই মেঘলা পায়ের গোড়ালি উঁচু করে দুই হাত কাব্যর ঘাড়ের উপর দিয়ে লক করে ঠোঁট আঁকড়ে ধরে। এইটা যেনো একটু বেশিই অপ্রত্যাশিত ছিলো। একদিনে এতো ধামাকা? মেঘলার চুলের নিচে হাত দিয়ে ধরতে ধরতেই মেঘলার বাঁধন হালকা হয়ে পড়ে। কাব্য শক্ত করে মেঘলাকে ধরে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো। চুলগুলো গুছিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।

সন্ধ্যার আজান কানে আসতেই কাব্যর টেনশন বেড়ে গেলো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এই মেয়ে এখনো ওঠলো না। এখনো যদি নেশা না কেটে থাকে তাহলে তো বড় মুশকিল। পকেট থেকে দ্রুত ফোনটা বের করে তনুর নাম্বারে ডায়াল করতেই সাথে সাথে ফোন রিসিভ করলো। কাব্য ঠান্ডা গলায় বললো,

– ফোন করেছিলে?

– হ্যা ভাইয়া। বলেছি মেঘলার যেতে দেরি হবে। বার্থডে পার্টিতে আছি।

– সন্দেহ করে নি তো?

– না না। আগে দু একবার এরকম ফ্রেন্ডদের পার্টের জন্য ফিরতে রাত হয়েছে আমাদের। সো এইটা নিয়ে তেমন সন্দেহ করবে না।

– ওহ্ ওকে! থ্যাংকস জানাচ্ছি না। বিকজ সব হয়েছে তোমাদের দুজনের জন্যই। কালকে দুটোকেই শাস্তি দেবো।

তনু সাথে সাথে ফোন কেটে দিয়ে বাঁচে। কাব্য এক গ্লাস লেবুর পানি নিয়ে মেঘরার রুমে চলে যায়। এখনো ঘুমে বেঘোর। সবাইকে টেনশনে রেখে নিজে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। দারুণ না ব্যাপারটা?

ঘুমের মাঝেই চামচ দিয়ে অর্ধেকটা লেবুর পানি খাইয়ে দিতেই দিতেই ঘুম ভেঙে যায় মেঘলার। মিটমিট করে সামনে তাকাতেই আবছা আবছা একটা ছায়ামূর্তির মতো কিছু লাগছে। ধীরে ধীরে ওঠে বসতেই মাথাটা ভার ভার অনুভব করে। সামলে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। কেউ যেনো পেছন দিকে ধাক্কাচ্ছে। পেছন দিকে পড়ে যাচ্ছেই সাথে সাথে কারো সাহায্য পেলো মনে হয়। ঘোলাটে চোখে বহু কষ্টে বোঝতে পারলো এইটা কাব্য। বিছানা থেকে নামিয়ে কোলে নিতেই ছুটতে চাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কারণ যে তার হাল এই অবস্থায় পিপড়াও তার সাথে যুদ্ধ করে দেশ দখল করতে পারবে।

পায়ের নিচে ঠান্ডা আর পানি পানি অনুভর হচ্ছে। মুখটা পানি দিয়ে না পরিষ্কার করতে পারলে ভালো মতো দেখা সম্ভব হচ্ছে না মেঘলার। সামনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কিছু। মনে হচ্ছে যেনো বড় সড় কোনো সুইমিং পুলের সামনে দাঁড়িযে আছে। কাব্য কি ওকে সুইমিং পুলে ডুবিয়ে মারার জন্য নিয়ে এসেছে? কিন্তু কেনো? কাব্য না ওর স্বামী। বউকে মেরে ফেলবে? না না এমনটা করবে না।

এইগুলো ভেবে পেছন ঘুরতে যাবে তখন আবারো কাব্য মেঘলাকে কোলে নিয়ে ফেলে দিলো বাথটাবে। আকষ্মিকভাবে এমন হওয়ায় মেঘলা টাল রাখতে পারছে না। ওঠতেও পারছে না। নাক দিয়ে বেশ খানিকটা পানিও ঢুকে গেছে। মেঘলার ওঠতে অসুবিধা হচ্ছে। কাব্য প্রথমে বুঝতে না পেরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। পরে যখন বুঝতে পারছে তখন ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত মেঘলাকে উঠিয়ে কোলে করে ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলে এনে বসিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেঘলা ক্রমাগত কেশে যাচ্ছে। মেঘলার অস্বাভাবিক কাশি দেখে কাব্যর বুক ভয়ে কেঁপে ওঠছে। ব্যস্ত কন্ঠে বলে ওঠে,

– আ’ম সরি জান। তুমি এতোটা ঘোরে ছিলে বুঝি নি। কষ্ট হচ্ছে খুব? নাকে পানি বেশি ঢুকেছে? ব্যাথা পেয়েছো কোথাও? কি হলো বলো না?

মেঘলা কাশতে কাশতেই খেয়াল করলো এইটা কাব্যদের বাড়ি। আর কাব্য ওকে বাথটাবে ফেলে দিয়েছিলো। রেগে কাব্যকে কিছু বলতে গিয়ে থেমে পড়লো। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ পড়ে গিয়েছে। হাত কাঁপছে তা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে মেঘলা। সত্যি বুঝতে পারে নি মেঘলা এতোটা ঘোরে ছিলো। নেশা অতিরিক্ত হযে গিয়েছিলো তার জন্য ইফেক্ট কাটে নি পুরো পুরি।
মেঘলা মাথা নিয়ে না সূচক উত্তর দেয়ার সাথে সাথে কাব্যে দুই হাত দিয়ে মাথা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। মেঘলা আবার কেশে ওঠতেই দ্রুত কাবার্ট খুলে একটা লম্বা নাইটি ড্রেস হাতে পেলো। এতো ঘাবড়ে ছিলো যে খেয়ালই করে নি এইটা নাইটি ছিলো। মেঘলাকে জামাটা এগিয়ে দিয়ে ব্যস্ত সুরেই বলে,

– দুই মিনিটের মধ্যে চেঞ্জ করে এসো যাও। দ্রুত। ঠান্ডা লেগে যাবে।

মেঘলাও ওটা হাতে নিয়ে না দেখেই ওয়াশরুমে চলে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর বের হতেই কাব্য তাকিয়ে চোখ আটকে গেছে। বেবি পিংক কালারের একটা নাইটি। হাটুটা ঢেকেই আছে। হাতাটাও প্রায় ফুলই। নাইটি হলেও মার্জিত। মূলত বাসায় কেউ এলে তার কর্ফোটের জন্য এক্সট্রা করে রাখা হয়। ভেজা চুলের পানিগুলোতে কাধ ভিজে ওঠেছে মেঘলার। লম্বা হলেও মেঘলা লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না। মুখেও ভেজা ভেজা ভাবটা রয়েছে। জামার রংটা মুখের ওপর বেশ আভা ফেলেছে। যার কারণে মুখটা বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। কাব্য নিজের জায়গায় অনড় দাড়িয়ে থেকে বুকের বাম পাশ টায় হাত রেখে নরম করে বলে ওঠে,

– ওফ্! গুরুতর আহত

মেঘলার কানে কথাটা যেতেই গালগুলো গরম হয়ে আরো লাল হয়ে গেলো। এক পা নড়তে পারছে না। বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ফ্লোর আটকে রেখেছে। কাব্য আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। মেঘলার অদ্ভুতভাবে হাত পা কেঁপে ওঠছে। কাব্য কোনো কথা ছাড়াই মেঘলাকে কোলে নিয়ে আয়নার সামনে বসিয়ে হাত থেকে তাওয়ালটা নিয়ে সযত্নে মাথা মুছে দিচ্ছে। মেঘলা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়না ভেদ করে কাব্যর দিকে তাকাচ্ছে। কাব্য ছুঁই ছুঁই করে তাওয়াল ধরে মেঘলার মাথার চুল মুছে দিচ্ছে। এতো নরম ভাবে মুছে দিচ্ছে যেনো চুলও টের পাচ্ছে না। মেঘলা চোখে গালে লজ্জা আর ঠোঁটে অজানা তৃপ্তির হাসি।

চলবে…….. ❤