তুই আমার কাব্য পর্ব-৪৯+৫০+৫১

0
1462

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 49 + 50 + 51
.
🍁
.

মানুষ অপেক্ষা হিংস্র প্রাণী পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। অনেকে হয়তো বাঘ, সিংহ, সাপ ইত্যাদি বলবে কিন্তু মানুষ এদের থেকেও হিংস্র, দ্বিগুণ বিষধর। মানুষের রাগ যে পরিমাণ বিষাক্ত তা যেকোনো সাপের বিষকেও তুচ্ছ করে দেবে। যেকোনো হিংস্র প্রাণী দেখলে বিপরীতে অবস্থান করা প্রাণটি নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে হয়তোবা পালাবে নতুবা যুদ্ধ করবে। কিন্তু মানুষ! বোঝার উপায় নেই কে কোন রূপের আড়ালে কোন রূপ লুকিয়ে রেখেছে। মুখোশ!

– কাব্য!

রৌশানের ডাকে কাব্য রৌশানের দিকে ম্লান একটা হাসি দিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে রৌশনের উদ্দেশ্য বলে,

– আচ্ছা বল এবার প্ল্যান কি তোর? কতদিনের জন্য এসেছিস?

– কতদিনের জন্য মানে? তুই কি চাচ্ছিস আমি কিছুদিনের জন্য দেশে থাকি?

– তুই কি স্থায়ী হতে এসেছিস?

– অবশ্যই। আর কত ভিনদেশী হয়ে থাকতে বলিস?

– ইউ আর কিডিং রাইট?

– এবসুলিউটলি নট। আই এম সিরিয়াস।

– সিরিয়াসলি?

– ইয়াহ্! বিয়ে করে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সংসার করতে এসেছি।

– ইউ গিভ মি এ গিভ সারপ্রাইজ রিয়েলি।

কাব্য রৌশানকে জড়ায়ে ধরে। একজন আরেকজনের কাঁধের উপর হাত রেখে খুশির জোয়ারে যখন ব্যস্ত তখন অজ্ঞাত এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠছে।

– হ্যালো!

– জ্বি কাজ কমপ্লিট করেছি অনেক আগেই।

– এখনো হয় নি। আরো একটা বাকি আছে।

– জ্বি বলুন। এবার টার্গেটে কে?

– এবার তেমন কিছু না। শুধু একটু হাওয়া দিতে হবে আগুন জ্বালানোর জন্য।

– জো হুকুম।

এদিকে তনু সারা ভার্সিটি খুঁজেও মেঘলার টিকিটারও সন্ধান করতে পারি নি। তাই আবারো খুঁজছে কাব্যকে। হাতে ফোন। মুখে বিরক্ত, রাগ ও কিঞ্চিৎ চিন্তার সংমিশ্রণ। ফোন বেজে চলছে কিন্তু ধরছে না কেউ। ফোনটা কানে নিয়েই এদিক ওদিক তাকাতেই চোখ পড়লো আবিরের দিকে। ফোনটা কেটে দৌড়ে আবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলে,

– দুঃখিত বিরক্ত করার জন্য। কিন্তু বিরক্ত করা ছাড়া উপায়ও নেই।

– কি হয়েছে দ্রুত বলো। ব্যস্ত প্রচুর।

– আরে রাখেন ব্যস্ত। মানুষ গুম হয়ে গেছে ওনি ব্যস্ততা দেখাচ্ছে।

– মানে? কে গুম হয়েছে?

– মেঘলা। অনেকক্ষণ যাবৎ খুঁজছি। কাব্য ভাইয়াকেও জিজ্ঞাসা করেছি। ওনি লোকেশন দেখে বললেন ভার্সিটিতেই আছে কিন্তু বিশ্বাস করুণ পুরো ভার্সিটি খুঁজে প্রাণ যায় যায় তবুও মেঘলার খোঁজ নেই। আল্লাহ জানে কোথায় আছে? পেলে খুন করে দেবো। কিন্তু কথা সেইটা না। কথা হলো ফোন যাচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না। টেনশন হচ্ছে খুব। বিপদে পড়লো না তো?

আবিরের কপালে ভাজ পড়ে গেলো কথা শোনার সাথে সাথে। ব্যস্ত হয়ে ফোন বের করে মেঘলার নাম্বারে ডায়াল করে ব্যতিক্রম কিছু পেলো না। চিন্তিত সুরে তনুকে ধমকে ওঠে বললো,

– মেঘলাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আর এইটা তুমি এখন বলছো? বাড়ি যায় নি তো?

– না না। আমি কায়েদা করে ফোন করেছিলাম। কারণ সরাসরি জিজ্ঞাসা করলে ওনারাও তো চিন্তা করতো।

– যাক! বুদ্ধি কিছুটা হলেও আছে। কি করা যায় এখন? আমি একবার আবার ওর লোকেশনটা দেখি।

আবির লোকেশন চেক করে দেখলো এখনো ভার্সিটিতেই শো করছে। ফোনটা পকেটে রেখে তনুকে বলে,

– পুরো ভার্সিটি খুঁজে দেখেছো সিউর তো?

– না মানে পুরো বলতে যেখানে যেখানে মেঘলা থাকতে পারে সেরকম সব জায়গায়। আর নিচ তালা সবটা।

– গবেট! চলো আমার সাথে। পুরো ভার্সিটি খুঁজতে হবে।

তনু আবিরের পেছনে পেছনে দৌড়ে ছুটে যায়। দোতালার সিঁড়ি ওঠতেই কাব্য ও রৌশানকে দেখে থেমে যায় আবির। রৌশানকে দেখে বেশ অবাক ও খুশিও। কিন্তু প্রকাশ করতে অক্ষম। এই মুহুর্তে আসলে কি ধরনের মনোভাব প্রকাশ করা উচিৎ তা বোঝে ওঠতে পারছে না আবির। এতো বছর পর রৌশানকে দেখার খুশি নাকি মেঘলার নিখোঁজের আশংকা।

রৌশান আবিরকে দেখা মাত্রই আবিরকে জড়িয়ে ধরে বলে,

– আবির! হেই! হোয়াটস আপ ইয়ার? তোর কাছেই যাচ্ছিলাম।

আবিরের চিন্তিত মুখে সামান্যতম পরিবর্তন না এসেই রৌশানের উদ্দেশ্যে বলে,

– খুশিটা পরে উপভোগ করি। আগে বিপদটা সামলে নেই।

– বিপদ!

রৌশানের দিক থেকে চোখ সড়িয়ে কাব্যর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ও রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

– আমি তো জানতাম আমার বিপরীত পক্ষের নেতা খুবই দায়িত্বশীল। বাহিরেও এবং ভিতরেও। কিন্তু এখন তো দেখছি তা একদমই ভুল।

কাব্য আবিরের মুখোমুখি হয়ে পকেটে দু হাত রেখে বলে,

– কি বলতে চাচ্ছিস সরাসরি বল। ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলে নিজের সময় এবং আমার সময় দুটোই অপচয় করার কোনো কারণ দেখছি না।

– মেঘলা কোথায়?

– তা তো তোর জানার প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে না।

– আমি প্রশ্ন করি নি, জানতে চেয়েছি মাত্র।

– মেঘলা মেঘলার জায়গায় আছে।

– ফোন দে তো। দিয়ে দেখ তো ঠিক কোন জায়গায় কেমন আছে?

আবিরের কথার সুর অন্যরকম। সুর অন্য কিছু বলছে। কাব্যর মুখের ভাব মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়ে গেলো। তনুর দিকে তাকাতেই চিন্তিত হয়ে পড়লো। কাব্যর প্রশ্নেই আগেই তনুর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ে। নিজেকে সামলাতে না পেরে তনু কেঁদেই বলে ওঠে,

– ভাইয়া মেঘলাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক খুঁজছি। লোকেশনে আবারো চেক করেছি। ভার্সিটতেই কিন্তু কোথায় তা জানি না। ফোনটাও ধরছে না। ভয় লাগছে খুব। কিছু হলো না তো?

কাব্যর মুখের রং মুহুর্তেই ফ্যকাশে হয়ে গেলো। বুকের ভেতর অজানা ভয় যার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠছে ওর মুখেও। কাব্য সাথে সাথে ফোনটা বের করে কল করতে যাবে তখনই আবির বলে,

– ফোন করে লাভ নেই। আমরা করেছি। ধরছে না।

কাব্য আবিরের কথা অগ্রাহ্য করে কয়েকবার কল করে কিন্তু তারক্ষেত্রেও একই জিনিস। কাব্য অস্থির হয়র পড়ছে। হাত পা যেনো চলছে না। তার তো এখন ছুঁটে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু ছুঁটতেই পারছে না। রৌশান কিছু জানতে চাচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির গম্ভীরতায় পারছে না। কাব্য একহাত দিয়ে চুল টেনে দাঁড়িয়ে আছে। আবির কিছু ছেলেদেরও খোঁজ লাগিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টায় আছে। হঠাৎই কাব্য বলে ওঠে,

– রাহি কোথায়? কেউ দেখেছিস?

সবাই না সূচক প্রশ্ন নিক্ষেপ করতেই কাব্য আবিরকে বলে,

– আবির তুই তনুকে নিয়ে উপরের দিকে যাহ্। কুইক। আমি অন্যদিক দেখছি।

– হুম! তুই সামনের বিল্ডিংটা দেখ। আমি এইটা দেখছি। রৌশান তুই কাব্যর সাথে যা।

রৌশান হয়তো জানে না এই বিষয়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই সে হিসেবে তার কোনো প্রতিক্রিয়াও তেমন নেই। তবে এ সবকিছুর মধ্যে তার খেয়াল হলো কাব্য ও আবিরের কথায়। মাঝখানের সময়, পরিস্থিতি, ঘটনাগুলো সে দেখে নি তাই জানে না। কিন্তু আগের সাথে বেশ সাদৃশ্যতা লক্ষ করলো। এইটা ভেবেই হালকা হেসে বলে,

– হুম আমি আছি তোরা যা।

কাব্য ততক্ষণে বেড়িয়ে গিয়েছে। এদিক ওদিক নিরুদ্দেশভাবে খোঁজ করার পর অতপর নিরব, জনমানবশূন্য এক বারান্দার সামনে রাহিকে আবিষ্কার করলো কাব্য। ছুঁটে গিয়ে দুই হাত চেপে ধরে দাঁতে দাঁত রেখে জিজ্ঞাসা করে,

– হোয়ার ইজ মেঘলা?

– কি আশ্চর্য! মেঘলা কোথায় তা আমি কি করে জানবো?

– অভিনয় করার ব্যর্থ চেষ্টা করবি না। তুই খুব ভালো করে জানিস অযথা আমি কাউকে ব্লেম করি না। সো নাও টেম মি হোয়ার ইজ মেঘলা?

– আই রিয়েলি ডোন্ট নো। আর আমি বুঝতে পারছি না তুই আমাকে কেনো জিজ্ঞাসা করছিস এইটা?

– আমি আবারো বলছি অভিনয় করার চেষ্টা করবি না। মেঘলার কোনো শত্রু এই ভার্সিটিতে নেই তুই ছাড়া। প্রথম থেকে না তুই ওকে সহ্য করতে পারতি আর না এখন পারিস আর তার কারণটাও আমি জানি। সো আমাকর বোকা বানানোর বিন্দু মাত্র চেষ্টা করিস না।

– আমি সত্যি বলছি জানি না। হ্যা আমার ওকে পছন্দ না কিন্তু তাই বলে গুম করে দেবো? না না এতোটাও না।

কাব্য রাহিকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিয়ে চোখে চোখ দিয়ে বলে,

– তুই না থাকলেই ভালো। বাট! বাই এনি চান্স যদি জানতে পারি এর সবকিছুর ক্রেডিট তোর আই সোয়ার, তোরটাই তোকে ফেরত দেবো দ্বিগুণ রূপে।

কাব্য ওখান থেকে সরে আসতেই রাহি নিজের হাতের দিকে তাকায়। আঙ্গুলের ছাপ ওঠে গেছে। আঙুল দিয়েই কেটে ফেলতে যেনো সক্ষম। রাহির হাতের ওপর হাত ঘসতে ঘসতে বিষাদীয় এক হাসি হেসে বলে,

– ইউ আর এবসুলিউটলি কারেক্ট বেইবি। অল ক্রডিট গোস টু মি। ইয়াহ্! ইটস্ মি। কিভাবে বুঝিস বল তো তুই? তোর এই সমস্ত বিষয়েই তো ফিদা আমি। পাগল আমি। কি কি করেছি আর কি কি করতে পারি তার কোনো ধারণাই তুই রাখতে পারবি না। আই এম ইউর সাইকো লাভার। আই ক্যান ডু এভরিথিং ফোর ইউ, ফর গেইন ইউ।
তোদের জীবনের যা কিছু অকল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছি আমি আর অর্ধেক তার নিয়তি।

#তুই_আমার_কাব্য 🍂
#part: 50

রাহি ফোনে কথা বলতে বলতে ওখান থেকে বের হয়ে এলো। সাথে দেয়ালের পেছন থেকে বেড়িয়ে এলো কাব্য এবং রৌশান । চোখে যেনো কেউ লাল রং ঢেলে দিয়েছে। মুখটাও লাল বর্ণ ধারণ করেছে। রৌশান কাব্যর কাঁধে হাত রেখে বলে,

– তাহলে কি ওটার পেছনেও রাহি?

কাব্য কোনো কিছু না বলেই শুধু তাকিয়ে সামনে হাঁটা শুরু করে। ফোনটা বের করে কানে ধরেই বলে,

– আই যাষ্ট গিভ ইউ টেন মিনিটস। ছেলেটাকে খুঁজে ক্লাবের রুমে নিয়ে যাহ্। এতো সমাদার হওয়া চাই যেনো আর কোনো মেহমান বাড়ি তত্ত্ব নেওয়ার কথা দুঃস্বপ্নেও না ভাবে।

আবির তনু হন্যে হয়ে খুঁজে চলছে। এতো বড় ভার্সিটি। প্রতিটি দালান খোঁজা শেষ। দুজনের চোখে মুখে হতাশার ছাপ। সিঁড়িতে বসে পড়লো তনু। চোখ ফুলে রয়েছে, নাকের নগা লাল টুকটুকে। তনুকে বসে পড়তে দেখে আবির বিরক্ত হয়ে তাকায়। আবছা আলো – অন্ধকার জায়গাটা। তনুর চোখের নিচে নোনা জল শুকিয়ে জলছাপের মতো হয়ে গেছে। মলিন মুখমন্ডল, অগোছালো চুল। কোনো তো রক্তের সম্পর্ক তার নেই মেঘলার সাথে আর না আছে আত্মীয়তার সম্পর্ক। বন্ধুত্ব নামক আশ্চর্য একট সম্পর্কে আবদ্ধ। তাতেই কি টান! কি মায়া! কি ভালোবাসা! সব বন্ধুই কি পারে? সবাইকে কি বন্ধুত্ত্ব শব্দটির মানে বুঝে? দায়িত্বগুলো পালন করতে জানে? সত্যিকারের বন্ধু যে কতবড় খোদার নেয়ামত তা যার না আছে সেই শুধু বুঝতে পারে। আবিরের কেনো যেনো বড্ড মায়া হচ্ছে তনুর উপর। হয়তো সেই মায়ার উপরই বাঁধা উপরে বলে,

– তনু বাহিরে যাও একটু। খোলা হাওয়া নাও। অনেকক্ষণ দৌড়িয়েছো। হয়তো খারাপ লাগছে। আমার সাথে পেরে উঠবে না। মেঘলার খোঁজ পেলে জানাবো।

তনু ক্লান্ত দুই চোখ আবিরের দিকে উঠিয়ে শ্রান্ত গলায় বলে,

– আমি পারবো। শুধু শুধু বসে থাকা সম্ভব হবে না। তবে একটু পানি পেলে ভালো লাগতো।

তনুর বলতে দেরি তো আবিরের যেতে দেরি হলো না। বসো বলেই ছুটে গেলো। কেনো সে ছুঁটে এলো তার কারণ হয়তো পরে ভাবলে সে পাবেই না। মানবিকতার খাতিরে বলে চালিয়ে নিতে পারে। তনু পানি খেয়ে বোতলের মুখ আটকাতে আটকাতে বলে,

– একটা কথা বলি? মানে কিছুক্ষণ ধরেই মাথায় ঘুরছে।

– হুম বলো

– এইটা তো আমরা সবাই এখন জানিই যে মেঘলা কারো কাছে জব্দ আছে। কেনো জেনো মনে হচ্ছে সে আপনাদের কাছেরই কেউ।

– কাছের তো বটেই।

– আচ্ছা এমন নয়তো যে সে ইচ্ছে করে মেঘলার ফোনটা ভার্সিটি রেখে ওকে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে আর আমাদের ঘোরাচ্ছে।

আবির একবার তনুর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিচের দিকে নিয়ে ভাবতে লাগলো। কথাটা তো ফেলে দেবার মতো নয়। এইটা সম্ভব। সত্যিই যদি এমন হয় তাহলে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে মেঘলাকে? ভাবতেই আবির আরো চিন্তিত হয়ে পড়লো। তখন আবারো তনু বলে,

– আমার একজনকে খুব সন্দেহ হয়।

– রাহি…… রাহি

দুজনে দুজনের দিকে তাকালো। একসাথে একই ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করায় কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে তাকালো। শুধু তাকিয়ে থেকেই দুজনেই আবার ছুটলো। হঠাৎই তনুর ফোন বেজে ওঠলো। ফোনের স্ক্রীনে কাব্য ভাইয়া নামটা বেজে ওঠলো। সাথে সাথে থেমে উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠলো,

– মেঘলার খোজ পেয়েছেন? কোথায় এখন? কেমন আছে? আমি আসবো। তাড়াতাড়ি বলুন।

– আমি রৌশান বলছি। কাব্যর বন্ধু। আবিরকে নিয়ে পুরোনো বিল্ডিংএ চলে আসো। কাব্য চলে গিয়েছে। তোমাকে জানাতে বললো। দ্রুত চলে আসো।

আর কোনো কথার শব্দ পাওয়া গেলো না। মানে কেটে দিয়েছে। তনু ব্যস্ত হয়ে আবিরকে জানিয়ে দুজনেই সেদিকে ছুটলো।

বেশ পুরোনো দালান। দুতালা। সর্ব প্রথমে এ দালানেই পাঠদানের কার্যকর্ম চলতো। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পুরোনো ছেড়ে নতুনের দিকে অগ্রসর হওয়ায় এইটা এখন ভার্সিটির পুরনো ও ফেলনা জিনিসের আশ্রয়কেন্দ্র। কাব্য নিচের সবকটা রুম খোঁজেও পেলো না। আর যেগুলো তালা দেওয়া সেগুলো দেখা তো সম্ভব নয়। তাই সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠতেই পাশের রুমটায় চোখ পড়লো। কোনো ক্রুটি রাখা চলবে না। তাই ওই রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু তালা দেওয়া। দেরি না করে চলে আসবে তখনি চোখ পড়লো দরজার উপরে। ধুলো পড়া দরজায় হাতের ছাপ। এখানে কারো আসার কথা না আর ছাপটাও পুরোনো লাগছে না। সামনে থেকে সরে গিয়ে দুরে দাঁড়িয়ে পায়ের নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো জুতোর হালকা ছাপ। ধুলোয় পা পড়লে যেমন ছাপ হয়ে তেমনই। নিজের পায়ের জুতোর নিচে তাকিয়ে ধুলোয় পায়ের ছাপ মিলিয়ে দেখলো ওর জুতো ছাড়াও আরো একাধিক ছাপ দেখা যাচ্ছে। কাব্য দরজার দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়েই ওঠে দাঁড়িয়ে দরজা ধাক্কা শুরু করলো। পুরোনো যুগের দরজা হলেও বেশ মজবুত। ভাঙ্গা মুসকিল ও সময়ও ব্যয়। কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। তালা ভাঙা এখন অসম্ভব। আশেপাশে তাকিয়ে জানালা আবিষ্কার করতে পারলো। জানালার সিকগুলো টেনে ওঠানোর প্রাণপন চেষ্টা করছে। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়ছে। এতোক্ষণ ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলেও এখন আর হয়ে উঠছে না। লক্ষ শুধু একটাই যে করেই হোক রুমের ভেতর যেতে হবে। জং পড়ে যাওয়া সিকগুলো বাকা হচ্ছে তবুও ভাঙ্গছে না। আবারো দরজার কাছে এসে দরজা ধাক্কাতে শুধু করছে। আবির, রৌশানও এসে হাজির। আবির রৌশানকে রড আনার কথা বলে দৌড়ে চলে এলো কাব্য কাছে। আবির কাব্যর কাঁধে হাত রেখে বলে,

– কাব্য সাইড হয়ে দাঁড়া। একসাথে চেষ্টা করতে দে।

কাব্যও সড়ে গিয়ে আবিরকে জায়গা করে দিলো। দুজনের প্রচেষ্টায় দরজা এক দিক থেকে ভেঙে পড়তেই কাব্য শিকল বরাবার দৌড়ে ধরে ফেললো। কাব্যর এমন কাজে আবির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

– দরজা ধরে রাখছিস কেনো? ছেড়ে দে। না হলে ভেতরে যাবো কি করে?

– আর ইউ ম্যাড? পেছনে মেঘলা থাকলে ওর উপরে পরতে পারে। সি উইল বি ইনজুরড।

আবির কাব্যর দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। কাব্যর এই অতি সুক্ষ্ম খেয়ালের কাছেই আবির হেরে গেছে। ভালো যে বেসেছিলো সত্যিই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওর থেকেও অধিক কাব্য বেসেছে। কাব্যর মতো অথবা কাব্যর থেকেও বেশি ভালোবাসতে পারলে হয়তো মেঘলা আজ তার হতো। সত্যিই কমতিটা নিজেরই।

– মেএএএঘ!

কাব্যর আত্ন চিৎকারে আবিরের ভাবনায় ছেদ ঘটলো।

দরজাটা সামনের দিকে টেনে ফেলতেই কাব্য মেঘলাকে আবিষ্কার করলো একট সিটের কোণাকে ভরসা করে জ্ঞানহীনভাবে বসে থাকতে। বিধ্বস্ত অবস্থা। পায়ের নিচের দিকে ও হাতের পুরো এক সাইটে ধুলোর আস্তরণ। দুই হাতের তালুও বাকি নেই। ব্যাগটা পাশেই পড়ে আছে তার কিছু দুরে ফোনটা। চোখের কাজল ও পানির দাগ শুকিয়ে ওঠেছে। নাকটা ও গাল ফুলে লাল হয়ে আছে। অস্বাভাবিক লাল। কাব্য দৌড়ে গিয়ে মেঘলাকে দুই হাত দিয়ে আকড়ে ধরে। হৃদস্পন্দন যেনো ফিরে এলে। অদ্ভুত এক প্রশান্তি। সারা শরীরের রক্তকনিকাগুলো যেগুলো ফুটছিলো সেগুলো যেনো শান্ত হতে শুরু করছে। দু হাত দিয়ে মাথাটা ধরে কপালে ও চোখে গভীর এক চুমু দিয়ে মাথা উঠিয়ে বুকের কাছে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে মেঘলাকে ডাকতে শুরু করে। কানের নিচ দিয়ে গাল ধরে নেরে ক্রমাগত ডেকে চলছে। কিন্তু মেঘলার কোনো সাড়াশব্দ নেই। কাব্য উদ্বিগ্ন হয়ে মেঘলার হাতের মুখের ময়লা ঝেড়ে দিচ্ছে আর ডেকেই চলছে। তনুও পাশে বসে ডাকছে। তখনই আবির বলে ওঠে,

– পানি! পানির ছিটা দে কাব্য। তনু! পানি আছে না?

তনু সাথে সাথে ব্যাগ থেকে পানি বের করে কাব্যর হাতে দিলো। কিন্তু কাব্য খুলতেই পারছে না। হাত কাঁপছে তার। আবির ব্যাপারটা বুজতে পেরে নিজেই পানি নিয়ে মুখে ছিটা দেওয়া শুরু করলো। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। কাব্যর গলা ভারি হয়ে আসছে। চোখ দিয়ে ভয় ও কষ্ট ঝড়ে পড়ছে। কাব্য অসহায় হয়ে আবিরকে উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে ,

– ওঠছে না কেনো? কি পানি দিচ্ছিস? বেশি করে দে। পানি লাগলে আরো দে। কি লাগবে আন কিন্তু ওকে তাড়াতাড়ি ওঠতে বল। চোখ খুলতে বল। কামন মেঘ! ওপেন ইউর আইস। মেঘ! … সরে যা। ইউ আর অল গুড ফর নাথিং।

বলেই মেঘলাকে কোলে তুলে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। তনু ও আবিরও পেছন পেছন বেড়িয়ে এলো।

#তুই_আমার_কাব্য 🍂
#part: 51

মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতে স্যালাইন ও ক্যনোলা নিয়ে বেডে শুয়ে আছে মেঘলা। বেডের পাশেই চেয়ার টেনে ক্যানোলা লাগানো হাতটা আলতো হাতে ধরে বসে আছে কাব্য। সোফায় রৌশান কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে আর তারপাশেই আবিরও দুইহাত জড়ো করে মুখ ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে মেঘলার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তনু ডাক্তার অর্থাৎ ওর মাকে নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলো। চেকআপ শেষে কাব্যর উদ্দেশ্যে বলে,

– কাব্য চিন্তার তেমন কিছু নেই। সি ইজ ফাইন নাও । প্রথমে…

– ফাইন মানে? ভালো হলে অজ্ঞান হয়ে এতো সময় থাকবে কেনো? অক্সিজেন কেনো লাগছে?

– শেষ করি কথাটা আগে?

– হুম বলুন।

– প্রথমে অক্সিজেন লেগেছিলো। এখন আর লাগবে না। সিসটার এসে খুলে দেবে। শুধু স্যালাইনটা চলবে। ওর ডাষ্ট এর্লাজি জন্য অতিরিক্ত ধুলো থেকে ঠান্ডার মতো লেগে শ্বাসকষ্ট শুরুু হয়েছিলো। শ্বাসকষ্টটা আগে থেকেই আছে জানো হয়তো। তাই অক্সিজেন দিয়েছিলাম রিকোভার দ্রুত করার জন্য। আর অজ্ঞান হয়েছিলো ভয়ে। অতিরিক্ত প্যানিকড হয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। তাই এর জন্য তেমন কোনো ঔষধ দিচ্ছি না। ওর অ্যাজমা ও এলার্জির জন্য মেডিসিন দিয়ে দিয়েছি। নাক ও গাল ফুলে গিয়েছিলো সেটাও কমে আসছে আর সেরেও যাবে চিন্তা করো না। সো নাও বি নরমাল। বাই দা ওয়ে তোমার হাতটা ড্রেসিং করিয়ে নাও। তনু বললো জানালা নাকি দরজা ভাঙ্গতে গিয়ে এমন হয়েছে। জানালায় সম্ভবত মরিচা ছিলো। হাতে এখনো লেগে আছে। ইনজেকশন লাগাতে হবে। তার আগে ড্রেসিং করিয়ে নাও। নার্সকে বলে দিচ্ছি। আমি ইনজেকশনটা নিয়ে আসছি। বসো।

বলেই ডক্টর বেড়িয়ে যেতেই নার্স এসে কাব্যর হাত ড্রেসিং করাতে যাবে তখনই বলে,

– ইটস ওকে। আপনি যান। আমি নিজেই করে নিতে পারবো। ধন্যবাদ। আপনি মেঘলাকে দেখুন। এসব খুলোন যা খুলতে বলেছ। ভালো লাগছে না আমার। অস্বস্তি লাগছে এমন দেখতে। দ্রুত করুন।

নার্সটা দ্রুত খুলে কাব্যর কথা মতো বেড়িয়ে এলো। কাব্য একা একা ড্রেসিং করলেও ব্যন্ডেজ করতে সক্ষম হচ্ছে না। সঠিকভাবে করতে পারছে না এক হাত দিয়ে। রৌশান তা দেখে ওঠে কাব্যর কাছে গিয়ে সাহায্য করতে গিয়ে আবিরের দিকে চোখ পড়ে। আবিরের দৃষ্টি, চাউনি অনেক কিছু বলছে। অভিমান, রাগের চাপে বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, চিন্তা জ্বালানিতে পরিনত হচ্ছে। আবিরের চোখে কষ্ট স্বচ্ছ কাঁচের মতো দৃশ্যমান কিন্তু প্রকাশ করতে নারাজ। রৌশান বুঝতে পেরে হঠাৎই পকেট থেকে ফোনটা বের করে কথা বলার ভঙ্গিতে আবিরকে বলে,

– দোস্ত একটু দ্যখ তো কাব্যকে। আর্জেন্ট কল। প্লিজ।

আবির অপ্রস্তুত হয়ে রৌশানের দিকে তাকিয়ে আছে। কাব্যও আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনেই হয়তো দুজনের বিপরীত প্রতিক্রিয়া আশা করেছে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। আবির ওঠে এসে ভালো করে আরো একবার ড্রেসিং করিয়ে ব্যন্ডেজ করে দিয়ে চলে আসবে তখনই আবারো বক্সটা থেকে একটা নাপা বের করে পানির গ্লাসসহ সামনে ধরে বলে,

– খেয়ে নে এটাও। ব্যাথা থেকে রিলিফ পাবি।

কেবিনে উপস্থিত তনু ও ফোনে কথা বলার অভিনয় করা রৌশান তৃপ্তি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তনু রৌশানের দিকে তাকাতেই রৌশানও তনুর দিকে তাকিয়ে হেসে দুজনেই একসাথে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এইটা বুজতে পেরে দুজনে আবারো একসাথে নিঃশব্দে হেসে ওঠে।

🍁

সকাল দশটা বেজে দশ মিনিট। মেঘলা ও আবিরের বাড়ির সবাই হসপিটালে উপস্থিত। গতকাল ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ার জন্য আর ওঠে নি মেঘলা। এখনো তাই ঘুমোচ্ছে। কাব্য এদিকে রিলিজের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। কারণ হাসপাতালে মেঘলাকে দেখে খুবই অস্বস্তি লাগছে। অদ্ভুত এক যন্ত্রণা। এতো যন্ত্রপাতির মাঝে সহ্যই করছে না মেঘলাকে। সুস্থ আছে শুধু কয়েকদিন রেষ্ট ও মেডিসিন নিলেই স্বাভাবিক হবে সব জেনে রিলিজের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রিলিজের কাগজ নিয়ে কেবিনে ডুকতেই ছোটখাটো জ্যাম অনুভব করলো। বাড়ির মহিলারা একসাথে মেঘলাকে ঘিরে বসে আছে। মেঘলাকে বসে থাকতে দেখে যেনো কাব্যর মনে একটু শান্তি ফিরে এলো। কিন্তু পরক্ষণেই ভ্রু কুচকে বিরক্ত হয়ে একটু জোড়েই বলে ওঠলো,

– তোমরা একসাথে সব কি করো এখানে? তাও আবার এতো কাছে। সরে দাঁড়াও। একটু অক্সিজেন তো যেতে দাও ওর কাছে। সবাই দূরে গিয়ে বসো। অদ্ভুত! এমন ভাব যেনো কোনোদিন দেখো নি যে আজকে এতো কাছ থেকে বসে দেখতে হয়। আম্ম! ভাবি! তোমরা বাসায় যাও এখনি।

বেড থেকে মেহের ওঠে অবাক দৃষ্টিতে বলে ওঠে,

– বাসায় যাবো মানে? আমার বোন অসুস্থ আর তুমি বাসায় যেতে বলছো ভাইয়া?

– হ্যা যেতে বলছি কারণ বাসায় কাজ আছে। আমার রুমটা ভালো করে তুমি নিজ হাতে গুছাবে। আর আম্মু তুমি তোমার হাতের হেল্দি স্যুপ বানিয়ে রাখো। মেঘলাকে নিয়ে ডিরেক্ট বাড়ি যাবো। কাজের লোকদের উপর এতো সেন্সেটিভ বিষয়ে ভরসা করা যায় না। আর তোমরা যতটা যত্ন নিয়ে করবে ওরা করবে না।

কাব্যর কথা শুনে ওর মা ও ওঠে জিজ্ঞাসা করে,

– বাড়ি মানে আমাদের বাড়ি?

– অবশ্যই। আর আমার রুমে। যতদিন না সুস্থ হয় ততদিন ও আমার কাছেই থাকবে। তারপর আবার আমি নিজে দিয়ে যাবো।

মেঘলা তো কাব্যর কথা শুনে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বেশ খুশিও লাগছে। অবশেষে কাব্যর কাছে যাবে। ভাবতেই মন নেচে ওঠছে কিন্তু শরীরে সেই শক্তিটা নেই। তাই মনে মনেই নাচছে। কবে থেকে অপেক্ষা করে ছিলো এইদিনটার জন্য। অবশেষে যেভাবেই হোক না কেনো কাব্যর কাছে যেতে পারছে। মনে মনে রাহির কথা ভেবে হাসিও পাচ্ছে খানিকটা। দূরে রাখতে চেয়েছিলো কিন্তু আরো কাছে এনে দিলো। কাব্যর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসে মনে মনে ভাবে,

– এহ দিয়ে যাবো। বললেই হলো? নিজে তো সারাদিন কিভাবে নজর নজর রাখেন বুঝিই না। তারমধ্য যখন নিজের মন চায় দেখেই উধাও। আমারো যে ইচ্ছা থাকতে পারে সেইটা তো দেখবেনই না। নিজের বেলায় ষোল আনা পূরণ করে আমাকে চার আনাও দেন না। ভালো যেনো শুধু নিজেই বাসে। আমার দিকটা দেখেই না। আমারো যে ওনার কাছে থাকতে ইচ্ছে করে তার কোনো মূল্যই নেই। হুহ! একটাই কথা, পড়াশোনার ক্ষতি হবে তোমার। পড়াশোনার ক্ষ্যতায় আগুন। কিভাবে ফেরত নিয়ে যান আমিও দেখবো। একবার শুধু যাই পারমানেন্টভাবে কিভাবে থাকতে হয় সেটার রাস্তাও হয়ে যাবে। হি হি।…

চলবে……. ❤