তুই যে আমারই পর্ব-৩৬+৩৭

0
4505

#তুই_যে_আমারই
#আঁখি আজমীর নুরা
part 36
হসপিটালে আঁখি আয়াজ দুইজনকেই ওটিতে নিয়ে গেছে। রোজিনা চৌধুরী কাঁদতে কাঁদতে সেন্সসলেস হয়ে গিয়েছে। যার জন্য ডক্টর ওনাকে ঘুমের ইনজেকশন আর স্যালাইন দিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর আঁখির কেবিন থেকে ডক্টর বের হতেই ইফাজ দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে
-আঁখির কি অবস্থা
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো মোটামুটি। তেমন কোনো ইনজুরি হয়নি আল্লাহর রহমতে।
-বেবি ঠিক আছে?
-জ্বি আলহামদুলিল্লাহ মা বাচ্চা ওকে আছে। কথাটা শুনেই যেনো ইফাজ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ওই মূহুর্তে আজিফা ফোন করতেই ইফাজ ফোনটা নিয়ে একটু সাইডে গিয়ে রিসিভ করে…

-হ্যাঁ আজু বলো?
-কই তুমি? রাত ১২টা হতে চললো এখনো তুমি বাসায় ফিরছো না। জানো আমার কতো টেনশন হচ্ছে। কবে বেরিয়েছো, সে খেয়ালকি তোমার আছে?
-আরে আমি একটা জরুরি কাজে আটকে গেছি। আজকে আর ফিরতে পারবোনা। তুমি আম্মুর সাথে ঘুমাও।
-মানে কি এমন জরুরি কাজ শুনি, যে তুমি বাসায় ফিরতে পারবা না।
-আরে আমার এক ফ্রেন্ড একটু হালকা পাতলা এক্সিডেন্ট করেছে। কিছুটা ইনজুরি হয়েছে। আমি হসপিটালাইসট করেছি। এভাবে একা পেলে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি সকালেই বাড়ি ফিরবো। ওকে? আর হ্যাঁ ভুলেও একা ঘুমাবানা। মায়ের সাথে ঘুমাও। আমি আম্মুকে ফোন দিয়ে বলছি যেন আম্মু তোমার সাথে থাকে।
-আচ্ছা। সাবধানে থেকো। আর রাতে খেয়েছো?
-হুম খেয়েছি। আচ্ছা আমি এখন রাখছি। বাই
-হুম বাই।

আসলে ইফাজ আয়াজ আর আঁখির এক্সিডেন্টের কথাটা আজিফা কে জানায়নি। কারণ সে এখন আট মাসের গর্ভবতী। এতো বড়ো নিউজটা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেনা। যা বাচ্চার উপর এফেক্ট পরবে। শেষ সময়ে এসে অনন্তত কোনো অঘটন ঘটাতে চাইনা। পরে নাহয় সব ধীরেসুস্থে জানানো যাবে।

কিন্তু এখন যেনো ভিষণ ভয় করছে। কজ আয়াজের অবস্থা ভালো না। খুব সিরিযাস কন্ডিশন। মাথায় প্রচুর পরিমান ইনজুরি হয়েছে। আল্লাহ আমার ভাইটাকে সুস্থ করে দিয়ে আবার আগের মতো আমাদের বুকে ফিরিয়ে দাও। আঁখির এখনো জ্ঞান ফেরেনি।

পাক্কা ছয় ঘন্টা পর আয়াজের ওটি থেকে ডক্টর বেরিয়েছে। বেরোতেই ইফাজ হাসান রহমান আলতাফ চৌধুরী সবাই দ্রুত পথে হেঁটে ডক্টরের সামনে গেলেন। আলতাফ চৌধুরী জিজ্ঞেস করে উঠলেন
-আআআমার ছেলে! আমার ছেলে কেমন আছে।
……..
-ডক্টর কে চুপ থাকতে দেখে আবারও জিজ্ঞেস করে উঠে, কি হলো কিছু বলছেন না যে। আমার ভাই কেমন আছে জিজ্ঞেস করে উঠে ইফাজ।
-আসলে কি বলবো বুঝতে পারছিনা। উনার শরীর থেকে বেশি মাথায় ইনজুরি হয়েছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কিন্ত?
-কিন্তু কি?
-উনার হয়তো শর্টফর্ম মেমোরিলস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকতে পারে আমরা উনার সিচুয়েশন দেখে যতটা বুঝতে পেরেছি। তবে এটা আশ্বাস দিতে পারি যে উনার হালকা পাতলা মেমোরিলস হলেও এটা সামরিক সময়ের জন্য। ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট আর সেবাযত্ন পেলে উনি খুব দ্রুতই সবকিছু রিকোভার করবে। তবে হ্যাঁ, ভুলেও উনাকে কোনোকিছু মনে করানোর চাপ প্রয়োগ করবেন না। আপনাআপনি ঔষধ ট্রিটমেন্ট নিলে আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

-হাসান রহমান জিজ্ঞেস করে উঠলো জ্ঞান কবে ফিরবে?
-২৪ঘন্টার মধ্যেই ফিরবে। বলেই ডক্টর চলে গেলেন।

আলতাফ চৌধুরী মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালেন।

সকাল হতেই আঁখি জ্ঞান ফিরতেই আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকাই। মাথাটা কেমন যেন ঝিম ধরে আছে। অসম্ভব ভার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কোনো দশ কেজি ওজনের ড্রাম মাথার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। তবুও মাথাটা চেপে ধরে কোনোরকম উঠার ট্রাই করলাম। মেয়ের জ্ঞান ফিরতেই নুরী রহমান দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে আস্তে করে ধরে উঠায়। আঁখি মাথাটা চেপে ধরে আছে। আসলে কি হয়েছে বুঝার ট্রাই করছে। আস্তে আস্তে সব মনে পরতেই বুকটা ছেঁত করে উঠলো। তাই হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠে

-আম্মু আয়াজ! আয়াজ কোথায়? ওর কিছু হয়নিতো। ও ওও ঠঠিক আছেতো। আমাকে আয়াজের কাছে নিয়ে যাও। আঁখিকে এমন উত্তেজিত হতে দেখে ইফাজ এসে আঁখিকে জড়িয়ে ধরে বলল
-বোন আমার আয়াজের কিছু হয়নি। ও ঠিক আছে। তুই আগে শান্ত হ। এই সিচুয়েশনে এতটা হাইপার হতে নেই বোন। বেবিটার কথাতো একটু ভাব। তুই এভাবে ভেঙ্গে পরলে বেবির কি হবে? বেবিকে কিভাবে সামলাবি। ইফাজের কথাতে একটু শান্ত হলেও পরক্ষণেই আবার জিজ্ঞেস করে ওর এখন কি অবস্থা। ঠিক আছেতো। ইফাজ বলে উঠে ঠিক আছে। কিন্তু?
-কিন্তু কি ভাইয়া?
-তারপর ইফাজ সব খুলে বলে। কজ আয়াজের যখন জ্ঞান ফিরে তখন আঁখি যদি গিয়ে দেখে আয়াজের মেমোরিলস হয়েছে তখন ভিষণ হাইপার হয়ে পরবে দুজনে। এতে করেই দুজনেরই ক্ষতি। তাই আগে থেকেই বলে দিয়েছে। যাতে একটু করে হলেও মানসিক ভাবে প্রিপেয়ার হতে পারে।

আঁখি কথাটা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পরে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের বেবির কথা বেবি নিজেকে শান্ত করে। আর মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করে আয়াজের যেনো সুস্থ অবস্থাতেই সেন্স ফিরে আসে। সবকিছু যেনো আগের মতোই থাকে। ডক্টরের সব কথা যেনো মিথ্যে হয়ে যায়।

বিকেলে আয়াজের জ্ঞান ফিরতেই সবাই একে একে দেখতে যায়। সবার সাথে খুব হাসি মুখে কথা বলে। এবং এ ও বলেযে সে এখন অনেকটা বেটার ফিল করছে। সবাই আয়াজকে সুস্থ দেখে খুশি হয় কিন্তু এটা ভাবছে যে ডক্টর যে বলল মেমোরিলস হবে কই সেতো আল্লাহর রহমতে সবাইকে চিনতে পারছে। তাহলে আয়াজ সুস্থ আছে। সবার শেষে আঁখি যায় আয়াজের সাথে দেখে করতে। আয়াজ আঁখিকে দেখে একটা মুচকি হাসি দেয়।
তারপর বলল আরে আঁখি আয়, এদিকে বস।

আর তোর এভাবে হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ কেন?
-কেন আম্মু আপনাকে কিছু বলনি।
-বলেছেতো। বলল তুই আর আমি ঘুরতে গিয়েছিলাম। আসার পথে এক্সিডেন্ট করেছি। জানিনা কেন যেন কিছুই মনে করতে পারছিনা। কিন্তু আম্মুরা বলল তুই ঠিক আছিস। বাট দেখছি উল্টো। অনেকটাই ছিলে গেছে তোর।

-আঁখি মুগ্ধ নয়নে আয়াজকে দেখছে। যেনো কতবছর দেখছে।
-আঁখি!
-আয়াজের ডাকে আঁখির হুস ফিরে আসে।
-হুম?
-কেমন আছিস?
-এইতো ভালো।
-তো তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?
-মানে?
-মানে আবার কি?
-আপনি জানেননা।
-কি জানবো। আর তুই এমন বিবাহিত মহিলাদের মতো ব্যাস ধরে আছিস কেন?
-তোমার কি কিছু মনে পরছেনা?
-কি মনে পরবেনা আমার?
-মানে আমি তোমার কে হয়?
-আজিব মেয়েতো! তুই আমার খালাতোবোন সেটা আবার ভোলার সম্পর্ক নাকি? পাগলের মতো প্রলাপ করিস।
-ওহহ
-হুম। তুই এখন যা আর আম্মুকে পাঠাতো একটু।

এতক্ষণে দরজার আড়ালে সবাই সবকিছু শুনছিলো আর দেখছিলো। আসলে আয়াজ আঁখির সাথে কেমন রিয়েক্ট করে তা দেখার জন্য। এখন যেন বিষয়টা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। আঁখি বের হতেই রোজিনা চৌধুরী ভিতরে যান। আর এই ফাঁকে ইফাজ ডক্টরের কাছে যায়। আর বিষয়টা ক্লিয়ার বলে। তখন ডক্টর বলে উঠে

-আমিতো আপনাদের বলেছিলামই। আর এটা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। মেডিসিন নিলেই হবে। আস্তে আস্তে সব আগের মতো হয়ে যাবে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানান যে মাথার উপর এতো ধকল যাওয়ার পরও উনি সুস্থ আছেন সেটা। এমন কেইসে বেশিরভাগই মানুষের মৃত্যু ঘটে।
-জ্বি। আজ তাহলে উঠি।

আঁখি বের হয়ে আরিফাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। আরিপু কেন উনার সাথে এমন হলো? উনার কি আমাদের বিয়ের কথাও মনে নেই? কিভাবে নিজের বেবিটাকেও ভুলে যেতে পারলো। আমি যে উনার অবহেলা মেনে নিতে পারবো না। আপুরে আমার যে অনেক কষ্ট হচ্ছে। উনি কি আমার কষ্ট অনুভব করতে পারছেনা।

-প্লিজ পাখিটা এভাবে কাঁদিসনা। তুই ভেঙে পরলে বেবিটার কি হবে। অন্তত বাচ্চার জন্য হলেও শক্ত থাকতে হবে তোকে। তুই লুজার হয়ে পরলে বাচ্চার উপর এফেক্ট আসবে। আর ডক্টর তো বলল সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এমনতো না যে আয়াজ আর কখনো সুস্থ হবেনা সেটাতো বলেনি আর। সো প্লিজ এভাবে ভেঙে পরিসনা।
-হুমম আপু। দুহাতে চোখের পানি মুছে বলল ঠিক বলেছো। আমি আমার বেবির কিচ্ছু হতে দিবো না।
-আরিফা অবাক নয়নে দেখছে কতটা বুঝদার হয়ে গেলো মেয়েটা। যে মেয়েকিনা নিজেই একটা বাচ্চা সে কিনা আরেকটা বাচ্চার চিন্তা করছে। আসলেই মা শব্দ দেখে যতটা সহজ আসলে ততটা কাঠিন্যে ভরা এর রহস্যটা। যার কোনো সমাধান নেই। আছে শুধু অনুভুতি। একমাত্রই সেই অনুভব করতে পারে যে এই মা হওয়ার স্বাদটা গ্রহণ করেছে।
চলবে

#তুই_যে_আমারই
#আঁখি আজমীর নুরা
part 37
পরেরদিন ইফতি আসে আয়াজকে দেখার জন্য। ইফতি আয়াজের কেবিনে ঢুকে আয়াজকে দেখে জিজ্ঞেস করে উঠে
-কেমন আছো ভাইয়া তুমি?
-এইতো ভালো। কিন্তু তোমাকেতো ঠিক চিন্তে পারলাম না।
-আমাকে চিনতে পারছোনা?
-আমি তোমার ফুফাতো বোন। ইফাজ ভাইয়ার বোন। আর তুমি কিনা আমাকে চিন্তে পারছোনা।
-মানে কি? উফফ কি হচ্ছে এসব। খালি সবাই এসে আমাকে চিন্তে পারছো চিনছো না আমি তোমার অমুখ আমি তোমার তমুখ। কিন্তু আমার কি হয়েছে? আমি সবকিছু মনে করতে পারছিনা কেন? উফফ বলেই মাথাটা চেপে ধরে। তখনই ইফাজ দৌড়ে এসে আয়াজকে সামলায়।
-ইফতি তুই এখন এখান থেকে যা। আর আয়াজ এভাবে মাথায় প্রেশার নিসনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে বেশি আঘাত পেয়েছিসতো তাই এমন হচ্ছে। কয়েকদিন গেলেই সুস্থ হয়ে যাবি। ইফতি আবালের মতো ওদের দিকে চেয়ে আছে। আসলে কি হচ্ছে এসব সেটাই বোঝার ট্রাই করছে। ইফাজ আবার চোখ রাঙ্গানি দিতেই ইফতি সুরসুর করে বের হয়ে গেলো।

তারপর আয়াজকে রেস্ট করতে বলে ইফতির কাছে গেলো। এবং পুরো বিষয়টা খুলে বলল। আর এটাও বলল যেনো প্রেশার না দেয় কেউ।
বেশকিছুদিন পর আয়াজকে রিলিজ দেওয়া হয়। এরমধ্যে আঁখি আর একেবারের জন্যেও আয়াজের মুখোমুখি হয়নি। শুধু দূর থেকে চেয়ে গেছে। কজ সে যদি আয়াজের সামনে যায় নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেনা। এইজন্যই দূরে দূরে থাকে। বাসায় আনার পর আঁখি আয়াজের সেবার কোনো কমতি রাখেনি। কিন্তু আয়াজের সাথে আর একসাথে একরুমে ঘুমোতো না। অন্যরুমে থাকতো।

প্রায় এরমধ্যে দুইমাস কেটে যায়। আঁখির প্রেগন্যান্সির দিনদিন খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে। কজ আয়াজের অযত্নের কোনোকিছুই কম রাখছেনা। কিন্তু নিজের শরীরের কোনো খোঁজ নেই। রোজিনা চৌধুরী বলে বলে কতখানিই বা করবে। যদিনা নিজে কেয়ারফুল না থাকে। ওজন একেবারে ৪০ এ নেমে গেছে। ডক্টর এসে স্যালাইন দিয়ে গেছে। আয়াজ আঁখিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে নোটিশ করছে। মেয়েটা যেনো কেমন বড়দের মতো হয়ে গেছে। কেন জানি মেয়েটার জন্য তার অনেক টানে? কিন্তু কেন? আর মেয়েরার পেটটা এমন ফুলে আছে কেন? কি হয়েছে? সবাই যেতেই আয়াজ রোজিনা চৌধুরী কে ডেকে উঠলো..

-আম্মু!
-কি হয়েছে বাবা?
-আঁখির কি হয়েছে আমাকে একটু বলবা? কেন জানি মনে হচ্ছে তোমরা সবাই আমার থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছ?
-ককই কি লুকাবো?
-তাহলে মেয়েটার পেটটা কেমন যেন ফুলে রয়েছে।
-রোজিনা চৌধুরী যেনো ভয় পেয়ে গেলেন? যেটা মনে মনে এতোদিন ভয় পেয়ে এসেছে সেটাই যেনো এখন সত্যি হতে যাচ্ছে। আরে ও কিছুনা। মেবি কৃমির প্রবলেম হবে। ডক্টর এসে তো দেখেই গেলো। দেখবি কয়েকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। বলেই রোজিনা চৌধুরী বাহানা দিয়ে ওখান থেকে কোনোরকম খেটে পরলো।

আর রুমে এসে ভাবতে লাগলো। নাহ মেয়েটাকে এভাবে আর রাখা যাবেনা এখানে। কিছু একটা করতে হবে। হুম পেয়েছি। বেবি হওয়া অবদি আঁখিকে নুরী রহমানের কাছে পাঠিয়ে দিবেন। নয়তো ছেলেমেয়ে দুইটারই ক্ষতি। হুম কালকেই আঁখিকে পাঠিয়ে দিবে।

এদিকে মা যাওয়ার পর আয়াজ আঁখির সামনে বসে আঁখিকে এক নয়নে তাকিয়ে আছে। বড্ড মায়া হচ্ছে। কেমন যেনো রোগা হয়ে গিয়েছে। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল। শুকিয়ে যাওয়ায় গলার নিচে হাড়গুলো যেনো দেখে মনে হচ্ছে এইনা বেড়িয়ে আসবে। নিজের অজান্তেই আঁখির কপালে একটা চুমু এঁকে দেয়।

তারপর রুম থেকে বের হয়ে যায়। ইজি চেয়ারে বসে চিন্তা করতে থাকে। তার কাছে কি যেনো নেই। বুকের মধ্যে সবসময় একটা শূন্যতা অনুভব করে।

পরেরদিন
সকাল হতেই রোজিনা চৌধুরী আঁখিকে ড্রাইভার কে দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। যাওয়ার সময় আঁখি অসম্ভব কান্না করে। কজ তার একটাই কথা সে আয়াজকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা। এখানে থাকলে অন্তত সে আয়াজকে কাছে না পাক চোখের দেখাতো দেখতে পাচ্ছে। রোজিনা চৌধুরী মনের অবস্থা ঠিকি বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কি করবে সেও যে অসহায়। ছেলেমেয়ে দুটোকে ভালোর জন্যইতো তিনি এমন করছেন। বলতে গেলে এক প্রকার জোড় করে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

বিকেলে আয়াজ বাসায় ফিরতেই আঁখিকে কোথাও দেখতে পাইনা। তাই রোজিনা চৌধুরী কে জিজ্ঞেস করে
-আম্মু আঁখি কোথায়। ওকে কোথাও দেখছিনা যে?
-আরে বলিসনা মেয়েটার নাকি বাড়ির সবার জন্য মন খারাপ হচ্ছে তাই আমাকে সকাল থেকে বারবার করে বলছে বাড়ি যাওয়ার জন্য। আমিও আর না করতে পারিনি।
-ওহহহ
বলেই আয়াজ উপরে উঠে চলে যায়।

এদিকে আঁখি রুমের দরজা অফ করে অজোর ধারায় কাঁদতে থাকে। কেন আয়াজ? কেন আমাদের ভালোবাসাটা ভুলে গেলেন? আমার কথাকি একটি বারের জন্য ও আপনার মনে পরেনা। কি করে ছোট বেলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথাগুলোও ভুলে গেলেন। বলছে আর কাঁদছে।

এভাবে আরো দুইদিন কেটে যায়। আয়াজের যেনো আজকাল কিছুই ভালো লাগেনা। বারবার মনে হয় কি যেনো নেই তার কাছে।কিন্তু কি সেটা যেনো সে বুঝতেই পারেনা। বাসাটা কেমন যেনো ফাঁকাফাঁকা হয়ে আছে। দিন এভাবেই চলতে থাকে। দুটি মানুষ দুই প্রান্তে। কিন্তু কারো মনেই যেনো সুখ নেই।

আঁখি তার পেটে হাত দিয়ে বলে। বাবা তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়। আম্মুর কষ্ট কি তোর চোখে পড়ছে না। তুই চলে আয় দেখবি তোর মার সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে। তোর বাবাটা না খুব পঁচা। তোর বাবা তোকে ভুলে গিয়েছে। তুই চলে আয় তারপর তুই আর আমি মিলে দুইজনেই তোর বাবা কে পানিশমেন্ট দিবো। বাবাইর উপর অনেক অভিমান হয়েছে তোর তাইনা? আমারও হয়েছে। এই যে এত্তোগুলো।

আঁখির এখন প্রেগ্ন্যানসির সাত মাস চলছে। বাড়িতে এসেছে এখন প্রায় তিনমাস হতে চললো। তবে আঁখি ফোন করে প্রত্যেকদিন আয়াজের খবর নেয়। এবং এটাও জানতে পারছে যে আয়াজ আগের থেকে অনেকটা রিকোভার করছে। খুব দ্রুতই নাকি সুস্থ হয়ে উঠবে বলে ডক্টর আশ্বাস দিয়েছেন। কথাটা শুনেই আঁখির মনে আশার প্রদীপ জ্বেলে উঠে। আবার সে তার পুরোনো আয়াজকে ফিরে পাবে। খুব শীঘ্রই।

রাতে নুরী রহমান খাবার নিয়ে আঁখির রুমে আসে। এসেই দেখে রুমের লাইট অফ করে শুয়ে আছে। লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। তারপর খাবারের জন্য ডাকতে থাকে।
-ওহ আম্মু তুমি!
-হ্যাঁ। খাবিনা?
-নাহ আম্মু খেতে ইচ্ছে করছে না।
-এমন করলে হবে? আমার নাতিটার কথাতো একবার ভাব। ওতো সম্পূর্ণ তোর উপর ডিপেন্ডেট। তুই না খেলে বাচ্চাটার কি সিচুয়েশন হবে ভাবছিস? এমনিতেই তোর প্রেগন্যান্সিতে অনেক কম্পলিকেট। আর এভাবে না খেলেতো আরো দূর্বল হয়ে পরবি। বলেই ভাত মেখে খাইয়ে দিতে থাকে। কিন্তু অল্প খেতেই আর যেনো পারছেই না। সাথে সাথেই বমি করেই ভাসিয়ে দেয়। নুরী রহমান কোনোরকম ফ্রেশ করিয়ে মেডিসিন খাইয়ে দেয়। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগে। আঁখির চোখেও যেনো রাজ্যের ঘুম এসে ভর করে।

এদিকে আয়াজের আজকেও আরো একটি নির্ঘুম রাত খাটছে। আঁখির জন্য ভিষণ মন পুড়ছে। মেয়েটা আশেপাশে থাকলেই যেনো মনে একটা শান্তি অনুভব করতো। মেয়েটা যাওয়ার পর থেকে মনের ভিতর কেমন যেনো অস্থির অস্থির ফিল হয়। আচ্ছা ও কেমন আছে? ভালো আছেতো? কালকে গিয়ে একটু দেখে আসবো। এভাবেই সারারাত ছটপটাতে ছটপটাতে কেটে যায়।

সকালবেলা রেডি হয়ে নাস্তা করেই আঁখিদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মনের ভিতর কেমন তৃপ্ততা ফিল হচ্ছে। আঁখিদের বাড়ির সামনে এসেই দরজায় বেল বাজালো। আঁখি ড্রইংরুমে বসে ছিলো। বেলের আওয়াজ শুনতেই দরজাটা খুলতেই সেই চির চেনা মুখকানি দেখেই মনটা স্বস্তিতে ভরে উঠলো। আজকে কতোদিন পর ভালোবাসার মানুষটাকে দেখলো। একনজরে চেয়ে আছি। আয়াজও অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। কেমন ঢিলাঢালা পোষাক পরে আছে। চেহেরায় নেই কোনো লাবণ্যতা। চোখের নিচে কালিগুলো বলে দিচ্ছে ভালো নেয়। একটু ভালো করেই লক্ষ্য করতেই রাগেই যেনো কপালের রগ ফুলে উঠলো। তাই আঁখি কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে নুরী রহমানকে চিল্লাতে লাগে।

আঁখি পাশে দরজাটা চেপে ধরেই কোনোরকম নিজের ব্যালেন্স রাখে। তারপর আয়াজের উদ্দেশ্য করে বলে
-আপনি আমাকে এভাবে ধাক্কা দিয়েছেন কেন? আর এইভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছেন কেন?
-চেঁচানো? মাই ফুট। তার আগে তুই বল পেটে এটা কার বাচ্চা নিয়ে ঘুরছিস? এই জন্য নিজেকে আড়াল করার জন্য ও বাড়ী থেকে পালিয়ে এসে এখানে লুকিয়ে আছিস। কার পাপের ফল পেটে ধরেছিস?

পিছন থেকে নুরী রহমান চিৎকার করে বলে উঠে
– আয়াজজজ! মুখ সামলে কথা বলো। যেটা জানোনা সেটা নিয়ে কথা বলবে না।
-কেন ছোট আন্টি কেন? অন্য কারো নোংরামির ফসল তোমার মেয়ে বয়ে বেড়াতে পারছে। আর আমি বললেই দোষ।
আঁখি যেনো আর সহ্যই করতে পারছে না। দৌড়ে ওখান থেকে রুমে চলে যায়। আর দরজা আটকে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কাঁদতে থাকে।
-ইয়া আল্লাহ এটা শোনার আগে আমার মৃত্যু হলোনা কেন? শেষে কিনা নিজের স্বামীর মুখেই নিজের সন্তানকেই এতো জগন্য অপবাদ দিচ্ছে।

আঁখিকে দৌড়ে এভাবে রুমের দিকে যেতে দেখে পিছন পিছন নুরী রহমানও দৌড়ে আসেন। এবং দরজা ধাক্কাতে থাকে।

আয়াজও রাগ নিয়ে ওখান থেকে বের হয়ে যায়। বাসায় এসেই রুমের ভিতর ভাংচুর করতে থাকে। কেন তার এতো রাগ হচ্ছে। কেন আঁখিকে ওভাবে দেখে এমন রিয়েক্ট করলো সে? কেন? কেন? আহহহহ বলেই ফ্লাওয়ার ভাসটা ছুড়ে মারে।
চলবে