তুই যে আমারই পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
6313

#তুই_যে_আমারই
#আঁখি আজমীর নুরা
Last পারত

হসপিটাল থেকে এক সপ্তাহ পর রিলিজ দেওয়া হয়। বাসায় আসার পর আয়াজ আঁখির অনেক যত্ন নিচ্ছে। যেহেতু সিজার তাই আয়াজ অনেক কেয়ারফুলি চলছে। খাওয়া দাওয়া গোসল সবকিছুই আয়াজ নিজেই করছে।
দুইদিন পর
আয়াজ আর আঁখির মেয়ের আকিকা দিচ্ছে। অনেক বড়ই করছে। বিশাল মানুষের খাওয়া দাওয়া। আয়াজ আর ইফাজকেই সবকিছু সামলাতে হচ্ছে। আয়াজের মেয়ের নাম তায়্যিরাত চৌধুরী আয়াত রেখেছে। আয়াত নামটা আয়াজের দেওয়া। বাকিটা আলতাফ চৌধুরীর পছন্দের। বেশ জমকালো ভাবেই আয়াতের আকিকা পালন করা হয়।

রাতে
সারাদিন আয়াজের উপর অনেক ধকল গিয়েছে। তাই ফ্রেশ বিছানায় গাঁ টা একটু এলিয়ে দেয়। নিচে আঁখি আজিফাদের সাথে গল্প করছে। আয়াতকে রোজিনা চৌধুরী কোলে নিয়ে আলতাফ চৌধুরীর সাথে ঝগড়া করছে। রোজিনা চৌধুরী বলছেন নাতনি তার মতো হয়েছে দেখতে বড় হলে আয়াতকে তার মতোই বানাবেন আর আলতাফ চৌধুরী বলছেন বড়ো হয়ে তার দাদায়ের মতো হবে। এই নিয়ে দাদায় দীদুনের মধ্যে খুনসুটি চলছে। এদের ঝগড়ার মাঝেই আয়াত ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠলো।
-ওলে আমার দাদু ভাই। কাঁদেনা কাঁদেনা এই যে দাদায় দীদুন আর ঝগড়া করছিনা। ওওওওও। কিন্তু কান্না যেনো থামছেইনা। রোজিনা চৌধুরী বুঝলেন নাতনির ক্ষিদে পেয়েছে। তাই আর দেরি না করে নাতনিকে নিয়ে আঁখির কাছে চলে গেলো।

-মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতেই আঁখি গল্প থেকে উঠে দাঁড়ালো দেখলাম মামনি আসছে।
-কি হয়েছে মামনি। কাঁদছে কেন?
-ক্ষিদে পেয়েছে আমার নাতনির। এইটুকুন বাচ্চা কখন বিকেলে কি খেয়েছে। নিয়ে যা খেতে দে আমার বোনটাকে।
-আঁখিও আলতো হাতে মেয়েকে কোলে নেয়। অনেক ভয়ে ভয়ে নেয়। এতো ছোট বাবু নিতে গেলেই মনে হয় এই বুঝি ব্যথা পেলো। আর তাছাড়া আঁখি খুব একটা নেয়না। সারাক্ষণ দাদীর কাছেই থাকে। আর নিবেই বা কি করে। সে নিজেইতো একটা বাচ্চা। সে নাকি কোলে নিবে আবার আরেকটা বাচ্চা।

রোজিনা চৌধুরী খুব সাবধানে আঁখিকে কোলে তুলে দিলো।
-এই যে কাঁদেনা মা। মাম্মাম এসে গেছিতো। বলেই আয়াতকে নিয়ে উপরে চলে এলো। এসেই দেখলো আয়াজ সটান হয়ে শুয়ে আছে। আঁখিকে আসতে দেখে আয়াজ উঠে বসলো। আয়াজের পাশেই আঁখি গিয়ে বসলো। কিন্তু এবার পড়লো মহা বিপদে। বাবুকে কিভাবে রাখবে কেমনে শোয়াবে কেমনে খাওয়াবে কিছুই বুঝতে পারছেনা।

আঁখির কান্ড দেখে আয়াজের মাথায় হাত।
-ও মোর খোদা! আল্লাহ আর মানুষ পাইলোনা তোরেই বেবি দেওয়া লাগলো। এখনো একটা বাচ্চা কোলে নিতে পারেনা সে নাকি মা?
-আয়াজের কথা শুনে আঁখি মুখ ফুলিয়ে বলল। এহহ বললেই হলো? না নিতে পারলে এতোদিন কিভাবে সামলালাম। আসছে বাচ্চা কোলে নিতে পারেনা [গালকে ভেটকিয়ে বিরবির করে বলল]
– ওহ তাই নাকি? এতোদিন বুঝি আপনি সামলিয়েছেন? তা ম্যাডাম বাবুর কয়টা কাজ করেছেন শুনি? ভালোভাবে তো এখনো আমার মেয়ের একটা নেপিও পরিষ্কার করতে পারেননা। এবড়োতেবড়ো করে ফেলেন। পরিষ্কারের পরিবর্তে আরো বেশি অপরিষ্কার করে ফেলেন। শেষে সবকিছু আমাকে করতেই হয়। আর গোসলতো আম্মুই করাই। প্রায় এক কথায় বলতে গেলে বাবুর ৮০% কাজ আম্মুই করে আর বাকিটা আমি।
-কি সাংঘাতিক কথা? আমি নাকি কিছু করিনা। আপনিতো দেখি মহা মিথ্যুক!
-ও এখন আমি মিথ্যুক হয়ে গেলাম? বুকের দুধটাও তো এখনো ঠিকঠাক ভাবে খাওয়াতে পারিসনা। চৌদ্দবার আমাকে ঠিক করে দিতে হয়।
-বজ্জাত আপনি মহা বজ্জাত। উগান্ডার ডাইনাসোর একটা নাক মুখ ফুলিয়ে বলল।
-তাই নাকি? তো এতোই যখন পারিস, আম্মু তোকে যে এঙ্গেলে আমার মেয়েকে কোলে দিয়েছে এখনোতো সেই এঙ্গেলেই বসে আছিস। না পারছিস নড়তে না পরছিস চরতে। এখনো আমার বাচ্চাকে খাবার দিতে পেরেছিস।
আঁখি যেনো এবার কেঁদে দিবে দিবে অবস্থা। বেচারারইবা কি দোষ? কখনো এতো ছোট বাবু কোলে নিয়েছে। আর সব থেকে বড়ো আয়াত আরো স্বাভাবিক বাচ্চার চেয়ে অনেকটায় হ্যাংলা। বেচারি নেওয়ার আগে ভয়ে মনে মনে একশো বার ফিট হয়। আর তাছাড়া আঁখি নিজেওতো ছেট একটা বাচ্চা কিশোরী ।

আয়াজ আঁখির সিচুয়েশন দেখে মিটিমিটি হাসছে। বেচারিকে ভালোই জব্দ করতে পেরেছে। আয়াজক আর কিছু না বলে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে নেয়। কি হলো আমার দিকে কি এখন ডেবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকবি। বাবুকে খাওয়াতে হবেনা? নাকি সেটাও আমি করতাম? আয়াজের মুখে এমন কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো। দ্রুত নিজেকে ঠিক করে নিলাম। দেন আয়াজ ঠিকঠাক পজিশনে মেয়েকে কোলে দেয়।
-নে এবার চুপচাপ খাওয়া। কোনো কথা বলবিনা। আজকে যদি বাবুর কাশি উঠেছেতো পিটুনি খাবি।

আসলে আঁখি বাবুকে খাওয়ানোর সময় আয়াজের সাথে হাবিজাবি বকবক করে। বাবু খাচ্ছেনা কেন, সুড়সুড়ি লাগে, আয়াজ মনে হচ্ছে বাবু এখন হিসু করে দিবে, বাবু মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে, একটু জোরে শ্বাস নিলেই আয়াজ দেখেন দেখেন বাবু কত্তো জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে এসব হাবিজাবি বলতে থাকে যার কোনো লজিক নাই। আর এসব বলবেতো বলবে কোনোদিকে হুঁশ থাকবে না। হাত কোনদিকে যায় বাবু কোনদিকে যায় কোনো খবর নাই। বাবুকে খাওয়াতে গেলেই এতো নড়াচড়া করবে যার কারণে যতবার বাবুকে দুধ পান করাবে ততবারই বাচ্চার কাশি উঠে যায়।

আঁখি মুখটাকে বাংলার সাতের মতো করে খাওয়াতে থাকে। আয়াজ দেখছে তার প্রিয়তমাকে। কেমন বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে আছে ভিষণ হাসি পাচ্ছে আয়াজের। পুরাই বাচ্চা।
আঁখি মুখ তুলে আয়াজকে কিছু একটা বলতে নিবে তখনি আয়াজ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকতে বলে।
-আঁখি আবার হতাশ হয়ে চুপ হয়ে যায়। মনে মনে বলছে এভাবে চুপচাপ বসে থাকা যায়। ধুর বাবা। তারচেয়ে ভালো একটু মোবাইল গুতায়। বাবুনিরও ডিস্টার্ব হলোনা। সে তার মতো খেতে থাকুক আমি আমার মতো ফোন চালিয়ে সময় কাটায়। এই ভেবে খাঁটের পাশ থেকে মোবাইল নিতে যায়। এদিকে যে মোবাইল নিতে গিয়ে বাবুর কোনো অসুবিধে ওতো হতে পারে তার কোনো জ্ঞান নেয়। ঠিক তাই হলো।
-এই এই কি করছিস। আয়াজ তাড়াতাড়ি বাবুকে ধরে। মনতো চাচ্ছে থাপড়িয়ে গালের চাপাটি ফাটিয়ে দিতে। ফাযিল মেয়ে। এমনটা কেউ করে? হ্যাঁ? ধমকে বলে উঠে আয়াজ।
-আআআমিতো ফোন…..
-গুষ্টি কিলায় তোর ফোনের। যতক্ষণ খাওয়াবি ততক্ষণ ফুল ফোকাস আমার বাচ্চার উপর রাখবি। বাচ্চার কিছুতো পারিসনা। সব আমাকেই সামলাতে হয়। যা একটা কাজ, খাওয়াতে যাস সেটাও পারিসনা। মাইর লাগাবো আমার মেয়ের যদি কিছু হয়। সবকানেই তার বদমাইশি করতে হবে।
আর তাই যতক্ষণ আঁখি এভাবে বাচ্চাকে খাওয়াবে ততক্ষণ আয়াজকে সামনে বসে থাকতে হয়। নয়তো বুঝতেই তো পারছেন।

আয়াত ঘুমিয়ে পরতেই আয়াজ আস্তে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। সাইড বালিস দিয়ে বাবুকে ঠিক করে দেয়। এরপর আঁখি মেয়েকে কপালে আর গালে চুমু এঁকে দেয়। তখনই আয়াজ বলে উঠে..
-ইসস দেখো এখন কত্তো আদর মেয়ের জন্য। খাওয়ানোর সময় মনে থাকেনা?
আঁখি মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। আয়াজ নিচে গিয়ে রাতের খাবার নিয়ে আসে। এসেই দেখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আয়াতের গায়ে খুবই আলতো আলতো হাতে চাপড় দিচ্ছে।
-মেয়ে ঘুমিয়েছে। আপনি এবার আসেন। আপনার খাওয়ার সময় হয়েছে।
-খাবারের কথা শুনে আঁখি নাক মুখ কুঁচকে তাকালো আয়াজের দিকে।
-কোনো লাভ নেই এভাবে তাকিয়ে। খেতে হবে। আর এখন আপনি একা নন। আমার বাচ্চার খাবার কিন্তু আপানার শরীরেই তৈরী হবে। সো এসব নাক ছিটকানো মুখ ছিটকানো বন্ধ করেন। এখনো আঁখিকে আসতে দেখছেনা দেখে আয়াজ আবার বলে উঠলো..
-এখন কি কান ধরে গিয়ে আনতে হবে নাকি। আঁখি গালটাকে দুইকেজি ওজন করে ফুলিয়ে আয়াজের সামনে গিয়ে ধপ করে বসে পরলো।
-আস্তে! সেলায় এখনো প্রোপার্লি শুকায়নি..
-আঁখি কোনো কথায় বলেনি।
আয়াজ ভাত মেখে আঁখিকে খাওয়াতে লাগে। খাওয়ানোর এক পর্যায়ে আঁখি বলে উঠলো
-এতো সবজি কেন দেন।
– শরীরের ওজনের খেয়ালকি আছে। কি হাল করেছিস একটিবার আয়নায় গিয়ে দেখে আয়তো।
-উমমমমম
-চুপ! হা কর। চুপচাপ গিলতে থাক। আয়াজ আঁখিকে খাইয়ে শেষ করে মেডিসিন খাইয়ে দেয়। এবার দুধের গ্লাস হাতে নিতেই আঁখি উঠে পালাতে নিবে অমনি আয়াজ হাতটা চেপে ধরে বসিয়ে দিলো। আঁখি কিছু বলতে নিবে কিন্তু আয়াজ এমন চোখ রাঙ্গানি দিলো ভয়ে কিছু বলবতো দূরে থাক ভিতরের আত্মাটা সহ কেঁপে ওঠেছে। সুরসুর করে আর কোনো কথা না বলে খেয়ে নিলাম। আমাকে খাইয়ে আয়াজ নিজের খাবারটাও শেষ করলো।

রুমের সবকিছু গুছিয়ে শুতে যাবো দেখলাম মহারানি গাল ফুলিয়ে বসে আছেন। তাই আস্তে আস্তে গিয়ে আঁখির পাশে বসলাম। আমাকে বসতে দেখে আঁখি উঠে চলে যেতে নেয় অমনি আমি টান দিয়ে কোলের উপর বসিয়ে দিলাম। আর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। মুখটা আঁখির গলার খাঁজে ডুবিয়ে দিয়ে আলতো আলতো চুমু দিলাম।
-উফফ ছাড়ুন।
-উঁহুম বলেই আরো ডিপলি চুমু খেতে লাগলাম। চলছে মান ভাঙ্গানো হাজারো খুনসুটি।

সকালে আয়াজ আঁখিকে নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। কলেজে ভর্তির ডেট চলছে। তাই এডমিশন করাতে গিয়েছে। এডমিশন করিয়ে এসে আঁখি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিলো। আঁখি জামা কাপড় গুছাচ্ছে আর আয়াজ মেয়েকে নিয়ে বসলো।
-কি করে আমার মা টা। আজকে দীদুনের সাথে কেমন কেটেছে। হুম? বলছে গালের উপর নাক ঘষে দিয়ে আদর করে দিচ্ছে।
-আয়াত আও আও করে সাউন্ড করছে।
-আয়াজ আলতো করে মেয়েকে কোলে নিয়ে নিলো। মেয়ের সাথে হাজারো কথার রাজ্য খুলে বসেছে।

বিকেলে আঁখি আয়াজের জন্য সহ কফি নিয়ে বারান্দায় গেলো। আয়াত তখন দাদা দীদুনের কাছে ছিলো।
-আয়াজ আঁখির হাত থেকে কফিটা নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল
-বাহ্ কফিটাতো ভালোই হয়েছে। কে বানিয়েছে।
-আমি ছাড়া বউ আরেকটা আছে নাকি যে বানিয়ে দিবে।
-এই তোদের মেয়েদের না একটায় প্রবলেম। কোনোকিছু সোজাসাপটা আনসার দিবিনা। সবকিছুতে জিলাপির পেঁচ বাঁধাতে হবে। হোক সেটা ছোট বিষয় বা বড়ো বিষয়।
-ভালো হয়েছে। বলেই চলে যেতে নিবো আয়াজ আমাকে টান দিয়ে কোলের উপর বসিয়ে দিলো।
-কই যাওয়া হচ্ছে? হুম?
-জাহান্নামে!
-ওলে আমাল পিচ্চিটা।
-কচু।

-জানিস! আজ আমি পূর্ণ। আর কোনো কালোছায়া আমি আসতে দিবোনা। শুধু বিনিময়ে তুই আমার পাশে থাকলেই হবে। সারাটি জীবন।
-হুম থাকবো। আপনিতো আমার সব।
-ছেড়ে যাবিনাতো?
– কখনোনা। আপনাকে ছেড়ে আমি কইবা যাবো?
-আর যেতেও পারবিনা। কারণ তোকে আমার ভালোবাসার শিকলে বেঁধে রেখেছি। চাইলেও তুই এটা কখনো ছিঁড়তে পারবিনা, #তুই_যে_আমারই….শুধুই আমার।
-আল্লাহ ছাড়া আর কেউ আমাকে আপনার থেকে আলাদা করতে পারবেনা। অনেক ভালোবাসি আপনাকে।
-আই লাভ ইউ টুু পুচকুটা বলেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আঁখিকে।
-আঁখি ও পরম শান্তিতে আয়াজের বুকে মাথা রাখলো

সমাপ্ত