তুমিময় অসুখ ২ পর্ব-০৬

0
2454

#তুমিময়_অসুখ ২
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬

১৪.
অভ্রে’র বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছে ইরাম?’

‘ ওর খাওয়াদাওয়া অনিয়মিত, তার উপর প্রচুর টেনশন করে। স্ট্রেস নিচ্ছে প্রচুর। এটা এ সময়ে ভালো লক্ষণ নয়।’

ইরামের বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ এ সময়ে মানে?’

ডাক্তার বললেন, ‘ আপনারা দু’জন আমার কেবিনে আসুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার মেয়ের জ্ঞান ফিরবে।’

বলে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন। ইরামের বাবা ওর মাথায় হাত বুলালেন। তারপর অভ্রে’র বাবার সাথে ডাক্তারের পিছু পিছু গেলেন। হসপিটালের করিডোরে অভ্র, ওর মা, ইরামের মা দাঁড়িয়ে আছেন। অভ্রে’র চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছেনা কিছু, কাঠ হয়ে বসে রইলো!

ডাক্তার তাঁর বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসলো। অভ্র আর ইরামের বাবা সামনের নরম গদিওয়ালা চেয়ারে বসলো। ডাক্তার বললেন, ‘ মেয়েটা প্রচুর টেনশন নিচ্ছে। তাছাড়া অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি।’

‘ আঠারো তো হয়েছে!’

‘ আঠারো হলেই তো আর হয়না। একটা মেয়েকে শারীরিক ও মানসিকভাবে স্ট্রং থাকতে হয়। নাহলে প্রচুর সমস্যা হয়। আর যেহেতু আপনার মেয়ে কনসিভ করে ফেলেছে, আমার মনে হয় ওর বেলায় ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে!’

অভ্রে’র বাবা থমকে গেলো। ইরামের বাবা চুপ। আসলেই তো, মেয়েটাকে আরও সময় দেওয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু কি আর করা যাবে, ডাক্তারের কথামতোই সব মানতে হবে। অভ্রের বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন করণীয়?’

‘ মেয়েকে দেখে দেখে রাখুন। খাওয়াদাওয়ায় যাতে অনিয়ম না হয়। স্ট্রেস যেন না নেয়। এসময় শারীরিক মানসিক চেঞ্জ আসে মেয়েদের। মুড সুইং তো আছেই। আর ইরাম নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে, তাই কোনো কাজই কর‍তে দিবেন না। ভারী কাজ নট এলাউড। একটু কেয়ারফুল থাকবেন!’

দুই বাবাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। ডাক্তার আবারও বললেন, ‘ঔষধপত্র ঠিকঠাক মতো খাওয়াবেন। আর সাবধানে রাখবেন।’

‘ আচ্ছা!’

১৫.
অভ্র বড়বড় চোখ করে তাঁর বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। ও বিশ্বাস করতে পারছেনা ও বাবা হবে! এক বাবা তার ছেলেকে এসে এই খুশির সংবাদটা দিচ্ছে আর তাতে অভ্র কেমন রিয়েকশন দেবে বুঝতে পারছেনা। সবাই-ই প্রায় অবাক। ইরামের বাবার খুব রাগ হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই। নিজের রাজকন্যা তাঁর গর্ভে একটা বাচ্চা লালন করছে! কতটুকু বয়সই বা ওর? যে ও বাচ্চা সামলাবে? এমন সময় নার্স এসে বললো, ‘ আপনাদের পেশেন্টের জ্ঞান এসেছে!’

ইরামের বাবা চোখ মুছে কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। সাথে অভ্রে’র বাবাও। সবাই গেলেও অভ্র গেলো না। ওর মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে, কেন এমনটা হতে দিলো ও? আর ইরু? ওরই বা বয়স কত? ওর পিচ্চি ইরু নিজেই আরেকটা পিচ্চি ধারণ করছে, ভাবা যায়? কিন্তু ওর ভুলের জন্য ইরাম কেন শাস্তি পাবে? কতই দেখেছে অল্প বয়সে মেয়েদের বাচ্চা হলে বেশিরভাগ মেয়েরা মারা যায়, নাহ! অভ্র চায় না, ইরাম এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করুক। কিছু একটা কর‍তে হবে!

_____________

মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। আমি মিটমিট করে তাকিয়ে দেখলাম অচেনা এক রুমে শুয়ে আছি। আশেপাশে চোখ বুলাতেই দেখলাম, স্যালাইন লাগানো হাতে আর আমি একটা বেডে শোয়া। তার মানে আমি হসপিটালে আছি! কিন্তু কেউ তো নেই ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে আব্বু-আম্মু, মামা-মামানিকে কেবিনে ঢুকতে দেখলাম। আম্মু একপ্রকার দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন লাগছে এখন?’

‘ ভালো।’

‘ মাথায় ব্যথা হচ্ছে?’

‘ তেমন না।’

আম্মু আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। মামানি বললো, ‘কষ্ট হচ্ছে?’

‘ নাহ!’

হঠাৎ মনে পড়লো অভ্র ভাইয়ের কথা। কষ্টটা হচ্ছে, খুব হচ্ছে। সবকিছু মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে গেলো। মামা অপরাধী গলায় বললেন, ‘একটা খবর দেওয়ার ছিলো মা!’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কি খবর?’

আব্বু আর মামা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারপর আম্মু বললো, ‘তুই মা হবি ইরু!’

কথাটা শুনেই আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ‘মা’ হবো? কিভাবে কি! আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘সত্যিই?’

‘ হুম।’

আমার হাতদুটো হঠাৎ পেটের কাছে নিয়ে গেলাম। আমি মা হবো মানে আমার একটা পুচকু/পুচকি আসবে? কিন্তু বাচ্চার বাবা? সে কি চাইবে এই বাচ্চা? সেতো বলেছে আমার প্রতি তার ফিলিংস নেই, ওনি ভুল করেছিলো! আচ্ছা, ওনি যদি বাবা হবার কথা শুনে তাহলে তো ঠিক হতেও পারে, তাইনা? বিকজ বাবা হওয়াটা আনন্দের, সবাই এই খুশি পেতে চায়, ওনি বাচ্চার জন্য হলেও নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবেন! আমি হাসলাম। মামা বললো, ‘আমরা দাদু হচ্ছি মা!’

মামানি বললো, ‘তোকে কিন্তু সেফ থাকতে হবে বাবুটা!’

‘ হুম, থাকবো!’

‘ তুই খুশি তো মা?’

‘ এটা কি খুশির চেয়েও বেশি কিছু নয়?’

‘ তা তো অবশ্যই।’

আব্বু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সবাই খুব খুশি, কজ আমি খুশি। নয়তো এতক্ষণ সবার মুখে অপরাধবোধ আর চিন্তার ছাপ দেখতে পাচ্ছিলাম। হাতে ক্যানোলা লাগানো, স্যালাইন শেষ হলেই আমি বাসায় ফিরতে পারবো। কিন্তু মানুষটা আসলো না কেন? লজ্জ্বায় নাকি আমার মুখোমুখি হতে চাইছেনা?

আমি মনটাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছি। মামানি আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। আম্মু বললো, ‘আর কতক্ষণ লাগবে স্যালাইন শেষ হতে?’

আব্বু বললো, ‘আধঘন্টা মতোন!’

মামা আর আব্বু দুইজন কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

মামানি বললো, ‘কাল রাতে কিভাবে পড়ে গিয়েছিলি তুই?’

‘ জানিনা, হঠাৎ মাথা ঘুরে গেলো!’

আম্মু বললো, ‘খাওয়াদাওয়া করিস না তো পড়বিই।’

মামানি হেসে বললেন, ‘এই পড়া তো সেই পড়া নয়!’

আমি লজ্জ্বা পেলাম। সংকোচ ভাবটা কাটানোর জন্য বললাম, ‘আমাকে এখানে নিয়ে এলো কে? মামা?’

‘ নাহ, অভ্র!’

আমি মনেমনে ভাবলাম, ‘আনবেই তো। নিজেই তো আমাকে মারলো ঢং দেখাতে এনেছে। কিন্তু এসব মারামারির কথা কাউকে বলা উচিৎ হবেনা, নইলে অভ্র ভাইকে দিবে বকা। যদিও কেউ সচরাচর ওনার মুখের উপর কথা বলার সাহস করেনা!’

১৬.
মামানি আর আম্মুও আমাকে রেস্ট নিতে বলে বেরুলেন, তার কিছুসময় পর হঠাৎই অভ্র ভাইয়া হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকলেন। আমি চমকে উঠলাম। ওনি কেবিনের দরজা লাগিয়ে আমার দিকে এগুতে লাগলেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম! ওনাকে এমন লাগছে কেন? অপরাধী চেহারা রাগে লাল হয়ে আছে, উষ্কখুষ্ক চুল। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘ আ..আপনি?’

ওনি আমাকে ভয় পেতে দেখে বললেন, ‘রিল্যাক্স। উত্তেজিত হওয়ার কারণ নেই!’

আমি শান্ত হয়ে ঢোক গিললাম। আমার পাশে এসে বসলো। আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে কপালে একটা চুমু এঁকে দিলেন। আমার হাতদুটো মুঠোতে নিলেন। আমার খুব আনন্দ লাগছিলো, বাবা হওয়ার আনন্দে হয়তো এরকম করছেন। আমার দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।

ওনি বললেন, ‘দেখ! আমি একটা কথা বলতে চাই,তুই হয়তো অবাক হবি!’

আমি পুলকিত গলায় বললাম, ‘বলুন।’

‘ তুই আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছিস। বাবা হওয়াটা কত আনন্দের আমি তোকে বোঝাতে পারবো না। আমি খুব খুশি হয়েছি!’

‘ হুম!’

‘ কিন্তু একটা কথা!’

‘ কি?’

‘ আমি তোর লাইফ রিস্ক নিতে চাইনা!’

‘ মানে?’

‘ তুই খুব ছোট ইরু, একটা বাচ্চার মতো। তোর বয়স অল্প। তুই তো জানিস অল্প বয়সে মেয়েদের কনসিভ করা তার জীবন নিয়ে টানাটানি করার সমান।’

‘ তাতে কিছু হবেনা। আমি কেয়ারফুল থাকবো। সবার তো আর এক প্রবলেম হয়না!’

‘ হয়, অল্প বয়সী মেয়েদের সবার প্রবলেম হয়!’

‘ আমি সহ্য করে নেবো।’

‘ কিন্তু আমি চাইনা!’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘চাননা মানে? কি চাননা!’

‘ তোর লাইফ রিস্ক নিতে আমি চাইনা।’

‘ কি বলতে চাইছেন আপনি?’

‘ এবোরশন করে ফেল!’

আমার বুকটা ধক করে উঠলো বাক্যটা শুনে। ‘এবোরশন!’ মানে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ আপনি বলতে চাইছেন আমি বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলি?’

‘ হুম।’

‘ কিন্তু কেন?’

‘ বললাম তো। তোকে হারাতে পারবোনা!’

আমি বললাম, ‘অভ্র ভাই! এটা আমার আর আপনার সন্তান। আপনি কি বলছেন বুঝতে পারছেন?’

‘ হুম।’

‘ আপনি আমাকে হারাতে চাইছেন না কেন? আমি মরে গেলে তো আপনি শান্তি পাবেন। দায়িত্ববোধ থেকে মুক্তি পাবেন। নিজের মতো বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরাঘুরি করতে পারবেন!’

‘ চুপ। মরার কথা বললে দেখিস কি করি।’

‘ কেন এমন করছেন? ভালোবাসেন আমায়?’

অভ্র ভাই বললো, ‘হুম মনে হয়। কিন্তু আমার কথাটা শুনতে হবে।’

ওনার কথায় আমার ভাবাবেগের পরিবর্তন হলোনা। ওনার বাচ্চা না চাওয়ার কথার নিচে ভালোবাসার কথাটা চাপা পড়ে গিয়েছে। আমি অনুভূতিহীন হয়ে পড়ছি। বললাম, ‘স্যরি আপনার কথা রাখতে পারছিনা।’

‘ ইরাম!’

‘ হুম। বাচ্চা আপনি না চাইলেও আমি চাই। এটা আমার বাচ্চা, আই ওয়ান্ট ইউ ফোল্লি!’

ওনি অসহায় চোখে তাকালেন। এলোমেলো চুলগুলো দুহাতে চেপে ধরে বললেন, ‘ বলেছিতো আমি তোকে ভালোবাসি। আমি আর কোনোদিন তোর কথার বাইরে যাবোনা। আব্বুর সাথে অফিস যাবো, তোর খেয়াল রাখবো। কিন্তু তোর জীবন নিয়ে টানাটানি করতে পারবোনা।’

‘ আপনার কথা শুনে খুশি হলাম। আর এখানে জীবন নিয়ে টানাটানি করার কিছু নেই।’

‘ তুই বুঝছিস না কেন ইরু?’

‘ আপনি যদি বুঝতেন তাহলে আমিও বুঝতাম।’

ওনি হঠাৎ রেগে বললেন, ‘তুই আমাকে ভালোবাসিস না ইরু?’

‘ বাসি। কিন্তু আপনার অন্যায় আবদার আমি রাখবোনা।’

‘ এখানে অন্যায়ের কিছু নেই, জাস্ট….!’

আমি কান চেপে ধরে চিৎকার করে বললাম, ‘প্লিজ চুপ করুন। পাগলের প্রলাপ বন্ধ করুন!’ হাত সরে আসাতে প্রচুর ব্যথা পেলাম। রক্ত উঠে গেলো স্যালাইনে। অভ্র ভাইয়া তাড়াতাড়ি করে খুলে দিলেন, ততক্ষণে স্যালাইন শেষের পথে।

ওনি রেগে বললেন, ‘ আমি যা বলছি তাই হবে। এবোরেশনের ব্যবস্থা করছি!’

‘ আপনি এমন করবেন না!’

ওনার রাগী গলা। আমাকে বালিশের সাথে চেপে ধরে বললেন, ‘করবোই করবো। তোকে হারাতে পারবোনা।’

‘ আমার বাচ্চা সে। আপনার অধিকার নেই, আমার বাচ্চাকে খুন করার। আমি মা, আমিই তাঁকে দেখবো। আপনাকে চাইনা আমার!’

‘ কিন্তু তোকে আমার চাই!’

আমি এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় ওনার বুকে কিল-ঘুষি দিতে লাগলাম! চিল্লিয়ে বলছি, ‘আমার আপনাকেও চাই, বাচ্চাটাকেও চাই!’

ওনি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন নানাভাবে। আমাকে জোর করে এবোরেশন করাতে চান ওনি, কতটা মারাত্মক হলে কেউ নিজের সন্তানকে দুনিয়ার মুখ দেখতে না দেয়? আমার চিৎকারে আম্মু-আব্বু, মামা-মামানি ছুটে চলে এলো!

👉”তিন ব্যক্তির দো‘আ নিশ্চিত কবুল হয়ঃ

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তিন ব্যক্তির দো‘আ
নিশ্চিতভাবে কবুল হয়, এতে কোন সন্দেহ নেই-

(১) মাযলূমের দো‘আ
(২) মুসাফিরের দো‘আ
(৩) সন্তানের জন্য পিতার দো‘আ।

(আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২২৫০, ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯, পরিচ্ছেদ-২; ছহীহাহ হা/৫৯৬)

তিনি বলেন, ‘ তোমরা মাযলূমের দো‘আ হ’তে সাবধান থাকো। কেননা তার দো‘আ ও আল্লাহর মধ্যে কোন পর্দা নেই’

(মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৭৭২,
‘যাকাত’ অধ্যায়-৬, পরিচ্ছেদ-১)”

👉”ইবাদত একটি ব্যবসার মত। এর দোকান হলো নির্জনতা, পূজি হলো তাকওয়া, লভ্যাংশ হলো জান্নাত!”
– হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)

চলবে…ইনশাআল্লাহ!