প্রীতিলতা আসবে বলে পর্ব-১+২

0
2309

প্রীতিলতা আসবে বলে
লেখিকা :আফরিন ইসলাম ৷
প্রথম পর্ব

আমার চোখের সামনে আমার মা বাবা খুন হয়েছে ৷আমার বাবার চোখ এখনো আমার দিকে যেন তাকিয়ে আছে ৷ঐ চোখ দুটো আমাকে একটা কথাই বলছে

ওদের কখনো ছাড়িস না মা ৷যারা তোর চোখের সামনে তোর মাকে ধর্ষন করেছে ৷তাদের ছাড়িস না ৷

মৃত্যু যন্ত্রনায় আমার বাবার জিহ্বাটা বেড়িয়ে গেছে ৷ মাথার একটা পাশ থেতলে গেছে ৷যেখান থেকে এখনো টুপটুপ করে রক্ত পড়ছে ৷চেয়ারের সাথে বাবার শরীরটা বাধা ৷ কিন্তু বাবার দৃষ্টি যেন আমার দিকেই ৷

আমার বাবার একটু দূরেই আমার মায়ের দেহটা পরে আছে ৷ আমার মায়েরও চোখ দুটো খোলা ৷মায়ের মাথাটা বিছানার নিচে ঝুলে আছে ৷কিন্তু ঐ খোলা চোখ আমায় বলছে

ওদের ছাড়িস না মা ৷যারা তোর বাবাকে বিনা দোষে খুন করেছে ৷তাদের ছাড়িস না ৷

ফ্লোরে পরে আছে আমার ছয় মাসের ছোট ভাই ৷যাকে নিয়ে একটু আগেও কত খেলেছি আমি ৷একঘন্টা আগেও কত খুশি ছিলাম আমরা ৷আমার ভাইটাকে দেওয়ালের সাথে আছাড় মেরে খুন করা হয়েছে ৷ওর ছোট মগজটা ছিটিয়ে পরে আছে ফ্লোরে ৷মুখটা চেনা যাচ্ছে না ৷পুরোই থেতলানো ৷

আমি সব দেখছি আলমারির ভেতরে বসে ৷ বাবার কিনে দেওয়া নতুন ক্যামেরাটা আমার হাতে ৷জানি না মা বাবার সাথে আর দেখা হবে কিনা ৷ কিংবা এই ঘটনা কেউ জানবে কিনা ৷তবুও কিছু ছবি তুলে রাখলাম ৷

হঠাৎ শুনলাম ওরা বলছে ৷এই বাড়ীটাতে আগুন লাগিয়ে দে ৷সবাই ভাববে আগুনে পুড়ে মরেছে সব ৷ওরা পৈশাশিক হাসি হাসতে লাগলো ৷তারপর বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে ৷

ওরা যেতেই আমি বেড়িয়ে আসলাম আলমারির ভেতর থেকে ৷মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম ৷মায়ের গলার চিকন চেইনটা খুলে নিলাম ৷এক সপ্তাহ আগে বাবা মাকে গিফট করে ছিল ৷বাবার কাছে গেলাম তারপর ৷বাবার খোলা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলাম ৷বাবার হাতের একটা আংটি খুলে নিলাম ৷ ছোট ভাইটার কাছে গেলাম ৷ওর মরা দেহটাকে কোলে নিলাম ৷তারপর ওর কপালে একটা চুমু দিলাম ৷ আমার চোখ থেকে এক ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো ৷আমি রক্ত ভয় পাই খুব ৷কিন্তু আজ ভয় পাচ্ছি না ৷

হঠাৎ নাকে প্রচন্ড পোড়া গন্ধ পেলাম ৷ ভাইয়ের লাশটা ফ্লোরে রেখে রাইরে এলাম ৷দেখলাম বাড়িতে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে ৷কিছুক্ষনের মধ্যে হয়তো আগুন ছড়িয়ে যাবে পুরো বাড়ীতে ৷ওরা চলে গেছে ৷বাবার লাশের কাছে এলাম ৷ বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম

ওদের আমি ছাড়বো না বাবা ৷প্রীতিলতা কাউকে ছাড়বে ৷আমি আবারো ফিরে আসবো বাবা ৷দেখা হবে আবারো ৷জানি না ভাইয়ার সাথে ওরা কি করবে কিন্তু ছাড়বো না ওদের আমি ৷

আমার প্রানহীন বাবার মুখে যেন হাসি ফুটলো ৷আমার কল্পনায় আমি তা একে নিলাম ৷এদিকে আগুন ছড়িয়ে গেছে ৷প্রীতি উঠে দাড়ালো ৷আট বছরের ছোট প্রীতি বাড়ীর পেছনের দরজা দিয়ে ছুট লাগালো ৷প্রীতি ছুটছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ৷

বড় ভাইয়ের স্কুলের সামনে প্রীতি দাড়ালো ৷কিন্তু তার যে আসতে দেরি হয়ে গেছে ৷তার বড় ভাই আবেশ যে শত্রুদের গাড়ীতেই উঠে গেছে ৷কি করে ভাইকে বাচাঁবে প্রীতি জানে না ৷ ওরা যে বন্ধু রুপী শত্রু ৷প্রীতি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ৷আর কেউ যে তার রইলো না ৷

বিশাল পর্দায় চৌদ্দ বছর আগের তোলা ছবি গুলো এক এক করে দেখছে প্রীতি ৷আগে এই ছবি গুলো দেখলে সে কাদঁতো ৷কিন্তু এখন আর কাদেঁ না ৷এখন সে এই ছবি গুলো দেখে শক্তি সঞ্চয় করে ৷মাথাটা একপাশে কাত করে আছে সে ৷হাতে সিগারেট জ্বলছে ৷চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে ৷ চৌদ্দ বছর আগের প্রীতি এখন আর নেই ৷প্রীতি আগে রক্ত ভয় পেত ৷কিন্তু এখন সে রক্ত দেখে আনন্দ পায় ৷

চলবে।

প্রীতিলতা আসবে বলে
লেখিকা :আফরিন ইসলাম
পার্ট :২

প্রীতিলতা চেয়ার হেলান দিয়ে বসে আছে ৷আর সামনে থাকা বিশাল পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে ৷হঠাৎ ওর মোবাইল টা বেজে ওঠে ৷প্রীতি ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে ওঠে ৷

ম্যাডাম আপনার কথা মতো ঢাকা যাওয়ার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে ৷আর চার দিন পর আপনার ফ্লাইট ৷ একজন সফল সিআইডি অফিসার হওয়ায় আপনাকে যেতে দেওয়া হচ্ছে ৷ঢাকাতে কয়েক বছর যাবত হত্যা ,গুম ,ধর্ষন বেড়েই চলেছে ৷কিন্তু অপরাধীদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না ঠিক মতো ৷আপনি তো ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেই পরপর প্রমান সহ যেই ভাবে কেস সমাধান করেছেন যা সত্যি কল্পনা করা যায় না ৷ এবার আপনার কথা মতো পোস্টিং ঢাকাতে করা হয়েছে ৷

প্রীতিলতা ফোনটা কেটে দিল ৷হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে গেছে ৷ সে আবারো আরেকটা সিগারেট হাতে নিল ৷তারপর লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে নিল ৷দীর্ঘ একটা টান দিল সে সিগারেটে ৷তারপর কালো ধোয়া গুলো উড়িয়ে দিল ৷প্রীতি পাশের টেবিল থেকে একটা ছবি হাতে নিল ৷ছবিটার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে সে ৷ অতঃপর বলল

আমার জগতে তোমায় সুস্বাগতম দ্বীপ চৌধুরী ৷আমার অন্ধকার রাজ্যে এবার তোমার আগমন হবে ৷ যেখানে আসা যায় কিন্তু ফেরত যাওয়া যায় না ৷ তোমায় আমি মারবো না ৷তোমায় কেবল নরক যন্ত্রনা দেব আমি ৷তুমি মরতে চাইবে কিন্তু মরবে না ৷মরলে তো মুক্তি পেয়ে যাবে ৷কিন্তু তোমায় আমি মরতে দেব না ৷নো নো নো ৷জানো আমার জগতে কোনো আলো নেই ৷শুধু অন্ধকার ৷

প্রীতি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল জানো আমার এই সুন্দর হাত দিয়ে এই পর্যন্ত আমি অর্ধশত খু/ন করেছি ৷রক্তে লাল হয়ে আছে আমার দুনিয়া ৷আমি কাদের মেরেছি জানো ৷তোমার মতো টাকা ওয়ালা জানোয়ারদের ৷যারা অসহায় মেয়ে গুলোকে ধর্ষন করে তারপর খুন করে ৷কিন্তু গরিব মেয়ে গুলো বিচার পায় না ৷আর সেখানে তো তুমি আমার মাকে ধর্ষন করেছো ৷তোমায় কি করে ছাড়বো বলতো ৷

প্রীতি থামলো তারপর বলল আজ আমার পঞ্চাশটা খু/ন পূর্ন হয়েছে ৷ঐ দেখ একটু আগেই একটাকে ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছি ৷ শালা একটা সাত বছরের মেয়েকে ধর্ষন করে ছিল ৷তাই ওকে ওর শাস্তি দিয়ে দিলাম ৷জানো ও মরার আগে কি বলেছে ৷আমি নাকি সাইকো ৷আমি নাকি পাগল ৷ ওর একটা একটা অঙ্গ কেটেছি ৷আর আস্তে আস্তে মেরেছি ৷তিনঘন্টা সময় নিয়ে মেরেছি ৷ কিন্তু আমার রাজ্যের বাইরে আমি একজন সৎ সিআইডি অফিসার ৷ সে পৈশাচিক হাসি হাসতে লাগলো ৷তারপর বলল হ্যা আমি সাইকো ৷হ্যা আমি পাগল ৷ আমি রক্তের জন্য পাগল দ্বীপ চৌধুরী ৷তোমার মতো জানোয়ারদের রক্তে আমি আনন্দ পাই ৷আমি পৈশাচিক সুখ পাই ৷কিন্তু আমাকে প্রথম রক্তের স্বাদ তুমি দিয়েছো ৷এবার তোমার রক্তের স্বাদ নেবে প্রীতিলতা ৷

কাগজের ছবিটা হাত দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল প্রীতি ৷তারপর পাশে পরে থাকা লাশটার কাছে গেল ৷একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলল

কি রে কেমন লাগছে এবার ৷তোকে ওপারে পাঠিয়েছি ৷এবার তোকে গুম করে দেব ৷কেউ কোনো দিন আর খুজে পাবে না তোকে ৷অতঃপর প্রীতি নিজের কাজ শুরু করতে লাগলো ৷

আবেশ চৌধুরী বিশাল এক বাড়ীর সামনে দাড়িয়ে আছে ৷হ্যা এই অভিশপ্ত বাড়ীটাই তার মা ,বাবা , বোন আর ছোট ভাইকে কেড়ে নিয়েছে ৷এটা এখন একটা পরিত্যাক্ত বাড়ী ৷পোড়া বাড়ীটা দেখতে ভুতুরে প্রাসাদের মতো ৷কোথাও প্রানের কোনো ছোয়া নেই ৷আবেশ চৌধুরী নিজের চোখের জল মুছে নিল ৷দুনিয়ার বুকে একেবারে নিঃস্ব সে ৷ কাধে কারো স্পর্শ পেতেই পেছনে ঘুড়লো আবেশ ৷নিজের প্রান প্রিয় স্ত্রীকে দেখে বলল

দেখেছো আমাদের বাড়ীটায় আজ কোনো হাসির শব্দ মেলে না ৷আমার আট বছরের ছোট অবুজ বোনটা এখন আর আমার কোলে দৌড়ে আসে না ৷এই সর্বনাশা বাড়ী সব কেড়ে নিল নিরুপমা ৷

তুমি এভাবে কেদঁ না৷দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে ৷বাবুরা কাদঁছে ৷চল বাড়ী যাই ৷রাত হয়েছে অনেক ৷

অন্যদিকে প্রীতি নিজের বারান্দায় দাড়িয়ে আছে ৷চারিদিকে অন্ধকার ৷হঠাৎ ওর মনে হলো কেউ ওর পাশে এসে দাড়িয়েছে ৷প্রীতি মুচকি হেসে বলল

কি ব্যাপার বাবা আজও এলে যে ৷তোমাকে না আসতে না করেছি ৷

ঘুমাস নি কেনো এখনো ৷

ঘুম আসে না ৷ঘুমালে তোমাদের দেখতে পাই ৷ সব জীবন্ত লাগে ৷

কেন এত কল্পনা সাজাস আমাদের নিয়ে ৷ আমরা শুধুই তোর কল্পনা ৷

তোমরা আমার কল্পনা নও ৷

এই পর্যন্ত যত জনকে খু/ন করেছিস সবাই তোকে সাইকো বলেছে ৷তুই রক্তে নেশায় পাগল হয়ে গেছিস প্রীতি মা ৷

প্রীতি চিৎকার করে বলল আমি পাগল নই ৷না আমি পাগল নই ৷আমি সাইকো নই ৷আমি কাউকে কল্পনা করি না ৷প্রীতি পাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই ৷

চলবে….