তুমিময়_অসুখ পর্ব-০৫

0
4060

#তুমিময়_অসুখ
#পর্ব-৫
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া

১০.
উনি আমার চোখের দিকে না তাকিয়েই বললেন,
‘তুই এখান থেকে যা ইরাম।’

আমি কিছু বলবো তার আগেই উনি আমাকে রুম থেকে বের করে দরজা থেকে আটকে দিলেন।
আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উনি আমাকে অপমান করলেন কি না সেটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে উনার জ্বর, উনি অসুস্থ।

-আরে ইরাম! তুমি কখন এলে? বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কি হয়েছে মা?

আমি চমকে উঠে পেছনে ঘুরে মামানিকে দেখে রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম।একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘আসলে আম্মু অভ্র ভাইয়ার জন্য খাবার পাঠিয়েছে।’

মামানি হেসে বললেন, ‘আর আমি সবার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে শুধু ছেলের জন্য চলে এলাম। না খেয়ে থাকাটা ও সহ্য করতে পারে না। এখন দেখি আমি না এলেও পারতাম।’

আমি একটা হাসি দিলাম। বললাম, ‘মামানি আমার মনে হচ্ছে ভাইয়া অসুস্থ, উনাকে কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছিলো। খাবারটাও ঠিকমতো খাননি!’

মামানি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘তাই নাকি? আমাকে তো একবারও বলেনি। এই ছেলের এক স্বভাব, অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকবে কিন্তু কাউকে কিছু বলবে না।’

তারপর মামানি আমাকে কিছুক্ষণ থাকতে বললেন। আমি সবকিছুর মাঝে আনইজি ফিল করছিলাম।মামানি অভ্র ভাইয়ার রুমে অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও উনাকে দিয়ে রুমের দরজা খুলতে পারলেন না। অবশেষে আমি কিছুক্ষণ বসে থেকে মামানির সাথে গল্প করলাম। মামানি নিজেত ত্যাড়াবেকা ছেলের কীর্তি আমাকে শোনালেন। একসময় আমি বাসায় ফিরলাম।

রাত প্রায় দশটার দিকে হঠাৎ করে আমার ফোনে অভ্র ভাইয়া ম্যাসেজ করলো। আমি ম্যাসেজ ভয়ে ভয়ে সিন করলাম। অভ্র ভাইয়া লিখেছেন, ‘তোর সাথে না এখন আমার খুব হাঁটতে ইচ্ছে করছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে চলে আয় নিচে। আমি ওয়েট করছি!’

আমি রেগে একাকার। মগের মুল্লুক নাকি? উনি যা বলবেন তাই হবে নাকি? যত্তসব। আমি লিখলাম,
‘পারবো না। এত রাতে ঘুরাঘুরি করার শখ আমার নেই। আম্মু আসতে দিবে না।’

অভ্র ভাইয়া রিপ্লাই করলেন, ‘তুই যদি না আসিস ই কিন্তু এক্ষুনি বাসায় এসে তোকে টেনে নিয়ে যাবো। আর ফুপ্পিআম্মু কিছু বলবেন না। আমি পরে বলে দেবো।’

আমি হতাশ হলাম। উনার না শরীর খারাপ। তাহলে উনি কি জ্বরের ঘোরে এরকম করছেন? তাহলে তো যেতেই হবে। মামানির একমাত্র ছেলে বলে কথা। যদি জ্বরের ঘোরে রাতের বেলা হারিয়ে যায়? ধুর…

আমি গায়ে সোয়েটার জড়িয়ে চুলগুলো দুই বিনুনি করে চলে এলাম। নিচে নেমে দেখি, উল্লুক ভাই আমার দাঁড়িয়ে আছে। জ্বরের কারণেই হোক আর অন্য কারণে উনাকে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছিলো।
আমি অভ্র ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ফর্সা গায়ে কালো রঙের শার্ট আর ট্রাউজার পরণে। হাতে কালো রঙের ঘড়ি আর কালচে-বাদামী চুলে উনাকে খুবই সুন্দর লাগছিল। আমি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছেলে অভ্র ভাইয়া আর আমাকে বাঁকা চোখে দেখছিল। মুখে কেমন অদ্ভুত হাসি ওদের। আমার কেমন ভয় লাগছিলো, তাই আমি অভ্র ভাইয়ার পাশাপাশি হয়ে হাঁটা শুরু করলাম। এমন সময় পাশ থেকে
একটা ছেলে বলেই ফেললো, ‘দোস্ত দেখ মাইয়াটারে কি লাগছে!’

একথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো। আরেকজন বললো, ‘দেখ মাইয়াটার সাথে একটু ইটিশপিটিশ কইরা আসি। রাত বিরেতে পোলার সাথে একসাথে ঘুরে কেন? চল, মজা নিয়ে আসি।’

সবাই একসাথে বললো, ‘হুম! ঠিক বলেছিস। চল!’

কথাগুলো শোনা মাত্রই আমি ভয়ে চুপসে গেলাম। ওরা পাঁচ-ছয়জনের দল। আমাকে আর অভ্র ভাইয়াকে ধরলে তো আজ শেষ। ভীষণ রাগ হচ্ছিলো অভ্র ভাইয়ার প্রতি। এতরাতে আমাকে না নিয়ে আসলেই পারতো। আর এখন এসব বখাটে ছেলেদের এসব কথা শুনেও উনি কোনো রেসপন্স করছেন না। আসলেই জীবন তো কোনো সিনেমা নয় যে, হিরো এসে হিরোইনকে বখাটেদের হাত থেকে বাঁচাবে। বাস্তব জীবনে প্রতিটা মুহূর্ত মানুষ সবকিছুকে দূরে ঠেলে লড়াই করে বেঁচে থাকে। নাটক-সিনেমা ও একজন মানুষের জীবনগল্পের কাছে হার মানবে। যাইহোক, আপাতত পরিস্থিতির মোকাবেলা কিভাবে করা যায় আমাকে ভাবতে হবে। সাথে থাকা মানুষটা তো আর আমাকে নিয়ে ভাবছে না। এ মুহূর্তে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে পারলে আমি বাঁচি, সেজন্য অভ্র ভাইয়াকে ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ভাইয়া!’

উনি পেছনে ঘুরে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডাকছিস?’

—“হুম!’

—“কেন? ক্ষিধে পেয়েছে?”

—” না। আসলে আমি বাসায় যাবো!”

—“কেন? এখানে কি সমস্যা হচ্ছে তোর?”

—“না, মানে আমার ঘুম পাচ্ছে!”

—“লাইক সিরিয়াসলি ইরাম? তোর ঘুম পাচ্ছে?”

আমি মাথা নিচু করে বললাম, ‘জ্বি!’

—“তুই যে মিথ্যে এতো ভালো বলতে পারিস আমার জানা ছিলো না।”

—“আমি কোনো মিথ্যে বলিনি!”

—“বলেছিস। তোর চেহারায় ঘুমের ছিঁটেফোঁটাও নেই। আর তুই যে মিথ্যা বলছিস সেটা বোঝাই যাচ্ছে, কেননা তুই মিথ্যে বললে তোর মুখচোখই সব বলে দেয়!”

—“সত্যি বলছি, আমার ঘুম পাচ্ছে!”

অভ্র ভাইয়া হাসলেন। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমার চোখে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিচ্ছিলো উনার সেই হাসি। বললেন, ‘আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে তুই শান্তিতে ঘুমাবি এটা তো হতে পারে না। তাই তোর ঘুম পেলেও আমার কিছুই করার নেই। আর কি হয়েছে বল তো!’

ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি ওরা এভাবেই বখাটেপনা করছে। তাই আমিও অভ্র ভাইয়ার জেদের কাছে হেরে গিয়ে বললাম, ‘ওরা আপনাকে আর আমাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করছে।’

অভ্র ভাইয়া আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমাকে সাথে করে টেনে নিয়ে গেলেন ওই ছেলেদের কাছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ছেলেগুলো আচমকা আমাদের এভাবে দেখে মিইয়ে গেলো। অভ্র ভাইয়ার মতো একজন মানুষ দেখে ওরা কেমন হকচকিয়ে উঠলো। অভ্র ভাইয়া বললেন, ‘দেখো তোমরা ছোট। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের টিজ না করে বাসায় গিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করো, কাজে দেবে। ভবিষ্যতে সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করার জন্য হলেও তো কিছু একটা তোমাদের কর‍তে হবে তাই না? তাই এসব ফালতু বখাটেপনা না করে বাসায় গিয়ে নিজের কাজে মন দাও আর ভালো ছেলে হও। আর কখনো মেয়েদের টিজ করবে না। আমি ফার্স্ট টাইম ছাড় দিলাম, নেক্সট টাইম তোমাদেরকে এসব করতে দেখলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।’

ছেলেগুলো যতটা না অবাক হলো তার চেয়ে বেশি অবাক আমি হলাম। কারণ আমি ভেবেছিলাম সিনেমার হিরোর মতো উনি ছেলেগুলোকে দু’ ঘা মেরে দেবেন। কিন্তু তা না করে উনি ভালো করে ছেলেদের কিছু উপদেশ দিয়ে দিয়েছেন, যেটা খুবই ভালো।

১১.
অতঃপর আমরা সেখান থেকে চলে এলাম। রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। খোলা রাস্তা, শীতল আবহাওয়া। কেমন মোহ কাজ করছে যেন। রাস্তার পাশের পার্কটার একপাশে একটা বেঞ্চিতে অভ্র ভাইয়া বসলেন, আমিও বসলাম। শুকনো পাতা বাতাসে ঝরে ঝরে পড়ছে। আকাশে মস্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে।

অভ্র ভাইয়া সেদিকে একমনে তাকিয়ে থেকে আমাকে বললেন, জানিস ইরাম,
এই চাঁদের প্রতি অদ্ভুত একটা আকর্ষণ আছে আমার, ছোটবেলা থেকেই। এখনো মাঝে মাঝে রাতের বেলা জানালা খুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি।আজকের রাতটাও খুব সুন্দর, দেখেছিস আকাশটা কেমন ধূসর মেঘে ঢাকা। একটু পরপর ঘোলাটে চাঁদটা সেই মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, আবার কিছু সময় পরপর পরিপূর্ণভাবে মেলে উঠছে। বাতাস ঠান্ডা,এই মায়াবী চাঁদের আলোতে বৃষ্টি হলে ভালো ছিলো। বৃষ্টি প্রকৃতিটাকে আরও স্নিগ্ধ,মায়াবতী করে তোলে।চাঁদ উঠার দিনগুলোতে পৃথিবীটাকেই রুপকথার স্বর্গরাজ্য মনে হয়।আম্মু শোনাতো আমায় সেই রুপকথাফ কল্পকাহিনী। সেই রুপকথার কাহিনীতে সবসময় শুনে এসেছি একটা চাঁদের বুড়ির কথা। যদিও জানি এগুলো রুপকথার গল্পেই থাকে,চাঁদের বুড়ি বলতে আসলে কিছু নেই,তাতেও ক্ষতি কি!কল্পনার জগতে আশ্রয় পাওয়া চরিত্রগুলোকেও মাঝে মাঝে ভালোবাসতে হয়, যেমন তুই! বৃষ্টি নামার অবকাশের মাঝে মনে পড়ে সেই সুদূর অতীতের কথা।যখন আকাশে চাঁদের সাথে লক্ষ্য-কোটি তারার মেলা বসতো।হারিয়ে যাই মেলার সেই দিনগুলোতে।তখন জীবনটা কি রঙিনই না ছিলো।এক টুকরো আনন্দের আশায় আজও খুঁজে ফিরি সেই রুপকথার স্বর্গরাজ্যটাকে! কিন্তু এখন আমি বড় হয়ে গিয়েছি। তাই কিছু পাওয়ার যোগ্যতা নেই আমার, তাই না?’

আমি অভ্র ভাইয়ার কথা শুনে অবাক। এ কেমন মানুষ তিনি? এভাবে কেউ কল্পনা কর‍তে পারে সেটা আমার জানা ছিলো না। এভাবে কেউ গুছিয়ে এতো সুন্দর কথা বলতে পারে আমি কোনোদিন ভাবিনি। আমি বললাম, ‘আপনি কি বাসায় ফিরবেন না?’

অভ্র ভাইয়া রেগে গেলেন। বললেন, ‘তোর খুব প্রবলেম হচ্ছে আমার সাথে থাকতে, তাই না।’

আমি আড়চোখে উনার দিকে তাকালাম। বললাম, ‘না। আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম।’

অভ্র ভাইয়া উঠে দাঁড়ালেন। রাগী গলায় বললেন, ‘চুপ। একদম চুপ। তোর সব সমস্যার কারণ হচ্ছি আমি, তাই আজ থেকে আর কোনো দিন তুই আমার বিষয়ে মাথা ঘামাবি না, কোনো কথা বলবি না। তুই জেনে রাখিস তুই শুধু খারাপ মেয়ে। তুই আমার কখনো ভালো চাসনি। নিজের কথাই তুই ভাবিস শুধু। বলেই অভ্র ভাইয়া আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজের বাসায় চলে গেলো। আর আমি উনার এসব কথায় খুব মর্মাহত হলাম, কেউ আমার উপর এভাবে কখনোই রাগেনি। সারা রাত কান্না করে কাটিয়ে দিলাম আমি। সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি কখনোই চাইনি আমার জন্য কেউ কষ্ট পাক।

১২.
সেদিনের পর থেকে অভ্র ভাইয়া আমাকে এড়িয়ে যেতে থাকে। উনি আমাকে দেখলে কিছু বলেন না। একপ্রকার কথা বলাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো আমাদের। কথা বলেননি পুরো এক মাস। আর আমিও উনার কথা ভুলে পড়াশোনায় কন্সেনট্রেট করলাম। আর যাইহোক, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। বাবা-মা যতই ছায়া হয়ে থাকুক না কেন মাঝে মাঝে অনেক কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় মেয়েদের। সেজন্য নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা একান্ত জরুরি। আমি জোরকদমে এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু হঠাৎ একটা ঝড়ে যে আমার স্বাভাবিক জীবনটা এভাবে উলটপালট হয়ে যাবে, আমি সেটা কখনোই ভাবিনি।

👉”আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি
ওয়া বারাকাতুহু”

বুঝে পড়লেও নেকী, না বুঝে পড়লেও নেকী, শুনলেও নেকী, শুনালেও নেকী!!
সুবহানআল্লাহ!

চলবে…ইনশাআল্লাহ। এখানের কিছু অনুভূতি আমি আগেই লিখে রেখেছিলাম। গল্প সম্পর্কে কিছু বলে যাবেন প্লিজ।