তুমিময়_অসুখ পর্ব-৬

0
3250

#তুমিময়_অসুখ
#পর্ব-৬
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া

১২.
একটু আগেই আমাকে অভ্র ভাইয়ার রুমে এনে বসানো হয়েছে। আর আমি একা একা বসে ভাবছি, কি থেকে কি হয়ে গেলো হুট করেই। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই যেন চোখের পলকে সবকিছু হয়ে গেলো। অথচ আব্বু-আম্মুর পরিপূর্ণ সম্মতি রয়েছে এই বিয়েতে প্রথম থেকেই, কিন্তু আমি চাইনি অভ্র ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে হোক। উনার সাথে আমার এডজাস্ট করতে খুব কষ্ট হবে আমার। কারণ আমি উনার কালচারের নই। চেয়েছিলাম পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিয়ে করবো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে আমি এখন সেই অভ্র ভাইয়ারই বউ, যার সাথে আমি কথা বলি না।

হুম, বিয়েটা হয়েছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না কেন আমিই বা মামা-মামানি, নানুর রিকুয়েষ্টে রাজি হয়ে গেলাম অভ্র ভাইয়াকে বিয়ে করতে। এছাড়া আর বিয়েতে অসম্মতির কোনো কারণ আমার নেই।

আমার ইচ্ছা ছিলো শুধু একটাই, পড়াশোনা করা। নিজের স্বপ্ন পূরণ করা। কিন্তু সব স্বপ্নই রয়ে গেলো। বুকের মাঝে সেই সব স্বপ্নগুলোকে পাথর চাপা দিয়ে এই বিয়েটা করতে হলো। অবশ্য মামা চান আমি পড়াশোনা করি, আমার যা ইচ্ছে আমি সেটাই করতে পারবো। শুধু উনার ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। কারণ আমি যখন বছর বিয়ে করবো না বলে দিয়েছিলাম তখন থেকেই অভ্র ভাইয়া একটু পাল্টে যান, খিটখিটে হয়ে যান। নিজের সমস্যা, খারাপ লাগার কথা কাউকে বলেন না। অফিস শেষে কোনো কোনোদিন বাসায়ও ফিরেন না। উনার সব অভ্যাস পাল্টে গিয়েছে, হাসিখুশি ছেলে থেকে হয়ে গিয়েছেন গম্ভীর, রাগী মানুষ। অবশ্য রাগ উনার ছোট থেকেই ছিলো, তবে সেটা প্রকাশ করতেন খুব কম। মামা নিজের ছেলের পাল্টে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছিলেন না, তাই কাল যখন আমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান তখন আমি না করতে পারিনি। এডমিশনের পড়া নিয়ে যখন কম্বলের নিচে কাঁপতে কাঁপতে পড়াশোনা করছি তখনই মামানি এসে জানালো, অভ্র ভাইয়া সেদিন রাতে বাসায় ফিরেননি। সারারাত রাস্তায় রাস্তায় এখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পরদিন দুপুরে অভ্র ভাইয়া বাসায় ফিরেন জ্বর নিয়ে। মামানিদের কিছু বলেনও নি। ওনারা আমার ব্যাপারটা আগে থেকেই জানতেন, তাই শেষমেশ ছেলের কষ্ট বুঝতে পেরে হাজির হন আমার কাছে। আমিও ফেরাতে পারিনি ওনাদের। রাজি হয়ে যাই ইচ্ছের বিরুদ্ধে। তবে আমি না চাইলে কখনোই বিয়ে হতো না। অবশ্য অভ্র ভাইয়াও আমাকে এভাবে বিয়ে করতে চাননি, কিন্তু মামানির জেদের কাছে হেরে তিনিও বিয়ে করতে রাজি হন। ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হওয়ার পর উনি আমাদের বাসা থেকে চলে আসেন। এখন ঠিক কোথায় আছে আমি জানিনা, বাসায় নাকি বাইরে জানিনা। জানার ইচ্ছেও নেই। তবে একটু ভয় ভয় করছে।

এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা শব্দ কানে এলো। শব্দটা কোনদিক থেকে এসেছে আমি বুঝতে পারছি না। দেখলাম শব্দটা দরজার কাছ থেকে আসছে। কেউ একজন আসছে দরজা খুলে, হয়তো মামানি বা অন্যকেউ। কিন্তু না। আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে রুমে ঢুকলেন অভ্র ভাইয়া। আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো আমার সামনেই আসবেন না, কিন্তু উনাকে দেখে আমি নিজেই অবাক। এবার আমার বেশ ভয় লাগছে। লজ্জ্বা আর ভয়ের সংমিশ্রণে হার্টবিট বাড়ছে। আমার মনে হচ্ছে আমার হার্টবিটের শব্দ অভ্র ভাইয়াও শুনতে পাচ্ছে। নতুন বউ বা বর আমাদের দুজনকে লাগছে না। ভাইয়া বরাবরের মতো ফরমাল গেট আপে আর আমি একটা শাড়ি পড়ে বসে আছি। আমি এর আগে কখনোই শাড়ি পড়িনি, সামলাতেও পারিনা। যাইহোক, কিন্তু রুমটা ফুলে সাজানো। আমি এসব সাত-পাঁচ ভাবছি আর ভয় পাচ্ছি।

কিন্তু অভ্র আহমেদ তো অভ্র আহমেদই। উনি রুমে ঢোকার সাথে সাথেই হঠাৎ করে দরজাটা লাগিয়ে লাইটটা অফ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন। দরজার প্রচন্ড শব্দে আমি কেঁপে উঠলাম। অন্ধকারে আবছা আবছা ভাবে দেখলাম অভ্র ভাইয়া বিছানায় শুয়ে পড়েছেন, তাই আমিও সাতপাঁচ না ভেবে ফ্লোরে বিছানা করে শুয়ে পড়লাম। আমার কোনো ইচ্ছে নেই এই লোকটার সাথে এক বিছানায় শোয়ার। আমার সাথে ভাব নেয়, হুহ। এতদিন তো আমার জন্য বৈরাগী হয়ে ঘুরঘুর করছিলি, আর এখন বিয়ে করে এনে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। যাইহোক, আমি আমার পড়াশোনা নিয়ে ভাবছি। ফিজিক্সের সূত্রগুলো মনে মনে রিভাইস করছি। হঠাৎ করে মনে হলো, আমিই বোধহয় একমাত্র মেয়ে যে বাসর রাতে ফিজিক্সের সূত্র নিয়ে পড়ে আছি।

১৩.
সারাদিনের ক্লান্তিতে শুবার সাথে সাথে দুচোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসলো। ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। একটা স্বপ্নও দেখলাম। স্বপ্নটা এরকম যে, ‘অভ্র ভাইয়া আমার চুল টেনে ধরে নিয়ে বলছেন এই তোর চুল তো দেখি অনেক সুন্দর হয়ে গিয়েছে। তোর চুল এবার কেটে ছোট কর‍তে হবে। আয় এখানে তোর চুল কেটে দিই। আমি রাজি না হওয়াতে অভ্র ভাইয়া আমার হাত পা বেঁধে ফচফচ করে চুল কেটে ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন। আর আমি চোখের পানি, নাকের পানি এক করে কাঁদছি। আর অভ্র ভাইয়া হু হা করে হাসছেন আমাকে দেখে।’

এই স্বপ্ন দেখে আমি চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠলাম। উঠে দেখি সকাল হয়ে গিয়েছে। যাক, এটা স্বপ্ন ছিলো। শুয়া থেকে উঠে বসতে গিয়ে দেখি অভ্র ভাইয়া আমার দিকে সন্দেহী চোখে তাকিয়ে আছেন। আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন আমি তাকাতেই এমন একটা ভাব করলেন যেন আমায় উনি দেখেইনি।

আমি বিরক্ত হয়ে উনার দিকে তাকালাম। দেখি উনি আগেই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছেন।আর আমি ফকিন্নির মতো ফ্লোরে বসে বসে ঝিমুচ্ছি। এদিকে শাড়ির আঁচল যে কোথায় আর আমি কোথায় সেটা আমার জানা নেই। চোখ পড়তেই আমার হুশ এলো। তাড়াতাড়ি করে শাড়ির আঁচল ঠিক করে উঠে দাঁড়ালাম, এই অভ্র ভাইয়াটা না আবার আমাকে এভাবে দেখে ফেলেছে। প্রচন্ড রাগ হলো আমার।
ছিহ ইরাম, এভাবে একটা উটকো লোকের কাছে তুই এভাবে হেরে গেলি? ফ্রেশও হতে পারলি না এর আগে? তোর জীবন রেখে লাভ নেই, তুই মরে যা। যত্তসব।

অভ্র ভাইয়া আড়চোখে আমাকে দেখছেন আমি বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি উনার দিকে তাকালেই উনি ভাব নিয়ে অন্য দিকে তাকান, যাতে আমি বুঝতে না পারি। শাড়িটা ঠিক করার জন্য ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম অভ্র ভাইয়া কেমন করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখাচোখি হতেই আমক তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে।ফ্রেশ হয়ে রুমে এলাম আর দেখলাম ওনি এখনও আগের মতোই বসে আছেন।

আর আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। ড্রইংরুমে মামা বসে আছেন, আমি রান্নাঘরে মামানির কাছে গেলাম। মামানি আমাকে দেখে বললো, ‘গুড মর্নিং!’

আমিও হেসে বললাম, ‘শুভ সকাল।’

—“আমাদের বাসায় কেমন লাগছে মা?”

—“ভালো!”

মামানি চিন্তিত গলায় বললেন, ‘আচ্ছা অভ্র কিছু বলেছে তোমায়?’

—“কোন বিষয়ে?”

—“এই যে, হঠাৎ করে তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ায়?”

—” না মামানি। উনি তো আমার সাথে একটা কথা পর্যন্ত বলেনি।”

—“বুঝলে না ইগো, এই ছেলের ইগো বেশি।”

আমি মামানিকে বললাম, ‘উনার ইগো উনি দেখাক, আমার ইগোর কাছে হার মানবে একসময়।’

—“ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চয়ই?”

আমি উত্তর দেবার আগেই পেছন থেকে অভ্র ভাইয়া বলে উঠলেন, ‘আম্মু নাস্তা কোথায়? রেডি করেছো?’

মামানি কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। অভ্র ভাইয়া আবারও জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু মামানি এবারেও চুপ। অভ্র ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আমি কি না খেয়ে এখন অফিসে বেরিয়ে যাবো? ওকে, নো প্রবলেম!’

মামানি এবার বললেন, ‘আমি পাঠাচ্ছি নাস্তা। তুমি যাও!’

অভ্র ভাইয়া ধুপধাপ শব্দ করে চলে গেলেন।মনে হচ্ছে একটু রেগে গিয়েছেন।

মামানি চটপট কফি আর সুপ বানিয়ে আমাকে দিয়ে বললেন, ‘প্লিজ মা, একটু নিয়ে যা।’

আমি অবাক হলাম। এই অভদ্র ইগোওয়ালা লোকটার জন্য নাকি আমি খাবার রেডি করে নিয়ে যাবো, একেবারে আদর্শ বউয়ের ভূমিকা পালন করছি। বাহ!

আমি গোমড়া মুখে খাবার নিয়ে বেরুতে গেলেই মামানি পেছন থেকে বললো, ‘তোকে খুব সুন্দর লাগছে শাড়িতে, একেবারে বউ বউ। তুই তুই করছি বলে আবার রাগছিস না তো মা?’

আমি হেসে বললাম, ‘একটুও না। তোমার মুখে তুই শুনতে পুরো চিনির মতো লাগছে।’

আমি অভ্র ভাইয়ার নাস্তা নিয়ে উপরে রুমে চলে এলাম। আমার হাতে নাস্তা দেখে অভ্র ভাইয়া বোধহয় একটু অবাকই হলেন। আমি উনাকে মুখ ঝামটা মেরে বললাম, ভাইয়া আপনার জন্য মামানি খাবার পাঠিয়েছেন। খেয়ে আমাকে উদ্ধার করবেন প্লিজ!’

আমার নিজেকে উনার বাসার কাজের বুয়া মনে হচ্ছে। মনে মনে হাজারটা গালি দিলাম, কিন্তু মনে মনে গালি দিলে ঝাঁঝটা তো আর মিটবে না। ভাইয়া বলাতে উনি মনে হয় রেগেছেন, কি ভয়ানক রাগান্বিত দৃষ্টি! দেখে মনে হচ্ছে আমাকে কাঁচা গিলে খেয়ে ফেলবেন। কিন্তু কিছু বললেন না। সুপের বাটিটা হাতে নিয়ে ভাব নিয়ে খেতে লাগলেন। ইগো দেখো! মনে হচ্ছে বোবা, কথা বলতে পারেন না।

আমি উনার সামনে থাকতে চাইনা। তাই ব্যলকুনিতে চলে এলাম। ব্যলকুনিতে ঠান্ডা বাতাস বইছে। ফুলের গাছগুলোতে সাদা, হলুদ, গোলাপি রঙের বিভিন্ন ফুলের মেলা। সকাল সকাল ফুল দেখলে মনটা বড্ড ভালো হয়ে যায়। গাছটা যেহেতু অভ্র ভাইয়ার তাই উনার উপর রাগটা আমি উনার ফুলের সাথে ঝাড়লাম। দিলাম বড় বড় দেখে কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে। সবচেয়ে সুন্দর মেরুন রঙের ডালিয়া ফুলটা ছিঁড়ে নিয়ে কানে গুজলাম। আহা! আমাকে নিশ্চয়ই সুন্দর দেখাচ্ছে। আমার শাড়িটাও মেরুন রঙের। মামানিকে দেখাবো বলে ঠিক করলাম, ব্যলকুনি থেকে রুমে ঢোকার সাথে সাথেই অভ্র ভাইয়ার চোখ গেলো আমার কানে গোজা ফুলটার দিকে। উনার হাত থেকে কফির মগটা নিচে পড়ে গেলো। এতক্ষণে বোবার মুখদ কথা ফুটলো। উনি একপ্রকার চিৎকার করে বললেন, ‘আ আ আমার ফুল ছিঁড়লি কেন???’

আমি চমকে উঠলাম এত বড় চিৎকার শুনে। বললাম, ‘আমার ইচ্ছা!’

—“তোর ইচ্ছা হলেই হবে নাকি?”

—“অবশ্যই হবে!”

—“তোর সাহস তো কম নয়, তুই আমার ফুলে হাত দিলি ড্যাম ইট!”

আমি এবার ভয় পেয়ে গেলাম। উনি আমার দিকে এগুতে লাগলেন। ভয়ে আমার আত্মা উড়ে গেলো।

নাইস,নেক্সট স্টিকার কমেন্ট পছন্দ না। প্লিজ অন্যকিছু বলবেন। একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বোধহয়।

👉”কেউ যদি মহান আল্লাহ’র জন্য একদিন রোজা রাখে; বিনিময়ে আল্লাহ তাকে জাহান্নামের ৭০ বছরের দূরত্বে সরিয়ে নিবেন।”

~ মুসলিম ২৭৬৭

চলবে….ইনশাআল্লাহ!