তুমিময়_অসুখ পর্ব-০৭

0
4424

#তুমিময়_অসুখ
#পর্ব-৭
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া

১৪.
উনি আমার পুরো কাছাকাছি চলে এসেছেন। একটা ফুলের জন্য এমন করবেন জানলে মরে গেলেও ফুল ছিঁড়তাম না। আমিতো ভয়ে ফিট হয়ে যাচ্ছি। ভাবছি, উনি কি আবার আমাকে ধাক্কা দিয়ে তিনতলার ব্যলকুনি থেকে নিচে ফেলে দিবেন? যা রেগে আছেন, ফেলে দিলেও আমি অবাক হবো না!

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘সরুন আমি নিচে যাবো!’

এই বলে আমি ফাঁকফোকর খুঁজছি কিভাবে এখান থেকে পালাতে পারি, কিন্তু ওনি
আমাকে কোনদিকে দেখার সুযোগ না দিয়ে আমার খুব কাছাকাছি এসে বললো, ‘তুই আমাকে বোকা ভেবেছিস? আমার গাছে তুই হাত দিস বেয়াদব মেয়ে!’

—“স্যরি স্যরি। আমি আর জীবনেও আপনার গাছে হাত দেবো না। প্লিজ সরুন!”

—” সেসব পরে দেখা যাবে, এখন তো পানিশমেন্ট পেতেই হবে।”

—“দেখুন…”

—” কি দেখবো?”

আমি বললাম, ‘দেখুন আমি এই বাসার বউ, সো আপনি আমার উপর অত্যাচার করতে পারেন না!”

অভ্র ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘তোর কি এই বাসার সাথে বিয়ে হয়েছে?’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘বাসার সাথে হবে কেন? আমার বিয়ে তো আ আপনার সা..”

আর কিছু বললাম না। চুপ করে গেলাম। অভ্র ভাইয়াও একটু থতমত খেয়ে গেলেন। আমাকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালেন, আড়চোখে আমাকে দেখছেন গম্ভীরভাবে। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, কিন্তু বারবার আড়চোখে দেখার মানেটা কি আমি বুঝলাম না। ইচ্ছে করছে দিই দুটো চড়। কিন্তু না, এতো সুন্দর ছেলের গায়ে হাত তোলাটা মানাবে না।

কিন্তু খোটা তো দিতে পারি। সেজন্য আমি কানে গোঁজা ডালিয়া ফুলটা ঠিক করে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে কেমন লাগছে?’

ওনি চুপ করে রইলেন। আমার ভীষণ রাগ হলো। বললাম, ‘এতক্ষণ তো খই ফুটছিলো মুখে, এখন চুপ কেন? ঢং যত্তসব!’

ওনি আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি চলে আসলাম রুমে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমাকে মোটামুটি ভালোই দেখাচ্ছে। আয়নার ভিতর দিয়েই দেখি অভ্র ভাইয়া সোফায় বসে ল্যাপটপ টেপার ছুঁতো করে আমাকে চুপিচুপি খেয়াল করছেন। তাই আমিও ঢং করে আরও একটু ভাব দেখিয়ে চলে এলাম মামানির কাছে।

মামানি আমাকে দেখেই বলে উঠলো, ‘তোকে তো শাড়িটাতে আর ফুলে খুব মানিয়েছে।’

আমি লজ্জ্বা পেয়ে গেলাম। কেমন কেমন অনুভূতি হচ্ছে। আসলে কেউ আমার সরাসরি প্রশংসা করলে আমার প্রচুর লজ্জ্বা লাগে। যতই তিড়িং বিড়িং করিনা কেন, লজ্জ্বা নামক বস্তুটা আমার শিরায় শিরায় বয়ে চলে।

মামানি বললো আচ্ছা তুই বস, আমি তোর সাথে গল্প করি। তোর মামাটাও অফিস চলে যায় সকাল সকাল, আর তোর নানুও গ্রামে গিয়ে বান্ধবীর সঙ্গে আড্ডা দিবে বলে চলে গেলো। আমার কথা কেউ ভাবে না।

নানু গ্রামে গিয়ে পৌঁছেছে?

—“হুম। একটু আগে ফোন করে জানালো। তোর মামাই তো ব্যবস্থা করে দিলো।”

তারপর আমি আর মামানি মিলে অনেক গল্প করলাম। হঠাৎ দরজায় বেল বাজলো। আমি মামানিকে বলে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলতেই রাফা আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

আমি রাফাকে বললাম, ‘ আরে কি করছিস? ছাড় আমাকে। আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো তো!’

রাফা খুশিতে বিগলিত হয়ে বললো, ‘আমি কি তোমায় একটু আদর করতে পারিনা? আমার ভাবিকে আমি আদর করবো, হুম! চলো সেলফি তুলি। বলেই ওর মোবাইলটা দিয়ে সেলফি নিলো আমার সাথে। বললো, ওয়াও! শাড়িতে তোমায় দারুণ দেখাচ্ছে ভাবি!’

—“একদম ভাবি ডাকবি না।”

—“আমার ভাইয়ের বউ, আর আমি ভাবি ডাকবো না?”

—“হুম!”

—“তাহলে কি ডাকবো?”

—“যা ইচ্ছা তাই ডাকবি, ভাবি বলিস না প্লিজ! আমার নিজেকে বুড়ি মনে হয়!”

রাফা হাসলো। কি একটা চিন্তা করতে লাগলো যেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ইউ আর সো কিউট!’

হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন অভ্র ভাইয়া এলো। বাহ! অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি। এমনিতেই সুন্দর, তাও কালো কাপড়ে ওনাকে প্রচুর সুন্দর লাগে। আমাকে আর রাফাকে একসাথে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলেন। আমি বুঝতে পারলাম না। রাফা ইশারা দেখে ওনাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ভাইয়া? কিছু বলছো? আচ্ছা আমি রুমে যাচ্ছি! হয়তো পার্সোনাল কথা তোমাদের, আমি যাই!’

বলেই একটা চোখ টিপ মেরে রুমে চলে গেলো।

রাফা হচ্ছে অভ্র ভাইয়ার একমাত্র ছোট্ট বোন। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার পর ও আমাদের এখানেই ইলহামের সঙ্গে কলেজে ভর্তি হয়েছে। পড়াশোনায় অনেক গ্যাপ পড়ে যাওয়ায় ও কিছুদিন যাবৎ হোস্টেলে থাকছিলো। আমাদের বিয়ের সময় ও থাকতে পারেনি। আসলে সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হলো যে কেউ-ই কিছু বুঝে ওঠতে পারেনি।

১৫.
অভ্র ভাইয়া আমাকে আবারও ইশারা করলেন। আমি ছাতার মাথা কিছুই বুঝলাম না। রেগে বললাম, ‘আপনার সমস্যাটা কি ভাই?’

এটুকু বলতেই ড্রইংরুমের খোলা দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে কিছু মহিলা, বাচ্চাকাচ্চার দল,আসতে লাগলো। আমি আর অভ্র ভাইয়া হা হয়ে রইলাম। অভ্র ভাইয়া আমাকে টেনে সাইডে নিয়ে আসলেন। কেউ আমাদের দেখতে পেলো না।

ওনি আমার হাত চেপে ধরেছেন। রাগে ওনার মুখচোখ লাল হয়ে যাচ্ছে। ‘ভাই’ ডাকায় রাগলো কিনা বুঝলাম না। আমি হাত ছাড়ানোর অযথা চেষ্টা করছি। বললাম, ‘আহা! আমার হাত ছাড়ুন। যত্তসব।’

আর ওনি এটা শুনে রেগে বললো, ‘কি হচ্ছেটা কি শুনি? তোর মাথায় কি কিচ্ছু নেই? তুই এতই বোকা ইরাম? তুই দেখছিস না এখানে কতো মেহমান!’

আমি রেগে বললাম, ‘মেহমান তো কি হয়েছে? আমার কি ওদের সামনে যাওয়া বারণ??’

অভ্র ভাইয়া রেগে আমাকে টেনে রুমে নিয়ে দরজা আটকে দিলেন। আমি আমি রেগে নীল হয়ে বললাম, ‘আপনার প্রবলেমটা ঠিক কোন জায়গায়, বলবেন আমাকে? এভাবে টেনে নিয়ে আসার মানে কি?’

আর ওনি আমার দিকে কেমন ভাবে যেনো রেগে চেয়ে রইলো, ‘তোর কি এভাবেই সবার সামনে থাকতে ভালো লাগে? একবার ছেঁড়া কাপড় পড়িস তো আরেকবার শাড়ি খুলে ফেলে দিস!’

আমি ওনার কথা শুনে অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বললাম, ‘আল্লাহ! আপনি এসব নাউজুবিল্লাহ মার্কা কথা বলছেন কেন?’

ওনি ভাব নিয়ে বললেন, ‘আমিতো এমন কিছুই বলিনি! যা সত্য, যা চোখে দেখতে পাচ্ছি দ্যান আমি সেটাই বলছি।’

আমি কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। দেখতে হচ্ছে বিষয়টা! ভেবে যেই না নিজের দিকে দৃষ্টি দিলাম এমনিই দেখলাম আমার শাড়ির কুচি অর্ধেক খোলে বাঁকা হয়ে একদিকে পড়ে আছে, বাকি দিকটাও পড়ে পড়ে অবস্থা। আঁচল সরে গিয়ে আমার পেট আর পিঠ দেখা যাচ্ছে! সুবাহানাল্লাহ!

আমি কি করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সামনে যে অভ্র ভাইয়া আছেন সেটাও আমার মনে নেই এমন একটা অবস্থা। শাড়ির কুচি ঠিক করতে গিয়ে পুরোটা এবার খুলে গেলো। হায় আল্লাহ! এসব যদি মেহমানদের সামনে হতো তাহলে আমি সত্যিই লজ্জ্বা পেতাম। কিন্তু সামনে যে অভ্র ভাইয়া আছেন উনার কথা মনে হতেই নাউজুবিল্লাহ বলে তাকালাম। ওনি আমার দিকে বাঁকা চোখে দেখছেন। আমি তাড়াতাড়ি ঠিকঠাক করে দাঁড়াবার চেষ্টায় রত, কিন্তু শাড়ির কুচি সব খুলে ফ্লোরে পড়ে গেলো।

অভ্র ভাইয়া বললো, ‘কি পারিস রে তুই? সামান্য শাড়িও পড়তে পারিস না। হাউ রিডিকিউলাস!’

—“আপনি পারেন? নিজে তো পারেন না খালি বকবক!”

—“এই চুপ কর।”

—“এখন আমার কি হবে?”

—“তোর কি হবে সেটা না দেখে শাড়ি কিভাবে পড়বি সেটা নিয়ে গবেষণা কর!”

আমি অসহায় চোখে ওনার দিকে তাকালাম। বললাম, ‘আমি তো শাড়ি পড়তে পারিনা, সকালে অনেক কষ্ট করে পড়েছিলাম, এখন আর আমার দ্বারা সম্ভব নয়!’

অভ্র ভাইয়া কিছু একটা ভেবে বললেন, ‘আমি হেল্প করে দিবো?’

আমি চমকে বললাম, ‘না। কখনোই না। ছিহ কি খারাপ চিন্তা আপনার।’

অভ্র ভাইয়া রেগে বললেন, ‘খারাপ চিন্তার কি হলো? যা! নিজের কাজ নিজে কর!’

এদিকে আমিও হ্যাবলাকান্তের মতো ভ্যাবলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, প্রচুর লজ্জ্বা আর অস্বস্তি হচ্ছে। এভাবে আলগোছা শাড়ি নিয়ে কি দাঁড়িয়ে থাকা যায়? কখনো আমি শাড়ি পড়িনি। তাও আবার অভ্র ভাইয়ার সামনে?

আমি কিছু বলছি না দেখে অভ্র ভাইয়া নিজেই এলেন আমায় সাহায্য করতে। আমি অবাক হয়ে তাকাতেই ওনিও রাগী চোখে তাকালেন আমার দিকে। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এভাবে তাকানোর কিছু নেই, আমি ঠিক করার চেষ্টা করছি। বাড়ির বউ তো আর এভাবে মেহমানদের সামনে দাঁড়াতে পারবি না!’

আমি অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি না করার আগেই উনি কুচিগুলো তুলে নিলেন, কোনোমতে ঠিক করে দিলেন। হঠাৎ করে অভ্র ভাইয়া আমার দিকে কেমন গভীর চোখে তাকালেন। আমিও ভ্রু কুঁচকে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ করে আমার চুল গিয়ে পড়লো ওনার মুখে। কিছু বলতেও পারছে না বেচারা। ওনি হাত দিয়ে উনার মুখের উপর থেকে আমার চুলগুলো সরিয়ে পিছনে ছেড়ে দিলো।

আমি একটু সরে শাড়ির আঁচল ঠিক করার জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম। হঠাৎ পেছন ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই অভ্র ভাইয়ার ঠোঁটের ছোঁয়া আমার কপালে পেলাম। আমি সন্দেহী চোখে তাকাতেই অভ্র নামক ইগোওয়ালা ব্যক্তি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমার মনে হলো, উনি আমার মুখোমুখি হতে চাননি!

কিন্তু এটা কি ছিলো? উনি এটা ঠিক কি করলেন এবং কেন করলেন আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। আমার সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। আপাতত শাড়ি সমস্যার সমাধান হওয়ায় আমি একটু শান্তি পেলাম।

১৬.
নীচে নামতেই রাফা এসে আবারও আমার উপর হামলা করলো। এই দুই ভাইবোন এমন কেন বুঝলাম না। একজন অদ্ভুত আর অন্যজন ঘোলাটে। একজন প্রাণ খুলে কলিজার কথা বলতে পারে তো অন্যজন মরে গেলেও কিছু বলবে না। একজনের রাগ প্রায় নেইই আর অন্যজনকে ইগোর কারণে কিছু বলাই দায়। রাফা আমার পাশে এসে বললো, ‘আপ্পি দেখো তোমাকে দেখার জন্য কারা এসেছে!”

কে এসেছে আমি তো দেখেছিই,
কিন্তু চিনিনা। তাই আমি রাফাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে এসেছে?’

—“আম্মুর বান্ধবীরা!”

বলে খুশিতে গদগদ হয়ে রাফা আমাকে একপ্রকার জোর করে ড্রইংরুমে নিয়ে গেলো। উপস্থিত সবাই আমাকে দেখে খুব খুশি। মাশাল্লাহ বলছে সবাই। আমিও হাসিমুখে সালাম দিলাম। একজন আমাকে সোফায় বসিয়ে অন্যদের সাথে কথা বলতে লাগলেন। আমি এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়িনি, বউ বলে ওঠেও যেতে পারছি না। প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে আমার। বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আর তখনই আমার চোখাচোখি হয়ে গেলো অভ্র ভাইয়ার সাথে। আমি তাড়াতাড়ি লজ্জায় অন্য পাশে ফিরে গেলাম। কারণ আমি ইয়া লম্বা এক ঘোমটা দিয়ে সবাফ সামনে বউ হয়ে বসে আছি। নিজের কাছে নিজেকে উদ্ভট লাগছে। কি নিয়তি আমার, হায়! আমার কেন লজ্জ্বা লাগছে বুঝতে পারছি না। সবকিছু আমার কাছে লিমিটনেস লাগছে। কিন্তু অভ্র আহমেদ এখানে এখানো কি করছেন? উনার তো অফিসে যাওয়ার কথা, এতক্ষণ হয়েছে ওনি এখনো যাচ্ছেন না কেন অফিসে?

আমি এসব ভাবছিলাম আর ঠিক তখনই কে যেন আমার কানে কানে বললো, ‘তোমার বর তোমাকে আজ আদর করবে, তাই অফিস যাচ্ছে না। তোমার বর তোমাকে চোখে হারাচ্ছে, বুঝতে পারছো না?’

আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। গলার স্বরটা কার তা নিয়ে আমি ভাবছি না। কথাগুলো ভাবছি, এসব কি বললো? পেছন ঘুরে দেখি কেউ নেই, অথচ আমি সোফাতেই বসা। আমি হঠাৎ ভাবলাম, ‘এটা কি দৈববাণী টাইপ কিছু? দৈববাণীর কথা নাকি বেশিরভাগ সময়ই সত্য হয়? তাহলে কি এই কথাটাও সত্য হবে?’

👉“বাচ্চাদের সালাতের নির্দেশ দাও,যখন তাদের বয়স হয় সাত বছর এবং যখন তাদের বয়স দশ বছর হয় তখন এ জন্য তাদের প্রহার করো।”

-আবূ দাউদ: ৪৯৪

চলবে…