তুমি আমারই পর্ব-১২

0
2591

#তুমি_আমারই
#পর্ব_১২
#Sumaia_Jahan

পৃথিবীতে সবচাইতে কষ্টদায়ক যন্ত্রণা হচ্ছে আপন মানুষ গুলোর থেকে যখন বিশ্বাসঘাতকতা করে।এই যন্ত্রণা সহ্য করা সব থেকে কঠিন।আপন মানুষ গুলোকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে।আপন মানুষ গুলো থাকে পৃথিবীর সবথেকে বড়ো ভরসার জায়গা।আর যখন সেই আপন মানুষ সেই ভরসার জায়গা গুলো থেকেই বিশ্বাসঘাতকতা আসে তখন তার থেকে যন্ত্রনাদায়ক বোধহয় আর কিছু হতে পারে না।আজ আমি এমনই এক যন্ত্রণা ভোগ করছি।এ পৃথিবীতে আমার সবথেকে আপন মানুষ আমার বাপি।আর বাপিই আমার সবথেকে ভরসার জায়গা ছিলো।আমি বাপিকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারতাম।আজ সেই মানুষটাই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো।আমার কাছে এ পৃথিবীতে এর থেকে যন্ত্রণার আর কিছুই নেই।আজ যখন আমি বাপিকে জিজ্ঞেস করলাম সব কিছু জানা সত্বেও কেন রোদ্দুর কে সবার সমনে জামাই হিসেবে পরিচয় করালো? তার উত্তরে বাপি কি বলেছে জানেন?বাপি গম্ভীর গলায় বললো,

—- আশপিয়া আদিকে ভুলে যাও ও তোমার আবেগ ছিলো।এখন তোমার রোদ্দুর এর সাথে বিয়ে হয়ে গেছে তাই এখন রোদ্দুরই তোমার সব।আমি ও দিনের পর থেকে অনেক ভেবেছি। রোদ্দুর খারাপ ছেলে না ও খুব ভালো ছেলে।ও তোমাকে সুখে রাখবে।তাছাড়া আদি তোমাকে সেই ছোটো বেলায় একটা কথা দিয়েছিলো ওর হয়তো এখন আর মনেই নেই তোমাকে।তুমি শুধু শুধু ওর জন্য নিজের জীবনটাকে নষ্ট করো না।ওর যদি আসার থাকতো তাহলে এতোদিনে ও এসে যেতো।আমি তোমাকে এতোদিন কিছু বলি নি কারন আমি ভেবেছি তুমি হয়তো সময়ের সাথে এই আবেগকে ভুলে যাবে তাই।কিন্তু তুমি তো এখনো সেই আবেগ নিয়ে পরে আছো।তুমি এখন এসব আবেগকে ভুলে রোদ্দুর কে মেনে নেও।এতেই তোমার ভালো হবে।

বাপির কথা গুলো শুনে আমি আমি আর একমুহূর্তের জন্যও ওখানে দাড়ালাম না সাথে সাথেই বেরিয়ে এসে একটা গাড়ি করে রোদ্দুরের বাড়ি চলে এসলাম। পিছন থেকে অনেক বার ডেকেছে অনেকে কিন্তু আমি একবারও পিছনে তাকাইনি। কেন তাকাবো আমি ওই মানুষ গুলোর দিকে যারা আমার এতোটা কাছের আপন মানুষ হয়েও আমার সাথে এতো বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করলো।আমার বিশ্বাস নিয়ে এইভাবে খেলতে পাড়লো।কিভাবে বলতে পাড়লো আমার আদিকে আমাকে ভুলে যেতে।তারপর বাড়ি এসে শাওয়ার চালিয়ে শাওয়ারের নিচে বসে বসে অনবরত কেঁদেই চলেছি।

কিছুক্ষণ পর ওয়াস রুমের ওপাস থেকে রোদ্দুর বললো,

—- আশপিয়া তুমি ওভাবে ওই বাড়ি থেকে চলে এলে কেন?তোমাকে আমি পিছন থেকে কতোবার ডাকলাম তুমি শুনলে না কেন?এমন কেন করছো?

আমার খুব হাসি পাচ্ছে যার জন্য আমার পুরো পৃথিবী উল্টে পাল্টে গেল,যার জন্য আমার সব প্রিয় মানুষ গুলো আমার পর হয়ে গেলো সেই আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি এমন কেন করছি।উনার কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি আরো কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থেকে পরে বের হলাম। আমাকে বের হতে দেখে রোদ্দুর একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,

—- যাক বাবা তুমি অবশেষে বের হলে আমি তো ভেবে ছিলাম সারারাত ওয়াস রুমেই থাকবে!

উনার সাথে আজ আমার একবিন্দুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।উনাকে দেখলেই বারবার মনে পরে যায় এই লোকটার জন্যই আজ আমার এ অবস্থা।তাই একটা তাছছিল্যের একটা হাসি দিয়ে পাসকাটিয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পরলাম। অন্য দিন হলে সোফায় শুয়া নিয়ে কতো ঝগড়া হতো। কিন্তু আজ আমি কিছু না করেই সোফায় গিয়ে শুয়ে পরলাম। রোদ্দুর আমার কান্ড দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর নিজেও খাটে শুয়ে পরলো।তারপর ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম।

আজ ভার্সিটি এসে একটাও ক্লাস করিনি। আমি আর ইশা ক্লাস বাদ দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি।ইশা বললো,

—- আশপি বল না আমাকে কি হয়েছে? এভাবে আর কতক্ষণ চুপ করে থাকবি?প্লিজ বল তোর কি হয়েছে?

ওর কথা শুনে আমি ওকে জরিয়ে ধরে কেঁদে দিলাম।ইশা আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ঘাবড়ে গেল।ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

—- আশপি কষ্ট গুলো নিজের মধ্যে রাখিস না অন্যের সাথে কষ্ট গুলো শেয়ার করলে দেখবি একটু হালকা লাগবে।আর তোর কষ্ট কারণ গুলো জানলে যদি আমি কিছু করতেও তো পারি?

আমি চোখ মুছে ইশার দিকে তাকিয়ে বললাম,

—- সত্যি তুই আমার জন্য কিছু করবি?জানিস আমার সব আপন জনেরা আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে?

ইশা আমার হাতে হাত রেখে মুখে একটা হাসি এনে বললো,

—- একবার বলেই দেখ না!

তারপর আমি ইশাকে বিয়ের দিন থেকে ঘটে যাওয়া সব কিছু বললাম
ইশা আমার সব কিছু শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললো,

—- সবই তো বুঝলাম! কিন্তু তুই আদিকে কি করে খুঁজবি তুই তো আদির এখনকার চেহারা টাই চিনিস না?

তারপর দুজনের মধ্যে আবার নিরবতা বিরাজ করলো।কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর ইশা আবারও বলে ওঠলো,

—- আচ্ছা তুই আর দিয়ার কোনো খোঁজ পাসনি।রোদ্দুর ভাইয়া কে জিজ্ঞেস করিস নি দিয়া কোথায়?

আমি হতাশ কন্ঠে বললাম,

—- অনেকবার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি।কিন্তু ওর ফোন বন্ধ। আর উনাকে সে তো আমি প্রথম থেকেই জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি দিয়া কোথায় কিন্তু উনার মুখ থেকে দিয়া সম্পর্কে একটা বের করতে পরিনি।

ইশা বললো,

—- তোর তো একবার দিয়ার বাড়ি গিয়ে খোজ নেওয়া উচিৎ ছিলো।

আমি আবারও হতাশ কন্ঠে বললাম,

—- সে উপায় আমার নেই আমাকে শুধু ভার্সিটি ছাড়া বাড়ির বাহিরে একা এক পাও বের হতে দেয় না ওই রোদ্দুর খান।তবে ভার্সিটিতেও কিন্তু আমাকে একদম একা ছাড়ে না ভার্সিটির বাহিরে কয়েকজন উনার কয়েকজন গার্ড আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য রেখেছে। আর যাওয়া আসার সময় তো রাহাত আসেই। ওকে আবার কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছে যেন আমাকে কোথাও না যেতে দেয় সোজা বাড়ি থেকে যাওয়া আর আসাতে সীমাবদ্ধ থাকে।আমি তো প্রথমে ভেবেছিলাম দিয়ার খোঁজ নিয়ে এখান থেকে পালাবো।কিন্তু আমি এখন এ বাড়ি থেকে পালানো অসম্ভব। পুরো বাড়ির বাহিরে গার্ড দিয়ে ঘিরে রাখা একটা মাছিও ওখান থেকে বের হতে পারবে না।

ইশাও হতাশ কন্ঠে বললো,

—- সত্যি রোদ্দুর ভাইয়া খুবই চালাক। তোর সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এই তুই কিছু করতে পারবি না কিন্তু আমি তো করতে পারবো?আমি তো দিয়ার খোজ নিতেই পারবো?

প্রথম কথা গুলো হতাশ হয়ে বললেও শেষের কথা গুলো খুব উত্তেজনা নিয়ে বললো।ওর কথা গুলো শুনে আমার চোখে মুখে খুশির জ্বলক ফুটে ওঠলো।সত্যি তো আমার হাত-পা বাঁধা কিন্তু ইশা তো চাইলেই খোঁজ নিতে পারে দিয়ার।আমি খুশিতে ওর হাত ধরে বললাম,

—- তুই পারবি দিয়ার খোঁজ নিতে?

ইশাও হাসি মুখে বললো,

—- কেন পারবো না অবশ্যই পারবো।তুই শুধু আমাকে দিয়ার বাড়ির ঠিকানা টা একবার দে দেখবি এক মিনিটেই দিয়ার খোঁজ এনে দিবো।

ওর কথায় আমার অশান্ত মনটা অনেকটাই শান্ত হয়ে গেলো।তারপর আমারা বাকি ক্লাস গুলো করে বাড়ি ফিরে এলাম।আর মাত্র একটা দিনের অপেক্ষা তারপর দিয়ার খোঁজ পাবো।ইশা বলেছে ও কালকের মধ্যেই দিয়ার খোঁজ এনে দিবে।আজ আমার এক একটা মিনিট যেন এক একটা দিনের মতো লাগছে।কিছুতেই সময় কাটছে না কখন যে দিয়ার খোঁজ পাবো সেই উত্তেজনায় আমার সময় কাটছেই না।এমন সময় রুহি আমাকে এতো অস্তির হতে দেখে বললো,

—- ভাবিমনি তুমি কোনো বিষয়ে খুব চিন্তিত?

ওর কথায় আমার ধ্যান ভাঙ্গলো।ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসি হাসি মুখ করে বললাম,

—- না না তেমন কিছু না ওই কিছু পড়া নিয়ে ভাবছিলাম। তো তুমি এখানে কি করতেছো?

রুহি বললো,

—- আমার না আজ মনটা খুব খারাপ।

আমি বললাম,

—- কেন?

রুহি বললো,

—- আসলে আমি সাতার পারি না।কিন্তু আমার বন্ধুরা সবাই সাতার পারে।ওরা আজ কি বললো জানো?

—- কি বললো?

রুহি মুখটা গোমড়া করে বললো,

—- যারা সাতার পারে না তারা নাকি পানিতে ডুবে মারা যায়।আমি পানিতে ভিষণ ভয় পাই।আমি কিছুতেই পানিতে ডুবে মরতে চাই না।জানো আমি আজকে নামাজ পরে আল্লাহর কাছে অনেকবার বলেছি আমাকে যেন পানিতে ডুবিয়ে না মারে।তুমি বলো না আমি কি সত্যি পানিতে ডুবে মারা যাবো।এর থেকে কি কোনো ভাবেই রেহাই পাবো না।

আমি ওর কথা শুনে হাসবো না কাঁদব বুঝতে পারছি না। রুহির মাঝে মাঝে বাচ্চামো কথাবার্তা গুলো শুনলে ভিষন হাসি পায়।কিন্তু আজকে তো পুরো সীমানা পাড় করে গেছে একটা চারপাঁচ বছরের বাচ্চাদের মতো কথা বলছে।এতো বড়ো একটা মেয়ে এই ধরনের কথা বলতে পারবে আমার ধরনার বাহিরে।আমি আর না হেসে পারলাম না। শব্দ করে হেসে বললাম,

—- সিরিয়াসলি রুহি তুমি এই কথার জন্য মন খারাপ করে আছো।তোমাকে ওরা বললো আর তুমিও বাচ্চাদের মতো বিশ্বাস করে নিলে।

রুহির সাথে এরকম আরো কিছু কথা হলো।রুহির মনে হয় ম্যাজিক জানে কারো মন খারাপ থাকলে ওর কথা দিয়েই তার মুখে হাসি ফুটাতে পারবে।এ বাড়িতে আসার পর আমার মন খারাপ হলেই ও কোথা থেকে যেন এসে ওর এমন বাচ্চামো কথা দিয়ে আমাকে ঠিক হাসাবেই।আজকের দিনটা ওর সাথে হাসতে হাসতেই কেটে গেল।

আমার এতো অপেক্ষার করার পর ভার্সিটি এসে এমন একটা কথা শুনতে পাবো আমি জানতাম না। আমার মাথায় পুরো আকাশ ভেঙে পরলো।

চলবে,,,,,,

[ ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]