তুমি আমার প্রেয়সী পর্ব-০৪

0
1406

#তুমি_আমার_প্রেয়সী
#পর্ব_৪
#তাসনিম_জাহান_রিয়া

২০ মিনিট পর রিকসা থামে আমাদের বাসার সামনে। আমরা রিকসা থেকে নামি। অহি ভাড়া মিটিয়ে দেয়। কলিংবেল বাজাতেই মিতু এসে দরজা খুলে দেয়। বাসার ভিতরে প্রবেশ করতেই অহির গালে কেউ ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আমি এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিলাম থাপ্পড়ের শব্দ পেয়ে মাথা উপরে তুললাম।

অহি গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর অহির সামনে দাঁড়িয়ে আছে বড় আব্বু। ড্রয়িংরুমে জুড়ে এখন নিস্তব্ধতা কেউ কল্পনাও করেনি বড় আব্বু অহিকে থাপ্পড় দিবে। আমি তো ভেবেছিলাম থাপ্পড়টা আমার গালে পড়বে।

আব্বু তুমি আমাকে থাপ্পড় মারলে।

অহি বড় আব্বুর দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।

হ্যাঁ মারলাম। তুমি দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছো। বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটা ভুলে যাচ্ছো? তুমি ভার্সিটি ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে বলছো আভিয়ানকে তুমি নিজের ভাই বলে মানো না। ছোঁয়াকে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করেছো। দেখো ছোঁয়া অপমানে কীভাবে কাঁদছে?

ছোঁয়া সোফায় বসে ন্যাকা কান্না কেঁদে যাচ্ছে। কিন্তু ভাইয়া এখানে নেই।

আব্বু তুমি একটা বাইরের মেয়ের কথা বিশ্বাস করে আমাকে মারলে। ছোঁয়াকে তো আমি তেমন কিছুই বলি নাই। ছোঁয়া আর তোমার গুনধর ছেলে মিলে ভার্সিটির সবার সামনে দাঁড়িয়ে কণাকে কানে ধরিয়ে এক পা তুলে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। এর প্রতিবাদ করেছি বলে আমি অভদ্র হয়ে গেছি। তোমরা অসহায় একটা মেয়ের প্রতি যে অন্যায়গুলো করছো তার জন্য তোমাদের পস্তাতে হবে।

অহি কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। বড় মা বড় আব্বুর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

এতো বড় মেয়ের গায়ে তুমি হাত তুললে। তুমি জানো না সন্তানরা বড় হলে তাদের গায়ে হাত তুলতে নেই।

হাত তুলবো না তো কী করবো? দেখলে আমার সাথে কেমন করে কথা বলে গেলো।

সব হয়েছে এই মেয়েটার জন্য। আজকে তোর জন্য ভাইজান অহির গালে হাত তুললো।

আম্মু আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল।

মহুয়া ( আমার আম্মু )তুই সব সময় সব কিছুতেই কণার দোষ খুঁজে পাস। নিজের ভাইয়ের মেয়ের দোষটাও দেখিস। ভার্সিটিতে কী হয়েছে না হয়েছে তা বাড়ি পর্যন্ত টেনে আনতে হলো কেনো ছোঁয়া। আভিয়ান ভার্সিটিতে কণাকে কত কিছু বলে। কণা তো বাড়িতে কাউকে বলে না। আমি আমার মেয়েকে চিনি অহি আর যাই হোক ছোঁয়াকে এভাবে অপমান করেনি।

আপা তুমি কী বলতে চাইছো? ছোঁয়া আমাদের মিথ্যা বলছে।

আমি আর এখানে দাঁড়ালাম না । অহির পিছু পিছু চলে এলাম। অহি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। আমি মাথায় হাত রাখতেই অহি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।

কণা এটা কী সত্যিই আমার আব্বু ছিল। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তোর মনে আছে হামিম স্যারের কথা। আমাকে বাসায় প্রাইভেট পড়াতেন। উনি আমার সাথে জোড় গলায় কথা বলেছিলেন বলে আব্বু উনাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। আজকে সেই আব্বু বাইরের একটা মেয়ের কথা বিশ্বাস করে আমাকে থাপ্পড় মারলো।

অহি প্লিজ শান্ত হ। তুই কেনো আমার হয়ে প্রতিবাদ করিস। আমার হয়ে প্রতিবাদ না করলে তো বড় আব্বু তোকে মারতো না।

তুই প্রতিবাদ করিস না বলেই তো আমাকে করতে হয়। সবাই তোকে এত কিছু বলে এতো অত্যাচার করে কেনো তুই সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে নিস। যেই মানুষগুলো তোকে প্রতিনিয়ত শারীরিক, মানসিকভাবে অত্যাচার করে তুই তাদেরই ভালো চাস। কেউ তোকে থাপ্পড় মারলে তুই তাকে থাপ্পড় না মেরে উল্টো জিঙ্গেস করিস সে হাতে ব্যথা পেয়েছে কী না? তুই এতো ভালো কেনো?

তুই এতো খারাপ তাই আমি ভালো। ( কিছুটা মজার সুরে। )

উফ কণা সব সময় ফাইজলামু ভালো লাগে না আর সব বিষয় মজা করে উড়িয়ে দিলে চলবে না। নিজের লাইফটা নিয়ে এবার একটু সিরিয়াস হও। এতো ভালো হয়ে তুই এই কঠিন দুনিয়াই ঠিকতে পারবি না। কেউ অপমান করলে মুখ বুজে সহ্য না করে তার করা অপামানের যোগ্য জবাব দিতে শিখ।

যে আমাকে সবচেয়ে বেশি অপমান করে সে আমার মা। সত্যি বলতে আমার জন্যই তো আম্মু সব কিছু হারিয়েছে। আমার জন্যই তো আব্বু আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

তোর কি সত্যিই মনে হয় ছোট আব্বু তোর জন্য আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে?

জানি না।

_________________

ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশে থালার ন্যায় চাঁদ উঠেছে। চাঁদকে ঘিরে মিটিমিটি জ্বলছে অসংখ্য তারা। এতো এতো তারার ভীরে চাঁদ যেনো বড্ড একা। আমার মতোই একা। পৃথিবীর এতো এতো মানুষের মাঝে আমি একা। আমার আপন একান্তই নিজের বলতে কেউ নেই। এতক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু আজকে একটুও ভয় করছে না। ছাদ জুড়ে নিস্তব্ধতা। আজকে এই নিস্তব্ধতা অনেক আপন লাগছে। হঠাৎ মনে হলো আমার পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। আমার পাশে ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়ার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আবার আকাশ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

আজকে সবকিছু তোর জন্য হয়েছি।

আমি উনার কথার কোনো জবাব দিলাম না। উনার সাথে একদম কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। উনার সাথে কথা বলা বা উনাকে দেখার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা ও নেই।

তোর জন্য অহি আমার সাথে এভাবে কথা বলছে। যেই মেয়ে আমি বলতে অঙ্গান ছিল সেই মেয়ে বলে আমাকে সে ভাই বলে মানে না। আব্বু আজকে ওকে থাপ্পড় মেরেছে। আব্বু কখনো অহির সাথে কড়া গলায় কথা বলেনি আর আজকে ওকে থাপ্পড় মেরেছে। আমার ছোট বোনটা কত কষ্ট পেয়েছে। আমি তোকে কখনো ক্ষমা করবো না।

আমি এবার ভাইয়ার দিকে ফিরে তাকাই।

সব সময় সবকিছুর জন্য আমাকে ব্লেইম করা বন্ধ করো। তোমরা কী ভাবো সব সময় তোমাদের সব অন্যায় আমি মুখ বুজে মেনে নিবো? অন্যের করা অন্যায়ের শাস্তি আমি কেনো পাবো। আজকে অহি আমার জন্য থাপ্পড় খায়নি খেয়েছে তোমার ন্যাকো থার্ড ক্লাস গার্লফ্রেন্ডের জন্য। ছোঁয়া বড় আব্বুকে অহির নামে মিথ্যা বানিয়ে বানিয়ে বলেছে। এই থাপ্পড়টা অহির গালে না পড়ে তোমার গালে পড়া উচিত ছিল। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইলে তো আমাকে ক্ষমা করার সুযোগ পাবে। তোমার মত লোকের কাছ থেকে ক্ষমার
চাওয়ার জন্য তো আমি বসে আছি।

কথাগুলো বলে এক দৌড়ে রুমে চলে আসলাম। বুকে হাত বড় বড় শ্বাস নিচ্ছি। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না আমি ভাইয়াকে এতগুলো কথা শুনিয়েছি।

_____________

এদিকে আভিয়ান নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যে মেয়ে তার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস পায় না। সেই মেয়ে তাকে এতগুলো কথা শুনিয়ে গেলো।

–“বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয় না হ্নদয়
কতটা তোমায় ভালবাসি…
চলতে গিয়ে মনে হয়
দুরত্ব কিছু নয়
তোমারি কাছেই ফিরে আসি
তুমি তুমি তুমি শুধু এই মনের
আনাচে কানাচে….
সত্যি বলোনা কেউ কি প্রেম হিনা
কখনো বাঁচে…..
তুমি তুমি তুমি শুধু এই মনের
আনাচে কানাচে….
সত্যি বলোনা কেউ কি প্রেম হিনা
কখনো বাঁচে…..
বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয় না হ্নদয়
কতটা তোমায় ভালবাসি

–“মেঘের খামে আজ তোমার নামে
উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দিলাম
পড়ে নিয়ো,তুমি মিলিয়ে নিয়ো
খুব যতনে তা লিখে ছিলাম..
মেঘের খামে আজ তোমার নামে
উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দিলাম
পড়ে নিয়ো,তুমি মিলিয়ে নিয়ো
খুব যতনে তা লিখে ছিলাম..
ও-চায় পেতে আরো মন
পেয়েও এতো কাছে…
বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয় না হ্নদয়
কতটা তোমায় ভালবাসি..”

–“মন অল্পতে-প্রিয় গল্পতে
কল্পনায় স্বপ্ন আঁকে…
ভুল ত্রুটি আবেগী খুনসুটি
সারাক্ষন তোমায় ছুঁয়ে রাখে
মন অল্পতে-প্রিয় গল্পতে
কল্পনায় স্বপ্ন আঁকে…
ভুল ত্রুটি আবেগী খুনসুটি
সারাক্ষন তোমায় ছুঁয়ে রাখে
ও-চায় পেতে আরো মন
পেয়েও এতো কাছে…
বলতে চেয়ে মনে হয়
বলতে তবু দেয় না হ্নদয়
কতটা তোমায় ভালবাসি”

বেলকনিতে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে গান গাইছে এক ছেলে। গানটা হয়তো তার প্রেয়সীর জন্য গাওয়া। ছেলেটি যখন গান গাইতে ব্যস্ত তখনি বেলকনিতে প্রবেশ করে ৪৫-৪৬ বছরের বয়সের মহিলা। মহিলাটি চেহেরায় বয়সের কোনো ছাপ নেই। হুট করে কেউ দেখে বলতে পারবে না এই মহিলাটির এত বড় একটা ছেলে আছে। ছেলেটি মহিলাটির উপস্থিতি বুঝতে পেরে গান গাওয়া অফ করে দেয়।

আজকে তো আমি কোনো শব্দ করি নাই। তাহলে তুই বুঝলি কী করে আমি এসেছি?

ছেলেটা তার মায়ের কাছ কফিটা নেয়। তার মাকে টেনে তার পাশে বসিয়ে দেয়। তার মায়ের কাধে মাথা রেখে বলে,

তোমার শব্দ করতে হবে না আমি তোমায় উপস্থিতি অনুভব করতে পারি। তোমার শরীর থেকে একটা মা মা গন্ধ আসে। এই গন্ধটাই তোমার উপস্থিতি আমাকে জানান দেয়।

আমার পিচ্চি ছেলেটি কী কারো প্রেমে পড়েছে নাকি?

প্রেমে তো আমি অনেক আগেই পড়েছি। তার মায়বী মুখের মিষ্টি হাসিতে। শুধু তাকে বলতে পারি নাই। মা জানো ও সবার থেকে আলাদা। আর চার পাঁচটা মেয়ের মতো ও না।

চলবে…..