তুমি কেন আগে আসোনি? পর্ব-১০

0
510

“তুমি কেন আগে আসোনি?”

১০.
দুই সপ্তাহ পর আজ হসপিটাল থেকে ফিরলো সিনথিয়া। অনেক ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত অবস্থায়। ওর বাসায় এখনো জানে না সিনথিয়ার প্র‍্যাগনেন্সির কথা। ওকে হসপিটালে এডমিট করেই সবাই চলে গেছিলো। দিনে একবার এসে দেখে গেছে শুধু। বারতি কোনো খোজ নেয়নি। তাই ডাক্তার ওর পরিবারকে ওর হেলথ কনন্ডিশান জানাতে পারেনি। আজ আসার সময় ডাক্তারই এসব বলেছে ওকে। প্রথমে খারাপ লেগেছিলো। পরে মানিয়ে নিয়েছে।

সোফায় বসেই শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে। শরীরের অবস্থার সাথে মনের অবস্থাও খুব খারাপ। আসমা এসেই গজগজ শুরু করেছে। সিনথিয়াকে নিরলস দেখে আরো রেগে গেছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

— “লুইচ্চা মা** কোথাকার। ছোকছুকানি স্বভাবের জন্য জামাইর ভাত খেতে পারলি না। তারপরেও দেমাগ কমে না তোর?”
— “কি দেমাগ দেখিয়েছি মা?” অসহায় কণ্ঠে বললো সিনথিয়া।
— “জানিস না তুই? তোর এসব দেমাগের কারণেই সায়ান তোকে ছেড়েছে। ব্যাশ্যা মা**। বাইরে বাইরে ব্যাশ্যাগিরি করতে ভালো লাগে তোর। জামাইর লগে নোখড়া মারাস৷”
— “মা। আমার কোনো দোষ ছিলো না। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি সংসার টিকিয়ে রাখতে…।”
— “তোর হে** করছিস মা**।”

সিনথিয়া চোখ বন্ধ করে নিলো। ধীরস্থির কণ্ঠে বললো,
— “এভাবে গালাগাল করো না মা।”
— “কি করবি তুই হ্যাঁ? একশবার গালি দিবো। তোর কারণে আজকে আমার পরিবারের দিকে আঙুল তুলবে সবাই। চরিত্রের দোষের কারণে জামাইর ভাত খেতে পারলি না। কি বলেছিলি তুই যার কারণে সায়ান সরাসরি ডিভোর্স দিলো তোকে?”
— “কিছুই বলিনি মা।”

সিনথিয়ার এমন নির্লিপ্ততা দেখে আসমা ওকে টেনে তুলে দাড় করিয়ে গালে চড় বসিয়ে দিলো। সিনথিয়ার মেঝ ভাবি রিহা এসে টেনে সরিয়ে আনলো সিনথিয়াকে। আসমাকে বললো,

— “কি শুরু করেছেন মা আপনি? মাত্রই এলেন। এখনই এসবের কি দরকার ছিলো?”
— “এই মেয়ের জন্য এখন কি একটা অবস্থায় পরেছি আমরা সেটা বুঝতে পারছো? ইচ্ছে তো করছে গলা টিপে মেরে ফেলি আপদটাকে।”

রিহা সিনথিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— “এই সিনথিয়া তুমি তোমার রুমে যাও।”

সিনথিয়া কোনোরকমে উঠে নিজের রুমে এলো। দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে ঘেঁষে দাড়ালো। হাতটা পেটে চলে গেছে। ঢুকরে কেঁদে উঠে সিনথিয়া। খুব কষ্ট হচ্ছে। যখন বাবুটা পেটে এসেছিলো ওকেই একমাত্র আপন মনে হয়েছিলো। খুব আপন। মনে হয়েছিলো ওর বাবুটা ওকে বুঝবে। কিন্তু বাবুটাও ওকে ছেড়ে চলে গেছে। একা করে দিয়ে চলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে সিনথিয়া মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পরে। চলতে থাকা ফ্যানের দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে।

.
অফিসিয়াল ভাবে আজকে সিনথিয়ার ডিভোর্স সম্পূর্ণ হলো। একটু আগেই লয়ার এসে কাগজে সাইন করিয়ে নিয়ে গেছে। সিনথিয়া এখন নিজের রুমের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা নামবে নামবে এমন সময় আকাশটা দেখতে খুব ভালো লাগে। আনমনা হয়ে আকাশটাই দেখতে লাগলো। কত কি না করেছে এই সংসার টিকাতে। কত কাঠখড় পোড়ালো। তারপরেও টিকেনি। সিনথিয়া নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। ওদের কটুকথা, অপমান, অবহেলা সব সয়ে নিয়েছিলো। সারাদিন বান্দীর মতো খেটেছে। নিজের ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত বিসর্জন দিলো তারপরেও হলো না।

সিনথিয়া নিজের ইদ্দত পালনকালীন সময় পার করছে নিজের রুমেই। এটা ওর মায়ের সহ্য হচ্ছে না। কেনো ঘরে ঢুকে থাকবে, কেনো এমন ঘরবন্দী হয়ে থাকবে এটাই ওর মায়ের কথা। হিসহিস করে সকাল থেকেই সিনথিয়াকে বকছে। এখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

— “বান্দীর ঝি রুম থেকে বাহির হো। তোর এই গর্তে ঢুকার স্বভাবের কারণেই সায়ান তোকে ছেড়েছে। ব্যাশ্যা কোথাকার। স্বামীর সাথে নোখড়া করে গর্তে ঢুকে থাকোস। আর বাইরের ব্যাডার লগে ডলাডলি করস। ওই শুয়োরের বাচ্চা বাহির হো।”

সিনথিয়া বেডের এককোনায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। এসব খোটা শুনতে একদম ভালো লাগে না। ডিভোর্স হয়েছে আজ দুইমাস। একটাদিনও শান্তি পেলো না এই বাড়িতে। দুইহাতে নিজের কান চেপে ধরে ফুপিয়ে কাঁদছে। সিনথিয়ার মনে হচ্ছে সায়ানদের থেকে ওর বাড়ির মানুষগুলোই ওকে বেশি ঘৃণা করে। একটাবার ওর অবস্থা জিজ্ঞেস করলো না। জানতেও চাইলো না কোনোকিছু। শুধু ওকেই দোষারোপ করে চলেছে। ওর বাবা তো বলেই দিয়েছে ওর মুখ আর দেখবে না। ভাইরা তো আগে থেকেই অবহেলা করতো। এখন আরো বেশি করে।

আছরের আযান পরতেই সিনথিয়া ওযু করে সালাতে দাড়ালো। সিজদায় যেতেই একেবারেই মুষরে পরেছে। এতোকিছু আর সহ্য হচ্ছে না।

সালাত শেষ হতেই উঠে দাঁড়ায়। জায়নামাজ ভাজ করে রেখে জানালার সামনে দাড়ালো। এখন একটু শান্তি লাগছে। আসলে সালাতেই অনেক শান্তি আছে। এটা যদি সব মানুষ বুঝতো তাহলে তারা প্রতিবার সিজদায় লুটিয়ে পরতো। ওর জানালা বরাবর অনেকটা দূরে একটা পুকুর আছে। পুকুরের অপাশে বস্তি। পুকুরের পাশ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। প্রায় সময় এই গাছটার দিকে তাকিয়ে সিনথিয়া কষ্টের সময়গুলো পার করে দেয়। সিনথিয়া অনেককিছু চিন্তা করছে। কিভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়।

টেবিলের উপর নিজের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো। ওর অর্ধেক করা এসাইনমেন্ট এখনো টেবিলে পরে আছে। সিনথিয়া একটা বই নিয়ে বিছানায় বসলো। অনেক পিছিয়ে গেছে। এখন পড়তে চাইলে আবার অনার্স প্রথম বর্ষ থেকেই শুরু করতে হবে। ড্রয়ার হাতিয়ে ওর ব্যবহৃত পুরানো বাটনসেট মোবাইল বের করলো। মোবাইলটা দেড় বছর ধরে ব্যবহার করা হয়না। ধুলো জমেছে অনেক। ফু দিয়ে সব ধুলো সরিয়ে কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে রইলো। সিনথিয়া নিজেই নিজেকে বলে উঠলো,

— “এভাবেই ফু দিয়ে সায়ানের সব স্মৃতি, সব অতীত মুছে দিতে চাই। আল্লাহ আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আপনার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।”

মোবাইলটা অনেক ঘেটেঘুটে ওর বান্ধুবি সাইমার নাম্বার পেলো। এই মেয়েটা পড়ালেখায় অনেক ভালো। ওর কাছ থেকেই কিছু জেনে নেয়া যাবে। ফোন দিলো সিনথিয়া। শেষবার টাকা রিচার্জ করেছিলো দেড় বছর আগে। এখন কল যাবে কিনা বুঝতে পারছে না। নানান কথা চিন্তাভাবনা করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি স্বরে কেউ ‘হ্যালো’ বলে উঠলো। সিনথিয়া অনেকটা চমকে উঠেছে। ও ভেবেছিলো কল যাবে না। অপাশ থেকে ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’ বলেই চলেছে। সিনথিয়া নিজেকে সামলে বললো,

— “আসসালামু আলাইকুম। সাইমা আমি সিনথিয়া বলছি।”
— “সিনথিয়া তুই? এতোদিন পর? না না দিন নয়। পুরো দেড় বছর পর। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি? আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোর খোজা নেয়ার। কিন্তু পাইনি। কি হয়েছিলো তোর?”
— “ব..বিয়ে হয়ে গেছিলো তাই।”
— “ওহ! তাই বলে যোগাযোগ রাখবি না? আচ্ছা এখন বল কেমন আছিস? দুলাভাই কেমন আছে?”
— “আস..আসলে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে।”

ওপাশ থেকে অনেকসময় নিরব রইলো। সিনথিয়াও চুপ করে রইলো। নিরবতা কাটিয়ে সাইমা বললো,

— “পড়ালেখা শুরু কর সিনথু। বোঝা হোস না কারো।”

সিনথিয়া ঢুঁকরে কেঁদে উঠে। এই একটা মেয়েই ওকে বোঝে। সেই স্কুল জীবন থেকেই সাইমার সাথে বন্ধুত্ব। সাইমা শান্তনা দিয়ে বললো,

— “কাঁদিস না। নিজেকে শক্ত করে। তুই খুব দুর্বল এবং বোকা সিনথু।”
— “আমি..আমি চাই আবার সব শুরু করতে নতুন করে। কিন্তু বাসা থেকে আমাকে কোনোরকম সাহায্য করবে না।”
— “তুই চিন্তা করিস না। এই মাসে আমার কাছে তিনিটা টিউশন অফার এসেছে। আমি আজই মানা করে দিতাম কারণ সময় পাচ্ছিলাম না। ভাগ্যিস তুই ফোন করেছিলি। আর চিন্তা করিস না পেমেন্ট নিয়ে।ওরা তোকে অনেক ভালো বেতন দিবে।”
— “শুকরিয়া দোস্ত।”
— “তবে আরো কিছুদিন সময় পর শুরু করতে হবে। কারণ এখন তো মাসের মাঝামাঝিতে আছিস। আগামী মাসের পরের মাস থেকে পড়াতে পারবি।”
— “আলহামদুলিল্লাহ। ঠিকাছে। এদিকে আমার ইদ্দতও শেষ হয়ে যাবে।”
— “ওকে দোস্ত রাখছি।”
— “ঠিকাছে। আসসালামু আলাইকুম।”
— “ভালো থাকিস। ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”

সিনথিয়ার এখন খুভ ভালো লাগছে। বইটা নিয়ে অনেকক্ষণ পড়েছে। অনেক কিছু ভুলে গেছে। আবার কিছু বিষয় আবছা মনে আছে। বইটা নিজের পাশে রেখে শুয়ে রইলো। তারপর উঠে ওর ছোটখাটো বুকসেল্ফের কাছে গেলো। সেল্ফের প্রথম তাকেই ওর আকীদার বই, ইসলামী শারিয়াহর বই, ফিকহের বই পরে আছে। এই বইগুলো কিনায় কত অপমান সইতে হয়েছে নিজের বাড়িতে। কত জঙ্গি, ভূত নাম উপাধি পেয়েছিলো। কিন্তু সেসবের একেবারেই পরোয়া করেনি সিনথিয়া। বইগুলোতে ধুলো জমেছে মোটা আস্তরণে। সব বই সেল্ফ থেকে নামালো সিনথিয়া। সেল্ফটা পরিষ্কার করে বইগুলো সব মুছে পরিষ্কার করে আবার সাজিয়ে রাখলো সেল্ফে। টেবিলও পরিষ্কার করে নিলো।

রুমটার দিকে ভালো করে চোখ বুলালো। অনেক ময়লা হয়ে আছে। এতোদিন নিজের মনের অবস্থা খুব বিধ্বস্ত ছিলো তাই কোনোদিকেই নজর দেয়নি। মাগরিবের সালাতের পর অল্প সময় থাকে এশারের। তাই আর রুম পরুষ্কারের কাজে গেলো না। আকীদার একটা বই নিয়েই বিছানায় গড়িয়ে পরলো।

পরিবারের সবাই সবসময়ই ওকে দূরে দূরে রেখেছে। যার কারণে এই রুমটাতেই নিজের একটা আলাদা জগত বানিয়ে নিয়েছিলো সিনথিয়া। অল্প কিছু পাতা পড়ে বইটা রেখে দিলো। এশারের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। সালাত শেষেই লেগে পরলো ঘর পরিষ্কার করার কাজে। সব ধুয়ে মুছে খুব ক্লান্ত হয়ে পরেছে। খাওয়া আর হলো না। ওভাবেই ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পরলো।

____________________________
আজ সিনথিয়া ভার্সিটি যাবে আবার। ইদ্দত শেষ হয়েছে দশদিন হলো। বোরকা পরে রেডি হয়ে নিলো। নিজেকে আয়নায় দেখে মনে হলো এটা সেই দেড় বছর আগের সিনথিয়া। যার জীবনে কখনো সায়ান নামের কেউ আসেনি। কিন্তু বাবুটার কথা মনে হতেই হাতটা পেটে চলে গেলো। নিরবে অনেকক্ষণ কেদেছে। তারপর নিজেকে শক্ত করে নিলো। কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। বের হওয়ার সময় আসমা হুঙ্কার দিয়ে বললো,

— “কোথায় যাচ্ছিস?”
— “অনেক তো হলো মা। এবার নিজেকে নিয়ে একটু ভাবতে চাই। পড়ালেখাটা আবার শুরু করতে চাই।”
— “কলেজের নাম দিয়া ফষ্টিনষ্টি করতে বাইরে যাচ্ছসি। বুঝি না ভেবেছিস?”
— “তোমাদের যা বুঝার বুঝে নাও। তবে এবার আর আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। অনেক করেছো তোমরা। আর আমিও মেনে নিয়েছি। আর নয়।”

সিনথিয়া চলে যাচ্ছিলো। মিম ওকে ডেকে বললো,

— “এতো যে তেজ দেখাচ্ছো এসবের খরচ চালাবে কি করে? নাকি নতুন লোকটা সব দিবে?”
— “আসলে ভাবি একটা বিষয় জানো। যে এককালে নাগড়ের টাকায় চলেছে সেই সবাইকে এরকম মনে করে।”

মিম দাঁতে দাঁত চেপে সিনথিয়ার দিকে তাকালো। সিনথিয়া হেসে বললো,

— “বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিন্তু তোমাকে মিন করিনি.. হুম? প্রতিশোধ নিতে আবার নতুন ফাঁদ পেতো না।”
— “কিসের প্রতিশোধের কথা বলছো তুমি?”
— “আমার থেকে তুমিই ভালো জানো। আর শুনো, যে আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। অবশ্য এই কথাটা তোমাদের কাছে যদিও ডালভাত। তবে আমার কাছে কথাটার মূল্য অনেক।”
— “বেশ কথা বলতে শিখেছো দেখছি।”
— “আমার হয়ে তো কেউ বলবে না। তাই নিজেরটা নিজেকেই বলতে হবে। চিন্তা করো না তোমার স্বামী থেকে টাকা চাইবো না। টিউশন পেয়েছি। আশা করি আল্লাহ এই অল্প টাকাতেই আমার প্রয়োজন মিটিয়ে দেবেন ইংশাআল্লাহ।”

সিনথিয়া বেরিয়ে গেলো। দাড়ালো না। রিকশা নিয়ে পৌছে গেলো কলেজে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কালই শুনেছিলো সায়ান নাকি আবার বিয়ে করেছে এবং বউটা দেখতে পুতুলের মতো। এসব শুনে সিনথিয়া কতক্ষণ থমকে বসে ছিলো। অজান্তেই চোখ কোণ থেকে জলও গড়িয়েছিলো। সারারাত চোখে ঘুম আসেনি। যতই হোক লোকটার প্রতি মায়া জন্মে ছিলো। সেইজন্যই খারাপ লেগেছে। সকালেই নিজেকে কঠিন করে নিয়েছে। আর কোনো পিছুটান নয়। সব শেষ। এবার নিজেকে নিয়েই চলতে হবে।

কলেজ, টিউশন তারপর বাসায় ফিরে পড়ালেখা করা। এভাবেই সিনথিয়ার দিন যেতে লাগলো। এরমধ্যে অনেক উড়ো খবর পেয়েছিলো সায়ানকে নিয়ে। সিনথিয়া সেসব বিষয় পাশ কাটিয়ে গেছে। আরশিও নাকি এসেছিলো ওদের বাসায়। ওর বাবা প্রথমে ঢুকতে দিতে চায়নি ঘরে। নিজের মেয়ের সাথে এমন করেছে তাই হয়ত একটু খারাপ লেগেছিলো। কিন্তু যখনই আরশি কেঁদে কেটে ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইলো ওমনি ভাইও গলে গিয়ে বাসায় এনে ঢুকালো। এসব কথা রিহাই সিনথিয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে মোবাইলে কাউকে বলেছে। সিনথিয়ার এসবে কিছু যায় আসেনা এখন আর। নিজের মতো করেই আছে।

.
খুব ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলো সিনথিয়া। লিডিংরুমে আসতেই শোরগোল শোনা গেলো। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলো অনেকে বসে আছে। তারমধ্যে আরশিকেও দেখলো। সিনথিয়া চলে আসছিলো। মিমই ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

— “সিনথিয়া এতোসময় কোথায় ছিলে?”
— “ভাবি তুমি জানো আমি কোথায় ছিলাম। তাই আপাতত তোমাকে উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। তবুও যদি তোমার উত্তরের প্রয়োজন হয় তাহলে তোমার যেই চামচা আমার পিছনে লাগিয়েছো তার থেকে জেনে নিও।”
— “কিসব বলছো এসব সিনথিয়া? আমি তোমার পেছনে?”
— “ভাবি প্লিজ স্টপ দিস ননসেন্স। এখন আমার এসব মেলোড্রামা লাগছে।”

এরমধ্যে একটা মেয়ে বললো,

— “আচ্ছা তুমি যে এভাবে প্যাকেট হয়ে আছো গরম লাগে না?”
— “কিজানি। হয়ত লাগে না৷ আমার কিন্তু সিনথিয়াকে এলিয়েন বেশি মনে হয়।” রিহার বান্ধুবি বললো।

এইকথায় সবাই হাসলো। সিনথিয়া নিকাব উঠিয়ে একটা দম নিলো। মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস বের করে দিলো। তারপর হাসি হাসি মুখে বললো,

— “আসলে কি হয়েছে জানো। আমরা যারা এরকম প্যাকেট হয়ে ঘুরি তারা সবাই সারা বছর প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত থাকে। তাই এরকম বস্তায় ঢুকে চলাফেরা করি। আর আমাদের গায়ের তাপে আশেপাশের সবাই ঝলসে নিজেদের কাপড় খুলে নেয়।”
— “কাপড় খুলে নেয় মানে?”
— “এই যে, আমি এখানে দাঁড়িয়েছি দেখে সবাই উত্তাপে কাপড় খুলে নগ্ন হতে শুরু করেছে। দেখো আশেপাশে তাকিয়ে।”

মেয়েটা সত্যিই আশেপাশে তাকালো। এদিকে বাকি সবাই কটমট চোখে সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ সবাই ওয়েস্ট্রান ড্রেস পরে আছে। সিনথিয়া মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,

— “আমার মনে হচ্ছে তুমিই একটু বেশিই আমার গায়ের গরমে পুড়ে যাচ্ছো।”

সিনথিয়া মুচকি হাসলো। মেয়েটা এবার বুঝলো সিনথিয়া আসলে কি বুঝিয়েছে। অপমানিত বোধ করলো। মেয়েটা হাটুর উপরে উঠানো কালো স্লিভলেশ ফ্রক পরেছে। সিনথিয়া চিনে না মেয়েটাকে। তাই আর কথা বাড়াতে চাইলো না। এরমধ্যেই রিহা বলে উঠলো,

— “শুনো সিনথিয়া, মনের পর্দাই হচ্ছে বড় পর্দা। আমা…।”
— “আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া!”

রিহা লাফিয়ে উঠে সরে গেলো। কান হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রেগে বললো,

— “সিনথিয়া এসব কি ধরনের বাচ্চামি। তুমি আমার কানের সামনে এতো জোরে চেচালে কেনো?”

সিনথিয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নখ খুটতে খুটতে বললো,

— “তুমিই তো বললে মনের পর্দা বড় পর্দা। তাহলে মনের পর্দা দিয়েই শুনবে। কানের পর্দার কি দরকার?”
— “ইউ জঙ্গি…।”

সিনথিয়া ওর ব্যাগ থেকে বলের মতো গোল একটা কাগজ নিয়ে রিহার দিকে ছুড়ে মেরে বললো,

— “ভাবি বোম। এখনি তোমাকে ব্লাস্ট করে দিবে।”

রিহা আবারও লাফিয়ে উঠে সরে গেলো। বাকি সবাই-ও একটু চেচিয়ে উঠে নিজেদের জায়গা থেকে সরে গেলো। নিজের অপ্রয়োজনীয় কাগজ সিনথিয়া এরকম বল বানিয়ে সবসময় ব্যাগে রাখে। কারণ কখনো কখনো টিস্যু পায়না। তখন এসব কাগজ দিয়ে চালিয়ে দেয়। সিনথিয়া হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরে নিজের রুমে চলে এসেছে। এতোটা বিনোদন আগে কখনো পায়নি।

চলবে,,,,
® ‘নুরুন নাহার’