তুমি কেন আগে আসোনি? পর্ব-১১

0
586

“তুমি কেন আগে আসোনি?”

১১.
কলেজ, টিউশন, পড়ালেখা এসবের চাপে একেবারে হাপিয়ে উঠেছে সিনথিয়া। আজ একটু ফ্রি সময় পেয়েছে। টিউশন গুলো আজ বন্ধ। তাই ভাবলো কলেজ থেকে বাসায় ফিরে যাবতীয় কাজ শেষ করে একটু ঘুমাবে। বিকেলে একটু ছাদে হাটাহাটি করবে। এতে যদি একটু মাইন্ড ফ্রেস হয় আরকি।

কলেজ থেকে তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরলো সিনথিয়া। রিকশায় বসেই এসব চিন্তা ভাবনা করছিলো। আজকে একটু খুশি লাগছে কারণ আজ একটা ছোট চারা গাছ কিনেছে। এটা বেলীফুলের গাছ। গাছটা ওর রুমের বারান্দায় লাগাবে। ফুল ফুটলে ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরবে রুমে। এসব ভেবেই কিনা।

রিকশাভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গেইটের ভেতরে ঢুকলো। ওদের বাসাটা পাঁচতালা। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা আছে গাড়ি পার্কিং করার। ওরা তিনতালায় থাকে। বাকি সব ফ্লোর ভাড়া দিয়ে রেখেছে। তিনতালায় পৌছে নিজেদের ঘরের দরজার সামনে দাড়াতেই দেখলো দরজা খোলা। সিনথিয়া এসব ঘাটলো না। কারণ দরজা সবসময় এরকম খোলা থাকে। সিনথিয়া ভেতরে ঢুকে সামনে এগোতেই থেমে গেলো।

একটা শীতল শিহরণ বয়ে গেলো সর্বাঙ্গ জুড়ে। আশেপাশে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো। প্রায় একবছর পর দেখছে সায়ানকে। সায়ানও ওকে দেখে থেমে গেছে। সিনথিয়া নিজেকে সামলে নিলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিরে এলো। সবকিছু মনে পরতেই সায়ানকে পাশ কাটিয়ে চলে এলো রুমে। রুমে এসে দেখলো ওর দুই ভাবি কাউকে ঘিরে বসে আছে। সিনথিয়া রুমে প্রবেশ করে কাধ থেকে ব্যাগ রাখলো। নিকাব খুললো। কেমন যেনো একটা ফিলিংস কাজ করছে। সবকিছু স্থির মনে হচ্ছে। সিনথিয়ার বড় ভাবি ওকে বললো,

— “দেখো সিনথিয়া তোমার রুমে কে এসেছে?”
— “(——)”
— “সায়ানের বউ এসেছে।”

সিনথিয়া এবারো থমকালো। বিবাহিত জীবনে লোকটা একটুও শান্তি দেয়নি। বিয়ের পরেও শান্তি দিচ্ছে না। চাইছে কি এই লোকটা? কখনো নিজের মাকে এখানে আসতে বলবে। আবার কখনো নিজে বউকেসহ নিয়ে টপকাবে। লজ্জাসরম বলতে কিছু নেই নাকি? নির্লজ্জ লোক একটা। সিনথিয়া ঘুড়ে দাড়ালো। সায়ানের বউয়ের দিকে তাকিয়ে আরেকদফা থমকে গেলো।

পিউর লাল রঙের শাড়ি পরেছে মেয়েটা। ফর্সা গায়ে খুব মানিয়েছে। মনে হচ্ছে এই রঙটা সায়ানের বউয়ের জন্যই তৈরি হয়েছে। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক। স্লিভলেস ব্লাউজ পরেছে। সত্যিই অপূর্ব লাগছে। একটা জীবন্ত পুতুল মনে হচ্ছে। সিনথিয়ার নিজেকে একেবারেই নগণ্য মনে হলো মেয়েটাকে দেখে। সিনথিয়া ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিলো মেয়েটার উপর থেকে। রিহা এগিয়ে এসে বললো,

— “আসো সিনথিয়া তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই অপ্সরার সাথে।”

অপ্সরা! সত্যিই মেয়েটা দেখতে অপ্সরীদের মতো। নামের সাথে চেহারা এবং গড়নের বেশ মিল আছে। অপ্সরা সিনথিয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। এখনো তাকিয়ে আছে। সিনথিয়া যেমন থমকেছে অপ্সরাকে দেখে ঠিক তেমনই অপ্সরাও থমকেছে সিনথিয়াকে দেখে। অপ্সরার ধ্যান ভাঙলো মিমের ডাকে। বললো,

— “অপ্সরা এই হলো আমাদের সিনথিয়া। এতক্ষণ তোমাকে ওর কথাই বলছিলাম।” সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, “জানো সিনথু, অপ্সরা আর সায়ানের দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্ক ছিলো। সেই ভালোবাসা এবার পরিণতি পেলো।”

সিনথিয়ার এবার বেশ মেজাজ গরম হলো। ইচ্ছে করেই এই দুই নারী ওর কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে। এতো ঘাটানোর কি আছে ওকে? সারাদিন খোটা দিয়ে মন ভরে না এখন আবার এই মেয়েকে সামনে এনে ওকে আরো গুড়িয়ে দিতে চাইছে। সিনথিয়া বিরক্তি নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। অপ্সরা বললো,

— “তুমিও বেশ সুন্দর।”

সিনথিয়া তাকালো মেয়েটার দিকে। আবার নজর ফিরিয়ে নিলো। মনটা এখন একদম বিষিয়ে গেছে। ভালো লাগছে না কিছু। সিনথিয়াকে আরেকটু দহনে দগ্ধ করতে রিহা বললো,

— “আরে কি যে বলো না অপ্সরা। কোথায় তুমি আর কোথায় সিনথিয়া। তোমার দিকে একবার কারো চোখ পরলে চোখ ফেরানো দায়। আর সিনথিয়া তো কালো। ময়লা রঙের। এতে আর সুন্দর কি!”

সিনথিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইচ্ছে করেই ক্ষেপাচ্ছে ওকে এরা এটা বেশ ভালোই বুঝলো। তবুও সেদিকে মন দিলো না। একটা চিনচিন ব্যাথা কাজ করছে বুকের বা পাশে। হয়ত কিছুটা মায়া এখনো রয়ে গেছে সেই পাষাণ হৃদয় ধারণকারী লোকটার প্রতি। অপ্সরা হাওয়ায় মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে বললো,

— “গায়ের রঙে কি আসে যায়। মনটাই তো আসল। এম আই রাইট সিনথিয়া?”

মুখ ফুলিয়ে একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে সিনথিয়া বললো,

— “এসব কথা উপন্যাস বা গল্পে মানায়। বাস্তবে সবাই উপরের রঙটাই দেখে। মনের খবর কয়জনই বা রাখে?”
— “হুম ঠিক বলেছো। তবে আমি বিশ্বাস করি এখনো এরকম মানুষ আছে। যারা উপরের চামড়া থেকে মনটাকে প্রাধান্য দেয়। যদিও তাদের সাক্ষাত পাওয়া মানে অন্ধকারে তীর ছোড়ার মতো।”
— “(—–)”
— “তোমার ঘন পল্লব বিশিষ্ট আঁখি যখন ধীরে ধীরে নামিয়ে নিয়েছিলে এক ঝাক স্নিগ্ধতায় ছেয়ে ছিলো মুহুর্তটা। আমি সিউর সত্যিকারের কোনো প্রেমিক পুরুষ এতেই তোমার প্রেমে পরবে।”

সিনথিয়া তাচ্ছিল্য হাসলো। অপ্সরার সামনে থেকে সরে ধীরে ধীরে বোরকা খুলে নিলো। গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিয়ে বললো,

— “নিশ্চয়ই কোনো উপন্যাসের কপি করা লাইন ছিলো এটা।”
অপ্সরা হেসে ফেললো। বললো,
— “ওয়েল। লাইন তো ছিলো উপন্যাসের। তবে আমার দেখা সত্যিকার উপন্যাসের নায়িকা তুমি। এখন শুধু নায়কের এন্ট্রি বাকি।”
— “বাই দা ওয়ে, আমি আপনাকে এর আগে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে।”

সিনথিয়া বিষয়টা এড়িয়ে গেলো। এই বিষয়ে কথা বলতে মোটেও ভালো লাগছে না। অপ্সরাও হয়ত বুঝেছে। তাই আর সেদিকে গেলো না। অপ্সরা বললো,

— “আমার মনে হচ্ছে তুমিই একটু বেশিই আমার গায়ের গরমে পুড়ে যাচ্ছো। রিমেম্বার?”
— “ওহ আই সি, তুমিই সেই। আসলে সেদিন একরকম লেগেছিলো এখন শাড়িতে অন্যরকম লাগছে।”
— “বেশি বাজে লাগছে আজ?”
— “উহু! স্নিগ্ধ লাগছে। সেদিন বাজে লেগেছিলো। খুব বেশিই।”
অপ্সরা হেসে বললো,
— “আমাদের কথোপকথনে কেউ বুঝতেই পারবে না তুমি আমার এক্স সতীন ছিলে।”

সিনথিয়াও হালকা হেসে ফেললো। আসলে মেয়েটাকে যতটা অহংকারী ভেবেছিলে মেয়েটা ততটা নয়। নাহলে এভাবে হেসে হেসে কেউ নিজের স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে কথা বলে কি? সিনথিয়ার একটু খারাপ লাগলো। আরশি আর সায়ান যদি এই মেয়েটার সাথে সেসব ব্যবহার করে যা ও পেয়েছিলো তাহলে কিভাবে মানিয়ে নিবে এই মেয়ে। দেখে তো মনে হচ্ছে বাবা-মায়ের ননীর পুতুল ছিলো। পরক্ষণেই ভাবলো সায়ানের ভালোবাসার মানুষ। দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্ক তাদের। নিশ্চয়ই কষ্টে রাখবে না। অপ্সরা একটু ইতস্তত করে বললো,

— “সরি!”
— “সরি? ফর হোয়াট?”
— “সেদিনের মন্তব্যের জন্য। আসলে আমি বাসায় যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছি এরকম মন্তব্য করাটা ঠিক হয়নি। গিল্টি ফিল হচ্ছিলো। তাই আজ এসেছি সরি বলতে।”
— “এইজন্যই আগমন?”
— “বলতে পারো সেটাই। আসলে আমি মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই আজ…।”
সিনথিয়া হাসলো। বললো,
— “ইটস ওকে। আমি কিছুই মনে রাখিনি।”

ওদের কথার শুরুতেই সিনথিয়ার দুই ভাবি চলে গেছিলো রুম থেকে। অপ্সরা এবং সিনথিয়া একাই রুমে কথা বলছিলো। কথার এক পর্যায়ে অপ্সরা বললো,

— “তোমার সম্পর্কে যতটা শুনেছি এখন মনে হচ্ছে সব মিথ্যে। তোমার কথার ধরনে এরকম কিছুই মনে হচ্ছে না আমার।”

সিনথিয়া কিছু বললো না। চুপ করেই রইলো। নিজের জন্য কোনো সাফাই গাইতে মন একটুও সায় দিলো না। যার যা মন চায় বলুক ওর নামে। তাতে কিছুই যায় আসেনা। অপ্সরার এইমাত্র কথায় বেশ অবাক হলো। সম্পূর্ণ উলটো কথাই শুনিয়েছে আরশি। তবে উপরে উপরে স্বাভাবিক রইলো। অপ্সরা বললো,

— “শুনেছি তুমিই সায়ানকে ভয় দেখিয়েছে বিয়ে করেছিলে? বিয়ের পর বিভিন্ন পুরুষের সাথে…।”

অপ্সরা বলতে পারলো না। সিনথিয়া গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেখানে উপস্থিত হলো সিনথিয়ার মা এবং আরশি। আসমা বেশ তেতেই বললো,

— “তা আবার বলতে। স্বামীর লগে নোখড়া করছে পুরোটা বছর। আর ডলাডলি করতে গেছে পরপুরুষের সাথে। কয়জনের লগে করছে হিসাব নাই। তাইতো মুখ লুকাইয়া চলে। মনে করছে বুঝি না কিছু।”

আরশি আড়চোখে তাকালো সিনথিয়ার দিকে। সিনথিয়া ভাবেলশহীন ভাবে বসে আছে। যেনো এদের এতো কথায় কিছু যায় আসেনা ওর। আরশি টিটকারি করে বললো,

— “হু! সেইজন্যই তো জামাইর ভাত খাইতে পারলো না।”

সিনথিয়ার ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। সিনথিয়া জানে আরশি ওকে ওর কথাই ফেরত দিয়েছে। তবুও চুপ করে রইলো। বাসায় এসে একটু রেস্ট নিবে ভেবেছিলো। কিন্তু সেটা আর হলো না। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়টা আরো ক্ষতবিক্ষত করে দিলো তাদের কথার দ্বারা। ওদের কথার প্রতিউত্তর করলো না। মাঝে মাঝে সব কথার উত্তর দিতে হয়না। রবের উপর ছেড়ে দিতে হয়। উত্তরটা না হয় তিনিই দিয়ে দেবেন এদের। জানালার বাইরের আকাশপানে তাকিয়ে রইলো। মধ্য বয়স্ক মহিলা দুজন আরো কথা শুনিয়েছে সিনথিয়াকে। তারপর চলে গেলো। অপ্সরা যাওয়ার আগে সিনথিয়ার মলিন মুখের দিকে তাকালো। ওর কেনো যেনো বিশ্বাস হলো না এদের কথা।

চলবে,,,
® ‘নুরুন নাহার’