#তুমি_শুধু_আমারই_হবে
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৮
একসময়ে খুব করে চাওয়া মানুষটি তার প্রিয় মানুষকে নিজে হাতে খাইয়ে দিচ্ছে বিষয়টা যেকোন মানুষের কাছে বিব্রতকর,অস্বস্তিকর সাথে খারাপ লাগার। সকাল সকাল অরিন ওয়াজিফার সাথে দেখা করতে এসেছে। সদর দরজা খোলাই ছিল, তাই তাকে আর আলাদা করে কলিংবেল চাপতে হয় নি। বাসায় ঢুকেই দেখতে পায় খাবার টেবিলে বসে মুহিব তার স্ত্রীকে নিজে হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। খেতে না চাইলে আদরের সাথে ধমক দিয়ে খাবারের লোকমা আবার মুখে তুলে দিচ্ছে। অরিন এসব দেখে ভাবতে থাকে মুহিব ভাই যদি সেদিন তার ভালোবাসা গ্রহণ করতো তাহলে ওয়াজিফার ভাবির জায়গায় সে থাকতে পারতো। ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা যে কতটা মোহময় যে পায় সে বোঝে।
অরিন হালকা কেশে নিজের উপস্থিতি বুঝিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। মুহিব আর অনামিকা সাথে সাথে সেদিকে তাকালো। মুহিবের বিয়ের পর এবারই প্রথম অরিন এ বাড়িতে আসলো তাই অনামিকার তাকে চেনার কথা না। অনামিকা মুহিবের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে মুহিব জানায় ওটা অরিন, ওয়াজিফার স্কুলের বান্ধবী।
অরিন তাদের দিকে এগিয়ে এসে সালাম দেয়। দুজনেই সালামের জবাব দেয়।
” এটা আমাদের ভাবি তাই না মুহিব ভাই?”
সালামের পরেই সবাই সাধারণত জিজ্ঞেস করে কেমন আছেন, কেমন দিন যাচ্ছে এসব কিন্তু অরিন অন্যকিছু জানতে চায়। তার কন্ঠটাও ভীষণ কাতর শোনালো।
মুহিবও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে, ” হ্যাঁ এটা আমার স্ত্রী অনামিকা।
অরিন মুখে জোরপূর্বক হাসি লেপ্টে বলে, ” বাহ, মাশাআল্লাহ, ভাবি তো দারুণ দেখতে। এই যে ভাবি আমিও ওয়াজিফার মতো আরেকটা ননদ। আমি ওর স্কুলফ্রেন্ড। ভাইয়ার সাথে তো আগে থেকেই পরিচিত বাদ ছিলেন শুধু আপনি।”
অনামিকা খাওয়া শেষ করে পানি খেয়ে নেয়। বসা থেকে উঠে অরিনের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
” বিয়ের তিনবছর হতে চলল আর ননদিনী আজ এসে পরিচয় দিচ্ছে?”
অনামিকার কথা শুনে অরিন একবার মুহিবের দিকে তাকায়। মুহিব ও একমুহূর্ত কাল বিলম্ব না করে মাথা নামিয়ে নেয়। অরিন এবার অনামিকার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,
” দেরি হলেও এসেছি তো, এবার ননদের মন রেখে চলতে হবে বলে দিলাম। জামাইয়ের দিকে বেশি নজরদারি না করে এই ননদের দিকেও নজর দিতে হবে কিন্তু। ”
অনামিকা হেসে জবাব দিলো, ” হ্যাঁ দেখি ননদের মন কি কি চায়! তুমি যাও ওয়াজিফা রুমেই আছে। তোমরা গল্প করো আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।”
” ঠিক আছে ভাবি আজ কিন্তু আমাদের সাথে আপনারও আড্ডা দিতে হবে।”
” সে হবে ক্ষণ। ননদের আর্জি ঠিক পালন করব। ”
অরিন এবার ওয়াজিফার রুমের দিকে অগ্রসর হয়, দরজার সামনে এসে আরেকবার মুহিবের দিকে তাকায় দুজনের চোখে চোখ পড়ে যেতেই মুহিব আবারও চোখ নামিয়ে নেয়।
অরিন ওয়াজিফার রুমের ভেতর চলে যায়। মুহিব তার কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নেয়। তার কপালে ঘামের সাথে চিন্তার ভাজ স্পষ্ট।
***
আজ যেহেতু শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন সেহেতু অনামিকা বায়না ধরেছে আজ সে বাহিরে ঘুরতে যাবে। মুহিব ও যেতে রাজি হয়ে যায়, তাই অনামিকা রেডি হয়ে নিচ্ছে৷ দরজা খোলা শুধুমাত্র পর্দা ছড়িয়ে দেয়া আছে। মুহিব শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছিল। ওয়াজিফা এসে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলে মুহিব ভেতরে আসতে বলে। সে ভেতরে এসেই দেখে অনামিকা কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। সে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়।
” ভাইয়া, তোমরা কি কোথাও যাচ্ছো?”
ওয়াজিফার প্রশ্নে মুহিব ফোন টিপতে টিপতে আনমনেই জবাব দেয়-
” হ্যাঁ আজ তো ছুটির দিন৷ অনেকদিন তেমন বের হওয়া হয় না তাই ভাবলাম একটু ঘুরে আসি।”
” ভাইয়া আমি আর অরিন ও তো ঘুরতে যেতে চাইছিলাম। চলো একসাথেই ঘুরতে যাই ভাইয়া।”
অনামিকা বসা থেকে দাঁড়িয়ে ওয়াজিফার দিকে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলে,
” সবাই একসাথে গেলে অনেক মজা হবে। আমরা দুজন যেতে চাইছিলাম এখন বলছো তোমরাও যাবে তাহলে চলো একসাথেই যাই কি বলো?”
মুহিব অনামিকা আর ওয়াজিফার কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলে,
” তুই তোর বান্ধবীর সাথেই যা বোন। আমি আর তোর ভাবি একটু ওর মামার বাড়ি যাব ওখানে তো আর তোদের নিয়ে যেতে পারি না। টাকা লাগলে বল আমি দিয়ে দিচ্ছি তোরা নিজেরা ঘুরে আয়।”
অনামিকা বুঝতে পারে মুহিব তাদের সাথে নিতে চাইছে না। অনামিকা নিজেও চাচ্ছিলো না শুধু বলার জন্য বলল। কোন স্ত্রীই বা চায় স্বামী-স্ত্রীর একান্ত কিছু ব্যক্তিগত সময়ে অন্য কেউ জড়াক!
ওয়াজিফাও আর কিছু বলে না। মুহিবের থেকে কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে যায়।
****
রাত আটটা-
অনামিকা আর মুহিব ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আকাশে সুন্দরমত আধখানা চাঁদ উঠেছে। রাতে এই দম্পত্তির ছাদে আসা হয় না। আজ হঠাৎ করে অনামিকা বায়না ধরেছিল সে ছাদে আসবে। দুজন ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আকাশে চাঁদ দেখছে। মৃদু হাওয়া বইছে, অনামিকার কপালের দিকের ছোট চুলগুলো চোখ, গালে একদম লেপ্টে গেছে। সে বারবার তা কানে গুজে নিচ্ছে কিন্তু চুলগুলো স্থীর থাকছে না। মুহিব তা খেয়াল করে অনামিকার ওরনা দিয়ে পুরো মাথা ঢেকে দিয়ে পিছনের দিকে টেনে দেয় তাতে চুলগুলো ওরনার সাথে পিছনের দিকে চলে যায়।
নিরবতা ভেঙে অনামিকা বলে ওঠে-
” আমার চকলেট খেতে ইচ্ছে করছে, তুমি এখানে থাকো আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি, কেমন?”
” এখন চকলেট খাবে? কোথায় রেখেছো বলো আমি নিয়ে আসছি তোমার যেতে হবে না।”
” তুমি যাবে? আচ্ছা যাও, দেখো আমার বালিশের ওখানটাতেই আছে। দুইটা আছে, দুইটাই নিয়ে আসবে কিন্তু।”
মুহিব অনামিকার গাল টেনে দিয়ে একটা হাসি দিয়ে সিড়ির দিকে অগ্রসর হয়।
রুম থেকে চকলেট নিয়ে বের হতেই অরিনের সাথে সামনাসামনি দেখা হয়ে যায় মুহিবের। পাশ কাটিয়ে চলে যাবে ঠিক তখনই অরিন ডাক দেয়। মুহিব দাঁড়িয়ে যায়, ভীষণ অস্বস্তি বোধ হচ্ছে তার।
” আপনি আমাকে এড়িয়ে কেন চলছেন?”
” তোমাকে এড়িয়ে চলার কি আছে অরিন?”
” আছে বলেই তো এড়িয়ে চলছেন।”
” এরকম কিছুই না।”
” অতীত মনে রাখবেন না। যেটা হওয়ার হয়ে গেছে এটা নিয়ে ভেবে খারাপ লাগা সৃষ্টি করবেন না। আপনি হয়তো ভাবছেন এতদিন পর কেন এলাম? আমি আপনাদের মাঝে কোন ঝামেলা করতে আসি নি মুহিব ভাই। আমার ওরকম কোন চিন্তাও নেই। আপনি আমার ভাগ্যে নেই তাই তো আমি আপনাকে পাই নি৷ যে পেয়েছে সে নিশ্চিত ভাগ্যবতী। ”
” আমি আমার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালোবাসি আর সেও আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। প্রতিদিন আমাকে হারানোর ভয়ে কান্না করে। আশা করছি তুমি তোমার কথা রাখবে। আমি চাই না আমাদের মাঝে কখনো ভাঙন নামুক। ও আমার জীবনে থাকতে আমি কখনও অন্য কোন নারীর প্রতি আকৃষ্ট হব না, কোন নারীর ক্ষমতা নেই আমাকে আকৃষ্ট করার। তুমি এখানে একদিনের জন্য বেড়াতে এসেছো আনন্দ করো পুরোনো কথা মনে করে কষ্ট পেও না আর আমাদের মাঝে ঢোকার চেষ্টা কোরো না। আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব অরিন। আল্লাহ আমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে শ্রেষ্ঠ কিছু দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। ”
মুহিব তার কথা শেষ করে, অরিন ও তার কিছু কথা বলতে থাকে। অরিন নিজেও চায় না কোন সুখী দম্পতির মাঝে সমস্যা সৃষ্টি করতে।
****
অনামিকা একা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। এইরাতে সে একা দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিলাস করছে। সুন্দর জিনিসের গায়ে নিশ্চয়ই কোন না কোন দাগ থাকে। চাঁদের ও কালো দাগ আছে আর সেই দাগ যেন চাঁদের সৌন্দর্য্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। অনামিকার গায়েও তো দাগ আছে, ভীষণ কালো দাগ তাকে মা না হতে দেওয়ার দাগ। মন ভালো করতে ছাদে এসেও যেন দুঃখ তার সঙ্গ ছাড়ে নি। হঠাৎ পিছনের দিকে কারো উপস্থিতি বুঝতে পারে সে। কারো উপস্থিতি বুঝে চোখের পানি মুছে নেয়। পিছন থেকে মুহিবের কণ্ঠ ভেসে আসে, ” অনু, এই অনু ওদিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন এদিকে তাকাও দেখো তোমার জন্য চকলেট নিয়ে এসেছি।”
মুহিবের গলা শুনে পিছনে তাকাতেই দেখে সেখানে কেউ নেই। অনামিকার শরীর পুরো ভারী হয়ে যায়। সে স্পষ্ট মুহিবের গলা শুনলো, পিছন ফিরে তাকাতেই কোথায় গেল সে? অনামিকা চুপিচুপি চারপাশে তাকিয়ে দেখে কোথাও কেউ নেই। হঠাৎ বিকট একটা শব্দ হতেই লোডশেডিং হয়ে যায় সাথে সাথে অনামিকা জোরে চিৎকার দিয়ে বসে পড়ে।
মুহিব অনামিকার চিৎকার শুনে ফোনে টর্চ অন করে দৌঁড়ে অনামিকার কাছে চলে যায়। সে ততক্ষণে চোখ বন্ধ করে কানে হাত দিয়ে দুই হাটুর মাঝে মাথা দিয়ে বসে ভয়ে কাঁপছে। মুহিব তাড়াতাড়ি অনামিকাকে জড়িয়ে ধরে।
গল্পের নতুন মোড় এখান থেকেই শুরু। সবাই নতুন কিছুর জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।
#চলবে…..