তুমি শুধু আমারই হবে পর্ব-০৯

0
142

#তুমি_শুধু_আমারই_হবে
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৯

সেদিন রাতের ঘটনার পর থেকে অনামিকা প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ অসুস্থ। খাওয়া দাওয়া তো ঠিকমতো করতে পারছেই না, এমনকি ঘুমাতেও পারছে না ঘুমের মাঝে চিৎকার দিয়ে দিয়ে উঠছে। বিছানা থেকে একা উঠে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে গেছে তার। এসময় মিসেস মেরিনা বউমার কাছে কাছে থাকছেন, যত্ন নিচ্ছেন। বড়বোনের সাথে কিছুদিন থাকার পর তার মাঝে পরিবর্তন খেয়াল করা যাচ্ছে। বউমার প্রতি ভালো ব্যবহার, যত্ন, ভালোবাসা দেখা যাচ্ছে।

অনামিকাকে প্রতিনিয়ত ডাক্তার দেখানো হচ্ছে তবুও জ্বর কমছে না। তার মামা- মামি এসেছে অনামিকা অসুস্থ হবার দ্বিতীয় দিনেই, মামা কাজের জন্য চলে গেলেও মামি যায় নি। এর মাঝে জারা এসেও বোনের কাছে দুদিন থেকে গিয়েছে। পরিক্ষা থাকায় তাকে বাসায় ফিরে যেতে হয়েছে।

প্রায় দুদিন হচ্ছে অনামিকার মাঝে শারীরিক উন্নতি দেখা যাচ্ছে। মুখের কালোবর্ণ আর শরীরের অসুস্থতার ভাবটা একটু কমে এসেছে। দুদিন ধরে অনামিকা কিছু খেতে পারছে দেখে শাশুড়ি আর মামি প্রতিটা সময় এটা ওটা নিয়ে বসেই আছেন খাওয়ানোর জন্য। সপ্তাহখানেক সময়ে অনামিকার অসুস্থতায় মুহিবের চোখের নিচে কালো দাগ দেখা দিয়েছে। অনামিকাকে দেখলেই তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। ক’দিন আগেও মায়ের কত কটু কথা সে সহ্য করে নিয়েছে, তাকে হারানোর ভয়ে কান্না করেছে সেই মেয়ে এখন চোখ তুলে তাকানোর শক্তিটাও হারিয়েছে। যেই মা অনামিকাকে তাড়ানোর জন্য কথার আঘা*ত করেছে,কাঁদিয়েছে সেই মা এখন ছেলের বউয়ের সুস্থতার জন্য কত কিছু করছে!

মুহিব অনামিকার কাছে বেশিক্ষণ থাকতে পারছে না। প্রিয় মানুষের এমন অবস্থা তাকে ক্ষ*তবিক্ষ*ত করে ফেলছে। দিনে দুইবেলা ডাক্তার এসে দেখে যাচ্ছে। হাসপাতালেও দেখানো হয়েছে কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়েনি ডাক্তারদের। তবে শেষ দুইদিনে অনামিকা অনেকটাই সুস্থ হয়ে গিয়েছে।
***

সকাল দশটা, অনামিকা শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। বাহিরের রুমে বসে মিসেস মেরিনা আর অনামিকার মামি বসে কথা বলছিলেন। হঠাৎ অনামিকার জোরে চিৎকার শুনে দুজন দৌঁড়ে অনামিকার রুমের দিকে যায়।

রুমে এসে দুজনের কেউই অনামিকাকে দেখতে পায় না। রুমের এপাশে ওপাশে চোখ বুলিয়ে নিতে থাকে কিন্তু নাহ অনামিকা কোথাও নেই। তারা অনামিকার নাম ধরে ডাকতে থাকে কিন্তু কোন জবাব নেই। মেরিনা বেগম ওয়াশরুমের দিকে যান কিন্তু সেখানেও সে নেই। অনামিকার মামি কি মনে করে খাটের সাইডে তাকালে দেখতে পায় অনামিকা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। তিনি সাথে সাথে মেরিনা বেগমকে ডাক দেন।
দুজন মিলে অনামিকাকে ধরে তুলে বাহিরের রুমে নিয়ে আসেন।
অনামিকা বসে বসে ঘামছে। গায়ের জ্বরটা এখন আর নেই। রেহেনা বেগম অনামিকার কাছে এসে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেন-

” কি হয়েছে মা? চিৎকার দিয়েছিলি কেন?”

রেহেনা বেগমের প্রশ্নে তার দিকে তাকিয়ে থাকে অনামিকা। কি বলবে সে! বললে কি সবাই বিশ্বাস করবে?
অনামিকাকে নিরুত্তর দেখে মিসেস মেরিনাও রেহেনা বেগমের প্রশ্নটি দ্বিতীয়বার করলেন।
অনামিকা এবার সিদ্ধান্ত নিলো এবার সে বলবে, অনেককিছুই তো ঘটে যাচ্ছে তার সাথে কিন্তু সে কাউকে কিছু বলার সুযোগ পায় নি। যখনই কাউকে বলবে বলে ভেবেছে তখনই কাউকে সে তার আশেপাশে অনুভব করেছে কিন্তু সেই অনুভব করা পর্যন্তই, কেউ তার সামনে আসে নি তবে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়েছে।

” মা, চলুন আমরা বাসা চেঞ্জ করে ফেলি।”

হুটহাট বাসা চেঞ্জ করার কথা শুনে বেশ অবাক হন মিসেস মেরিনা।

” বাসা কেন চেঞ্জ করব? কি হয়েছে বল তো মা?”

” মা এই বাড়িতে কোনকিছু ঠিক নেই।”

পাশে থেকে মিসেস রমেলা বলে ওঠেন,

” বুঝিয়ে বল তো মা সবকিছু, আমরা বুঝতে পারছি না রে।”

” মামি এই কয়েকদিন ধরে আমার সাথে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে। আমি অন্যরকম কিছু অনুভব করছি। ”

অনামিকা সেদিন রাতের ঘটনা তাদের জানায়। এরপর আরও কি কি ঘটেছে সবকিছু বলে। সবটা শুনে তারা যেন আকাশ থেকে পড়ে। মিসেস মেরিনা তো সাথে সাথে কোন হুজুরের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আয়াতুল কুরসিসহ কিছু দোয়া পড়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে বলেন অনামিকাকে। অনামিকাও কথামতো কাজ করে নেয়।

” চিন্তা কোরো না মা, কিছু হবে না তোমার। তোমার সাথে সাথে সবসময় থাকার জন্য কি আমি ওয়াজিফাকে বাসায় আসতে বলব? ও আসলে হয়তো একটু ভালো লাগবে।”

” না মা, ওর তো পড়াশোনা করতে হয় অনেক। ও এখন বাসায় আসলে ওর পড়ায় ক্ষ*তি হয়ে যাবে।”

” তোর শরীর কি একটু ভালো লাগছে রে মা?”

রমেলা বেগমের স্নেহময় প্রশ্নে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। তিনি অনামিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।
মিসেস মেরিনা কিছু একটা ভেবে অনামিকার দিকে তাকান আর বলেন,

” আমি মুহিবকে কল করছি, ওকে সবকিছু জানাই। তুমি বিকেলে রেডি থেকো আমার পরিচিত এক হুজুরের কাছে নিয়ে যাব। ”

” না মা ওসব লাগবে না। ”

অনামিকার কথায় তিনি পাত্তা না দিয়ে রুমে চলে যান। রুম থেকে ফোনটা নিয়ে আবার সেখানে ফিরে আসতেই অনামিকা আমতা আমতা করে বলতে থাকে-

” মা আপনার ছেলে প্রায় এক সপ্তাহ ছুটির পর আজকেই অফিসে গিয়েছে। মন দিয়ে কাজ করুক, অফিসে নিশ্চয়ই অনেক কাজ জমে গিয়েছে সব তো শেষ করতে হবে। ও বাসায় আসলে নাহয় কথা বলা যাবে, কালকের দিন পরই তো শুক্রবার ছুটির দিন।”

অনামিকার কথা শুনে রেহেনা বেগম বলে ওঠে-

” হ্যাঁ বেয়াইন, মেয়ে কিন্তু ঠিকই বলেছে। জামাই বাবাকে এখন এসব না জানানোই ভালো আমার মনে হয়। এতদিন পর অফিসে গেছে এসব শুনলে আবার আলাদা একটা চিন্তা। এমনিতেই ছেলেটা অনামিকার অসুস্থতার জন্য কেমন হয়ে গেছে। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তাহলে মুহিবের বাবার সাথে কথা বলি৷ ”

অনামিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে তাকে ফ্রেশ হতে বলে নিজের রুমে চলে যান। অনামিকার মামি এবার অনামিকাকে বসিয়ে নিজে গিয়ে তার জন্য খাবার গরম করে টেবিলে রাখেন। অনামিকাও ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নেয়। আজকে শরীরটা তার খুব ভালো লাগছে। তাকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে অনামিকা এক টানা এক সপ্তাহ জ্বরে বিছানায় পড়ে ছিল।

অনামিকা খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজেই গোসল দিয়ে নেয়। শরীরটা আগের দিনগুলোর মতো একদম স্বাভাবিক লাগছে। কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে ফোনটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে। প্রায় সাড়ে বারোটা বাজতে চলল৷ এই সময়ে মুহিব অনেকটাই ফ্রি থাকে আর আধাঘন্টা পরই তো ব্রেকটাইম।

অনামিকা ফোনস্ক্রিনে নম্বরটা তুলে কল দেয়। দুইবার রিং হতেই কল রিসিভ হয়ে যায়। হয়তো মুহিব ফোনেই কিছু একটা করছিল তাই রিং হওয়ার সাথে সাথেই কল রিসিভ হয়ে যায়। কল রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে অনামিকা নড়েচড়ে বসে।

” আসসালামু আলাইকুম বরসাহেব।”

” ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমার বিবিসাহেবা ফোন দিলো?”

” কি মনে হচ্ছে আপনার?”

” মনে হওয়ার বিষয় সাইডে রেখে বলো তো তোমার শরীর কেমন এখন?”

” একদম ঠিকঠাক। ”

” একদম ঠিকঠাক? ”

” হ্যাঁ,তবে আর বলছি কি!”

অনামিকার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে কতটা প্রফুল্লতার সাথে কথা বলছে। প্রিয় মানুষ ভালো আছে জানলেই হয়তো মন ভালো হয়ে যায়। এই কয়েকদিনে মুহিবকে কেউ হাসতে দেখে নি। সবসময় মুখটা মলিন হয়ে থাকতো।

মুহিবকে চুপ থাকতে দেখে অনামিকা বলে ওঠে,

” অ্যাই আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসবে প্লিজ?”

মুহিব এবার কথায় কঠিনভাব এনে বলে,

” এই সময় একদম আইসক্রিমের বায়না ধরা যাবে না। তুমি এখন অসুস্থ, আগে পুরোপুরি সুস্থ হও তারপর যা যা খেতে চাইবে সব খাওয়াব।”

” বললাম তো আমি এখন একদম সুস্থ।”

” একবেলায় একদম সুস্থ হয়ে যায় কীভাবে মানুষ ?

” জানি না, আমি হয়ে গেছি বুঝতে পারছো না?”

” বুঝতে পারছি কিন্তু এখন তবুও খাওয়া যাবে না।”

” আনবে না তো?”

” উহু। ”

” আমি কিন্তু দারোয়ানকে দোকানে পাঠিয়ে দেব। ”

” আবার দারোয়ান কেন? আচ্ছা আমিই নিয়ে আসব বাসায় ফেরার সময়। ভালো একটা বর পেয়ে খাটিয়েও নিলে।”

” বর আমার, আমি খাটিয়ে নেব না তো কে নিবে?”

” তাই তো। আর কিছু খাবে?”

” উমমমম না, আর কিছু খাব না। শুধু আইসক্রিম নিয়ে আসলেই হবে।”

” চকলেট ফ্লেভার?”

” না, ভ্যানিলা।”

” আচ্ছা ঠিক আছে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে নিও আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব।”

” ঠিক আছে।”

অনামিকা ফোনটা রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ে। এখন একটু ঘুমোলে আরেকটু ভালো লাগবে। নির্দ্বিধায় এবার চোখটা বন্ধ করে নেয় সে।

প্রায় আধাঘন্টা যাবৎ চোখ বন্ধ করে এপাশ ওপাশ নড়াচড়া করছে কিন্তু ঘুম কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। হঠাৎ রুমে আবার আগের মতো কারো উপস্তিতি টের পায়। এবার অনামিকার হৃৎস্পন্দন বাড়তে থাকে। তবে কি আবার কেউ এলো রুমে? কি চায় সে? কেন সামনে এসে সব খোলাসা করছে না?

#চলবে…