তুমি শুধু আমারই হবে পর্ব-১০

0
161

#তুমি_শুধু_আমারই_হবে
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১০

রুমে অদ্ভুত কিছু অনুভূত হতেই গা শিউরে ওঠে অনামিকার। তবে কি আবার কিছু রুমে এলো! এবার আগের মতোই ভয়ে সে চোখ খুলতেও পারছে না। তার মনে হচ্ছে কে যেন তার সামনেই দাঁড়িয়ে তাকে এক পলকে দেখে যাচ্ছে।
অনামিকা তার বান্ধবীর থেকে শুনেছিল তার সৎমা যখন তাকে কালোজা*দু করেছিল তখন নাকি তার মনে হতো তার আশেপাশে কেউ আছে। সময় সময় নাকি খিলখিল করে হাসতো আর মোটা কণ্ঠে কি বলে ভয় দেখাতো কিছু সময় তো কুকুর বিড়ালের রূপে এসে এক পলকে চেয়ে থাকতো। অনামিকারও একজনকে সন্দেহ হচ্ছে কিন্তু এটা তার ভুল ভাবনাও হতে পারে।

অনামিকা ভয়ে ভয়ে তাকাতেই দেখে চারপাশ একদম ঠিকঠাক শুধু বেলকনির দিক থেকে বাতাস এসে পর্দা এলোমেলো করে দিচ্ছিলো, বাতাস খুব জোরালো ছিল। হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে, হঠাৎ এই সময়ে ফোন বেজে ওঠায় ভয় পেয়ে যায় সে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে জারা কল দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করে তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দেয়। একপ্রকার জানার আগ্রহ থেকেই তার বান্ধবী সাফার নম্বরে কল দেয়। তার সাথে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো এবার খুব করে ভাবাচ্ছে।

কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে নরম কণ্ঠে কেউ হ্যালো বলে ওঠে।

” সাফা!”

” হ্যাঁ রে, আজ হঠাৎ কি মনে করে কল দিলি? কেমন আছিস?”

” শরীরটা একটু অসুস্থ। আজ হঠাৎ করে কেন কল দেব? আমি তো মাঝেমধ্যেই তোকে কল দিই।”

” সে নাহয় দিস, তবে আজ অনেকদিন পর কল দিলি তো তাই বললাম।”

” শোন না একটা কথা। কয়েকদিন ধরে আমার সাথে অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে।”

সাফা বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে-

” কেমন?”

” সেদিন ছাদে মুহিবের কন্ঠ শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। পরে বিকট একটা শব্দ হয়, মনে হয়েছিল কেউ আমার দিকে ধেয়ে আসছে। সেদিন থেকে প্রায় এক সপ্তাহ জ্বরে পরে আছি আমি। তারপর থেকেই মনে হয় কেউ আমার আশেপাশে আছে, আমাকে দেখছে, আমি অনুভব করতে পারি। মাঝে মাঝে বেশ বিশ্রি গন্ধ আসে রুমে।”

” কি বলছিস কি! তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস কোন হুজুরের সাথে দেখা কর। দেরি করিস না অনু, তোর খুব খারাপ সময় আসতে চলেছে হয়তো। এখন তোকে কেউ ভয় দেখাচ্ছে, হয়তো পরে ক্ষতি করবে। তুই এক কাজ কর তো নিজের জামাকাপড় চেক কর সব ঠিক আছে তো! তুই যা যা ব্যবহার করিস আবার নিজের বিছানার নিচে, রুমের কোণায় বালিশ সবকিছু একটু চেক কর পাখি, আমার খুব ভয় করছে। তুই বলেছিলি তোর শাশুড়ি তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে দেখতে পারে না। আমার তো এবার ভয় লাগছে, এখনও তেমন কিছু হয় নি তবে হতেও কিন্তু সময় নিবে না তুই নিজের রুমটা একটু চেক কর তো।”

সাফার কথা শুনে অনামিকা একপ্রকার ভয় পেয়ে যায়। আসলেই কি তার সাথে এমন কিছু করতে পারে তার শাশুড়ি!

অনামিকা আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে দিয়ে রুম চেক করতে থাকে।
খুটিয়ে খুটিয়ে সবকিছু দেখে সে। আলমারির সব জামাকাপড়, শাড়ি সব এলোমেলো করে ফেলেছে সে। সবই তো ঠিক আছে, কোথাও কোন গড়মিল নেই। আলমারি বন্ধ করে ফোনের দিকে যাবে হঠাৎ তার মনে পড়ে বিয়ের শাড়ি থাকলেও বউ ওরনাটা কোথাও দেখতে পেল না তো!

অনামিকা দৌঁড়ে গিয়ে আবার ভালো করে সমস্ত আলমারি চেক করে। নাহ, কোথাও তো বউ ওরনা নেই! তবে কি………….!!!
ভয়ে তার সারা শরীর কাঁপছে। বিয়েটা ভাঙতেই কি তবে বউওরনা গায়েব করা হয়েছে! শুধু বিয়ে ভাঙতে চাইলে ওরনা নিয়েছে তাহলে সে কেন অসুস্থ হয়ে আছে! তবে তার ওপর কালোজা*দু করা হয়েছে সত্যি সত্যিই।

অনামিকা গিয়ে বিছানা উলোটপালোট করে ফেলে। এবার সে আরেক দফায় চমকে যায়। বিছানায় সে যেখানে ঘুমায় ঠিক সেখানেই কোমরের দিকে দুইটা কাগজ রাখা। আরবি হরফে কিছু লেখা আর মানুষের ছবি আঁকা।

কাগজগুলো হাতে নিয়ে ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। ভালোবেসে স্বামীর সাথে থাকতে চাওয়াটা কি খুব বড় অপরাধ! নাকি ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে এতিম হওয়া অপরাধ! নাকি মা হতে না পারাটা অপরাধ!
কাগজগুলো হাতে নিয়ে বিছানায় বসে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে সে। নিজে মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের এতবড় ক্ষতি কি আসলেই কেউ করতে পারে!

অনামিকা চোখ-মুখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। বিছানা ঠিক করে রেখে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে মামির জন্য বরাদ্দ করে রাখা রুমে চলে যায় সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়ে। মিসেস রেহেনা নামাজ শেষ করে তার দিকে ফিরে তাকায়।

” কি রে অনু! নিজের রুমে ঘুম ধরল না বুঝি? শেষে কি না মামির রুমে এসে শুতে হচ্ছে?”

” এমনভাবে বলছো যেন আমি আগে তোমার কাছে থাকতামই না! মনে করে দেখো তোমার মেয়ের চেয়ে আমিই বেশি থাকতাম তোমার কাছে। এখন নামাজ শেষ হলে তাড়াতাড়ি এখানে এসো আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো।”

” দাঁড়া আসছি, অপেক্ষা কর।”

” হুম জলদি এসো।”

রেহেনা বেগম নামাজ শেষ করে বিছানায় এসে বসতেই অনামিকা এগিয়ে গিয়ে উনার কোলে মাথা রাখে। রেহেনা বেগম ও তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

” মামি….”

” হুম শুনছি, বল।”

” কষা কষা করে গরুর মাংস রান্না করে দিবে? অনেকদিন তোমার হাতের গরুর মাংস খাই না। এখানে তো আমি রান্না করি কিন্তু তোমার হাতের রান্নার মতো মজা হয় না। ”

” আজকেই খেতে হবে?”

” হ্যাঁ বিকেলে একটু রান্না করে দাও না গো।”

” আমার মেয়েটা কতদিন আবদার করে না! আজ করেছে, রান্না তো করতেই হবে কিন্তু তোর শাশুড়ি কি রান্নাঘরে ঢুকতে দেবে?”

” দেবে না কেন শুনি? তুমি বলবে আমি তোমার হাতের রান্না খেতে চেয়েছি।”

” আচ্ছা ঠিক আছে বলব।”

মিসেস রেহেনা একবার দরজার দিকে তাকিয়ে উঁকি দিয়ে আবার অনামিকার দিকে তাকিয়ে বলেন,

” একটা কথা বলবি অনু?”

” হুম বলো না কি বলতে হবে?”

” উঠে বস তো একটু।”

অনামিকা শোয়া থেকে উঠে বসে। চোখমুখ ঢেকে যাওয়া ছোটো ছোটো চুলগুলো কানে গুজে স্থির হয়ে বসে।

” হ্যাঁ এবার বলো।”

” সত্যি করে বল তো মা তোর শাশুড়ি কেমন মানুষ? ”

” তুমি এসে তো দেখছোই, উনি খুব ভালো মানুষ। ”

” আমরা যা দেখি সবসময় সেটা সত্যি না-ও হতে পারে।”

” না না মামি, আমার শাশুড়ি আসলেই ভালো মানুষ। ”

” জারা আমাকে সব বলেছে অনু।”

রেহেনা বেগমের এই কথায় যেন অনামিকাসহ আশেপাশের পরিবেশ একদম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। জারা সব বলে দিয়েছে!
তোতলা তোতলাভাবে অনামিকা বলে,

” জ জা জারা!”

” হ্যাঁ জারা। তোর শাশুড়ি যে মুহিবের জন্য ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল সেটা জারা আমাকে বলেছে। বলতে হয় না, জানি না কার ভাগ্যে কি আছে তোর ননদের বিয়ের পর যদি জানা যায় যে সেও মা হতে পারবে না আর তার শাশুড়িও যদি ছেলেকে দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চায় তখন কি করবে?”

” মামি আস্তে বলো আমার শাশুড়ি শুনলে ঝামেলা হবে। এমনিতে উনি কিছুদিন যাবৎ খুব ভালো ব্যবহার করছেন। আমার কত যত্ন নিচ্ছেন দেখছো না?”

” শোন অনু সব ভালোতে ভালো থাকে না। তোর কথা শুনে তো আমার সন্দেহ হচ্ছে।”

” কি সন্দেহ মামি?”

মিসেস রেহেনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,

” তোকে বলব না ভেবেছিলাম, তবুও তোকে সাবধান করতে বলতেই হবে আমার।”

” কি বলতে চাইছো বলো তো মামি?”

” তোর শাশুড়ির চাচাতো বোন আমাদের বাড়ির পাশের বাড়ির সানজিদা আছে তার মামি হয়। কথায় কথায় পরিচয় হলে তার কাছে একটা কথা জানতে পারি।”

” কি কথা?”

” তোর শাশুড়ি মুহিবের আপন মা নয়। এটা তোর শশুরের দ্বিতীয় স্ত্রী।”

” কিইইইইই!!!”

” হ্যাঁ রে, তোকে জানাবো জানাবো করতেই তোর অসুস্থতার খবর পাই। এখানে এসে দেখি তোর অবস্থা খুব খারাপ। কথাটা বলার মতো কোন পরিস্থিতি ছিল না তাই বলতে পারি নি।”

” তুমি সত্যি বলছো মামি?”

” মিথ্যে কেন বলব বল?”

মিসেস রেহেনার কথায় সব জট যেন খুলে যাচ্ছে। সৎ শাশুড়ি বলেই কি এত খারাপ ব্যবহার করতে পেরেছে তার সাথে! এমন কোন দিন যায় নি যেদিন অনামিকা কান্না করে নি। হঠাৎ করে এই কয়েকদিন কেন ভালো হয়ে গেল!

” মামি…..”

” হ্যাঁ বল।”

” আমার শাশুড়িকে আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে।”

” সন্দেহ তো আমারও হচ্ছে রে মা।”

অনামিকা বিছানা থেকে উঠে দরজার দিকে গিয়ে এপাশে ওপাশে তাকিয়ে দেখে তার শাশুড়ি রুমে কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। অনামিকা এবার মামির কাছে ফিরে এসে সামনাসামনি বসে পড়ে। রেহেনা বেগমের হাত নিজের হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।

” মামি, আমার শাশুড়ি আমাকে কালোজা*দু করেছে।”

অনামিকার এমন কথা মিসেস রেহেনা বেশ অবাক হন। নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অনামিকার মুখ তুলে উঁচু করে নেন।

” কি বললি তুই?”

অনামিকা ওরনা গিট ছাড়িয়ে কাগজের টুকরো বের করে রেহেনা বেগমের হাতে ধরিয়ে দেয়। তিনি কাগজ খুলে ভেতরটা দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলেন।

অনামিকা সাথে সাথে কাগজটা নিয়ে নেয়, রেহেনা বেগমের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,

” মামি আল্লাহর নামে কসম করে বলো এই কথা আমি আর তুমি ছাড়া কোনদিন কেউ জানবে না।”

” পাগল হয়েছিস তুই অনু! কেউ জানবে না মানে? তুই আজই মুহিবকে বলবি৷ তোর শাশুড়ির সাথেও কথা বলবি এসব নিয়ে তিনি এতো উশৃঙখল কেন?”

” আমি শাশুড়ির সাথে কথা বলব কিন্তু মুহিবের সাথে আগেই কথা বলা ঠিক হবে না। কারণ যখন তখন যা ইচ্ছে করে ফেলতে পারে আমার শাশুড়ি। যা করার আমি করছি তুমি শুধু কথা দাও এই বিষয়ে তুমি কারো সাথে কোনদিন কথা বলবে না আমি ম*রে গেলেও না কারণ মুহিব তার আপন ছেলে না ওর সাথেও খারাপ কিছু করতে পারে যা আমি কখনোই তা সহ্য করতে পারব না।”

আরও অনেক কথা বলে মিসেস রেহেনাকে বুঝিয়ে রাজি করায় অনামিকা। মিসেস রেহেনা যেন আজই বাড়ি ফিরে যায় একথাও বলে অনামিকা। মিসেস রেহেনাও অনামিকার সবকথা শুনে রাজি হয়ে যায়।

বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চোখমুখ মুছে শাশুড়ির রুমের দিকে রওয়ানা দেয় অনামিকা।

#চলবে……..