তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব-৩+৪

0
239

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩

সিনথি আপুর হলুদ সন্ধ্যা। অতিথিরা সকলে চলে এসেছে। শুরু হয়ে গিয়েছে অনুষ্ঠান। একে একে পরিবারের সদস্যরা সকলে আপুকে হলদে রাঙা করে দিলো। এবার আমার আর তৃষার পালা। লেহেঙ্গা সামলিয়ে দু’জনে গিয়ে দাঁড়ালাম আপুর সম্মুখে। ইশ্! হলদে আভায় আপুকে মাশাআল্লাহ্ কি সুন্দর লাগছে! কারোর নজর না লেগে যায়! বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সব মেয়ের সৌন্দর্য ই কি এভাবে বৃদ্ধি পায়? বোধহয় হ্যাঁ। আমি হলুদের বাটি হতে দু হাতের আঙ্গুলে হলুদ মেখে নিলাম। প্রথমে তৃষা অতঃপর আমি। আপুর নরম তুলতুলে দু কপোলে আলতো করে হলুদ বাটা মেখে দিলাম। তৃষার দুষ্টু কথায় লাজুক হেসে উঠলো আপু। আমি মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করলাম সে লজ্জা মিশ্রিত হাসি।

আপুকে হলুদ ছুঁয়ে দিয়ে আমরা দুজনে এক পাশে সরে দাঁড়ালাম। দেখতে লাগলাম চারিদিক। হঠাৎ আমার নজরে পড়লো আমার বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক। হলুদ পাঞ্জাবি পরিহিত যুবকের হাতে দামী ক্যামেরা। একটু পরপর সে ফটো তুলছে। আর আমি যদি ভুল না হয়ে থাকি তবে সে আমার ফটোই তুলছে। এ কেমন অভদ্র আচরণ! বিনা অনুমতিতে একটি মেয়ের ফটো তুলছে! বিন্দুমাত্র বোধ নেই? মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। কিন্তু সকলের উপস্থিতিতে অভদ্র আচরণ করা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ। তাই দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে শুধু আরেকবার ফটো ক্লিক করুক তখন আমি..! আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো সম্মুখে অতি সন্নিকটে পুরুষালি উপস্থিতিতে। হকচকিয়ে গেলাম আমি! তূর্ণ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আমার সামনে। উনি মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই আমাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

” নিশি ওরা ওদিকে তোদের খুঁজছে। ফটাফট ওদের কাছে যা। ”

” আচ্ছা ভাইয়া। ”

সম্মতি জানিয়ে তৃষা আমার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। গন্তব্য নিশিপু আর তার দলবল। হাঁটতে হাঁটতে একবার অবশ্য পিছু ঘুরে তাকালাম। কিছুটা অবাক হলাম তূর্ণ ভাইয়ার কর্ম দেখে! সে ওই ছেলেটার কাছে যাচ্ছে কেন? স্বল্প সময়ের মধ্যে বিষয়টা বোধগম্য হতেই এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল অধর কোণে। নিশ্চিন্তে তৃষার সাথে পা বাড়ালাম।

আঁধার রজনী। হলুদের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়েছে ঘন্টা দেড়েক আগে। এই মুহূর্তে আমরা মেয়ে কাজিনরা মিলে আড্ডায় মেতে উঠেছি। বিছানায় গোলাকার হয়ে বসে আছি আমি, তৃষা, নিশিপু, সিনথিপু আর বড়াপু। সকলের মধ্যমণি হবু কনে সিনথিপু। নিশিপু দুষ্টু কণ্ঠে বলে উঠলো,

” সিনথিপু! তোমাকে আজকে হলুদের অনুষ্ঠানে যা লাগছিল না! একদম চোখধাঁধানো সৌন্দর্য যাকে বলে। তা বলছি হবু জিজু ফটো পেয়েছে? নাকি বেচারা বউয়ের ফটোর অভাবে অনাহারে ভুগছে? ”

সশব্দে হেসে উঠলাম সবাই। নিশিপু যেমন টোনে বললো, না হেসে উপায় আছে কি? সিনথিপু লাজে রাঙা হয়ে বললো,

” ধ্যাৎ! তোরা যে কি শুরু করেছিস না? সেই সন্ধ্যা থেকে শুধু লজ্জাই দিয়ে যাচ্ছিস। ”

তৃষা কিছু বলার পূর্বেই আমি বলে উঠলাম,

” আজ তো সবে শুরু। এরপর বিয়ে, রিসিপশন পার্টি সর্বশেষ তোমাদের মধুমাখা মধুচন্দ্রিমা! লাজে লাজে হতে চলেছে তোমার দি ওয়েডিং সাগা। ”

তৃষা হাসিমুখে সম্মতি পোষণ করে বললো,

” একদম। আজ তো শুধু তোমায় লজ্জা দিচ্ছি। কাল বিয়ে। আসুক আমাদের জিজু। ওনাকে বুঝিয়ে দেবো লজ্জা কত প্রকার ও কি কি। ”

তৎক্ষণাৎ আপত্তি জানালো সিনথিপু।

” খবরদার! ওনার সাথে অত ফাজলামি করবি না কিন্তু। ”

বড়াপু হাই তুলে বললো,

” কি দিনকাল এলো রে! বিয়ে হতে না হতেই বরের তরফদারগিরি শুরু! ”

সিনথিপু লাজে মুখখানি নত করে ফেললো। মিনমিনে গলায় বললো,

” তুমিও তো বিয়ের আগে এমন করেছিলে। ”

” বুইন রে তোর মতো এত করিনি। আর তোদের রিশাদ ভাইয়াও তোর জনের মতো এত পা’গলপ্রেমী ছিল না। ”

চকিতে চমকালাম আমরা! আমি তৎক্ষণাৎ ন্যা কা আহাজারি করে বললাম,

” ওহ্ মাই আল্লাহ্! এসব কি শুনছি? আমার কানে কি ময়লা জমেছে? না মানে আমি ভুলভাল কি শুনছি? রিশাদ ভাইয়া নাকি পা’গল প্রেমী ছিল না! ও এম এ! ”

বড়াপু ফটাফট আমার বাহুতে লাগিয়ে দিলো গাট্টা।

” ড্রামাবাজ! বড় বোনের সাথে ফাজলামি হচ্ছে? ”

নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলাম আমি। ডান কাঁধ হতে চুল সরিয়ে ভাব নিয়ে বললাম,

” ইহা ফাজলামি নয়। একদম হাচা কথা। এখানকার সকলে সাক্ষী। কি রে তৃষা বল। ”

তৃষা সাথে সাথে বললো,

” সাক্ষী মানে? আমরা তো রাজসাক্ষী। রিশাদ ভাইয়া যে রোমান্টিক ছিলো। ছিলো বলছি কি? এখনো আছে। সে তো বিয়ের সময়.. ”

আর বলা হলো না। বড়াপুর চোখ রাঙানি দেখে তৃষা ফুস! মুখ টিপে হেসে উঠলাম। নিশিপু এতক্ষণ নীরব দর্শক ছিল। সে যেই না কিছু বলতে যাবে ওমনি আমাদের টায়ার পাংচার! এই রে খালামণি আসছে!

” তানজি! নিশি! এই কোথায় তোরা? ”

ডাকতে ডাকতে খালামণি হাজির। চমকে গেল সে! কেননা ভদ্র বাচ্চার ন্যায় আমরা বিছানা এবং ফ্লোরে নিজ নিজ শোবার স্থান দখল করে শুয়ে রয়েছি। খালামণি ছোট ছোট চোখ করে বললো,

” সব কয়টা একসাথে! এখুনি রুমের লাইট বন্ধ চাই। তাড়াতাড়ি সব ঘুমিয়ে পড়। কাল বিয়ে মনে আছে কি? রাতভর আড্ডা দিলে নববধূ তো ঘুমের ঘোরে দুলতে দুলতে বিয়ের আসরে যাবে। সেটা কি খুব ভালো হবে? ”

আস্তে ধীরে না বোধক মাথা নাড়ালাম আমরা।

” মনে থাকে যেন। এখন সব কয়টা ঘুমিয়ে পড়। গুড নাইট। আল্লাহ্ হাফিজ। ”

খালামণি নিজেই রুমের আলো নিভিয়ে দিলো। অতঃপর দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। বড় শ্বাস ফেলে আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম। হায়! কি আর করার? বন্ধ করে নিলাম চক্ষু জোড়া। ইটস্ স্লিপিং টাইম!

সকাল সকাল হৈচৈ! বিরক্ত বোধ করে ঘুমকাতুরে আমি দেহে কাঁথাটা আরো ভালোমতো জড়িয়ে ডান কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। কি সুন্দর খাবারদাবার ভাসছে চোখের পর্দায়! আকস্মিক ধাক্কা! ভেঙে চুরমার হয়ে গেল আমার স্বপ্নটা। অসম্ভব রাগ নিয়ে চোখ মেলে তাকালাম আমি। নয়নতারায় বন্দি হলো তৃষার দাঁত ক্যালানো হাসি। মেজাজ আমার বিগড়ে একশো আশি হলো। কাঁথাটা ছিটকে পাশে ফেলে দিলাম। বসলাম উঠে। তৃষা যেই না কিছু বলতে যাবে মা”রলাম ওর পিঠ বরাবর শক্তপোক্ত এক ঘু ষি! কঁকিয়ে উঠলো মেয়েটা। ক্ষ্যা পা কণ্ঠে বললো,

” ওই ছে ম ড়ি! গায়ে বেশি জোর হইছে? দিলি তো আমার সুন্দর মসৃণ পিঠটা ভাইঙ্গা। ”

” ভাঙ্গছি। বেশ করছি। তুই যে আমার সাধের ঘুমটা ভেঙে দিলি? তার বেলায়? ”

” ভাঙ্গমু না তো কি করমু? মামিজান রুটি বেলুনি হাতে তেড়ে আসছে। বাঁচতে চাইলে ফটাফট উঠ। ”

কিহ্! মামি তেড়ে আসছে! ইন্না লিল্লাহ! আমাকে আর পায় কে? দ্রুততম গতিতে উঠে পড়লাম। তৃষার সহায়তায় গুছিয়ে ফেললাম ফ্লোর বেড। ইতিউতি না করে পোশাক নিয়ে ছুটলাম ওয়াশরুমে।
___

তাড়াহুড়ো করে ডাইনিং রুমে এসে বসলাম। শূন্য রুম। সকলের খাওয়া-দাওয়া শেষ। শুধু আমিই বাকি। ইশ্! আম্মু যদি একবার জানতে পারে না? আমার পিঠে কাঠ ভাঙ্গবে! হাতে মোটেও সময় নেই।‌ কেউ যে খাবার বেড়ে দিবে তা তো দুঃস্বপ্ন! কিইবা করার আছে? নিজে নিজেই বেড়ে নিতে হবে। আমি যেই না প্লেটে ভাত নিবো অমনি আমার বাম পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো কেউ। আকস্মিক এমন হওয়ায় কেঁপে উঠলো অন্তর আত্মা! বুকে থু থু ছিটিয়ে বামে তাকালাম। ওমনি মেজাজের দফারফা! তূর্ণ ভাইয়া! তাই তো বলি এমন কুকর্ম কে করতে পারে? তূর্ণ ভাইয়া অবাক চাহনিতে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। এহেন চাহনিতে বিব্রত বোধ করলাম। দৃষ্টি সরিয়ে মৃদু স্বরে বললাম,

” এভাবে কি দেখছো? ”

” তোকে। ”

চমকে তাকালাম তার দিকে। আমাকে দেখছে! আমাকে আবার দেখার কি আছে? নতুন দেখছে নাকি? মনের কথা মনে চেপে না রেখে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,

” আমাকে দেখার কি আছে? নতুন দেখছো নাকি? ”

” জ্বি না। তোকে নতুন দেখার কি আছে? তোকে তো সেই শিশুকাল থেকেই দেখে আসছি। ”

” আচ্ছা? তাহলে কি দেখেছিলে? ”

তূর্ণ ভাইয়া চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। ঘামে ভেজা শার্ট কাঁধ থেকে সামান্য সরিয়ে দেহে বাতাস ছুঁয়ে নিতে নিতে বললেন,

” দেখছিলাম তোর আশ্চর্যান্বিত আরেক রূপ! মানে তোর মতো কুমড়োপটাস, অকর্মার ঢেঁকি কিনা নিজে নিজে খাবার বেড়ে খাচ্ছে! ও আল্লাহ্! এ দিন দেখার আগে আমায় অন্ধ করে দিলে না কেন? ”

ওপর দিকে তাকিয়ে কথাটা শেষ করলেন উনি। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

” আমি কুমড়োপটাস? অকর্মার ঢেঁকি? তাহলে তুমি কি হাঁ? আস্ত এক দেশী খোসায় বিদেশি প্রোডাক্ট। ”

আমার কথা শুনে তূর্ণ ভাইয়া বুঝি আকাশ থেকে ধপাস করে পড়লো। অবাক চাহনিতে বললো,

” আমি দেশী খোসায় বিদেশি প্রোডাক্ট? ”

” একদম।‌ কোনো সন্দেহ নেই। ”

” পুতলা রে! তোর মুখটা আজকাল বড্ড চলছে। গুরুজনদের সম্মান করে কথা বলতে হয়। জানিস না? ”

আমি ব্যাঙ্গ করে বললাম,

” জ্বি জানি। কিন্তু তুমি বোধহয় জানো না ছোটদের কেও স্নেহ করতে হয়। ”

” কে বলেছে জানিনা? অফকোর্স জানি। ছোটদের স্নেহ করতে হয়।‌ পাশাপাশি আদরও করতে হয়। তো আয় বাবু আয়। তোকে আদর করে দিই। ”

তূর্ণ ভাইয়া দুই হাত দু’দিকে ছড়িয়ে আমাকে আহ্বান করতে লাগলো। ছিঃ! এ তো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা রা হলো! তড়িৎ বেগে চেয়ার ত্যাগ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। উনি ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে আমায় শুধোলেন ‘কি?’.

” নাথিং! ”

মেজাজ খারাপ করে দিয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কি! আমি আর অহেতুক কথা বাড়ালাম না। নিজের প্লেটে ভাত ও সবজি নিয়ে ওখান থেকে চলে যেতে উদ্যত হলাম। কেননা এখানে থাকলেই অশান্তি। যেই না ডাইনিং ত্যাগ করবো অমনি শুনতে পেলাম তূর্ণ ভাইয়ার কণ্ঠ।

” এই পুতুল! আমার খাবার সার্ভ করে দেবে কে? কুমড়োপটাস! এই? ”

আমি আর দাঁড়ালাম না। গজগজ করতে করতে চলে গেলাম ওখান থেকে। মহাশয় এখন একাকী বসে বসে সারেগামাপা করুক!

চলবে.

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৪

আদিত্যর কিরণে উজ্জ্বল বসুধা। গোটা বাড়ি ব্যস্ত নিজ নিজ কর্মে। হবু বধূ সিনথিয়াকে ইতিমধ্যে পার্লারে পাঠানো হয়েছে। সাথে গিয়েছে দুয়া’র বড় বোন তানজিনা, নিশি এবং মনিকা। মনিকা হলো তূর্ণ’র বন্ধু। পেশায় একজন ডক্টর। এদিকে পুরো বাড়ির সকলে প্রস্তুত হচ্ছে বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য।

সমতল আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে দুয়া। মায়াবী আঁখি যুগল আইলাইনারের ছোঁয়ায় রাঙালো। ওষ্ঠাধর রাঙা হলো লিপস্টিকের কৃত্রিম রঙে। সাজ সম্পন্ন! মিষ্টি হাসি উপহার দিলো মেয়েটা নিজ প্রতিবিম্ব দেখে। অতঃপর দক্ষ হাতে হিজাবে আবৃত করলো দীঘল কালো কেশ। ঠিক সে মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করলো তৃষা।

” দুয়া! এই দুয়া! তোর সাজগোজ হলো? ”

বলতে বলতে মেয়েটার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো দুয়া’র পানে। বিমোহিত হলো মেয়েটি! দুয়া’র পড়নে ক্রিম কালার মাল্টি লেয়ার্স লেহেঙ্গা। গুলুমুলু দেহে লেহেঙ্গাটি বড্ড মানিয়েছে। বাঁ কাঁধে ছেড়ে রাখা দোপাট্টা। দীঘল কালো কেশ আবৃত মানানসই হিজাবে। মায়াবী আঁখি যুগলে মোটা করে আইলাইনার এর প্রলেপ। ওষ্ঠাধরে লাইট পিঙ্ক লিপস্টিক। ডান হাতে ব্রেসলেট। বাঁ হাতে লেডিস ওয়াচ। ব্যস সাজ সম্পন্ন!

” মাশাআল্লাহ্! বেবি তোকে কি সুন্দর লাগছে! ”

তৃষা চটাপট ছুটে এলো। নজরটিকা লাগিয়ে দিলো মেয়েটির কানের পেছনে। মৃদু হেসে দুয়া শুধালো,

” আরে এসব আবার কি করছিস? ”

” নজরটিকা লাগাচ্ছি বেবি। নজরটিকা। আজ তোকে যা লাগছে না? কত বেডা যে হুঁশ হারাবে আল্লাহ্ মালুম। তাই আগেভাগেই বলে রাখছি আমার আঁচল ধরে ধরে ঘুরবি। আমি তোকে সেফ করবো। বুঝেছিস? ”

না চাইতেও সশব্দে হাসলো দুয়া। তৃষা মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করলো সে হাসি! তাড়া দেখিয়ে বললো,

” আচ্ছা অনেক হয়েছে। এবার তাড়াতাড়ি চল। ওদিকে সবাই প্রায় রেডি। ”

” হুঁ হুঁ। চল। ”

দুই বোন প্লাস সখি দুরন্ত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলো।

পেলব দু হাতে লেহেঙ্গা সামলিয়ে দুয়া পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত কক্ষে। গুটিগুটি পায়ে প্রবেশ করলো। দেখা মিললো প্রিয় মানুষটির। হাসিমুখে এগিয়ে গেল দুয়া। দু হাতে পেছন থেকে আলিঙ্গন করলো। প্রথমে অবাক হলেও নিজেকে সামলিয়ে নিলো সে মানুষটি। মুচকি হেসে পিছু ঘুরে তাকালো। মুখোমুখি দু’জনে দাঁড়িয়ে।

” নানুমনি! ”

বিপরীতে দাঁড়িয়ে আনোয়ারা বেগম। সত্তরোর্ধ্ব মানবীর চামড়ায় ভাঁজ সৃষ্টি হয়েছে। পড়ে গিয়েছে একটি দাঁত। তবুও চেহারায় আকর্ষণীয় রূপের ছটা। গৌর বর্ণের এই নারীকে দেখলেই বোঝা যায় যৌবনে কতটা সুন্দরী ছিলেন। দুয়া আদুরে গলায় বললো,

” আমার সোনা নানুমনি! তুমি রেডি তো? ”

” এই তো নানু। আমি তৈরি। ”

নাতনিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে,

” মাশাআল্লাহ্! আমার নানুকে তো পরীর মতো লাগছে! কারো নজর না লেগে যায়। ”

” তুমিও বলছো নানুমনি? আমার মতো কুমড়োপটাস – কে কিভাবে পরী লাগবে? ”

নাতনির অভিমানী কণ্ঠ শুনে আনোয়ারা বেগম ইষৎ চমকালেন!

” কুমড়োপটাস! এসব কি বলছো নানু? ”

দুয়া জবাব দিলো,

” ঠিকই তো বলছি। তোমার প্রিয় নানাভাই ই তো বলেছে আমি নাকি কুমড়োপটাস! ”

” প্রিয় নানাভাই! কে? ”

সেকেন্ড ভেবে,

” তূর্ণ নানাভাই? ”

মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো দুয়া।

” তাছাড়া আর কে হবে? তোমার ওই আদুরে নানাভাই তো চিরকাল ই আমাকে ঈর্ষা করে। দেখলেই উল্টাপাল্টা নামে ডাকবে। ”

নিঃশব্দে হাসলেন আনোয়ারা বেগম। ভারী দেহ নিয়ে বসলেন বিছানায়। হাসি মুখে শুধোলেন,

” সে শুধু ঈর্ষা ই করে? ভালোবাসে না? ”

” ছাই বাসে। ”

আনোয়ারা বেগম হেসে উঠলেন। কিছু বলতে উদ্যত হতেই বাহির থেকে দুয়া’ মা তাহমিদা’র কণ্ঠ শোনা গেল।

” এই রে মা ডাকছে। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ও সোনা নানুমনি! চলো চলো। মা তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে। ”

” আচ্ছা চল। ”

দুয়া যত্ন করে নানুমনির হাত ধরে উঠতে সহায়তা করলো। দু’জনে মিলে আস্তে ধীরে বেরিয়ে গেল কক্ষ হতে।

বাড়ির প্রাঙ্গনে বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আলো ঝলমলে পরিবেশ। আগত অতিথিদের উপস্থিতিতে মুখরিত চারিপাশ। কনের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসে সিনথিয়া। পাশেই রয়েছে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা। দুয়া ছোট ভাই জাহিনের হাত ধরে হাঁটছে। ঘুরে ঘুরে দেখছে আশপাশ। জাহিনের পড়নে কালো ব্লেজার স্যুট। বেশ লাগছে দেখতে।

দুই ভাই-বোন ঘুরে ঘুরে দেখছে ঠিক সেসময় হঠাৎ সম্মুখে এসে হাজির হলো তূর্ণ। আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ! হঠাৎ তূর্ণ ভাইয়াকে দেখে হকচকিয়ে গেল দুয়া! কিন্তু স্বাভাবিক জাহিন। তূর্ণ ছোট ছোট চোখ করে দুয়া’র পানে তাকালো। অদ্ভুদ চাহনিতে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,

” এসব কি পড়েছিস? পেঁচানো পেঁচানো? কুমড়ো ড্রেস নাকি? ”

অপমানিত বোধ করলো মেয়েটা। যেখানে আজ সবাই কম-বেশি ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ সেখানে তূর্ণ ভাইয়া কিনা এমন বাজে কথা বলছে? মেয়েটা কড়া কণ্ঠে জবাব দিলো,

” হাঁ। কুমড়ো ড্রেস। আজ ই বাজারে লঞ্চ হয়েছে। আর ফার্স্ট ক্রেতা আমি। হ্যাপি? ”

নাক ছিটকে তূর্ণ বললো,

” ছিঃ! তোর রুচিবোধ কোথায় নেমে গেছে পুতুল? শেষমেষ কুমড়ো ড্রেস! ”

” শোনো আমার রুচি ঠিকই আছে। মাঝখান থেকে তোমার টেস্ট জঘন্য হয়ে যাচ্ছে। নিজে এসব কি পড়েছো? পেঁয়াজের খোসার মতো লাগছে। ইয়াক! ”

ব্লেজার স্যুটকে এমন অপমান! মানা যায়?

” তোর চোখে বোধহয় ছানি পড়েছে। কাকে পেঁয়াজ বলছিস? জানিস এটা ব্র্যান্ডেড? প্রাইস কত? ”

” এটা ব্র্যান্ডেড! ও মা! আমি তো ভাবলাম কাওরানবাজার এর পাইকারি দোকান থেকে পেঁয়াজের সাথে ফ্রি পেয়েছো। ”

মেয়েটার কণ্ঠে বিস্ময়! তূর্ণ দাঁতে দাঁত চেপে যেই না কিছু বলতে উদ্যত হলো ওমনি তার কান মলে দিলো কেউ। চমকালো তূর্ণ! বাম পাশে তাকিয়ে দেখলো নানুমনি দাঁড়িয়ে। ছেলেটা মিথ্যা মিথ্যা কঁকিয়ে উঠলো।

” আহ্! নানুমনি? কি করছো? লাগছে তো। ”

” লাগুক। তোমার সাহস তো কম না তুমি আমার নানুভাইকে কুমড়োপটাস বলো! ”

কান ছাড়িয়ে তূর্ণ বললো,

” ভুল কিছু বলেছি কি? ”

” ভুল মানে মস্ত বড় ভুল বলেছো। ”

নানুমনিকে পেয়ে মেয়েটা আহ্লাদী হলো। গিয়ে দাঁড়ালো নানুমনির পাশ ঘেঁষে। আনোয়ারা বেগম পুনরায় বললেন,

” আমার পরীর মতো দেখতে নানুভাই! তুমি তাকে নিয়ে মজা করছো? খুব খারাপ। ”

তূর্ণ বক্র হেসে বললো,

” পরীর মতো নানুভাই! তা ওনার রাজ মশাই কোথায়?”

চরম আশ্চর্যান্বিত হলো দুয়া! চোখমুখ কুঁচকে কিছু বলতে উদ্যত হতেই আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ গায়েব! ফটাফট কেটে পড়েছে। দুয়া অভিযোগের গলায় বললো,

” নানুমনি তুমি! তুমি শুনলে? আমাকে পরিমনির সাথে তুলনা করলো? আমি পরিমনি? ”

নানুমনি কিছু বলার পূর্বেই দুয়া বিড়বিড় করে আওড়ালো,

” আস্ত এক খ|বিশ। ”

অতঃপর চোখের সামনে থেকে সরে গেল দুয়া। নানুমনি একাকী নিঃশব্দে হেসে উঠলেন। হঠাৎ উনি লক্ষ্য করলেন জাহিন এখানে নেই! সে আবার গেল কোথায়?

” ওহ্ হো! শান্তিপ্রিয় নানাভাই আমার অশান্তি দেখে সরে পড়েছে। ”

দুয়া, তৃষা এবং নিশি প্রাঙ্গনের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। এদিকে লোকজনের কম আনাগোনা বলা চলে। তৃষা লজ্জা মিশ্রিত মুখে বললো,

” তোমরা জানো আজ কি হয়েছে? ”

নিশি জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে শুধালো,

” কি হয়েছে? এত ব্লাশিং ব্লাশিং! কেস কি? ”

দুয়াও সাথ দিলো।

” হাঁ। ব্যাপার কি রে তৃষা? লজ্জায় টমেটো লাল হয়ে যাচ্ছিস কেন? বল। ”

তৃষা লজ্জায় মুখ লুকালো লেহেঙ্গার ওড়নায়। মৃদু স্বরে থেমে থেমে বললো,

” আমি না ক্রাশ খেয়েছি। ”

ব্যস! বলতে না বলতেই পিঠের উপর দুম করে এক ঘু”ষি। মে|রেছে জাহিরাহ্ দুয়া! দাঁতে দাঁত চেপে দুয়া বললো,

” ফা জি ল মাইয়া! তোর কেরোসিনের কেস এমন ঝাকানাকা মশলা মাখিয়ে বললি মনে হচ্ছিল তোর বিয়েটাই হয়ে গেছে। ”

তৃষা ছোট ছোট চোখ করে বললো,

” বিয়া ক্যামনে হইতো? আগে তো তোর সিরিয়াল। দুই মাসের বড় কিনা। ”

” আচ্ছা? আমি সিরিয়ালে আগে না থাকলে তুই করে নিতি? ”

তৎক্ষণাৎ তৃষার জবাব।

” অফকোর্স করতাম।‌ বিবাহ অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করে জানিস না? ”

দুয়া ব্যাঙ্গ করে বললো,

” ইহ্! নামাজ কালামের ঠিক নেই। উনি নাকি আবার অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করবে! ”

হেসে উঠলো নিশি। বললো,

” তৃষা বোন আমার! বিবাহ করিতে বেশ উদগ্রীব হয়ে গেছিস মনে হয়? ”

” হাঁ। অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করতে হবে না? আমি তো সিরিয়ালে পড়েছি এই মাইয়ার জন্য। এটাকে বিদায় করতে পারলেই আমার রাস্তা ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার। ”

দুয়া শুধালো,

” আচ্ছা? সিরিয়ালে শুধু আমিই আছি? আর নিশিপু? সে বুঝি অলরেডি ম্যারিড? ”

আঁতকে উঠলো তৃষা।

” ইন্না লিল্লাহ! এখনো দুইজন। তারপর আমি! আয় হায় রে? তোমরা একটু প্রেম ট্রেম করতে পারো না? তাইলে তো হয়ে যেতো। সোজা কাজি অফিসে গিয়ে বিনে পয়সায় বিবাহ খতম। আর এদিকে আমার রাস্তাও ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার! ”

সশব্দে হেসে উঠলো দুয়া এবং নিশি। সঙ্গী হলো তৃষা নিজেও।

সদ্য বিবাহ সম্পন্ন হলো সিনথিয়া এবং কবির এর। বোনের থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে মিহাদ। অনার্স শেষ বর্ষে পড়ুয়া ছেলেটা আজ বোনের স্মরণীয় দিনে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছে। পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু স্নেহের ছোট বোনের বিবাহে কে না আবেগপ্রবণ হয়ে উঠবে? দু’জনের বয়সের পার্থক্য মাত্র দেড় বছর। পিঠাপিঠি ভাই-বোন ছিল দুজনে। অন্য সবার মতো ছিল খুনসুটি, দুষ্টুমি, ভালোবাসা। আজ সেই আদরের বোনের বিয়ে হয়ে গেল। জীবন জুড়ে গেল অন্যের সনে। একপ্রকার পর হয়ে গেল বোনটা। আগের মতো সেই সুসম্পর্ক আর রইবে কি? উঁহু! এখন আর যখন তখন দু’জনের মা*রামারি হবে না, চুল টানাটানি হবে না। বোনটা যখন তখন এটাসেটা বায়না করবে না। ছোট হওয়া স্বত্ত্বেও নাম ধরে ডাকবে না। অনেক কিছুই যে বদলে যাবে। ভাবতেই ছলছল করে উঠলো আঁখি জোড়া। সবার অলক্ষ্যে ছেলেটা সেথা হতে সরে গেল।

আঁধার রাত্রি। বিবাহ অনুষ্ঠান সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন বিদায় বেলা। মায়ের কাঁধে মুখ লুকিয়ে হুঁ হুঁ করে কেঁদে চলেছে সিনথিয়া। সাথি মেয়েকে জড়িয়ে নিজেও কেঁদে চলেছেন। আবেগঘন এক মুহুর্ত। স্ত্রী কন্যার ক্রন্দনে দিশেহারা বোধ করছেন মাহফুজ সাহেব। ওনার নিজেরও যে খুব কষ্ট হচ্ছে। জ্বলন অনুভূত হচ্ছে হৃদয়ে। তবুও শক্ত থাকতে হবে। উনি ভেঙ্গে পড়লে চলবে কি করে? নিজেকে সামলিয়ে মাহফুজ সাহেব এগিয়ে গেলেন। ক্রন্দনরত কন্যার হাত দু’টো সমর্পণ করলেন নতুন জামাই কবিরের হাতে। কবির মোলায়েম কণ্ঠে শ্বশুরকে আশ্বস্ত করলো। অশ্রুসজল নয়নে সিনথিয়া এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বড় ভাইকে খুঁজছে। কিন্তু ভাইকে আজ কোথাও দেখতে পেল না। বুঝতে বাকি নেই তার ভাইটা এখানে কেন অনুপস্থিত! বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে।

কবির যতন করে নববধূকে গাড়িতে বসালো। আটকে দিলো ডোর। অশ্রুসিক্ত নয়নে সিনথিয়া তাকিয়ে রইলো পরিবারের পানে। হাত নেড়ে বিদায় জানালো। দাদী আনোয়ারা বেগমও বিপরীতে হাত নেড়ে নাতনিকে বিদায় জানালেন। দোয়া করলেন হৃদয়ের অন্তঃস্থল হতে। অতঃপর বিদায় নিলো সিনথিয়া। অগ্রসর হতে লাগলো গাড়িটি। একসময় চলে গেল দৃষ্টি সীমার বাহিরে। তূর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহাদ’কে খুঁজতে লেগে পড়লো। এসবের ভিড়ে অনুপস্থিত দুয়া। মেয়েটা আবার গেল কোথায়?

ব্যস্ত সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছে গাড়িটি। ক্রন্দনে লিপ্ত মেয়েটির কায়া ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত হচ্ছে। ডান পাশে বসে নতুন বর কবির।‌ অর্ধাঙ্গিনীর ক্রন্দনে দিশেহারা বোধ করছে মানুষটা। কি করে সে কান্না বন্ধ করবে? মেয়েটা কি বুঝতে পারছে না তার কান্নায় পাশে বসে থাকা মানবের হৃদয়ে ঝড় উঠছে! আস্তে করে মেয়েটার দিকে ধাবিত হলো কবির। বসলো অতি সন্নিকটে। কাঁপা কাঁপা হাতটি রাখলো স্ত্রীর ডান কাঁধে। হঠাৎ কাঁধে হাত রাখায় চমকে উঠলো সিনথিয়া! তাকালো স্বামীর পানে। নয়নে মিলিত হলো নয়ন। মেয়েটির কর্ণ কুহরে পৌঁছালো পুরুষালি কণ্ঠস্বর,

” কেঁদো না সিনু। তোমার প্রতি বিন্দু অশ্রু যে আমার হৃদয়ে ঝড় সৃষ্টি করছে। ”

চমকিত মেয়েটি টেরও পেলো না কিচ্ছুটি। সম্মোহিত এর মতন স্বামীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো। মাথা রাখলো কাঁধে। চলতে লাগলো গাড়িটি।

চলবে.