তোকে ঘিরে পর্ব-৬২

0
723

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬২.
#ফাবিয়াহ্_মমো

( অংশ – ০১.)

শান্ত স্নিগ্ধ ভেজা চোখদুটো অশ্রুপূর্ণে টলটল করে উঠলো। নিচের রক্তাক্ত ঠোঁটটা জোরে-জোরে কাঁপতে লাগলো। ঘন পাপড়ির সুন্দর চোখদুটো আচমকা বন্ধ করে কুচকে ফেললে ওমনেই গাল গড়িয়ে পানি পরলো ফ্লোরে। সাথে সাথে অশ্রুবিদ্ধ মুখখানা আড়াল করার জন্য পূর্ব মাথাটা নিচু করে ফেললো। পূর্ণতার পেটের উপর এখনো তার ক্ষতবীক্ষত হাত রাখা, যেটা থরথর করে আকস্মিক কান্নায় কাঁপছে। এ দৃশ্য দেখে চৌদ্দ শিকের বেড়িটা ভাঙতে ইচ্ছে করছিলো পূর্ণতার। আরো একবার পূর্ব প্রচণ্ড খুশিতে মনের যেখানে নরম মুখোশটা প্রকাশ করে ফেলেছে সেখানে গতবারের মতো আর জড়িয়ে ধরতে পারছেনা ও। নিজের ব্যর্থতায় কাতর হয়ে পূর্ণতা ঝাপসা চোখ মুছলো। লোহার চৌদ্দশিকের ফাঁক গলে পূর্বের এলোমেলো চুলের উপর হাত রাখলো। ওমনেই ছিটকে আসা কান্নায় পূর্ণতা হেচকির সুরে বললো,

– তোমাকে কি ওরা মেরে ফেলবে?

কন্ঠের মধ্যে থাকা তীব্র কষ্টটা যেনো পূর্বের বুকটা চিড়চিড় করে দিলো! কি করে বলবে রিমান্ডের নামে ওরা পূর্বের সাথে কি কি করছে! পূর্ব মাথা নিচু অবস্থায় খুব সাবধানে চোখ মুছে ওর দিকে তাকালো। ঢোক গিলে গলা ঠিক করে পূর্ণতার পেট থেকে হাত সরিয়ে ভেতরে আনলো। নিজেকে বহুকষ্টে সামলে নিয়ে জোরে নিশ্বাস ছাড়লেও চোখ ভরে আসছিলো ওর। তবুও ওই অবস্থায় ধাতস্থ কন্ঠে পূর্ব বললো,

– আমি চলে গেলে তো আর সমস্যা নেই পূর্ণ। ও তোমার সঙ্গে আছে। তুমি দয়াকরে ভুলেও আর এখানে এসো না। ওরা আমার সাথে যা করছে করুক, তোমার কিছু হলে আমি সত্যিই মরে যাবো, ওর কিছু হতে দিও না, আমার এই একটা ইচ্ছা তুমি যত্ন করে রেখে দিও। আমি আর কিছুই চাইনা। তুমি এসো না।

কথাগুলো বলতে বলতে পূর্ব ‘না’ সূচকে মাথা নাড়াতে থাকে। ওর চোখ থেকে বৃষ্টির মতো অশ্রু পরতে পরছিলো তখন। এভাবে কখনো পূর্বকে অশ্রুসিক্ত অবস্থায় বিধ্বস্ত দেখেনি পূর্ণতা। নিজেকে শক্ত করার মতো স্পৃহাটা যার কাছ থেকে পেতো আজ সে-ই যেনো দুইটুকরো হয়ে ভেঙ্গে পরেছে। এতোক্ষন যেই কঠোর মুখ ভঙ্গিতে মানুষটা ছিলো সেটা যেনো সন্তান আগমনের খুশিতে পাল্টে গিয়েছে। পূর্বের ওই অবস্থা দেখে পূর্ণতা ফোঁপানো অবস্থায় নিকাবের নিচটা ধরে টান মেরে খুলে। চোখের পলকে পূর্বের গালদুটো কাছে টেনে স্বল্প ফাঁকের মধ্যেই ওর রক্তাক্ত ক্ষতবীক্ষত ওষ্ঠজোড়া দখল করে। পূর্ব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলেও পূর্ণতার সাথে এইটুকু সঙ্গ যেনো অনন্তকালের সুখ ছিলো। এতোদিনের সকল দুঃখ যেনো একটু একটু করে কেটে যাচ্ছিলো। পূর্ণতার স্পর্শে ব্যকুল হয়ে উঠা পূর্বের মনটা অনিমেষ শান্তিতে বিমুগ্ধ হচ্ছিলো। ক্ষতযুক্ত ঠোঁটে পূর্ব প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করলেও হাতের মুঠো শক্ত করে খিচে থাকলো। অন্তত এইটুকু সুখের মূহুর্তে সে ব্যথাটুকু পাত্তা দিবেনা। আরেকটু ব্যথা সহ্য করলে সে মরে যাবেনা। পূর্ণতার জন্য যার সবকিছু হাজির, সেখানে এই যন্ত্রণার ক্লেশটা একফোঁটা তিল মাত্র। এদিকে জেলার আসতে নিলে পূর্ব আড়চোখে সেটা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি পূর্ণতাকে সরাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু আজ যেনো নিজের শরীরের চেয়ে পূর্ণতার শক্তিটাই ঢের ছিলো। পূর্ণতার মুখ যদি জেলার দেখে ফেলে তাহলে বিপদের আশঙ্কা থাকতে পারে। পূর্ব নিরুপায় হয়ে দ্রুত পূর্ণতার মাথা থেকে নিকাবটা টেনে জেলার যেদিক দিয়ে আসছে সেদিকটার কাছে কাপড়টা ফেলে দেয়। পদধ্বনির আওয়াজটা তীব্র থেকে তীব্রতর হলে পূর্ণতা সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো পূর্বকে ছেড়ে দেয়। দ্রুত নিকাব ঠিক করে চোখ ফিরিয়ে বামে তাকিয়ে দেখে বাইরে চেয়ার-টেবিলে বসা যেই পুলিশকে দেখেছিলো তার সঙ্গে দুটো দারোগা জুটেছে। তারা একদৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে হো হো করে ব্যাঙ্গাত্মক সুরে হাসছে। পূর্ণতা গরম চোখে তাকিয়ে এরপর দৃষ্টি ফেরালো পূর্বের দিকে। ওমনেই পুলিশটা খোচা মেরে বললো,

– হুজুরনি আফা, এটা জেল। আপনাদের লুতুপুতু খানা না। একটু আগে যেইটা করছেন ওটা চিপাচাপায় করবেন। ভালো উপদেশ দিলাম। এখন বিদায় হন।

পূর্ণতা যেই পুলিশের উদ্দেশ্যে মুখ ঘুরিয়ে কিছু বলবে ওমনেই পূর্ব অস্ফুট শব্দে বলে উঠে,

– পূর্ণ না, চুপ…

পূর্ণতা নিকাবের আড়ালে নাক ফুলিয়ে তপ্তকর নিশ্বাস ছাড়লো। পূর্বের আদেশসূচক বার্তা শুনে আর কিছুই বললো না। অন্যদিকে সাগ্রত গোপন তথ্য জোগার করার জন্য ‘ আসছি ‘ বলে একটু ভেতরে চলে গেলে, আয়মান চুপচাপ পূর্ণতার কাছে ফিরে আসে। এসেই দেখে জেলার পূর্ণতাকে এক্ষুনি উঠার জন্য জোর তাগাদা দিচ্ছে। আরেকটু হলে যেনো পুলিশ পূর্ণতার গায়ে হাত দিয়ে জোরপূর্বক তুলবে! আয়মান দ্রুতবেগে পূর্ণতার কাছে এসে ফ্লোরে ঝুঁকে ওর হাত ধরলো। নিচু কন্ঠে বললো,

– চল পূর্ণতা। পুলিশ বেটায় যথেষ্ট টাইম দিছে। তেড়িবেড়ি করিস না। তুই কিছু করলে পূর্ব ভাইরে ছাড়বো না। উঠ রে বইন, আর ঝামেলা বাড়াইস না।

পূর্বের দিকে স্থিরদৃষ্টি রেখে পূর্ণতা আয়মানের হাত ধরে উঠে দাড়ালো। এদিকে সাগ্রত এখনো আসলোনা। পুলিশগুলো আরো কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে তাদের থামিয়ে দিয়ে পূর্ব শান্ত কন্ঠে বলে,

– মেয়েদের সাথে সভ্য আচরণ করুন। যা করার আমার সাথেই করবেন। ওদের কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।

পুলিশ চোখ মুখ রাঙিয়ে পূর্বের দিকে তাকিয়ে থাকলে পূর্ব সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পূর্ণতার দিকে তাকায়। শুষ্ক মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মতো হাসে পূর্ব।বিদায় মূহুর্ত এসে গেছে জেনেও পূর্ণতার ইচ্ছা করছিলো না এখান থেকে যেতে। পূর্ণতা বিহ্বল হয়ে পরতে নিলে অতি দ্রুত আয়মান ওকে ধরে সেখান থেকে নিয়ে যায়। চোখের পানিতে ভিজে উঠা নিকাব আবারও অশ্রুধারায় চুপচুপে হয়ে যায়। পূর্ণতাকে গাড়িতে বসিয়ে সাগ্রতকে কল করে আয়মান। কলটা কেটে দেয়ার একমিনিটের মাথায় সাগ্রত জেল থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চড়ে বসে। পুরো রাস্তায় পূর্ণতা হু হু করে কেদেঁ দিয়ে ওয়াসিফ ভিলায় পৌঁছে। আয়মান কিছুক্ষণ পূর্ণতাকে সান্ত্বনা দিয়ে চুপ করিয়ে বাসায় ফিরে। সাগ্রত থম মেরে সোফায় বসে থাকে। কিছুক্ষণ নিজের চিন্তায় ডুবে থেকে পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। পূর্ণতা তার ঠিক সামনের সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে। আয়েশা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সাগ্রত একটু হালকা কেশে গলা পরিস্কার করে বললো,

– আমার কাছে ঘটনাটা খুবই জটিল লেগেছে। একে তো রিমান্ডের ঘটনার সাথে কিছু বিষয়বস্তুর তেমন মিল পেলাম না। তবে পূর্ণতা, এখানে কিছু একটা রহস্য আছে।

সাগ্রত তার কথা শেষ করে অন্যমনষ্ক হলে আয়েশা ও পূর্ণতা দুজনই বিষ্ময়সূচকে চোখ তুলে তাকায়। পূর্ণতা চোখ মুছে নাক টেনে কৌতুহল গলায় জিজ্ঞেস করে,

– আপনার কথার মানে বুঝিনি। কি বলতে চাইছেন ভাইয়া? আমরা সবাই জানি সবুজ নয়তো কৈলেশ পূর্বের শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে ক্ষতিটা করেছে। আর এজন্যই ওরা গুম। মানে কাজ সেরেই পালিয়েছে। এখানে রহস্যের কি আছে?

পূর্ণতার প্রশ্নাত্মক কথাগুলো শুনে সাগ্রত মৃদ্যু ভঙ্গিতে হেসে দেয়। এটা দেখে পূর্ণতার কুঁচকানো ভ্রুঁ আরো খানিকটা কুঁচকে যায়। সাগ্রত টেবিলের উপর থেকে ধোয়া উঠা কফির মগটা তুলে সরল গলায় বলে উঠে,

– গতবার যা ভেবেছিলাম এবার তার ঠিক উল্টোটা পেয়েছি। আমরা চোখে যা দেখছি সেগুলো কেউ ইচ্ছে করে আমাদের দেখাচ্ছে।প্রথমত, পূর্বের বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলো কৈলেশ, সবুজ, সাব্বির, ওমর ও বিজয়। আর পার্সনাল গাড়ির ড্রাইভার ছিলো মোমিন। মোমিন এখনো ড্রাইভার রূপেই এ বাড়িতে আছে। কিন্তু পূর্ব যাদের কাছে তোমার নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি দিয়েছিলো তারাই এখন গুম।

সাগ্রতের কথা শুনে মাথার ভেতর ছোটখাট জট লেগে যায় পূর্ণতার। এখানে এতোগুলো নাম কেনো আসছে এখন? গতবার শুধু তিনজন ছিলো আর এখন এতোগুলো নাম হলো? পূর্ণতা কিছুই ভাবতে পারছিলোনা। এলোমেলো চিন্তায় সে আবারও সাগ্রতকে প্রশ্ন করলো,

– এখানে মূল ব্যক্তি হলো দুজন। কৈলেশ আর সবুজ। সাব্বির আপাতত পূর্বের নির্দেশে হয়তো কোথাও চলে গেছে। কিন্তু এখানে এমন প্যাঁচটার মানে কি? আর মোমিনও যে করবেনা, তা তো জানা কথা। কারন ও বাড়িতেই। পালায়নি।

সাগ্রত কফিতে ছোট্ট চুমুক দিয়ে গলায় ঢোক ফেলে গাঢ় কন্ঠে বললো,

– এখানে বাইরের মানুষ জড়িত আছে। আচ্ছা, পূর্ব কি কখনো এমন কোনো ব্যক্তির নাম বলতো যাকে ও সহ্য করতে পারতো না?ছিলো কেউ?

পূর্ণতা একটু ভেবেচিন্তে হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো,

– হ্যাঁ, আছে। চ্যার্টাজী নামের একটা লোক। লোকটা বামপন্থী করে শুনেছিলাম। আর লোকটা খুবই খারাপ। পূর্ব কখনোই ওই লোকটাকে সহ্য করতে পারতো না।

– কি একটা অবস্থা! কমিউনিজম করা পার্টিগুলার মধ্যেও এমন দু/একটা কিট পতঙ্গ ঢুকে আছে। মার্কসের আর্দশগুলো এদের মতো নিচুশ্রেণীর মানুষের জন্য দিনদিন ধ্বংস হচ্ছে। আচ্ছা বাদ দাও। চ্যার্টাজীর খবর বের করছি। চিন্তা করো না। আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের হেল্থের দিকে ধ্যান দাও। আমি আজ আসি। কিছুদিন ব্যস্ত থাকবো হয়তো। কিন্তু যেকোনো প্রয়োজনে তুমি আমাকে কল দিবে। ঠিক আছে? আসি তাহলে।

পূর্ণতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচকে সম্মতি জানালে সাগ্রত বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। দিনটা আর ভালো কাটলো না। চোখের সামনে পূর্বের আহত অবস্থাটা ভাসছিলো। ঠোঁট কাটা, সমস্ত শরীর জুড়ে কালচে ছাপ, চুল এলোমেলো, হাতের তালু ক্ষতবীক্ষত। তবুও রুক্ষ চেহারায় একটুকরো আলোর দেখা দিয়ে পূর্ব হেসেছিলো।

.

পূর্ণতা চলে যাওয়ার পর পূর্বের উপর নির্মম আচরণ শুরু হলো! পুলিশকে মুখের উপর ওইটুকু বলাতে আজ তার শরীরে আবারও রোলারের আঘাত পরলো! দুইহাত দুইদিকে বেধে কয়েক ঘন্টা পিটিয়েছে তারা। গতবারের চেয়ে এবারের ডোজটা বেশি ছিলো যেনো। পূর্ব ব্যথা সহ্য করতে না পেরে বেঁহুশ হয়ে যায়। নাক-মুখ দিয়ে তরল রক্ত বেরিয়ে গলগল করে পরতে থাকে। তারা পিটিয়ে যখন হাপিয়ে উঠে তখন ওর হাতের বাধন খুলে ফ্লোরে ফেলে দেয়। অবচেতন পূর্ব যখন ব্যথায় নিষ্প্রভ হয়ে যায় তখন ওরা আর ভুলেও ওর কাছে দেখতে আসেনা। পুরোটা রাত পূর্ব জ্ঞানহীন ছিলো। সকালের দিকে যখন আধো আধো চোখে ঝাপসা দৃষ্টি মেললো তখন কানে কিছু মানুষের আলাপালোচনা শোনা গেলো। তারা হেসে হেসে পূর্বের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছে। সঙ্গে সেই পুলিশের কন্ঠ এবং জেলারের গলাও শোনা যাচ্ছিলো। পূর্ব স্পষ্ট চোখে কিছু দেখতে না পেলেও কানে যতদূর শুনছিলো তাতে এটুকু বুঝে যায়, এখানে জেলার ও পুলিশ-সহ আরো তিনজন ব্যক্তি যুক্ত। সেই তিনজন ব্যক্তির হাস্যোজ্জ্বল গলা শুনে বুকের ভেতরটা ছিড়ে আসছিলো ওর। কি পাপ করলো ওদের সাথে? কেনো এতো বড় ক্ষতি করলো? পূর্ব অসাড় শরীরে চোখ বন্ধ করে পরে থাকলেও চোখের কোল থেকে অবিরামভাবে পানি পরছিলো। জীবনে ব্যর্থতা সহ্য করা যায় কিন্তু প্রতারণার আঘাত না। নিজের আর্দশ নীতিতত্ত্বে যারা অটল থাকার ওয়াদা করেছিলো তারা এমন ধোকা দিলো, পূর্বের অশ্রুগুলো যেনো সেই কষ্টের সাক্ষী ছিলো।

জীবনটা যখন বিষের মতো বিষাক্ত হয়ে উঠছিলো তখন আয়মান নিজেই যেনো সবকিছু উলোটপালোট করে ফেলছিলো। কখন খাওয়া, কখন নাওয়া, কখন ঘুম, কখন যাওয়া – এসবই যেনো বিশৃঙ্খলায় চলতে লাগলো। সাবিহা আগ বারিয়ে কিছুদিন ওর যত্ন নেওয়া বন্ধ রাখলো। বাড়ির টুকটাক কাজ ও রান্নার দিকটা আফিয়ার অনুমতিতে সাবিহাই সামলাতো। কাজেই আয়মানের রুমে সে একপ্রকার যাওয়া বন্ধ করে দিলো। আয়মান রাত এগারোটার দিকে স্যূট খুলতে খুলতে নিজের রুমে চলে যায়। ক্লান্ত মুখটা দূর থেকে দেখতে পেয়ে সাবিহা অনেকক্ষন পর বাধ্য হয়ে আজ আয়মানের রুমের কাছে আসলো। কি মনে করে যেনো বারান্দার দিকে তাকালো ওমনেই সাবিহা শিউরে উঠে দৌড় দিয়ে বারান্দার দিকে চলে যায়!আয়মান রেলিংয়ে উপর বসে পা বাইরে ঝুলিয়ে বসে আছে! বারান্দাটা আদি যুগের মতো গ্রিল ছাড়া এবং রেলিংয়ের দেয়ালটা সুন্দর করে কারুনৈপুণ্যে বাধাই করা। সাবিহা দ্রুত আয়মানের পাশে দাড়িয়ে ওর বাহুটা পেঁচিয়ে অস্থির কন্ঠে বললো,

– আপনি পরে যাবেন প্লিজ নামুন! এভাবে পাগলামি করবেন না! অঘটন ঘটতে সময় নেই!!

আয়মানের চক্ষুদৃষ্টি দোতলার উপর থেকে নিচের দিকে থমকে আছে। বাতাসও শো শো করে সাবিহার রেশমী কেশ উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মনের উপর আক্ষেপটা হঠাৎ করে উদয় হতেই আয়মান অদ্ভুত কন্ঠে ওই অবস্থায় বলে উঠলো,

– এখান থেকে ঝাপ দিলেও পারতো, হাত কেন কাটতে গেলো? ওর হাতে কি ব্যথা হয়নাই? আমার একটু খানি কাটলেই তো কি পরিমাণ জ্বলে। ওর কি কবজিটা আগুনের মতো জ্বলেনাই? কেন ওইদিন মরতে গেলো? আমার চিন্তাও কেউ করলো না? কে আমার জন্য ভাবলো? মা-ও আমার জীবনে বোঝা চাপিয়ে দিলো। প্রত্যেকটা দিন আমার কাছে একেকটার যুগের মতো যন্ত্রণা লাগে। আহা দুনিয়ার মানুষ রে… আমাকে একটা বার বুঝতি? আমারও তো বুকটা ফাটে।

সুরের মধ্যে কান্না, কন্ঠের মধ্যে যন্ত্রণার প্রকাশ ছিলো। আয়মান চোখ ভিজিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে রাতের অন্ধকার আকাশে তাকিয়েছিলো। পাশে চুপ করে দাড়িয়ে থাকা সাবিহার দৃষ্টি এই অশ্রাব্য ভাষার লোকটার দিকে আবদ্ধ ছিলো। লোকটার ডানপাশটা কেবল দেখতে পাচ্ছিলো সাবিহা। সংক্রামনের মতো সাবিহার মধ্যেও যন্ত্রণার রেশটা ঢুকে গেলো। সাবিহা দাঁত শক্ত করে নিশ্বাস আটকে কান্না সংবরন করছিলো ঠিকই, কিন্তু চোখের ভেতর বড় বড় বৃষ্টিফোঁটা জমেছিল। কানে শুধু বারবার বাজছিলো ‘ আমারও তো বুকটা ফাটে ‘। কয়েক মূহুর্ত যেনো বাতাসের শো শো ধ্বনিটা চললো, এরপর ঝড়ের মতো তুমুল বাতাসে সাবিহা দম ছেড়ে আয়মানের ডানকাধে কপাল ঠেকিয়ে কেদেঁ উঠলো। হাতদুটো আয়মানের ডানবাহুটা পেঁচিয়ে আঙ্গুলের চাপে খামচে ধরা। আয়মানের দৃষ্টি তখনও তারা-নক্ষত্রের ঝিকিমিকি আকাশে নিবদ্ধ। সাবিহা কান্না জড়িত কন্ঠে বললো,

– শ্রেয়াকে কেনো এখনো মনে করতে যান? উনি কি আপনার কথা কখনো চিন্তা করেছে? আপনাকে কখনো ভালোবাসি বলেছে? কেনো উনার জন্য আপনি প্রতিটা দিন কষ্ট পান? উনি তো চলেই গেছে। যদি আপনার কথা চিন্তা করতো, তাহলে ওইভাবে নিজেকে হত্যা করতো না। উনি তো আর ফিরবে না। উনি তো আজীবনের জন্য চলে গেছে। আপনাকে একা করে দিয়েই উনি বিদায় নিয়েছেন। আপনার কথা উনি চিন্তা করেনি।

রাতের ঝিকিমিকি তারাগুলো দেখতে যেয়ে চোখের উপর সব ঝাপসা হয়ে এলো আয়মানের। ফিসফিসিয়ে মৃদ্যু শব্দে কেদেঁ দিয়ে অনেকটা জোর গলায় বললো,

– সবাই তো স্বার্থপর। সবাই আমাকে দোষী বানিয়ে দিছে গেছে। আমি যেন নিজেরে মাফ না করতে পারি ওমন আকামই সবাই করছে। শ্রেয়া পারলে আমার সাথে আরেকবার যোগাযোগ করতো, খালি আরেকটা বার! ও করেনাই। মা আমাকে আরেকটা বার বুঝতো! মা-ও বুঝেনাই! তুমি হুটহাট আমার বাড়িতে বউ হয়ে আসলা কিন্তু মানুষের কাছে আমাকে অপরাধী বানিয়ে দিছো। কি দোষ আমার? আমি তো কাউকে বিয়ে করে কষ্ট দিতে চাইনি। তাও কেন এই অবস্থাটা হলো?

সাবিহা হাত আলগা করে বাহু ছেড়ে দিয়ে আয়মানের মুখ ধরে নিজের দিকে ডানে ফেরালো। আয়মানের সিক্ত বিষন্ন দৃষ্টির পানে চোখ রেখে সাবিহা ঢোক গিলে বললো,

– আমি তো আপনাকে অপরাধী বানিইনি। কে বলেছে এমন কথা? মা বলেছে? আপনি উনার কথায় কেনো কষ্ট পাবেন বলুনতো? মা কি আপনার সুখ দেখার অধিকার রাখেন না?

আয়মান স্থির দৃষ্টিতে কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক বোঝালো। সাবিহা গাল থেকে হাত সরিয়ে আসমানী রঙের সুতির শাড়িটার আচঁল খানিকটা সামনে টানলো। আঁচলটা হাতে নিয়ে আয়মানের চোখ ও গাল মুছে দিয়ে নাক টানতেই বললো,

– শ্রেয়া আপুর জন্য দুঃখ পেতে থাকলে আপনার সুন্দর জীবনটা ভালো ভাবে কাটাতে পারবেন না। একবার ভাবুন? আজ যদি আপু বেঁচে থাকতো তাহলে আপনার কান্না কি দেখতে পারতো?

আয়মান সম্মোহন দৃষ্টিতে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানায়। সাবিহা হাত ধরে ওকে ভেতরে টেনে আনলে আয়মান বাইরে থেকে পা দুটো ভেতরে ফেলে। সাবিহা আবার শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,

– শ্রেয়া আপু পরেও কখনো ভালোবাসতো কিনা এটার কোনো গ্যারান্টি ছিলো?

আয়মান ফ্লোরে পা ফেলে মাথা নাড়িয়ে দ্বিতীয় দফায় ‘না’ জানায়। সাবিহা ওকে দাড় করিয়ে রুমের ভেতরে নিয়ে যেতেই বলে উঠে,

– আপু যদি আপনাকে রিজেক্ট করতো তাহলে আপনি দেবদাস হয়ে থাকতেন? বিয়ে কি পরে করতেন না? মায়ের জন্য হলেও তো করতেন ঠিকনা?

আয়মান চুপচাপ ভঙ্গিতে মাথাটা উপর-নিচ নাড়াতেই সাবিহাকে ওকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ঠান্ডাটা নিবারনের জন্য পায়ের কাছে ভাঁজ করা কম্বলটা খুলে আয়মানের গা ঢেকে দিতেই সাবিহা ওর পাশে বসে। নরম সুরে বলে উঠে,

– পাশের রুমটায় আছি। দরকার পরলে ডেকে দিবেন। কখনো বারান্দায় গিয়ে ওরকম কাজ করবেন না। আপনাকে জন্ম দিতে মা যেই কষ্ট করেছে সেই কষ্টের কাছে আপনার এই কষ্টগুলো কিছুই না। অন্তত মায়ের জন্য ভাববেন।

সাবিহার কথা শুনে চুপ করে রইলো আয়মান। কিছুই বললো না এর বিপরীতে। বিছানা ছেড়ে সাবিহা যেই উঠতে নিবে ওমনেই সে পুনরায় বসে পরলো। আয়মানের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলো ও এখনো ড্যাবড্যাবে তাকিয়ে আছে। সাবিহা মিচকি হাসি দিয়ে হুট করে আয়মানের গালে চুমু দিয়ে ওমনেই উঠে চলে যায়। আচমকা এমন কাজে হতভম্ব হয়ে যায় আয়মান। গালে হাত দিয়ে চোখ বড় করে অবাক কন্ঠে বলে উঠে,

– কি করলে তুমি !

.

দেয়ালের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে সাগ্রত। সাদা দেয়ালটার সর্বত্র জুড়ে ছোট ছোট নোটচিট লাগানো। পূর্বকে কেন্দ্র করে যতো মানুষ ছিলো সবার নাম ওই নোটচিটের ওপর স্থান নিয়েছে। প্রায় চার ঘন্টা যাবৎ একাধারে দাড়িয়ে থেকে ভাবনায় ডুবে আছে। পূর্বকে দ্রুত রেহাইয়ের জন্য যেটা বিশেষ প্রয়োজন সেটা হলো সলিড প্রমাণ-সহ সাক্ষী। নয়তো যে এই ঘটনার পেছনে মূলহোতা তার কাছে সোজাসুজি আলাপ করতে হবে। এই মূলহোতাটা কি চ্যাটার্জী? নাকি পূর্বের দলের কোনো নেতা? নাকি অন্যকেউ? এখানে পলিটিক্যাল পাওয়ারে টর্চার চলছে সেটা সাগ্রত ইতিমধ্যে বুঝে গিয়েছে। কিন্তু জেলার বা পুলিশ কেউ মুখ খুলতে চাইছেনা। ভালোই বন্দোবস্ত করে পূর্বকে ফাসানো হয়েছে, কিন্তু আসল ব্যক্তিটা কে সেটাই ধরা যাচ্ছেনা। হঠাৎ নিবরতার জালে ছিদ্র করে সাগ্রতের ফোনটা বাজতে লাগলো। দেয়ালের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে সে পকেট থেকে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করলো। কথা শুরু যেই করবে ওমনেই বিপরীত দিকের বার্তা শুনে সাগ্রতের স্বাভাবিক মুখটা অস্বাভাবিক হয়ে কপালে ভাঁজ পরলো। সাগ্রত আশ্চর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠতেই টেবিলে এক ঘুষি মেরে বললো,

– ওরা আবার মারার প্ল্যান করেছে কেন? রিমান্ডের ডেট তো কবেই শেষ। আদালত তো..

কথা শেষ না করতেই ওপাশ থেকে যে কথাগুলো শুনলো সাগ্রত এক হুঙ্কার মেরে ফোন কেটে দিলো। তাড়াতাড়ি দৌড়ে বেরিয়ে যেতেই দরজার কাছে টেবিলের উপর থেকে রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে গেলো! অস্থির হয়ে উঠা সাগ্রত, অকল্পনীয় অবস্থার কথা চিন্তা করে ভয়ংকর উৎকন্ঠায় ছটফট করে উঠলো…

– ‘ চলবে ‘

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬২.
#ফাবিয়াহ্_মমো

( অংশ – ০২.)

সাগ্রত আজকের মতো এতোটা অস্থির হয়নি, যতোটা সে জেলের ভেতর পূর্বের অবস্থা শুনে হয়ে গেছে! পায়ে-পায়ে তুমুল দৌড় লাগিয়ে সাগ্রত গাড়ির দরজা খুলে বসে। যত দ্রুত সম্ভব সে জেলখানায় পৌঁছে। সব ফরমালিটিস কমপ্লিট করতে কিছু সময় পেরিয়ে গেলেও তার ভেতর অস্থিরতার রেশ একবিন্দু কমেনি। একটু আগে গোপনসূত্রে খবর পেয়েছে, পূর্বকে রিমান্ড ছাড়াই মারার জন্য জঘন্য পরিকল্পনা করেছে। গতবার পূর্বের যেই অবস্থা দেখেছিলো তার মধ্যে যদি আবার ওকে পিটায় তাহলে কেমন বীভৎস অবস্থা পূর্বের হবে, সেটা ভাবলেই ওর গা শিউরে উঠে! সাগ্রত তার গোয়েন্দা জীবনে শতশত কেস দেদারসে হ্যান্ডেল করলেও এবারের কেস যেনো বুকের মধ্যে ছুড়ি চালিয়ে দিচ্ছে। প্রচণ্ড অস্থির বোধ হচ্ছে, ছটফটানিতে ভেতরের অবস্থা করুন। এদিকে পুলিশ কাহিনী শুরু করলে সাগ্রত ওদের স্টাইলেই দূর্নীতি করে ঘুষ খাইয়ে দেখা করার বন্দোবস্ত করে। অনুমতি পেতেই সাগ্রত দৌড়ে সেলের কাছে পৌঁছে পুরোপুরি থমকে যায়। গ্রীষ্মের খরতপ্ত শুষ্কতার মতো গলা একদম কাঠ-কাঠ হয়ে যায়। শুকনো গলায় ঢোক গিলতেও কষ্ট অনুভূত হচ্ছে ওর। চোখের দৃষ্টি নির্বাক হয়ে বুকের ভেতর তোলপাড় চলছিলো। সাগ্রত নিজেকে ক্ষণিকের মধ্যে সামলে নিয়ে মধ্যবর্তী ব্যবধান কমিয়ে সেলটার কাছে এগিয়ে যায়। লোহার শিকগুলো দুহাতে ধরতেই নোংরা ফ্লোরে ডানকোণায় পরে থাকা মানুষটার উদ্দেশ্যে গলা খাকারি দেয়। ফ্লোরে উপুড় হয়ে পরে থাকা মানুষটা মৃদ্যু ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে শব্দউৎসটার দিকে মুখ ফেরানোর চেষ্টা করে। সাগ্রতের অটলদৃষ্টি কেনো জানি ঝাপসা হয়ে আসছে। বহুদিন পর আবারও সেই অদৃশ্য টানটা অনুভূত হলো। এই টানটা যতবার বুকের ভেতর উদ্ভব হয়েছে ততবার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে উঠেছে। সাগ্রত তাড়াতাড়ি নিজের চোখদুটো ধূসর জ্যাকেটের হাতায় ডলে নিলো। চোখ ফিরিয়ে আবারও সেই মানুষটার দিকে দৃষ্টি দিতেই শান্ত গলায় বললো,

– পূর্ব সাহেব, আমি এসেছি। আমাকে চিনতে পারছেন না?

শেষ কথাটা উচ্চারণ করতে যেয়ে গলা ধরে এলো ওর। কি বললো? পূর্ব চিনতে পারবেনা কেনো? ওরা কি পূর্বকে মানসিক রোগী বানিয়ে দিয়েছে নাকি? সাগ্রত তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধরে নিয়ে কিছু বলবে, ওমনেই পূর্ব ব্যথাতুর কন্ঠে আধো আধো গলায় বললো,

– তাশরীফ সাগ্রত..

পূর্বের ওইটুকু উত্তর শুনে সাগ্রতের বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেলো। সে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে ফেললো।। চোখ আবার ঝাপসা হতে চাইছে। নিজেকে সামালানো উচিত। পূর্বের উপর আবারও কয়েক ঘন্টার নৃশংস অত্যাচার চলেছে দেখে তার মন কোনোভাবেই কঠোর থাকতে পারছেনা। মোটা রোলারের তরতাজা আঘাত স্পষ্ট চোখে দেখা যাচ্ছে তার। পূর্ব ধীরে ধীরে শরীরের সমস্ত ব্যথা সহ্য করে দেয়াল ধরে উঠে বসে। মাথায় একহাত রেখে কয়েক মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকলে ধীরে ধীরে শিকের কাছে চলে আসে। পিপাসায় গলা শুকিয়ে আছে কাল রাত থেকে। জেল কর্তৃপক্ষ একফোঁটা পানি দেয়নি পূর্বকে। সাগ্রত এখনো চোখ নিচু করে শিক আঁকড়ে দাড়িয়ে থাকলে পূর্ব অনেক সময় নিয়ে দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে শিক ধরে সাগ্রতের সামনে বসা থেকে উঠে দাড়ায়। শরীর ভেঙ্গেচুড়ে আসতে চাইছে। কিন্তু পূর্ব যেনো সব সহ্য করে একটা মুখোশ পরে সাগ্রতকে ফেস করার সংকল্প করেছে। পূর্বকে সামনে দেখে চকিত দৃষ্টি ছুড়ে সাগ্রত কিছু বলবে তার আগেই পূর্ব ক্লান্ত রুগ্ন স্বরে বলে,

– ও কেমন আছে?

গলা আটকে আসছিলো সাগ্রতের। উত্তর দেওয়ার মতো শক্তি ওর মাঝে দেখা দিচ্ছিলো না। নিজের মুখ থেকে গলগল করে তরল রক্ত বেরুচ্ছে অথচ সে সবার আগে পূর্ণতার খবর জিজ্ঞেস করছে। সাগ্রত অশ্রু চোখে ওর কপালের দিকটায় তাকালো। ডানপাশটা কেটে চোট শুকিয়ে কানের পাশ দিয়ে কালচে রক্ত শুকিয়ে আছে। সাগ্রতকে ওমন ভঙ্গিতে দেখে পূর্ব রক্তাক্ত চোয়াল ঝুলিয়ে আহত চাহনিতে আবার প্রশ্ন করে,

– পূর্ণতা কেমন আছে?

এটুকু প্রশ্ন করতেই যেনো পূর্বের জান বেরিয়ে যাচ্ছে। লম্বা টানে শ্বাস নিতে হচ্ছে। হাঁশফাশ করছে প্রচুর। সাগ্রত নিরব দৃষ্টিতে তাকিতে থাকতেই বুড়ো আঙ্গুলের ডগায় নিজের চোখের কোণাটা মুছে। প্রসন্ন কন্ঠে বলে উঠে,

– আপনার পূর্ণতা আর সন্তান দুজনই ভালো আছে। কিন্তু আপনার এই অবস্থা দেখলে ওই মেয়েটা পাগল হয়ে যাবে।

সাগ্রতের কথা শুনে ভারাক্রান্ত দৃষ্টিতে হাসলো পূর্ব। থরথর করে কাঁপতে থাকা রক্তাক্ত চোয়াল যেনো ঢোক গিলার জন্য একটু থামলো। এরপর শিকের হাতটা আলগা করে কাপুনি অবস্থায় ধীরগতিতে সেটা সাগ্রতের হাতের উপর রাখলো। শুষ্ক গলায় পূর্ব বললো,

– ওর জন্য সবুজ, কৈলেশ নামের দুজন ছেলেকে নিযুক্ত রেখেছি। তবুও টেনশনে থাকি। জেলের এরা ভালো না। একদম ভালো না। টাকার জোর আর ক্ষমতার অপব্যবহারে সব করতে পারে। পূর্ণতাকে এখানে আসতে না করবেন।

সাগ্রত চট করে কিছু বলতে যেয়ে বুকে ধাক্কা খায়। পূর্বের দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে এরপর চোখ নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। পূর্ব কাদের নিয়ে পূর্ণতার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে? কৈলেশ, সবুজ যে গ্রেফতারের দ্বিতীয়দিন থেকেই গুম সেটা তো পূর্ব জানেনা। আর কতো আঘাত খাবে? তবুও মিথ্যার অন্ধকারে না রেখে সাগ্রত পূর্বকে সত্যি কথা বললো,

– আপনার পূর্ণতাকে সিকিউরিটি দেওয়ার মতো কেউ নেই পূর্ব সাহেব। আপনি যাদের উপর এতো বড় দায়িত্বটা দিয়েছেন তারাও আপনার ক্ষতি করে গুম হয়ে গেছে।

কথাটা শুনে স্তব্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে পূর্ব। শরীরের উপর দিয়ে যেনো শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। মাথার ভেতরে রিনরিন করে উঠলো। এতোক্ষন নিজের শারীরিক ব্যথা হজম করে থাকলেও হঠাৎ যেনো মানসিক ব্যথাটা পুরো শরীরটা কাবু করে ফেললো। পূর্ব চুপচাপ কিছুক্ষণ ওই ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলে সাগ্রত নিবরতার জালে ছিদ্র করে বলে,

– আপনাকে এখান থেকে বের হতে হবে পূর্ব সাহেব। এমন দূর্নীতিপূর্ণ দেশ আপনাকে মারলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি আপনাকে শাস্তি পেতে দিবো না। আশা রাখুন। দিন হয়তো খারাপ কিন্তু আজ নয়তো কাল আপনার ভালো দিন আসবেই। আপনি যেই মানুষগুলোর জন্য চিন্তা করেছেন তারা এগিয়ে আসবেই। আপনি ভেঙ্গে পরবেন না পূর্ব সাহেব। আপনার স্ত্রীর কমরেড ডাকটা শোনার জন্য হলেও আপনার জীবিত থাকতে হবে। আপনি দয়াকরে আমাকে বলুন আপনার সাথে কার বেশি শত্রুতা আছে? কারা আপনার ক্ষতি করতে উন্মূখ হয়ে আছে? সব বলুন পূর্ব সাহেব। আর ভেতরে কথা লুকিয়ে রাখবেন না। আপনি একটা কথা গোপন করলে মনে রাখবেন আপনি বাঁচার সুযোগ থেকে পিছিয়ে যাবেন।

কন্ঠ আটকে আসছিলো সাগ্রতের। বারবার চোখের সামনে পূর্ণতার কান্নারত নিশ্চুপ চেহারাটা ভাসছিলো। সেই মেয়েটা যদি এই মূহুর্তে পূর্বের এই অবস্থা দেখতো তাহলে কি হতো? সাগ্রত নিজের পকেট থেকে তাড়াতাড়ি একটা রুমাল বের করে শিক গলে পূর্বের সামনে বারিয়ে ধরলো। মাথা নিচু করে থাকা পূর্ব, ধীরে ধীরে থরথর করে কাঁপা হাতটা দিয়ে রুমালটা হাতে নিলো। মুখের রক্ত ধীরগতিতে পরিস্কার করতেই পূর্ব বললো,

– আপনাকে আজ একটা সত্যি বলি সাগ্রত সাহেব, শুনুন। আমার জীবনে ধাক্কা খেতে খেতে বড় হয়েছি। আমার আব্বু মানুষটা খুব সরল সহজ বলে কখনো চাচাদের কুমন্ত্রণা বুঝতে পারতো না। কিন্তু যখন বুঝতো তাদের ছাড় দিতো না। আমি কখনো বিলাসিতা ছাড়া বড় হইনি, কিন্তু নিজের বিলাসিতা কখনো বাইরে প্রকাশ করিনি। গরীব মানুষগুলোকে দেখলে আমার খুব কষ্ট লাগতো। ওরাও তো মানুষ তবুও ওরা ঠিক করে খেতে পযর্ন্ত পায়না। ওদের কঠোর পরিশ্রমে আজ ধণীরা এসির নিচে আরামে কাজ করছে। কিন্তু ওরা তিনবেলা ভাতটাও ঠিকমতো জুটাতে পারেনা। কেন এই বৈষম্য ভাই? আমি এই বৈষম্যের থিওরি বুঝতে গিয়ে কার্ল মার্কস, মাও সে তুং এনাদের মতো ব্যক্তির ব্যাপার বুঝলাম। এই মানুষগুলো পুরো সমাজের ভেতর থেকে সেই বৈষম্যের রেখাটা মুছে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের মানসিকতার জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। আমি বামপন্থী দলে যোগদান করলাম। সেখানকার মুখ্য নেতার সঙ্গেও দেখা করার সুযোগ পেলাম, উনি ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু জেলার যে কেন্দ্রীয় বামপন্থী নেতাটা ছিলো সে ভালো চিলো না। সবাই চ্যাটার্জী বলেই চিনে। আমি তখন ভার্সিটিতে পড়তাম। কিছুদিন কমিউনিজম করেছিলাম কিন্তু উনার সাথে সংঘাত লাগার পর আমি দল ছেড়ে কিছুদিন আলাদা ভাবে থেকেছি। এরপর আমার কাছে একদিন ডানপন্থী দল থেকে যোগ দেওয়ার জন্য একটা সুযোগ এলো। তাদের কাজ ও আর্দশ নিয়ে আমার মূল আর্কষন ছিলো শুধু তৎকালীন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, মাওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমেদ, নুরুল ইসলাম, মহিউদ্দিন এনাদের মতো আরো বহু মানুষের আত্মত্যাগের জন্য। আমি ততদিনে এটা বুঝে গিয়েছিলাম প্রতিটি দলেই কিছু না কিছু নিচুস্তরের মানুষ থাকে, যারা দূর্নীতি করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, জনগণের ক্ষতি করে।এদের মতো গুটি কয়েক মানুষের জন্য সব দলকে খারাপ চোখে দেখে জনগণ। ডানপন্থী দলে খুব শ্রম দিয়ে কাজ করলাম, মানুষের জন্য নিঃস্বার্থে কাজ করলাম। মানুষের কাছে আপনও হয়ে গেলাম, আর ঠিক তখনই দল থেকে ঘোষণা এলো আগামী ইলেকশনে আমার দাড়ানোর মতো একটা সুবর্ণ সুযোগ আছে। আমি জেলা ভিত্তিক সব মানুষের হয়ে তাদের দূরবস্থার কথা সংসদে উত্থাপন করতে চেয়েছিলাম। সংবিধান মতে, পচিঁশ বছরের উর্ধ্ব হলেই একজন পুরুষ এমপি নির্বাচনে দাড়াতে পারবে। সব জানা সত্ত্বেও আরো পাঁচ বচর সময় নিয়ে নিজেকে যোগ্য করে তারপর নির্বাচনে আসলাম। বড় ধাক্কাটা সেদিন খেলাম, যেদিন একই টেবিলে বসে থাকা কিছু অন্য জেলার সংসদ সদস্য তাদের মিত্র মানুষ ইমতিয়াজ উদ্দীনের জন্য আমাকে অনুরোধ করলো টিকিটটা ছেড়ে দিতে। আমি কোনোভাবেই সেটাতে রাজি হইনি। ওই ইমতিয়াজ লোকটা খুবই জঘন্য মানসিকতার মানুষ। পূর্ণতাকে ক্ষতি করার জন্যও মাঝেমাঝে আমাকে হুমকি দিতো। একদিন উনার নির্দেশে আমার পায়ের উপর দিয়ে টায়ার উঠে যায়। আমি ক’মাস প্রচুর ভুগেছি। তবুও টিকিট ছাড়িনি। এরপর প্রচারণার কাজে যখন নামলাম তখনও তিনি নানাভাবে আমাকে হুমকি দিতো। আমার ভয়টা কখনো নিজের মৃত্যু নিয়ে ছিলো না। যারা রাজনীতি করে তাদের মৃত্যুভয় থাকেনা। কিন্তু আমার দূর্বল দিক শুধু পূর্ণতা ছিলো। ওর জন্য আমি ভয়ে থাকতাম। যেই আমি একসময় ছুড়ি চালাতেও দ্বিধা করিনি, সেই আমি কিনা এক বদ লোকের জন্য ভয় পেতাম। আমার পূর্ণতা দুঃখ ছাড়া কিছুই পায়নি সাগ্রত সাহেব। ও তো জানতো না আমাকে ভালোবাসার পরিণাম এতো ভয়াবহ হবে। আমাকে সাধারণ ক্যাটাগরির মানুষ ভেবে ও ঠিকই আমার প্রতি দূর্বল ছিলো, কিন্তু যখন দেখেছে আমি ভিন্ন টাইপের মানুষ, এরপর থেকে ও শক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে। আমি জানিনা আমি সামনে বাঁচবো কিনা। ওরা রিমান্ডের ভেতর অনেক চেষ্টা করেছে আমার মুখ দিয়ে স্বীকার করাতে, ওই ফেনসিডিল, ওয়াকিটকি, বিদেশী অস্ত্র আমার। কিন্তু আমি স্বীকার করিনি বলে এখনো মারছে। সাগ্রত সাহেব, মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পযর্ন্ত পূর্ণতার কথা চিন্তা করে অস্থির থাকবো। তাই আপনার কাছে আমি হাতজোড় করছি, ওর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন। অন্তত মৃত্যুটা যেনো আমার জন্য কষ্টসাধ্য না হয়। আমি এই অবস্থায় ওকে দেখে রাখতে পারছিনা। ও কষ্ট পাচ্ছে। আমার অনাগত সন্তানটার কাছে সময় দেওয়ার সুযোগ নেই। আমি নিরুপায় হয়ে আছি..

রুদ্ধ কন্ঠের সাথে চোখ ছাপিয়ে পানি পরছিলো রাশভারী উপাধী পাওয়া পূর্বের। কোনো রাশভারী মানুষ এভাবে কেদেঁ দিতে পারেন জানা ছিলোনা সাগ্রতের। তার সামনে পূর্বের শোচনীয় অবস্থা দেখার মতো আর সার্মথ্য ছিলো না। পূর্বকে বিদায় দিয়ে যখন চলে আসবে তখন পূর্ব ওর হাতে একটা চিঠি তুলে দেয়। সাদা খামটার এককোণা জুড়ে লাল রক্তের প্রলেপ শুকিয়ে ছিলো। রক্তটা কিসের ছিলো সেটা আর জিজ্ঞেস করার হিম্মত করলো না সে। চুপচাপ বিদায় দিয়ে জেলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। দুপুরের সূর্যটা তেজহীন হয়ে মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে। সাগ্রত সেটা আকাশে তাকিয়ে অদ্ভুত উত্তেজনায় দেখছে। পকেটের ভেতর পূর্বের দেয়া চিঠিটা রাখা, যেটা সে হাত ঢুকিয়ে ধরে আছে শক্তভাবে। মনে মনে সাগ্রত উচ্চারণ করছিলো শুধু, গায়ের সব রক্ত তোরা শুষে নিলেও ওই মানুষটার মুক্তি চাই! নিরাপরাধ মানুষকে শাস্তি দিলে এই দেশকে ধিক্কার জানাই!

.

দুটো দিন ধরে আয়মানের শরীর অসুখে ফেঁসেছে। শীতের কারনে ঋতু পরিবর্তনজনিত ঠান্ডায় ভুগছে। আফিয়া সকাল-বিকাল ছেলেকে গরম পানি, বিভিন্ন পদের চা ও তুলসী পাতার সরষে তেল খাওয়াচ্ছে। কিন্তু ফলপ্রসু কিছুতেই মেলছেনা। আয়মানের জন্য জটিল সমস্যা হলো ঠান্ডা লাগলে সেটা সহজে সারেনা। এর মধ্যে সাবিহা এক সপ্তাহ হলো শিকদার বাড়িতে নেই। গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ বাবাকে দেখতে কিছুদিনের জন্য ওখানে থাকতে গিয়েছে। ফোনের মাধ্যমে আফিয়ার কাছ থেকে আয়মানের অসুস্থতার খবর শুনলে সাবিহা তৎক্ষণাৎ আসার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু আফিয়া বাধা দিয়ে বলে কিছুদিন বাবার দিকে খেয়াল রাখতে, এখানে আয়মানের সাথে উনি আছেন। সাবিহা এ উত্তর শুনে মিইয়ে গেলেও ভেতরে প্রচণ্ড উৎকন্ঠা অনুভব করে। ইচ্ছাকৃত বা অজান্তেই হোক সাবিহা আয়মানের প্রতি একটু একটু করেই দূর্বলতা অনুভব করে। অসুস্থতার খবর শুনে দ্রুত চলে আসার পরিকল্পনা স্থির করে ফেলে।

ডিজিটাল ঘড়িতে বড় বড় ডিজিটে রাত তখন নয়টা বিয়াল্লিশ বাজে। আয়মান গায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে গলা পযর্ন্ত ঢেকে শুয়ে আছে। এখন ঠান্ডা বলতে কাশতে কাশতে গলা ব্যথা ও বুক ব্যথা এবং দুই কান বন্ধ হয়ে গেছে। রাতের খাবারটা আফিয়া জোর করে খাওয়ানোর পর আর ঘুম আসেনি চোখে। অদ্ভুত ধরনের ছটফটানি অনুভূত হয় মনে। ঘুম থেকে উঠলেই একটা পরিচিত মুখ দেখার জন্য তীব্র আশায় থাকে। আয়মান নিজের অপরিচিত অনুভূতি নিয়ে এখনো শঙ্কায় আছে। আদৌ কি সে শ্রেয়ার পর অন্য কাউকে জায়গা দিতে চাচ্ছে? আয়মান চোখ বন্ধ করে হাতদুটো কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়। টিক-টিক-টিক করে সময় আরো কয়েক ঘন্টা পেরুতেই আয়মানের চোখে যখন নিদ্রার আভাস আসছিলো ঠিক তখনই যেনো অকল্পনীয় দৃশ্যপট দেখে সে থমকে যায়! রুমের ভেজানো দরজা ক্যাচ করে খুলে সাবিহা ঢুকে। পড়নে তার গাঢ় নীলের শাড়ি, কালো মোটা পার। ডানপাশে একটা সাইড বেনী করে রেখেছে, কিছু চুল কানের দুইপাশে লম্বা হয়ে ঝুলছে। আয়মান বিছানায় শোয়া অবস্থায় চমকানো দৃষ্টিতে বলে উঠে,

– সাবিহা, তুমি কখন এলে?

সাবিহা চুপচাপ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা চাপিয়ে আয়মানের কাছে এসে বসে। আয়মানের চোখ জুড়ে সাবিহার মুখ আটকে আছে। সাবিহা আচঁলের নিচ থেকে নরমাল হটব্যাগ বের করে আয়মানের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে বুকের উপর রেখে দেয়। আয়মান বিষ্ময়সূচক দৃষ্টিতে বালিশ থেকে মাথা উচু করে বসতে নিলে সাবিহা ওকে বাধা দিয়ে শুয়ে থাকতে বলে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

– একটা সপ্তাহ দূরে ছিলাম আপনি একটা কল পযর্ন্ত করেননি। এ বাড়ির চাকরও আমার তুলনায় আপনার কাছে বেশি মূল্য পায়। অথচ আমি মানবতার খাতিরেও কোনো মূল্য পাইনি।

আয়মান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে কিছুক্ষণ পর উত্তরের পাল্লা খুলে,

– আমি যে অসুস্থ সেইটা চোখে পরেনা?

সাবিহা একই ভঙ্গিতে কঠোর গলায় জবাব দিলো,
– আপনি অসুস্থ ছিলেন, সেন্সলেস না। চাইলে ঠিকই একটাবার কল দিয়ে আমার আব্বার কথা জিজ্ঞেস করতে পারতেন। আপনি আমাকে কল দেওয়া তো দূর, মাকেও নাকি বলেছেন আমার বিষয়ে আপনার কাছে কথা না উঠাতে। কেন করেছেন এই কাজ? আপনি কি চান ডিভোর্সের তকমা লাগিয়ে আমি চলে যাই? আপনি সত্যি কথাই বলুন, আপনি কি আমাকে সহ্য করতে পারছেন না? আমি কি আজীবনের জন্য চলে যাবো?

আয়মান নিরুদ্যম ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলো। সাবিহার অভিমানী মুখটা দেখতে কেনো যেনো ভালো লাগছিলো। ওর মুখের অবস্থা এমন হয়ে দাড়ালো যে, কেদেঁ দিবে-দিবে অবস্থা। কিন্তু আয়মানের খামোশ ভঙ্গিটা দেখে তীব্র ক্ষোভ ও প্রচণ্ড রাগে চোয়াল কাঁপাচ্ছিলো সাবিহা। আর সহ্য করতে পারলো না সাবিহা। হঠাৎ ঠোঁট শক্ত করে কান্না আটকাতে গিয়ে তুমুল অশ্রুধারায় গাল ভিজিয়ে ফেললো। মনের সকল দুঃখগুলো চোখের পানিতে সিক্ত হয়ে প্রকাশ করলো। অসহ্য যন্ত্রণায় সাবিহার ইচ্ছে করছিলো জীবনের গতিপথ থামিয়ে দিয়ে শ্রেয়ার মতোই অভিশপ্ত পথ বেছে নিতে। খারাপ সময়ে কেউ যখন পাশে এসে দাড়ায় না, একা ছেড়ে চলে যায়, তখন নিজের নিশ্বাসটাও যন্ত্রণার মতো লাগে। মাথা নিচু করে কান্নারত সাবিহার দৃশ্যটা দেখে আয়মান মৃদ্যু ভঙ্গিতে হেসে বুকের উপর থেকে হটব্যাকটা সরিয়ে রাখে। দোটানা চিন্তায় বেকায়দা হলেও সাবিহাকে কি কাছে টানবে? নাকি দূরে ঠেলবে এমন চিন্তাভাবনায় যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া প্রয়োজন, ঠিক সেসময় একটা অভাবনীয় কাজ করে ফেললো আয়মান। সে সাবিহার হাত ধরে কাছে টেনে দুই হাতে পিঠ আকড়ে জাপটে ধরলো বুকের সাথে। শুয়ে থাকা আয়মানের প্রশ্বস্ত দেহের উপর জীবনে এই প্রথম জায়গা পায়। অত্যন্ত কাঙালের মতো সে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষের কালো টিশার্ট মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে রাখে। আয়মানের অশান্ত মন তখন প্রশান্তমনায় স্বস্তি পেয়ে মূহুর্ত্তের মধ্যে ভিন্ন দুনিয়ায় হারিয়ে যায়। মনের মধ্যে কোণঠাসা করে রাখা সুক্ষ অনুভূতিগুলো আচমকা উজাড় করে দেয়। দিনের পর দিন যাকে নিয়ে আয়মান অবসাদগ্রস্ত জীবনের দিকে ঝুকেছিলো তারই স্মৃতি আকড়ে সে সাবিহাকে মনের অন্য আসনে জায়গা দিলো।নিঃশব্দ রুমের ভেতর একজনের কান্নাসুর শোনা গেলেও অপরজনের নিশ্বাসের বেগ শোনা যাচ্ছিলো তখন। আয়মান অনেকক্ষন সাবিহাকে ওভাবে জাপটে ধরে অভিমানভরা অনুভূতিগুলো মুছে দিতে থাকে। সাবিহার মনে হচ্ছিলো বহুদিন পর সে শান্তিপূর্ণ আবাসগৃহে ফিরে এসেছে। আয়মান শান্ত সুরে নিচু কন্ঠে বলে উঠে,

– সাবিহা, আমি কারো প্রতি অন্যায় করার মনোভাব রাখিনা। জীবনে একটাই ভুল করেছি, শ্রেয়ার ক্ষমাটা ঠিক সময়ে করিনি। সেই ভুলটা আমার জীবনে কতখানি ক্ষত করে গেছে সেটা তুমি, মা, বাবা, পূর্ণতা, পূর্ব ভাই সবাই দেখেছো। আমি নিজের আচার আচরণ পরিবর্তন করতে পারিনা, আবার পরিবর্তন করতে টাইমও নেই না। কিন্তু তোমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিবো না সাবিহা। আমি শ্রেয়াকে কোনোদিনও ভুলতে পারবো না। না আমি ওকে ভুলার কখনো চেষ্টা করবো। হ্যাঁ ঘটনাটা তোমার কাছে নাটক সিনেমার গল্প লাগতে পারে। আমি চাইলে চিরকুমার হয়েও থাকতে পারতাম। কিন্তু সাবিহা, এটা হচ্ছে বাস্তব জীবন। এখানে কেউ কারো জন্য থেমে থাকতে পারেনা। প্রয়োজনের জন্য সবাইকেই একদিন অতীত ফেলে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া লাগে। আমি শ্রেয়াকে এখনো ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি, ও সামনে থাকলে হয়তো ভালোবাসাটা একটু হলেও প্রকাশ করতাম কিন্তু আজ যেহেতু ও নেই, কাজেই প্রকাশ করার মানে হয়না। সাবিহা, আজ যদি শ্রেয়া আমার জায়গায় হতো, ও আরো আগে বিয়েশাদি করে সংসার শুরু করতো। কিন্তু আমি ছেলে বলে এতোদিন পিছিয়ে থাকতে পেরেছি। আমাকে ভুল বুঝো না সাবিহা। আমার জীবনে অনুভূতি নামক কিছুই নেই। হয়তো এখন যা অবশিষ্ট আছে, তাও খুব তলানি পরিমাণে আছে। মনের দিক থেকে একটা মানুষকে কখনোই ভুলা সম্ভব না। আমি ওকে ভুলতে পারবো না। তুমি কি এই দ্বৈত অনুভূতির ‘আমি’টাকে মেনে নিবে?

আয়মান তার দীর্ঘ বার্তা শেষ করে উত্তরের জন্য সাবিহার কাছ থেকে অপেক্ষা করতে থাকে। সাবিহা ক্ষণকাল চুপ থেকে পরে মাথা ‘হ্যাঁ’ সূচকে নাড়িয়ে অস্ফুট শব্দে বলে,

– হু..

উত্তর শুনেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হেসে দেয় আয়মান। বাহুবন্ধনীর দৃঢ়তা আরো শক্ত করে আকড়ে রাখে সাবিহার কোমল দেহ। দীর্ঘদিনের ‘অহেতুক’ উপাধি পাওয়া সম্পর্কটা আজ যেনো মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হলো।

.

রাতের স্তব্ধ প্রহরে বিছানায় বসে আছে পূর্ণতা। একটু আগে একগাদা বমি করে তার শরীরটা ক্লান্ত হয়ে পরেছে। আগের তুলনায় এবার একটু বেশি কষ্ট হচ্ছে। পা তুলনামূলক ভারী হয়ে ফুলে উঠেছে, পেটেও মাঝেমাঝে হুটহাট ব্যথা করে উঠে। রাতে একদম ঘুমাতে পারেনা পূর্ণতা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে সময় পেরিয়ে যায় ওর। নিঃসঙ্গ সময়গুলো খুব যন্ত্রণায় কাটছে এখন। পূর্বের কথা চিন্তা করলে চোখ ছাপিয়ে পানি পরে হুটহাট। নিজেকে সামলানো কষ্টসাধ্য হয়ে পরে অনেকটা। আজ কোলের উপর পূর্বের পাঠানো চিঠিটা রাখা। কাগজের ভাঁজ খুলে চিঠিটা পড়ার সাহস হচ্ছেনা পূর্ণতার। বুক চিড়ে বিধ্বস্ত কান্নায় সবকিছু ভেঙ্গে আসতে চাইছে ওর। কতদিন পূর্ণতা ওকে দেখে না। রক্তাক্ত অবস্থায় সেদিন দেখার পর আর দেখা করার সুযোগ মেলেনি। পূর্ণতা শাড়ির আচঁলে চোখ মুছে নাক টেনে চিঠিতে অনেকক্ষন পর হাত দিলো। তিনভাঁজের কাগজটা খুলতেই পূর্বের লেখাগুলো দেখতে পেলো। কিন্তু আবারও সেই যন্ত্রণা এসে হানা দিয়ে পূর্ণতাকে অশ্রুবিদ্ধ করে ফেললো। চিঠিটা দুহাতে ধরে লেখাগুলো পড়তেই চোখ কুঁচকে হু হু করে কেদেঁ উঠলো পূর্ণতা।

পূর্ণ,

তুমি আজ আমার কাছ থেকে খুব দূরে আছো। আমি এক বন্দিখানায় আছি, যেখানে একটু পরপর মৃত্যু এসে ঘুরে যায়। আমি হয়তো তোমার কাছে আর ফিরতে পারবো না। ওরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখার ভুল করবেনা। আমি কখনো ভেঙ্গে পরবো এটা ভাবিনী পূর্ণ। কিন্তু সত্যি আজ খুব ভেঙ্গে পরেছি। তোমার জন্য খুব চিন্তা হয় পূর্ণ, আম্মুর জন্য চিন্তা হয়, আব্বুর জন্য চিন্তায় আমি শেষ হই। কোনোকিছু পরোয়া না করে নিজের জীবনটা শেষ করে ফেলেছি। যাদের জন্য আমি সবটা বিলিয়ে দিলাম কেউ আমার জন্য প্রতিবাদ করতে আসেনি। আমার লেখা খুব খারাপ হচ্ছে। বুড়ো আঙ্গুলটার মাথায় চামড়া উঠে গেছে। কলম ঠিকমতো ধরে রাখতে পারছিনা। কিন্তু আজ যদি আমি কিছু না বলি, হয়তো আর কখনো তোমাকে লেখার সুযোগ আল্লাহ্ আমাকে দিবে না। চিঠির উপর কয়েকটা শব্দ পড়তে একটু কষ্ট হবে পূর্ণ। রক্তের কারনে কিছু লাইন ঢেকে গিয়েছে। তোমাকে নিয়ে আমার অনেক কিছুই বলার আছে। তুমি আমাকে সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি উপহার দিয়েছো পূর্ণ। আমার সন্তান, আমার অংশ, আমার চিহ্ন তুমি আবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছো। আমাকে ফার্স্ট যেদিন ভিজিট করতে এলে তোমার সাথে দেখা করার সাহস ছিলো না, জানো? তবুও তুমি আমাকে কাছে টেনে চুমু খেতে দ্বিধা করোনি। আমি অবাক হয়েছিলাম, রক্ত মাখা বিশ্রী ঠোঁটে কিভাবে তুমি নিজের সুন্দর ঠোঁট ডুবিয়ে নষ্ট করলে? কিন্তু আমি নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অপদার্থ ভাবি। ওরা আমার সামনে তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলো। আমার উপস্থিতিতে তোমাকে লজ্জা দিচ্ছিলো। আমি খুব কেদেঁছি। এখনো কাঁদছি। যেই হাতটা দিয়ে আমার সন্তানের আগমন স্পর্শ করালে সেই হাতটা ওরা ভেঙ্গে দিয়েছে। আমি একদম নাড়াতে পারিনা। মাথাব্যথায় এখন দিনের পুরোটা সময় কাতরাতে থাকি। ওরা কেউ এসে ডাক্তার ডাকেনা। ইমতিয়াজ নামক লোকটা যে আমাকে জেলের জন্য ফাঁসিয়েছে ও কাল এসেছিলো। আমি যদি ওর পা ধরে ক্ষমা চাই তাহলে নাকি ও আমাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সাহায্য করবে। আমি ওর পা ধরতে রাজি হইনি! আমি কোনোদিন মিথ্যাকে সার্পোট করবো না। আমি এ কথাটা তোমাকে জানিয়ে রাখলাম পূর্ণ। কারন, ও-ই আমাকে মূলহোতা হিসেবে ফাঁসিয়েছে। শুধু এটুকু দোয়া করো, আমি যেনো মরে গেলেও ওদের কাছে মাথানত না করি। ওরা আমার শরীরের শেষ রক্ত টেনে নিলেও ওদের মিথ্যাকে আমি মেনে নিবো না। আমি তোমার কাছে ভেঙ্গে পরতে পারি, কিন্তু মিথ্যাবাদীর সামনে কক্ষনো মাথানত করবো না। মৃত্যুর জন্য আমি সদা প্রস্তুত ।

ওয়াসিফ পূর্ব,
( জেলখানা )

-‘ চলবে ‘

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬২.
#ফাবিয়াহ্_মমো

(অংশ – ০৩)

পূর্ণতার প্রতিটা চিৎকার যেনো আয়েশার মনে ক্ষরণ করছে। তিনি কোনোভাবেই পূর্ণতাকে সামলাতে পারছেন না। পূর্ণতার হাউমাউ চিৎকার শুনে আয়েশার চোখ থেকে নির্লিপ্তে পানি ঝরছে। দুহাতে পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে আগলে রাখলেও পূর্ণতার কান্না যেনো প্রতিটি কষ্ট পাওয়ার সাক্ষী বহন করছে। বারবার পূর্ণতা অশ্রুবিদ্ধ গলায় থেমে-থেমে বলছে, ‘ওরা হাত ভেঙ্গে দিয়েছে মা, ওরা ওকে মেরে ফেলবে।’ আয়েশা ওর কথা প্রথমে না বুঝলেও পরক্ষনে চিঠির হদিশ পেলে সেটা হাতে তুলে তিনি পড়তে থাকেন। ছেলের করুন দশায় তিনি চুরমার হয়ে ভেঙ্গে পরলেও পূর্ণতার জন্য নিজেকে শক্ত করেন। চোখ মুছে সকল যন্ত্রণা তিনি গুটি পাকিয়ে ভেতরে দমিয়ে রাখেন। পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে অনবরত মাথায় হাত বুলিয়ে নানা সান্ত্বনা সূচক বাক্য শুনিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। পূর্ণতা এখনো চোখ খিচে নিচের ঠোঁট কামড়ে অবিরাম ধারায় অশ্রু ফেলছে। আয়েশা চিঠিটার উপর আরেকবার চোখ বুলিয়ে ব্যথিত মনে সেটা ভাঁজ করে বালিশের তলায় রেখে দিলেন। শাড়ির আচঁল টেনে পূর্ণতার চোখ মুছে নাক টেনে শান্ত কন্ঠে বললেন,

– কেঁদে লাভ আছে? ও কি তোমার কথা ভেবেছিলো? আমার কথা চিন্তা করেছিলো? কে বলেছিলো অন্যের জন্য নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে? ও তো কারোর কথা শোনেনি। ও তো স্বার্থপরের মতোই নিজের মনমর্জি খাটিয়েছে। আমি-তুমি-আমরা সবাই জানি ও যে পথে কাজ করতে চায় সেখানে কষ্ট আর মৃত্যু ছাড়া কিছুই নেই। শান্ত হও। তুমি অসুস্থ হলে ভেতরের মানুষ তো সুস্থ থাকবেনা। অন্তত চিঠির মালিকের কথাটা মনে রাখো। ও নিশ্চয়ই তোমার এ অবস্থা সহ্য করবেনা।

কন্ঠ ভারি হয়ে আসছিলো আয়েশার। নিজেকে কান্না থেকে সংবরণ করা নিদারুণ কষ্টের ছিলো। চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রুর বর্ষন হচ্ছিলো। মাতৃমনের বুকটা হাহা করছিলো চিঠিটা পড়ার জন্য। রূহটা রেখে দেহটা পুরো শেষ দিয়েছে ওরা। আয়েশার ফোপানো আওয়াজ শুনে এবার ধীরেসুস্থে চোখ খুলে তাকায় পূর্ণতা। অশ্রুজলে টলটল করতে থাকা পূর্ণতার চোখ আয়েশার দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হলে আয়েশা তখন ব্যথাতুর কন্ঠে বলে উঠে,

– ওরা আমার সন্তানকে মেরে ফেললে ওই আল্লাহ্ মালিক ওদের ছাড়বেনা। আমি খোদার কাছে বিচার দিলাম। আমি বিচার দিলাম, ওই পাপিষ্ঠদের শাস্তি হোক। এই অসহায় মায়ের আকুতি আল্লাহ্ কোনোদিন ফিরিয়ে দিবেনা। ওই খোদা দেখছে তো! উনি কাউকে ছাড়বেনা! কোনোদিন ছাড়বেনা। আমার ছেলে আজ ধুকে ধুকে মরলে ওদের কঠিন শাস্তি চাই। আমার পূর্বের উপর জুলুম করা মানুষের বিচার …

কথাটুকু শেষ করতেই আয়েশা চোখে আচঁল চেপে হুড়মুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। ক্ষতবীক্ষত হৃদয় নিয়ে আয়েশাও আজ বুক ভাসিয়ে কেদেঁ দিলেন। স্থির হয়ে বসা থাকা পূর্ণতা অশ্রু নয়নে দরজার দিকে তাকিয়েছিলো। চোখের সীমানা ডিঙিয়ে বড় বড় অশ্রুফোঁটা গাল ভিজিয়ে পরছিলো। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় শুধু মনেমনে বলছিলো ‘ নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি ‘।

.

রাতটা ভয়ংকর অন্ধকারে ঢেকে আছে। চাঁদের আলোটুকু আজ নেই। কোথাও কোনো শব্দ নেই, আওয়াজ নেই, শোরগোল নেই। চারিপাশ যেনো রাতের আধারে গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে। ঠান্ডা বাতাস চলছে এখন। বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকালে কুয়াশা মতোন দেখা যায়। সাগ্রত হাতভাঁজ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে কিছু ভাবছে। মাথার মধ্যে শুধু একটাই প্যাঁচ, একটাই চিন্তা, কিভাবে ওয়াসিফ পূর্বকে জেল থেকে নির্দোষরূপে অব্যহতি দেওয়া যায়। ওর পেছনে যে ঘোরতর ষড়যন্ত্র লেগে আছে সেটা কিভাবে নিস্ক্রিয় করা যায়। রাতে এখন শান্তির ঘুম আসেনা। চোখ বন্ধ করলে পূর্ণতার সেই অশ্রু মাথা মুখটা শুধু ভাসে। গর্ভাবস্থায় মেয়েটা প্রচুর কষ্ট পোহাচ্ছে। চিন্তার প্রহর তিল তিল করে বাড়তে থাকলে কাধের উপর হাতের স্পর্শ অনুভব হলো। হাতটা কার সাগ্রত সেটা বুঝতে পেরেও চোখ পিছু করে দেখলোনা। সাগ্রতের এরূপ আচরণ দেখে হাতের মালিকটা একটু ক্ষুদ্ধ হলো যেনো। সে পেছন থেকে সরে গিয়ে তারের শুকনো কাপড়গুলো ক্লিপ সরিয়ে তুলতে লাগলো। সাগ্রত আড়চোখে সেটা বুঝতে পেরে চুপচাপ রুমের ভেতরে চলে যেতেই হুট করে ফিরে এসে তার পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে কাধে মুখ গুঁজে দিলো। চমকে উঠে মৃদ্যু ভঙ্গিতে শিউরে উঠতেই সে আর তারের কাপড়গুলো হাতে নিতে পারলো না। সাগ্রত পেটের উপর শক্ত করে চেপে ধরে আছে। ইদানিং সাগ্রতের শক্তি যেনো আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। নিজেকে তুলার মতো নরম অনুভব হয় সাগ্রতের বাহুবন্ধনে। স্নেহা মাথা ঘুরিয়ে সাগ্রতের মুখটা দেখতে চাইলো, কিন্তু সে দেখতে পারলো না। সাগ্রত আরো শক্ত করে চেপে ধরে নিচু গলায় বললো,

– একটু স্থির থাকো। নড়াচড়া করার দরকার নেই।

এমন উত্তরে আগাগোড়া কিছু না বুঝলেও স্নেহা পাল্টা প্রশ্ন করলো না। দুহাত ভর্তি শুকনো কাপড় নিয়ে সাগ্রতের উদ্ভট কাজে চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। এদিকে ঠান্ডা বাতাসে শরীরের পশম কাটা দিয়ে উঠছে। সাগ্রতের গায়ে জিপার সিস্টেমের নরমাল জ্যাকেট থাকলেও স্নেহার গায়ে কিছুই নেই। কাপড় তোলার সময় মনে ছিলোনা শালটা গায়ে টানতে। স্নেহা অনেকক্ষন পর জিজ্ঞেস করলো,

– তুমি কি আবার কেস নিয়ে চিন্তা করছো?

সাগ্রত অস্ফুট স্বরে উত্তর দিলো,
– হু।

স্নেহা শুকনো কাপড়গুলো আবার তারে ঝুলিয়ে দিলো। পেটের উপর রাখা সাগ্রতের হাতে নিজের দুহাত রেখে দিলো। মুখটা ডান দিকে ফিরিয়ে সাগ্রতের গালে ওষ্ঠ স্পর্শ করলো। সাগ্রত চোখ খুলে তাকালে ওই অবস্থায় দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। স্নেহা যেনো গভীর দৃষ্টিতে সাগ্রতকে বোঝার চেষ্টায় আছে। সাগ্রত ওই ভঙ্গি দেখে দ্রুত স্নেহাকে ছেড়ে দিয়ে রুমের ভেতরে চলে গেলো। সাওদা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে দেখে নিঃশব্দে ওর কাছে গিয়ে কপালে চুমু দিলো। স্নেহা ততক্ষণে সব কাপড় এনে সোফার উপর রেখে দিতেই সাগ্রতের দিকে তীব্রদৃষ্টিতে তাকালো। সাগ্রত সেদিকে ধ্যান না দিয়ে আইপ্যাড অন করে আবারও কেস সংক্রান্ত ঝামেলা নিয়ে বসলো। স্নেহা ইদানিং লক্ষ করছে, সাগ্রত বেশিরভাগ সময় প্রচুর দুশ্চিন্তায় ভুগছে। আগে কখনো কোনো কেস নিয়ে এমন বিবশ, বেহাল, বিমর্ষ অবস্থা দেখেনি। স্নেহা গায়ে মোটা শালটা জড়িয়ে নিতেই সাগ্রতকে খোঁচা মেরে বললো,

– সিরিয়াল কিলারকে এই অবস্থায় মানায় না ।

খোঁচা খেয়ে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো সাগ্রত। দুই ভ্রুঁ খানিকটা কুঁচকে হাতের আইপ্যাডটা পাশে রেখে উঠে দাড়াতেই সন্দিগ্ধ গলায় বললো,
– কি অবস্থায় মানায় তাহলে? আমাকে কি অবস্থায় দেখতে চাচ্ছো?

কথার ভঙ্গি ও চোখের চাহনি দুটোই স্নেহাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিলো। এর মধ্যে সাগ্রত যেভাবে এগিয়ে আসছে এতে প্রচণ্ড লজ্জাবোধ হচ্ছে ওর। স্নেহার দুইহাতে শালটা আরেকটু চেপে ধরতেই চোখ নিচু করে থতমত করে বললো,

– না ওইযে, বলতে চাচ্ছিলাম, মানে আরকি, তুমি ওভাবে..

স্নেহা তার কাঙ্ক্ষিত কথাটা শেষ করতে পারলো না। সাগ্রত হেঁটে এসে স্নেহার একদম নিকটে দাড়িয়ে ভ্রুঁ কুন্ঞ্চন মুখভঙ্গিতে বলে উঠলো,

– আমার দিকে কি তুমি আগের মতো ধ্যান দাও? সাওদা আসার পর থেকে দুইমিনিট আমাকে সময় দিয়েছো? বলো স্নেহময়ী! তুমি কি আগের মতো আমাকে প্রোপার এ্যাটেনশ্যান দিচ্ছো?

স্নেহার মুখ ভীষণ কালো হয়ে গেলো সাগ্রতের কথা শুনে। সাওদা যত বড় হচ্ছে ততই সাগ্রতের সাথে সুক্ষ্ম একটা দূরত্ব না চাইতেই সৃষ্টি হচ্ছে। নিজের দিক থেকে বিশাল অপরাধ হয়েছে বলে স্নেহা পাল্টা কোনো উত্তর দিলো না। কিন্তু সাগ্রত একটা অভাবনীয় কাজ হিসেবে হালকা মতোন ধাক্কা দিয়ে স্নেহাকে ডিভানে ফেলে দিলো। গা থেকে শাল সরে গিয়ে স্নেহা ডিভানে বেকায়দায় পিঠ লাগিয়ে পরে গেলো। সাগ্রত ওর মাথার দুইপাশে হাত ফেলে ঝুঁকলে অভিযোগ ছুড়ে বললো,

– আমার গায়ে হাত দিয়ে তুমি শোও? আগের মতো কি আমার দিকে তাকাও? আমি টেনশন করছি , না কি করছি সেদিকে লক্ষ রাখো? ইউ আর ওয়ার্থলেস! জাস্ট হেইট ইউ স্নেহময়ী!

সাগ্রতের ক্ষিপ্ত কথায় প্রচণ্ড নিশ্চুপ হয়ে যায় স্নেহা। মেয়ের জন্য ঠিকই আগের মতো খেয়াল রাখা সম্ভব হয়না। কিন্তু সাগ্রতের মতো এতো ম্যাচিউর ব্যক্তির কাছে এই সুক্ষ ব্যাপারগুলো এতো ভয়ংকর হয়ে উঠবে সে সম্বন্ধেও ওর জানা ছিলো না। স্নেহা ঢোক গিলে আশ্বস্ত কন্ঠে নরম ভঙ্গিতে বললো,

– তোমার মেয়ের জন্যই তো পারিনা। আমরা কি আগের মতো আছি বলো? এখন তো আমাদের মাঝে সাওদা আছে। ওর দিকে কি ধ্যান দিতে হবেনা?

স্নেহার যৌক্তিকতা শুনে কিছুটা নরম হলো সাগ্রত। কিন্তু তখনও সে স্নেহার উপর ঝুঁকেছিলো। স্নেহা ওকে উপর থেকে সরতে বলে বিছানায় শুয়ে পরতে বললো। আজ কেসের চিন্তায় রাত না জেগে ঘুমাতে বলে যেই উঠতে নিবে ওমনেই সাগ্রত ওর উপর ভর ছেড়ে দিয়ে ওষ্ঠযুগল আবদ্ধ করলো। স্নেহা প্রচণ্ড মাত্রায় অবাক হয়ে বিস্ফোরিত চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে সাগ্রত নিজের ওষ্ঠকার্য সম্পাদনে মগ্ন ছিলো। ধু ধু মরুভূমিতে একফোঁটা জলের আভাস দেখলে মনে যে পুলকের উচ্ছাস জন্মে ঠিক তেমনই উদ্দীপ্ত অবস্থায় সাগ্রত ছিলো তখন। পরিচিত উষ্ণতায় নিজের ভারী গা ছেড়ে দিয়ে ওষ্ঠমায়ায় নিমত্ত ছিলো সাগ্রত। শ্বাস টানের জোগাড় হলে সাগ্রত দ্রুত স্নেহাকে ছেড়ে দিয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। স্নেহা এমন পরিস্থিতিতে সুপ্ত লজ্জায় পরলে তাড়াতাড়ি সাগ্রতকে সরিয়ে ডিভান থেকে উঠে দাড়ালো। সাওদার পাশে গিয়ে তৎক্ষণাৎ কম্বলের ভেতরে ঢুকে মাথা মুড়ে শুলো। সাগ্রত ডিভানে বসে শ্বাসকার্য চালাতেই এ দৃশ্য দেখে ঠোঁটের কোণে কিন্ঞ্চিত হাসি ফুটালো। জ্যাকেটের জিপারে হাত রেখে সেটা উপর থেকে নিচের দিকে টান মেরে খুললো। গা থেকে ধূসরবর্ণের জ্যাকেট খুলে কালো টিশার্টটা একটু ঠিকঠাক করে নিলো। বিছানার ডানপাশে স্নেহা, মাঝখানে সাওদা, তারপর সাগ্রত শুয়ে থাকে। সাগ্রত হেঁটে এসে যেদিকে ঘুমায় সেদিক থেকে আইপ্যাড তুলে ডিভানে গিয়ে বসে। স্নেহা মাথা থেকে চোরের মতো কম্বল সরিয়ে উঁকি মারতেই সাগ্রতের চাহনির সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি আবার আগের মতো কম্বল মুড়ে মাথা ঢাকতেই সাওদা অস্ফুট আওয়াজে কেদেঁ উঠে। ঘুমের ঘোরে ছোট্ট সাওদার বুকে হাত বুলিয়ে দিতেই সাওদা ঘুমিয়ে পরে। কিন্তু সাওদার দিকে খেয়াল দিতে গিয়ে কখন যে সাগ্রত স্নেহার পিছনে যেয়ে শুয়ে পরে সে ধ্যান অবশ্য স্নেহার নেই। স্নেহা ঠিক করে শুতেই দেখে চোখের উপর কবজি তুলে সটান হয়ে শুয়ে আছে সাগ্রত। এদিকে মেয়ের পাশে বামদিকটা শূন্য। স্নেহা আর কথার তলব না টেনে সাওদার পাশে কোল বালিশ রেখে সাগ্রতের দিকে ফিরলো। চোখের উপর থেকে কবজি সরিয়ে ওর মুখের দিকে এগোলো। সাগ্রত চোখ বন্ধ করে থাকলেও স্নেহা জানে সাগ্রত ইচ্ছে করেই এমনটা করছে। স্নেহা ধীরেসুস্থে কম্বলটা টেনে সাগ্রতের পা থেকে বুক পযর্ন্ত ঢাকলো। শীতের জন্য হাতের তালু বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাত গরম করার দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপলে স্নেহা চুপচাপ সাগ্রতের টিশার্ট উঠিয়ে দুহাত ঢুকিয়ে দেয়। উষ্ণ বুকের উপর ঠান্ডা হাতের তালু বসিয়ে দিতেই সাগ্রত হকচকিয়ে চোখ খুলে আর্তনাদে চেঁচিয়ে বলে,

– স্নেহময়ী হাত সরাও, সরাও! কি খারাপের খারাপ ! নিজের ঠান্ডা হাত এনে আমার বুকের উপর রাখছো? হাত সরাও বলছি। বরফের মতো ঠান্ডা হাত!

সাগ্রতের এমন অপ্রতিভ আচরণ দেখে খিলখিল করে হেসে দেয় স্নেহা। সাগ্রতের গরম গায়ে ঠান্ডা হাত বসিয়ে উষ্ণতা নিতে চরম লাগছে তার। স্নেহার চালবাজি বুঝতে পেরে সাগ্রত কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে শক্ত চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে পরক্ষনে কিছু না বলে স্নেহার দিকে ঘুরে কম্বলটা গলা অবধি টেনে চোখ বন্ধ করে। বুকের উপর থেকে ঠান্ডা হাত তখনও সরায়নি স্নেহা। পিটপিট করে হাস্যোজ্জল চাহনিতে দেখছিলো সাগ্রতকে। সাগ্রত চোখ বন্ধ করে স্নেহার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা বুঝতে পেরে চট করে সেও স্নেহাকে ঠান্ডার শিহরনে কাঁপিয়ে দেয়। নিজের ঠান্ডা হাত স্নেহার কামিজ উঠিয়ে পেটের উপর রাখতেই স্নেহা চিৎকার দিতে যেয়ে মেয়ের জন্য কন্ঠ নিচু করে বলে উঠে,

– এ কি করছো! তোমার হাত খুব বেশি ঠান্ডা! বরফের চাকা যেনো রাখছো। হাত সরাও প্লিজ।
সাগ্রত ত্যক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– এখন কেমন লাগে? নিজের বেলায় ফিটফাট, অন্যের বেলায় বাজিমাত? ন্যাকড়া না দেখিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকো। বেশি চিল্লাচিল্লি করলে কি করতে যেয়ে কি করবো নিজেও জানিনা! আমার হাত কিন্তু খুবই খারাপ স্নেহময়ী। এলার্ট থাকাটা তোমার কর্তব্য।

.

অন্ধকার জেলে সময়গুলো খুবই জঘন্য হিসেবে কাটছিলো। কখন সকাল হয়ে রাত হয়, কখন ভোরের আলো ফুটে রাতের আধার নামে কিছুই জ্ঞাতব্য ছিলো না পূর্বের। একেকটা দিন একেকটা অভিশাপের মতো যাচ্ছিলো ওর। চব্বিশ ঘন্টার অর্ধেকটা সময় অর্ধচেতন হিসেবেই থাকতো। বেঁচে থাকার আশা এবং জেল থেকে নির্দোষ হিসেবে বের হওয়া সবকিছু পূর্ব ত্যাগ করেছিলো বহু আগেই। জীবনের দূর্বিসহ দিনগুলো নিজের অন্তিম সময় বলে বিবেচনা করতো। যেকোনো মূহুর্তে মৃত্যুর আগমন চলে আসতে পারে এ নিয়ে প্রচণ্ড সজাগ ছিলো। শরীরের উপর নূন্যতম শক্তি ছিলো না ওর। খাবার চিবিয়ে খাওয়ার মতো অবস্থাও ফুরিয়ে গিয়েছিলো। চোখের উপর স্বচ্ছ পানির আভাস সর্বদা অনুভূত হতো। টলটল করে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরতো। ঝাপসা দৃষ্টি দিয়ে জেলের সিলিংয়ের দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতো। প্রচণ্ড মাথাব্যথায় দেয়ালে কতবার বারি মেরেছে সে হিসেব নেই। কপাল ফেটে কানের পাশে তরল জিনিসের অস্তিত্ব অনুভব হয়েছে সে হদিশ নেই। যখন কানের পাশে চিপচিপে লাগতো তখন হাত দিয়ে বুঝতো তাজা রক্ত বেয়ে পরছে। সেই সেলে একাকিত্বের মধ্যে থেকে কতগুলো দিন পেরিয়ে যাচ্ছিলো পূর্ব সে হিসেব টুকে-টুকে মস্তিষ্কের ভেতর জমা করছিলো। পূর্ণতার মুখচ্ছবি দেখার জন্য মনেমনে আকুলিবিকুল করতো। অনাগত অতিথি নিয়ে একটু সুখকর অনুভূতি শেষ যাত্রার স্মৃতি হিসেবে পেতে চেয়েছিলো, কিন্তু ভাগ্য যেনো সহায় হয়নি। সেই অন্ধকার সেলে হাত পা ছড়িয়ে ক্ষতবীক্ষত দেহ লুটিয়ে পূর্ব স্মৃতির দুয়ার মেলে নিজের সাথে আত্ম কথা চালাতো। সবটা ঘিরে, সবটা জুড়ে শুধু পূর্ণতা ছিলো। আজ পাশে কেউ নেই ভাবতে গেলেই চোখের কোটর অসহ্য যন্ত্রণায় ভিজে উঠতো।

আমার নির্মলচিত্তের পূর্ণতা, আজ আমি তার কাছ থেকে বহু দূরে আছি। এখন শুধু মৃত্যুর জন্য সময় গুনছি। নিজের ভুলের শাস্তি হিসেবে আমি তাকেও কষ্ট দিচ্ছি। ওকে যেদিন আমার সামনে প্রথম দেখেছিলাম সেদিন বুঝিনি ওই রাতের অন্ধকারে নির্জন সড়কে রক্তাক্ত, চেতনাহীন মেয়েটি আমার শক্ত হৃদয়ের সবটা জুড়ে বিচরণ করবে। আমি ভাবিনী আমার বিক্ষিপ্ত, কঠোর, উষ্ণ হৃদয় কখনো মায়াময় স্নিগ্ধপূর্ণ মুখচ্ছবিতে নিবিষ্ট হয়ে শীতলতা ছড়িয়ে দিবে।

রাজনীতির অঙ্গনে দূর্দান্ত গতিতে চলার পথে কোনো সুন্দরী ললনা আমাকে ক্ষণিকের জন্য আর্কষিত করতে পারেনি। কখনো অজস্র নিয়মের গতিবেগ রোধ করে আমার মন গলাতে পারেনি, সেই আমিই কিনা নিজের মৃত্যুটা চোখের সামনে পেয়েও তার জন্য কেদেঁ মরছি। এখনো তার বীভৎস ঘটনার স্মৃতিগুলো আমাকে অপরাধী বানাতে আসে। স্বল্প সময়ের জন্য তাকে একা রেখে যাওয়ার কষ্টগুলো খুব পীড়া দেয়। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা সেই মলিন মুখের চেহারা আমার হৃদয়ের রুদ্ধদ্বারে এখনো কঠিনভাবে আঘাত করে। আমি সেদিন তাকে আগলে রাখতে পারিনি। তার সব যন্ত্রণা আমি কোনোভাবেই নিজের করতে পারিনি। যতবার দূরে গিয়েছি, আমি নিজের ক্ষতি করেছি। আমি নিজেকে ধ্বংস করেছি। আমার নিজের বানানো নিয়মকানুন আমি নিজেই ভেঙ্গে ফেলেছি।

তার আগমনের প্রথমদিকে আমি তখনো জানতে পারিনি তার জন্য আমার মধ্যে কিসের অনুভূতি হচ্ছিলো। বুঝতে পারিনি আমার মনের রাজ্য জুড়ে তার রাজত্ব ইতিমধ্যে একটু একটু করে শুরু হতে যাচ্ছিলো। তার মোহময় মুখটা দেখার জন্য আমার দৃষ্টি প্রতিনিয়ত তাকে খুজেঁ বেড়াতো। তার প্রতিটি পাগলামিপূর্ণ অভিব্যক্তি শোনার জন্য আমার মনপ্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠতো। তার নরম স্পর্শ পাবার আকাঙ্ক্ষায় প্রচণ্ড উন্মাদ, উন্মুখ, উন্মত্ত হয়ে যাবো, আমি কখনো ভাবিনি। আজ আমি শঙ্কিত পূর্ণ। এ নির্জন জেলের মধ্যে কোথাও তুমি নেই। তোমার স্পর্শ নেই, তোমার দেখা নেই, তোমার আগমন নেই। তোমার জন্য নিজ থেকেই আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আজও এই অন্ধকার সেলের ভেতর অদ্ভুত আলোর জন্য প্রতীক্ষায় আছি। আমার বিশ্বাস তুমি আমার ব্যর্থ জীবনের সবচেয়ে স্বার্থক ব্যক্তি হিসেবে আসবে। এক নতুন দিনের উন্মোচন করে আমার শেষ চিহ্ন নিয়ে তুমি আবারও নিজেকে গড়বে। ভুলিয়ে দিবে সমস্ত ঈর্ষা, কলুষতা, যন্ত্রণা, স্বার্থপরতার প্রহর। আমি শুধুই স্বপ্ন দেখি তোকে ঘিরে, সমাজকে ঘিরে, দেশ ও রাজনীতিকে ঘিরে।

একদিন হবে দেখা, যেদিন ভেঙ্গে যাবে সব মিথ্যার পরিকল্পনা। হয়তো একদিন বীরবেশে ফিরবো, নয়তো সত্য আকড়ে লাশ হয়ে অগোচরে হারিয়ে যাবো।

.

সকাল দশটা বিশ। নাস্তার টেবিলে মগের হ্যান্ডেলে আঙ্গুল পেচিয়ে ঠোঁটের কাছে আনতেই বিশ্রী রিংটোনে ফোন বাজতে লাগলো। মগটা টেবিলে আগের জায়গায় রাখতেই ফোনটা রিসিভ করে কানে রাখলো। ওমনেই ওপাশ থেকে সর্তক ভঙ্গিতে কেউ বললো,

– সাগ্রত স্যার, পেয়ে গেছি।

উত্তরটা শুনে মুখের পাউরুটি আর চিবাতে পারলো না সাগ্রত। এক চিৎকার দিয়ে চেচিয়ে উঠতেই কফি ফেলে দৌড় লাগালো।

– ‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO