তোকে চাই পর্ব-০৫

0
1460

#তোকে_চাই
#পার্ট_৫
#লেখনীতে_সুহাসিনী_চৌধুরী(ছদ্মনামের লেখিকা)

~বাগান বিলাস~

খান বাড়ির গেটে এই নামটা লিখা দেখে মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো রাইতার।আজ প্রায় এক মাস পর নিজের বাড়িতে পা রাখলো সে।বাড়িতে ঢোকার পথে দুই সাড়িতে লাগানো লাল গোলাপের গাছ।এক সাইটে দোলনা।আর এক সাইটে কৃত্রিম ঝর্ণা।নিচে গালিচা বিছানো।বাড়িটা তৈরি করা হয়েছে মার্বেল পাথর দিয়ে।যে কেউ একবার এই বাড়িটার দিকে তাকালে এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে বাদ্ধ।বলা বাহুল্য এই বাড়িটা তৈরি করেছেন শেখ শরিফ রায়হান খান।যিনি রিক্ত,সাইফ এবং রাইতার দাদু।অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার তিনি।তার অর্ধাঙ্গিনী মিসেস রামিমা রায়হান খান একজন বিখ্যাত উকিল।সে নিজেও এখন অবসরপ্রাপ্ত।তাদের তিন সন্তানের মধ্যে বড় মিস্টার রাশেদ রায়হান খান।মেজো ছেলে মিস্টার শাহেদ রায়হান খান।এবং ছোট মেয়ে শিরিন রায়হান খান যে এখনো অবিবাহিত।অবিবাহিত কেন তার কারণটা পরে জানতে পারবেন সবাই।

রাইতা আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে সদর দরজার সামনে।কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলেন মিসেস মাইমুনা রায়হান খান অর্থাৎ রিক্তর মা।দরজা খুলে সে রাইতাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য যেন নিজের কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললেন।হঠাৎই রাইতাকে জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কাঁদতে লাগলেন মিসেস মাইমুনা রায়হান খান।আজ কতগুলো দিন পর তিনি তার নিজের থেকেও বেশি প্রিয় মেয়েকে দেখলেন।কাছে পেলেন।ভাবতেই যেন তিনি চাঁদ হাতে পেয়ে গেলেন।

মিসেস মাইমুনার কান্নার আওয়াজে একে একে রিক্তর দাদু,দিদুন,বাবা,চাচ্চু,মামণি আর মাম বেরিয়ে আসলেন।

মিস্টার রাশেদ রায়হান খান এসে ওনার স্ত্রীর পাশে রাইতাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন।সেই সাথে অনেক খুশিও হলেন।হাজার হোক নিজের একমাত্র মেয়েকে আজ প্রায় এক মাস পর নিজের চোখের সামনে দেখছেন যে মেয়েকে কিনা এক দিন না দেখলে গলা দিয়ে খাবার নামতো না।সেই মেয়েকে আজ এতোগুলো দিন পর দেখে খুশিতে পানি এসে গেছে তার চোখে।এই মুহূর্তটা হয়তো কোটি টাকা দিয়েও কেনা সম্ভব নয়।

মিসেস লামিয়া রায়হান খান অর্থাৎ মিস্টার শাহেদ রায়হান খানের স্ত্রী এবং সাইফের মা রাইতাকে দেখেই ছুটে আসেন ওর কাছে।এসেই নিজের বুকে জড়িয়ে নিলেন।এই মেয়েটাকে তিনি বড্ড ভালোবাসেন।আজ যদি তার মেয়েটা তার কাছে থাকতো তবে রাইতার মতোই দেখতে হতো।কিন্তু নিয়তির কাছে তারা হার মেনে গেছেন।তাইতো আজ মিস্টার শাহেদ রায়হান খান আর মিসেস লামিয়া রায়হান খান আজ দুই সন্তান থাকা সত্বেও এক সন্তানের জননী।এসব ভেবেই চোখের পানি বিসর্জন দিতে লাগলো মিসেস লামিয়া রায়হান খান অর্থাৎ রিক্ত আর রাইতার মামণি।

শিরিন রায়হান খান!রিক্ত,রাইতা আর সাইফের মাম।ছোটবেলা থেকেই নিজের ছেলে-মেয়েদের মতো মানুষ করেছেন তিনি তার এই তিন ভাতিজা-ভাতিজিকে।এক মুহূর্তের জন্যও বুঝতে দেননি যে তিনি ওদের মা নয় বরং ফুপি।বেশিরভাগ সময়ই ওরা তিন ভাই-বোন শিরিনের কাছেই থাকতো।এখনো তাই করে।কোনো কিছু হলেই তিন ভাই-বোন ছুটে আসে তাদের মামের কাছে।প্রত্যেকটা কথা শেয়ার করে।এমনকি কাউকে ভালো লাগলে সেটাও সবার আগে মামের কাছেই এসে বলা চাই সবার।তবে রাইতার সাথে তার সম্পর্কটা একদম বেস্ট ফ্রেন্ড এর মতোই।সেই মেয়েটাকে এতোদিন পর নিজের সামনে দেখে তিনিও কেঁদে ফেললেন।অথচ এই সেই মানুষ যে কিনা নিজের বিয়ে ভাংগার দিনেও এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলেননি।কিন্তু রিক্ত,সাইফ আর রাইতার কিছু হলে তিনি পাগল প্রায় হলে যান।

মিসেস রামিমা রায়হান খান নিজের প্রাণ প্রিয় নাতনিকে এতোগুলো দিন পর দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পরেন।ধীরে ধীরে নাতনির কাছে এসে দাড়ান তিনি।তারপর মাথায় হাত রাখেন রাইতার।মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে রাইতা সাইটে তাকিয়ে দেখে তার দিদুন চোখ ছলছল করে তাকিয়ে আছে।দিদুনকে দেখেই মামণিকে ছেড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে রাইতা।মিসেস রামিমাও পরম যত্নে নাতনিকে জড়িয়ে ধরেন।

মিস্টার শাহেদ রায়হান খান!একজন দায়িত্ববান পুলিশ অফিসার।পুরো থানায় তাকে সবাই ভয় করে চলে।কারণ তিনি প্রচুর রাগী একজন মানুষ।অথচ এই মানুষটায় রাইতা নামক ছোট্ট মেয়েটাকে বড্ড ভয় করেন।ভয় বলা চলে না।আসলে অনেক ভালোবাসেন তিনি রাইতাকে।ওয়ানিয়াকে হারানোর ঠিক এক বছর পর খান বাড়িকে আলোকিত করে জন্ম নেয় “রাফাতুল রাইতা”। এই সেই মেয়ে যাকে কাছে পেয়ে মিস্টার শাহেদ রায়হান খান এবং মিসেস লামিয়া রায়হান খান নতুন করে হাসতে শিখেছিলেন।সেই মেয়েটাকে কাছে পেয়ে যেন জান্নাতের সুবাস পাচ্ছেন তিনি।রাইতার কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে নিজের চোখের পানি মুছলেন।

শেখ শরিফ রায়হান খান বরাবরই কঠোর একজন ব্যক্তি।তিনি কখনোই কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি।না কখনো দিবেন।রাইতার উপরে সে বেশ রেগে আছেন।কারণ রাইতা যা করেছে তা মোটেও ঠিক করেনি।রাগের বসে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে সে বড্ড অন্যায় করেছে।এর শাস্তি তো রাইতাকে পেতেই হবে।তিনি গম্ভীর কন্ঠে ডাকলেন রাইতাকে।

“রাফা”

দাদুর ডাক শুনে রাইতা দাদুর কাছে এসে মাথা নিচু করে নিলো।মিস্টার শরিফ রায়হান খান রাইতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“রাফা,তুমি জানো বাকি সবাই তোমাকে রাইতা বলে ডাকলেও আমি তোমাকে রাফা বলে ডাকি কারণ রাফা শব্দের অর্থ আল্লাহর দান।তুমি সত্যিই আমাদের পরিবারের জন্য আল্লাহর দেওয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ দান।তুমি বরাবরই বেশ বাচ্চা স্বভাবের হলেও বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে।তোমার থেকে আমি এমন কিছু আশা করিনি যাতে আমাদের এই হাসি-খুশি পরিবারের উপরে তার প্রভাব পড়ে।কিন্তু তুমি সেরকমই একটা কাজ করেছো।তাই এই অন্যায়ের শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।”

দাদুর গম্ভীর কন্ঠের এমন কথা শুনে রাইতা করুণ চোখে তাকালো তার দাদুর দিকে।এই করুণ চোখের চাহুনির দিকে তাকিয়ে মিস্টার খান আর কি শাস্তি দিবেন?সে নিজেও আর রাগ করে থাকতে পারলেন না রাইতার উপরে।হেসে দিয়ে বললেন,

“থাক থাক হয়েছে।আর এমন মুখ করে থাকতে হবে না।এবারের মতো মাফ করে দিলাম।কিন্তু হ্যা,পরবর্তীতে যেন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর কখনো না হয়।”

এই বলেই রাইতার গাল দুটো টেনে দিলেন তিনি।রাইতাও খুশি মনে দাদুর গালে চুমু দিয়ে বললো,

“আমার সোনা দাদুটা।আমি আর কক্ষনো এমন করবোনা প্রমিস।”

এতোকিছুর মধ্যেও রাইতা কাউকে একটা মিস করছে।আর সেই কেউটা হলো শিরিন।রাইতা সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এক কোণে চোখে পানি নিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে আছেন তিনি।রাইতা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললো,

“আমার কলিজা মাম,জানি তুমি আমার উপরে খুব রেগে আছো।কারণ আমি যে রাগ করার মতোই কাজ করেছি।কিন্তু আমার সেদিন দাভাইয়ের উপর খুব অভিমান হয়েছিল।কেন আমাকে মেরেছিল?আমি কি কিছু করেছিলাম নাকি?সব তো ঐ নিহান শয়তানটার দোষ।ওও কেন আমাকে প্রপোজ করেছিল সবার সামনে?তাই তো ওকে শায়েস্তা করার জন্য শুধু প্রপোজালটা এক্সেপ্ট করেছিলাম।কিন্তু দাভাই আমার কোনো কথা না শুনেই আমাকে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিলো।পুরো পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসে গিয়েছিলো আমার গালে।তাই তো আমি রাগে,দুঃখে,অভিমানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু সেটায় ছিলো আমার জীবনের চরম ভুল”

এই বলেই কান্না করে দিলো রাইতা।ওর এখনো মনে পড়ে সেই দিনের কথা।যেদিন ওও রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিলো বাসা থেকে।এরপর একটা ফ্রেন্ড এর বাসায় ওঠে ওও।ভাগ্যক্রমে সেদিন ওর ফ্রেন্ড নিশির বাসায় কেউ ছিলো না।নিশির বাবা,মা আর ছোট বোন বেড়াতে গিয়েছিলো নানুবাড়িতে।শুধু নিশি যায়নি।কারণ ওর গ্রাম খুব একটা ভালো লাগে না।তাই সেখানেই উঠেছিলো রাইতা।আর সেই খবরটা গোপন করতে বলেছিলো সবার কাছে।যার দরুণ নিশিদের বাসায় গিয়েও রাইতার কোনো খবর পায়নি কেউ।এভাবেই সাত দিন কেটে যায়।একদিন রাইতা একায় ফুচকা খাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়েছিল।তখনই একটা মাইক্রো এসে দাড়ায় ওর সামনে।আর সেখান থেকে কিছু ছেলে বের হয়ে ওর মুখে ক্লোরোফম স্প্রে করে অজ্ঞান করে তুলে নিয়ে যায় সেই গোডাউনে যেখানে বাকি বাচ্চা আর মেয়েদের রাখা হয়েছিল।রাইতা সেদিন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল।অনেক কান্না করে সবার কাছে বাসায় ফিরে আসার কথা বললেও কেউ ওর কথা শোনেনি।এভাবেই একদিন সবাই শোনে তাদের নাকি বিদেশে পাচার করে দেওয়া হবে।তাই ঐ জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়।সেখানেই ঐ শয়তান ছেলেটা ওর সাথে যা করে তা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে রাইতার।

এতোক্ষণ সবকিছু নিরব দর্শক হয়ে দেখছিলো রিক্ত আর সাইফ।সাইফ ভেতরে এসে সবার সামনে দাড়ালেও রিক্ত কারো দিকে না তাকিয়ে হনহন করে উপরে গিয়ে নিজের রুমের দরজা বিকট আওয়াজে বন্ধ করে দিলো।যে আওয়াজে কেঁপে উঠল সবাই।এই ছেলেটা আর শুধরাবে না।অনেক চেষ্টা করেও রিক্তর রাগ কেউ কমাতে পারেনি।এখন সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছে।তবে সবার এখন একটায় প্রত্যাশা রিক্তর জীবনে এমন একজন আসবে যে এই বদমেজাজি,রাগি,অহংকারি,গম্ভীর ছেলেটাকে আর পাঁচটা ছেলের মতোই হাসি-খুশি করে তুলবে।যে সবার সাথে মিশবে,মজা করবে,হৈ-হুল্লোড় করবে।মাতিয়ে রাখবে সবাইকে ঠিক আগের মতো।কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব?ওয়ানিয়া যে ওর সাথে সাথে রিক্তর সেই মনটাকেও নিয়ে গেছে!

রাইতাকে পেয়ে সবাই অনেক খুশি।তাই রাইতাকে ঘরে পাঠিয়ে ফ্রেশ হতে বললেন ওদের মাম।আর বাকি সবাই হলরুমে বসে সাইফের কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা শুনতে লাগলেন।কিন্তু রাইতার খবরটা শুনে সবাই অনেক রেগে গেলেও রোজের গুলি লেগেছে এইটা শুনে সবাই অনেক কষ্ট পেলো।আর কোনো এক অজানা কারণে মিসেস লামিয়া রায়হান খানের বুকটা ধক করে উঠলো রোজের নামটা শুনে।তাই ডিনি সাইফকে জিজ্ঞেস করলেন,

“মেয়েটা এখন কেমন আছে?”

“ডক্টর বলেছে এখন ভালো আছে।তবে রিস্ক একটা আছেই।কারণ গুলিটা এমনভাবে লেগেছে যে ওর হার্টের এক পাশে হালকা ক্ষয় হয়ে গেছে।তাই আবারো যদি ঐ জায়গায় গুলি লাগে বা কোনো বড় ধরনের আঘাত লাগে তবে হয়তো রোজকে আর বাঁচানো যাবে না।”

সাইফের প্রথম অংশের কথা শুনে সবাই খুশি হলেও শেষের কথা টুকু শুনে সবাই চিন্তিত হলো।কারণ সিআইডি মানেই এমন হাজারো আঘাত লাগবেই।তাই রোজকে নিয়ে সবাই চিন্তিত।কারণ ওর যে অন্য কোনো মিশনে গিয়ে আবার এমন কোনো গুলি বা আঘাত লাগবে না তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

চলবে???