তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব-৩৭+৩৮

0
650

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৭.
~
দরজার বাইরে যাওয়া মাত্রই মিথি থমকে গেল। নিমিষেই চোখের কোণটা ভিজে উঠল তার। অবাক হলো খুব। নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। বুকটা ধিপ ধিপ করছে তার। পেছন ফেরে বাবার দিকে তাকাল। কথা বলতে গিয়েও যেন পারছে না। কন্ঠনালীতে আটকে যাচ্ছে। জোরে নিশ্বাস নিল। কাতর কন্ঠে বললো,

‘স্কুটি? কেন বাবা?’

আতাউর সাহেব মেয়ের কাছে এগিয়ে এলেন। চোখের কোণ টা তারও ভেজা। কোমল কন্ঠে তিনি বললেন,

‘দু বছর আগে ভাইয়ের জন্য তুই তোর স্কুটি টা বিক্রি করেছিলি। তোর সবথেকে প্রিয় জিনিস টা তখন তুই তোর ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য হারিয়ে ফেলেছিলি। তাই আজ..আজ তোর ভাই বললো সে নাকি আবার তার বোনকে তার প্রিয় জিনিস টা ফিরিয়ে দিতে চায়। আর এসব কিছু মাহির আইডিয়া।’

মিথি যেন বাকরুদ্ধ। কি বলবে সে? কিভাবে নিজের অনুভূতি টা প্রকাশ করবে? অনেক টা সময় চুপ থেকে সে বললো,

‘এত টাকা..কিভাবে বাবা?’

আতাউর সাহেব মাথা নিচু করে হাসলেন। তারপর তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অতঃপর বললেন,

‘মাহির কাছে জমানো কিছু টাকা ছিল। আর ব্যাংকে যেগুলো ছিল সেখান থেকেই মিলিয়ে জিলিয়ে নিয়ে এসেছি। তোর পছন্দ হয়েছে তো মা?’

মিথির এবার কান্না পেয়ে গেল। এমন একটা পরিবার না পেলে হয়তো সে কখনোই ভালোবাসার মর্ম বুঝত না। সে জড়িয়ে ধরল তার বাবাকে। কিছুক্ষণ কাঁদল। তার চোখের এই স্বচ্ছ শুভ্র দানাগুলোই প্রমাণ করছে সে তার পরিবারকে কতটা ভালোবাসে। মেয়ের কান্নায় এবার সকলেই ভেঙে পড়লেন যেন। কেঁদে কেটে সবাই নাক মুখ লাল করে তবেই ক্ষান্ত হলেন। মিথি তারপর নিজের স্কুটির কাছে গেল। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগল। একটা সময়ে তার এক বিশাল ভালোবাসা ছিল এই জিনিস টা। তখনই ভাই অসুস্থ হয়, আর চিকিৎসার জন্য এত টাকা না থাকায় বাধ্য হয়ে সে তার এই স্কুটি টা বিক্রি করে দেয়। আজ আবার সে একটা স্কুটি পেয়েছে; তার সেই ভালোবাসার জায়াগাটা আজ আবারও পূর্ণ হলো। আবারও একবার পরিবারের ভালোবাসায় সিক্ত হলো মিথি। তার মনে হলো, তার এই ছোট্ট জীবনে সে অনেক কিছু পেয়ে ফেলেছে। কুঁড়িয়েছে এক আকাশ ভালোবাসা। মনটা আজ খুশিতে অস্থির। মানুষ ঠিকই বলে, সৃষ্টিকর্তা কিছু কেড়ে নিলে তার থেকে দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেয়। তার জন্য অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে। সবসময় যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। আর মন খুলে সবাইকে ভালোবাসতে হবে। এটাতেই খুব করে বিশ্বাসী মিথি। ভালোবাসতে তো আর অর্থের প্রয়োজন হয় না, তবে এতে এত কিপটামী কিসের..!
.
.
বিকেলে বাইরের পিচ ঢালা রাস্তাটায় স্কুটি টা নিয়ে বের হয় মিথি। অনেকদিন হলো চালানো হয় না, এখন পারবে কি না কে জানে? মনে সাহস নিয়ে স্কুটিতে বসে সেটা স্টার্ট দেয় সে। প্রথমে সোজা ভাবে হ্যান্ডেল করতে না পারলেও কিছুক্ষণের মাঝেই কন্ট্রোল করে নেয়। খুশি হয়ে ছুটতে থাকে। এপাশটায় তেমন কোনো বড়ো গাড়ি চলাচল করতে দেখা যায় না। তাই এখানে সে খুব ভালোভাবে স্কুটি টা চালাতে পারে।

কিছু সময় পর মিথি একটু থামল। স্কুটি টা ব্যাক করে আবার তাদের বাসার গেইটের সামনে এসে দাঁড়াল। সেখানে মাহি দাঁড়িয়ে ছিল। মিথি তখন বললো,

‘চল, তুই আমার পেছনে বস। তোকেও সামনে থেকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।’

বোনের উপর এই মুহুর্তে ঠিক ভরসা করতে পারছে না মাহি। যদিও সে জানে একসময় মিথি বেশ পাঁকা ছিল এই ব্যাপারে। কিন্তু এখন অনেক দিন হয়ে গেছে, তাই মাহির একটু একটু ভয় করছে। যদি আবার কোনো দূর্ঘটনা ঘটে। মাহি তাই প্রথমে রাজি হয় না। মিথি একপ্রকার জোর করেই তাকে তার পেছনে বসিয়ে ছুটতে শুরু করে। অনেকটা পথ চলে আসে দুজন। অনেক দিন পর স্কুটি চালিয়ে খুশিতে মিথির আজ মনে হচ্ছে যেন পুরো বিশ্বটা এখনই ভ্রমণ করে ফেলবে। তার এখনও খেয়াল হয়নি যে সে কতটা পথ এসেছে। মাহিও এখন খুব এনজয় করছে। তাই তারও এই ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই। তারা দুজনই এখন যেন অন্য এক দুনিয়ায় আছে।
.
অনেকটা পথ আসার পর মিথি এবার থামল। আরেকটু সামনে গেলেই হাই রোড। আর যাওয়া যাবে না। তাই সে স্কুটি ঘুরাল। ফেরার পথে একটা গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। দেখে মনে হচ্ছে নৈরিথের গাড়ি। একটা কফিশপের সামনে দাঁড়ান। মিথি পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে মাহিকে বললো,

‘এই মাহি, দেখতো এটা নৈরিথের গাড়ি মনে হচ্ছে না?’

মাহিও সেদিকে তাকিয়ে বললো,

‘হ্যাঁ, এটা তো ভাইয়ার গাড়ির মতো।’

মিথি তখন কিছু একটা মনে মনে ভাবল। তারপর সে তার স্কুটি টা নৈরিথের গাড়ির সাথে পার্ক করে একপাশে দাঁড়াল। মাহির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আমার ফোনটা তোর কাছে না, দে তো!’

মাহি পকেট থেকে মিথির ফোনটা বের করে তার হাতে দিল। মিথি কল লাগাল নৈরিথের নাম্বারে। বারবার ব্যস্ত দেখাচ্ছে। মিথিও লাগাতার কল দিয়েই যাচ্ছে। অনেক গুলো কলের পর অবশেষে কলটা রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে নৈরিথের ব্যস্ত কন্ঠখানা শোনা গেল,

‘আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরে কল দিচ্ছি।’

মিথি তাড়াহুড়ো করে বললো,

‘আচ্ছা আচ্ছা, আপনি এখন কোথায় আছেন এইটুকু বলে দিন তাহলেই হবে।’

নৈরিথ কিছুটা বিরক্ত হলো। বললো,

‘একটা কফিশপে আছি। ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং এ। এখন কথা বলতে পারবো না, রাখছি।’

নৈরিথ কল কেটে দেয়। মিথি সিউর হয়ে যায়, নৈরিথ এখানেই আছে। যদিও এখন তার ইচ্ছে করছে দেখা করার, কিন্তু এই ব্যস্ত মানুষের তো সেইটুকুও সময় নেই। সেই মুহুর্তে সে মনে মনে ভাবল, সে কি একবার বলবে নৈরিথ কে যে সে এই কফিশপের নিচে দাঁড়ান? এক উছিলায় তো দেখাও হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু আবার যদি নৈরিথ রেগে যায় এটা ভেবে যে সে একটা স্কুটি চালিয়ে এত দূর চলে এসেছে? উনার তো আবার রাগের কোনো কারণ থাকে না। হুদাই চিল্লা ফাল্লা করে।

অনেকক্ষণ ভাবল। ভেবে ভেবে নৈরিথের নাম্বারে একটা ম্যাসেজ লিখল, ‘আপনি যেই কফিশপে আছেন আমি সেই কফিশপের নিচে দাঁড়ান।’ ম্যাসেজ টা সেন্ড করে হাঁসফাঁস করতে থাকে সে। মনে মনে ভয় পায়, নৈরিথ যদি রেগে যায়। আবার নিজেকে নিজেই আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘উফফ, রাগবে কেন? উনি তো বরং খুশি হবে আমাকে দেখে। হ্যাঁ, একশো বার হবে। খুশি হতে বাধ্য উনি।’ মনে মনে সাহস জুগিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।

প্রায় বিশ মিনিট এইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।
.
.
‘তুমি এখানে কি করছো?’

কন্ঠস্বর টা চেনা মিথির। তাই খুশি হয়ে পেছন ফেরে তাকাল। নৈরিথকে দেখে ঠোঁটের হাসির রেশটা আরো কিছুটা গভীর হলো। নৈরিথ তার দিকে এগিয়ে এল। বুকের উপর হাত দুটো ভাজ করলো। গম্ভীর সুরে বললো,

‘কি হলো? কিছু বলছো না কেন? হঠাৎ এখানে?’

মিথি মুচকি হেসে বললো,

‘ঐ যে দেখুন।’

মিথির আঙ্গুলের ইশারা অনুসরণ করে নৈরিথ সামনের দিকে তাকাল। দেখল তার গাড়ির পাশেই একটা হালকা কমলা রঙের স্কুটি রাখা। নৈরিথ ব্রু কুঁচকাল। বললো,

‘কার স্কুটি এটা?’

জবাবে মিথি সরস গলায় বললো,

‘আমার। বাবা আর মাহি আজকে সকালে কিনে এনেছে। তাই মাহিকে নিয়ে এখন একটু বেরিয়েছি। আর রাস্তায় আপনার গাড়ি দেখে মনে হলো আপনি হয়তো এখানে আছেন। তাই কল দিয়ে সিউর হয়ে নিলাম।’

নৈরিথ চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল মিথির কথা শোনে। হঠাৎই সে রেগে গেল। চেঁচিয়ে উঠে বললো,

‘হুয়াট? আজকে স্কুটি কিনেছো আর আজই সেটা নিয়ে এত দূর চলে এসেছো? পাগল নাকি তুমি? যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেত তখন? এত পাকনামি করো কেন? কিছুদিন তো অন্তত প্রেকটিস করবে ঠিক মতো চালাতে পারো কি পারো না। তা না আজকে কিনে একেবারেই আজকেই টই টই করে ঘুরতে বেরিয়ে যেতে হলো?’

মিথি গাল ফুলিয়ে তেতো মুখে বললো,

‘স্কুটি আমি আরো আগে থেকেই চালাতে জানি। তাই বেরিয়েছি। নাহলে এত দূর কখনোই আসতাম না।’

নৈরিথ দ্বিতীয় বার কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। মাহির সেদিনের বলা কথাগুলো মনে পড়ল তার। মাহি তাকে আগেই সব বলেছিল। তাই এবার নিজেকে কিছুটা শান্ত করে সে বললো,

‘তাও যতোই হোক, তুমি তো আজ অনেক দিন পর আবার স্কুটি চালাচ্ছো তাই না? তাই প্রথম দিনই এইভাবে এত দূরে চলে আসা ঠিক হয়নি। আচ্ছা যাকগে এসে যখন পড়েছো এখন তো আর কিছু বলেও লাভ নেই। এখন কি বাড়ি ফিরছিলে?’

মিথি মুখ কালো করে বললো,

‘জ্বি।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে বাড়ি যাও। আমিও এখন বাসায় চলে যাব।’

মিথি তখন একহাতের নখ দিয়ে অন্য হাতের নখ খোঁচাতে খোঁচাতে মিহি কন্ঠে বললো,

‘আপনাকে একদিন আমি আমার স্কুটি তে চড়াবো। আপনি পেছনে বসবেন আর আমি সামনে বসে স্কুটি চালাব। অনেক ঘুরবো সেদিন, ঠিক আছে?’

নৈরিথ হাসে। শব্দহীন নিরব হাসি। তবে সেই হাসিতেই উপচে পড়ছে তার একরাশ প্রশান্তি। কোমল কন্ঠে সে বলে,

‘ঠিক আছে। আমার এই ব্যস্তময় জীবনের একটা দিন না হয় আমি তোমার নামে লিখে দিব। সেদিন যত খুশি আমাকে নিয়ে ঘুরো। কিন্তু এর আগে কখনও আর এই স্কুটি নিয়ে এত দূর আসবে না। একটা ছোট ভুল কিন্ত পুরো জীবন কে এলোমেলো করে দিতে পারে। তাই সবসময় সাবধানে থাকবে।’

মিথি খুশি হলো খুব। উচ্ছাস নিয়ে বললো,

‘ঠিক আছে। আর বের হবো না। তবে আপনাকেও তাড়াতাড়ি সময় বের করতে হবে। আমি এত অপেক্ষা করতে পারবো না কিন্তু।’

‘আচ্ছা, খুব তাড়াতাড়িই সেই সময় পেয়ে যাবে তুমি। এখন বাড়ি যাও। আর হ্যাঁ, একদম কম স্পিডে আর সাইডে সাইডে চালিয়ে যাবে। একদম কোনো গাড়ী কে অভারটেক করতে যাবে না। বুঝেছো?’

মিথি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। তারপর যে যার মতো গাড়িতে গিয়ে বসল। স্কুটি সাথে না আনলে হয়তো নৈরিথই তাকে ড্রপ করে আসতো। কিন্তু এখন এই স্কুটির জন্য সেটা সম্ভব হচ্ছে না। মিথি তার স্কুটি নিয়ে রওনা দিল। নৈরিথ গাড়ি স্টার্ট করে সামনে আগালেও মনটা অস্থির হয়ে উঠল তার। গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল সে। মিথি যে পথে গিয়েছে সেই পথেই আবার ছুটল। কিছুটা সামনে যেতেই মিথির স্কুটি টা দেখতে পেল সে। তারপর নৈরিথ তার গাড়ির স্পিড কমিয়ে মিথির স্কুটির পেছন পেছন যেতে লাগল। আসলে সে মিথিকে এখন একা ছাড়তে পারছিল না। মন সাঁই দিচ্ছিল না তার। তাই এখন মনের অস্থিরতা কমাতেই একই পথে ছুটল সেও।

চলবে..

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৮.
~
তিন দিন ধরে টানা বৃষ্টি। প্রকৃতি যেন এই এক নতুন রূপে মেতে উঠেছে। গ্রীষ্মের রেশ সবেই শেষ হলো। প্রকৃতি জুড়ে শুরু হলো আষাঢ়ি কান্না। শহরের পিচঢালা রাস্তাগুলো বৃষ্টির পানিতে চকচক করছে। আবার অনেক জায়গায় জমেছে ভাঙা রাস্তার গর্তে পানি। বৃক্ষ লতাগুলো সবুজে সবুজে মেলা বসিয়েছে। চারদিকের আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। দক্ষিণা ঠান্ডা বাতাস বইছে ক্ষণে ক্ষণে।
বৃষ্টি বরাবরই মিথির পছন্দ হলেও আজ তার ভালো লাগছে না। এক লাগা তিন দিন বৃষ্টিতে চারদিক যেন কেমন শ্যাত শ্যাতে হয়ে আছে। গুমোট হয়ে আছে পুরো পরিবেশ। আজ নৈরিথের সাথে দেখা করার কথা ছিল কিন্তু এই বৃষ্টির কারণে সেটাও সম্ভব না। মিথি তার বিষন্ন মন নিয়ে বারান্দায় বসে আছে। বৃষ্টির আবছা এসে লাগছে তার গায়ে। চোখে মুখে ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি মাখানো। ভালো লাগছে না কিছুই। সিফাতও গ্রামে চলে গিয়েছে সে কবেই। যা কথা হয় ঐ একটু আধটু ম্যাসেজে। নেহা’টা আজকাল তার রিলেশন নিয়ে খুব টেনশনে আছে। বাড়ির সবাই ইতিমধ্যে সব মেনে নিলেও বেঁকে বসেছে নৈরিথ। সে অযথায় ঝামেলা পাকাচ্ছে। ঐ ছেলে কে নাকি তার পছন্দ না। এই নিয়ে মিথিও খুব রাগ দেখাচ্ছে তার সাথে। ভেবেছিলো আজ নৈরিথের সাথে দেখা করে তাকে একটু বোঝাবে, কিন্তু মনে তো হচ্ছে না সেটা আর পারবে বলে। আকাশের যা অবস্থা!

ফোন এল। নেহার নাম্বার। মিথি কলটা রিসিভ করলো। নেহার বিষন্ন কন্ঠখানা শুনতে পেল।

‘দোস্ত, ভাই কে এখনও কনভিন্স করতে পারছি না। ভাই কোনো ভাবেই সাদ কে মেনে নিচ্ছে না। কি করবো এখন? ঐদিকে সাদের মা বাবা এক পায়ে রাজি আমাকে তাদের বাড়ির বউ করার জন্য। বল না দোস্ত, কি করবো এখন আমি?’

মিথির চুপচাপ শুনল সব। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বললো,

‘এত টেনশন করিস না দোস্ত। আমি আছি তো। আমি বোঝাব নৈরিথকে।’

নেহা কান্নার সুরে বলে,

‘ভাই যদি তোর কথা না শুনে?’

‘শুনবে না মানে? ও শুনবে ওর..না না আমার শ্বশুর তো অলরেডি শুনে নিয়েছে। আরে দোস্ত, প্যারা নিস না। আমি আছি কি করতে, আমি নিজে তোদের বিয়ে দিব। তোর ভাই যদি ভিলেনগিরি করতে আসে না তবে এক ঘুষি মেরে তার নাক ফাটিয়ে দেব।’

নেহা নাক টেনে বললো,

‘হ্যাঁ, এখন তুই’ই আমার শেষ ভরসা। প্লীজ দোস্ত ভাই কে বোঝা। আমি কিন্তু সাদ কে না পেলে মরে যাব।’

মিথি ধমক দিল। বললো,

‘বাংলা সিনেমার ডায়লগ বন্ধ কর। বললাম তো সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। এখন রাখ তুই। আমি তোর ভাই কে কল দিচ্ছি।’

নেহার কল টা কেটে দিয়ে মিথি নৈরিথ কে কল লাগায়। কল কেটে দিয়ে সে আবার কল ব্যাক করে। মিথি সালাম দেয়। নৈরিথ তার জবাব দিয়ে বলে উঠে,

‘বৃষ্টি কমেনি, এখন আর কষ্ট করে বের হইও না। এই বৃষ্টি তে ঠান্ডা লাগতে পারে।’

আহারে কত কেয়ার। মিথি বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নেই। ক্ষীণ সুরে বলে,

‘কি করছেন?’

‘এই তো একটা ফাইল নিয়ে বসেছি। সামনে একটা প্রেজেন্টেশন আছে ঐটা কমপ্লিট করতে হবে।’

মিথি বিরক্তির সুরে বলে,

‘প্রেজেন্টেশন আর মিটিং ছাড়া আপনি আর কিছু বুঝেন না না? সারাদিন খালি মিটিং আর প্রেজেন্টেশন। এদিকে যে উনার বউ উনাকে না দেখতে পেয়ে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে সেদিকে উনার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।’

নৈরিথ আধশোয়া অবস্থায় ছিল এতক্ষণ। মিথির কথা শুনে সোজা হয়ে বসল। তারপর ফাইল টা বন্ধ করে হেয়ালির সুরে বললো,

‘আমি তো শুনেছি মানুষ না খেতে পেয়ে শুকিয়ে যায় কিন্তু এখানে তো দেখছি উল্টো, তুমি আমাকে দেখতে না পেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছো? কিভাবে পসিবল বলতো? আমাকে দেখতে পেলে কি তোমার পেট ভরতো নাকি?’

মিথি মুচকি হেসে বললো,

‘পেট না ভরলেও মন তো ভরতো। আর আমার তাতেই হতো। কিন্তু এখন তো তাও হচ্ছে না।’

নৈরিথ মৃদু হাসে। বলে,

‘ঠিক আছে, কাল যদি বৃষ্টি না থাকে তবে কাল তোমার মন ভরাবো। বিকেলে স্কুটি টা নিয়ে বেরিও।’

মিথি এইটুকু শুনেই খুশিতে লাফিয়ে উঠল। বললো,

‘ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি তো আজ তবে মনে প্রাণে দোয়া করবো যেন কাল বৃষ্টি না থাকে।’

নৈরিথও মুচকি হাসে। মেয়েটা অল্পতেই কত খুশি হতে পারে। তার সঙ্গ টা যে মিথি খুব করে চায় সেটা সে বোঝে। কিন্তু অফিসের এই এত এত কাজের চাপে এই সামান্য জিনিস টাই সে মিথি কে দিয়ে উঠতে পারে না। তবে যদি আবার একটু খানি সময় সে তাকে দেওয়ার কথা বলে তাতেই যেন মিথি হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে যায়। এখন তার মনে হয়, ভাগ্যিস মিথি তার জীবনে এসেছিল। নয়তো তার এই অন্ধকার জীবনে হয়তো কখনোই সে আর ভালোবাসার দেখা পেত না।
.
.
সাদের ব্যাপারে এখনই মিথি নৈরিথ কে কিছু বলে না। কালই একেবারে দেখা হওয়ার পর সব বলবে। তাই অন্য প্রসঙ্গে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তারা। কথার শেষ পর্যায়ে এসে মিথি হঠাৎ বলে,

‘জানেন তো আপনি না খুব আনরোমান্টিক।’

নৈরিথ ব্রু কুঁচকে বললো,

‘হঠাৎ আমাকে আনরোমান্টিক কেন মনে হলো?’

মিথি হালকা অভিমানের সুরে বলে,

‘অন্যসব ছেলেরা কি সুন্দর তাদের বউদের সাথে কথা বলা শেষে তাদের আই লাভ ইউ বলে কল কাটে। কিন্তু, আপনি আজ পর্যন্ত আমাকে একবারও আই লাভ ইউ বলেন নি। আই লাভ ইউ তো দূরে থাক একটু ভালোবেসে কথাও বলেন নি। কিছু হলেই ধমকা ধমকি আর না হয় হ্যালো হাই বাই বাই বলেই কল কেটে দিয়েছেন। যেন মনটার মধ্যে বিন্দুমাত্র কোনো ফিলিংস নেই।’

নৈরিথ ইতস্তত হলো খুব। সে কি আসলেই খুব আনরোমান্টিক? সত্যিই তো বিয়ে হলো দু মাস হয়ে গেছে অথচ মেয়েটাকে এখনও আই লাভ ইউ বলা হলো না। আচ্ছা, এটা কি ঘোর কোনো অন্যায় করে ফেলেছে সে? তবে কি সে আদর্শ স্বামী হতে পারলো না? একজন ভালো প্রেমিক পুরুষও হতে পারলো না? জীবন তো তবে তার ব্যর্থ, একেবারেই ব্যর্থ। হা হুতাশ করলো মনে মনে। নিজেকে নিজেই ধিক্কার জানাল। হ্যাঁ, এটা তার ভীষণ অন্যায় হয়েছে। এখনই সেই অন্যায়ের প্রায়াশ্চিত্ত তাকে করতে হবে। এই বলে গলা ঝাড়ল নৈরিথ। মোলায়েম কন্ঠে বললো,

‘আচ্ছা, এখন কি আমাকে আই লাভ ইউ বলতে হবে? আই মিন আমি যে খুব রোমান্টিক সেটা প্রুভ করতে গেলে দিনে আমাকে ঠিক কয়বার আই লাভ ইউ বলতে হবে বলতো? চার পাঁচ বার নাকি দশ বারো বার?’

মিথি তখন কপট রাগ দেখিয়ে জবাবে বললো,

‘মজা করছেন আমাকে নিয়ে। যান লাগবে আপনার আই লাভ ইউ বলা। আপনি থাকুন আপনার মত। আমি আর আপনাকে কলই দেব না।’

নৈরিথ হেসে বলে,

‘আহারে, বাচ্চা মেয়েটা আবারও রেগে যাচ্ছে। শোনো মেয়ে, আমি না আরো অনেক আগেই তোমার নেশায় আটকে গিয়েছিলাম। এখন যত দিন যাচ্ছে এই নেশা তত বাড়ছে।তুমি বোঝো একজন নেশাগ্রস্ত মানুষ ঠিক কি পরিমান উন্মাদ হয়? তার নেশা টা যখন মাত্রাতিরক্ত হয়ে যায় তখন সে পুরোপুরি পাগল হয়ে পড়ে। পারবে তো তখন আমার সেই পাগলামী টা সামলাতে। তখন যেন হাঁপিয়ে না উঠো। তাই আগে থেকে সাবধান করছি। বি প্রিপেয়ার ইউরসেল্ফ, ডেয়ার।’

নৈরিথের ঠান্ডা কন্ঠস্বর, স্তব্ধ হয়ে গেল মিথি। সামান্য কথাতেই হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে তার। উফফ! মানুষ টা অদ্ভুত । এমনিতে কিছু বলে না বলে না কিন্তু একবার শুরু করলে আর হার্ট অ্যাটাক না করিয়ে ছাড়ে না।
.
জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে মিথি। এই হয়েছে তার এক বাজে অভ্যাস নৈরিথের মুখে একটু কিছু শুনলেই বুকের ধুকধুকানি বেড়ে যায়। এই বুক নিয়েই আবার কত বড়ো বড়ো কথা! নিজের উপর নিজেই চরম লেভেলের বিরক্ত সে। নৈরিথ অনেকক্ষণ যাবত নিশ্চুপ। মিথিও তাই। নৈরিথ সময় নিয়ে বললো,

‘আমি শুধু একটাই জিনিস ভাবি জানো তো, সামান্য কথাই যেই মেয়েকে এতটা দূর্বল করতে পারে সেই মেয়ে কে আমি কিভাবে বাসর রাতে কনভিন্স করবো। ইশ, মনে তো হচ্ছে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হবে।’

মিথি এবার অনেক বেশি লজ্জা পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিয়ে বুকটা চেপে ধরল। আরে ভাই, এইভাবে কেউ কথা বলে? বাচ্চা মেয়েটা মরে যাবে না। সত্যিই এই ছেলে ভয়ানক! সহজেই তার মুখ খুলতে দেওয়া যাবে না। নয়তো এই ভয়ংকর সব কথাগুলো শোনাতে শোনাতে কবে যে তাকে মেরে ফেলবে কে জানে..?

চলবে..