তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব-৩৯

0
630

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৯.
~
অন্যদিনের তুলনায় আজকের বিকেল টা একটু বেশিই সুন্দর। বৃষ্টি নেই। তবে আকাশ মেঘলা। রোদের আবছা কিছু আলো দেখা যাচ্ছে। আকাশের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে দলা পাকানো মেঘগুলো। যেন তারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ ভালোবাসা। ভেজা স্যাঁতসেঁতে রাস্তায় মৃদু বেগে ছুটে চলছে মিথির স্কুটি টা। পেছনে বসেছে নৈরিথ। মিথির মনের ভেতরকার অনুভুতি টা এই মুহুর্তে সে ঠিক প্রকাশ করতে পারছে না। কোনো ভাষা জানা নেই তার। কিভাবে বলবে মন তার কেমন করছে। সে নিজেও তো বুঝতে পারছে না। নৈরিথেরও তার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু ঘটছে না। এইভাবে বউয়ের পেছনে বসে স্কুটিতে করে কয়জন বর ঘুরেছে সেটা ঠিক তার জানা নেই। রাস্তার কিছু মানুষ বারবার বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। নৈরিথ অবাক হয় তাতে। যেন এটা কোনো অন্যায়। সত্যিই এই সমাজের মানুষগুলো বড্ড অদ্ভুত।
.
শহরের ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে তারা যায় একটা নিরব জায়গায়। যেখানে কোনো কোলাহল নেই, কোনো হৈ চৈ নেই। যেখানে নিশ্বাস নিলেই কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গন্ধ পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে নির্মল বাতাসে মিষ্টি ফুলের সুবাস।
.
স্কুটি টা একপাশে রেখে মিথি নৈরিথের পাশে এসে দাঁড়ায়। নৈরিথ তার সামনে থাকা দীঘি টার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দীঘি টা সুন্দর। তার পানিটাও পরিষ্কার। চারদিকের নারকেল গাছে আরো বেশি সুন্দর লাগছে তাকে। মিথি চোখ বুলিয়ে আশে পাশের সবকিছু দেখল। তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পানির কাছে গেল। পা ভিজিয়ে একটা সিঁড়িতে বসে পড়ল। ভালো লাগছে। পেছন ফেরে নৈরিথকেও হাতের ইশারা দিয়ে ডাকে। নৈরিথ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মিথির পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘শাড়ি টা ভিজছে।’

মিথি গুরুত্ব দিল না। বললো,

‘ভিজুক।’

নৈরিথ প্রতিত্যুর করলো না। খানিক চুপ থেকে বললো,

‘শাড়ি পরে স্কুটি চালাতে অসুবিধা হয়নি? আজকে শাড়ি পরার কি দরকার ছিল?’

মিথি মাথা উপরে করে নৈরিথের দিকে তাকাল। থমথমে গলায় বললো,

‘আপনার জন্য পরেছিলাম। কিন্তু আপনার যেহেতু পছন্দ না তাহলে আর পরবো না।’

নৈরিথ কপাল কুঁচকে ফেলল। ঝটপট জবাবে বললো,

‘কে বললো পছন্দ না? আমি তো শুধু তোমার অসুবিধার কথা ভেবে বলছিলাম। সেটাতেও তুমি মন খারাপ করে ফেললে? এত মন খারাপ করলে কি করে হবে বলতো?’

মিথি মুখ ঘুরিয়ে নিল। দীঘির পানিতে গভীর দৃষ্টি রাখল। অতঃপর ফিচেল গলায় বললো,

‘আমি মন খারাপ করলেই বা কি? আপনার তো আর তাতে কিছু যায় আসে না।’

নৈরিথ নিশ্বাস নিল। নরম সুরে বললো,

‘তোমাকে আমি সবকিছু মুখে বলে বোঝাতে পারবো না মিথি। সবাই সবটা প্রকাশ করতে পারে না। আমি জানি তোমার হয়তো আমার প্রতি অনেক অভিমান আছে। আমি তো এমনই। তুমিও তো জানো। একসময় তো আমি ভালোবাসাতেই ভয় পেতাম। কিন্তু, এখন ভালোবাসতে শিখেছি। তুমি সেটা শিখেয়েছ আমায়। তুমি আমার জীবনটা কে বদলে দিয়েছ মিথি। এই অনুভূতিহীন মানুষটাকে আবার অনুভূতি কে আকড়ে ধরে বাঁচতে শিখিয়েছ। তবে এখনও আমার মাঝে অনেক বদলের বাকি। আমাকে কিছু সময় দাও, একদিন তোমার সমস্ত অভিযোগ আমি মিটিয়ে দিব। শুধু কিছুটা সময় দাও আমায়..!’

নৈরিথ কথাটা শেষ করে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মিথি বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। নৈরিথকে জড়িয়ে ধরলো শক্তভাবে। নৈরিথের বুকে নিজের মাথাটা চেপে ধরল। নৈরিথ দুহাতের বাহুডোরে আগলে নিল তাকে। মিথি প্রাণ ভরে নৈরিথের শরীরের ঘ্রাণ নিল। তারপর ক্ষীণ সুরে বললো,

‘আপনি আমাকে যতটুকু দিয়েছেন যা দিয়েছেন আমি তাতেই খুশি। আপনাকে বদলাতে হবে না। আমার মন খারাপের কারণ কখনোই আপনি না। আমি জানি আপনি আমায় ভালোবাসেন। হয়তো অন্য সবার মতো হাজার বার মুখে বলে সেটা প্রকাশ করতে পারেন না। ঠিক আছে, লাগবে না। আপনি তো মনে মনে আমায় ভালোবাসেন, তাতেই হবে। মুখে বলতে হবে না। আমি এমনিতেই বুঝে নিব।’

নৈরিথ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মিথিকে। নিরবে দাঁড়িয়ে থাকল অনেকক্ষণ। মিথি এবার একটু নড়ে উঠতেই নৈরিথ তার হাতের বাঁধন আরো শক্ত করলো। মিথি স্মিত সুরে বললো,

‘কি হলো?’

‘নড়ছো কেন?’

‘আর কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকব। ছাড়ুন।’

নৈরিথ ছাড়ল না। বিরক্ত কন্ঠে বললো,

‘আমি যতক্ষণ না চাইব ততক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।’

মিথি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,

‘কি বলছেন? মানুষ দেখবে, ছাড়ুন তো।’

‘আজব! তুমি এখানে মানুষ কোথায় দেখছ? এখানের আশে পাশে কোথাও কোনো মানুষ নেই। আর থাকলেই বা কি? আমি আমার বউকে যত খুশি জড়িয়ে ধরব, মানুষের কি তাতে?’

নৈরিথের মৃদু প্রতিবাদের সুরে খানিকটা থমকে যায় মিথি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবারও তার মোচড়া-মোচড়ি শুরু হয়ে যায়।

‘আরে, নৈরিথ ছাড়ুন না। মাঝে মধ্যে আপনার কি হয় বলুন তো? এমনিতে তো সবসময় খুব ভদ্র থাকেন কিন্তু হঠাৎই এমন অভদ্র হয়ে উঠেন কেন?’

নৈরিথ মেকি রাগ দেখিয়ে বললো,

‘অভদ্রতার কি দেখলে? আমি কি সবার সামনে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি? এখানে কেউ নেই, তাই। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো আজ ওয়েদার টাও ভীষণ রোমান্টিক। খেয়াল করেছো সেটা?’

মিথি এবার মাথা উঁচু করে তাকাল। চোখ জোড়া ছোট ছোট করে সন্দিহান কন্ঠে বললো,

‘আপনি আবার কবে থেকে এসব জিনিস খেয়াল করতে শুরু করেছেন, হু?’

নৈরিথ বাঁকা হাসে। বলে,

‘যবে থেকে তোমার প্রেমে পড়েছি।’

মিথি মাথা নিচু করে হাসল। হঠাৎ তার মনে পড়ল নেহার কথা। নৈরিথের মন টা এখন ভালো আছে। এখনই তাকে সাদের ব্যাপারে কথা বলা উচিত। কিন্তু আবার একটু একটু ভয়ও হচ্ছে। উনার তো আবার মুড চেঞ্জ হতে বেশি সময় লাগে না। যদি আবার রেগে টেগে যায়? কিন্তু, না বলেও উপায় নেই। ঐদিকে নেহা টা খুব কষ্ট পাচ্ছে। না তাকে বলতে হবেই। আর এখনি বলতে হবে। এছাড়া হয়তো পরে আর সময় নাও পেতে পারে। মিথি জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর সে নৈরিথের শার্টের বোতামটা আঙ্গুল দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে আহ্লাদীর সুরে বললো,

‘আপনার কাছে একটা জিনিস চাইব?’

নৈরিথ মিথির কপালের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বললো,

‘হ্যাঁ, বলো কি লাগবে?’

মিথি মিটমিট করে নৈরিথের দিকে তাকাল। ক্ষীণ সুরে বললো,

‘আপনি আবার রেগে যাবেন না তো?’

নৈরিথ গভীর দৃষ্টিতে মিথির মুখের দিকে তাকাল। বললো,

‘না, বলো?’

মিথি প্রথমে ঢোক গিলল। তারপর জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভেজাল। আস্তে করে বললো,

‘নেহার সাথে সাদ ভাইয়ার বিয়েতে আপনি মত দিয়ে দিন প্লীজ।’

নৈরিথ তাকিয়ে রইল। কোনো জবাব দিল না। হঠাৎই মিথি কিছু অনুভব করলো। তার উদরে উষ্ণ কিছুর স্পর্শ। কেঁপে উঠল মিথি। নৈরিথের শার্ট টা খামছে ধরলো। নৈরিথ গম্ভীর সুরে বললো,

‘সাদ কে আমার পছন্দ না মিথি। ওকে আমি চিনি। ও একসময় খুব বাজে ছেলে ছিল। এর আগেও অনেক প্রেম করেছে। তবে মাঝখানে আর ওকে দেখেনি। তারপর সেদিন আবার ওকে দেখে আমি অবাক হই খুব। চেঞ্জ হয়েছে অনেক। কিন্তু তাও আগের ঘটনাগুলো এখনও আমার মাথায় আছে। আমি আমার বোনকে ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দিব না।’

এই বলে সে মিথিকে ছেড়ে দাঁড়াল। মিথি জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলল। শাড়িটা ভালোভাবে টেনে পেটের অংশ টা ঢেকে নিল। তারপর নৈরিথের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সুরে বললো,

‘মানুষ তো সবসময় এক রকম থাকে না। অতীতে তো অনেকেই অনেক কিছু করে। অতীত ধরে বসে থেকে বর্তমান কেন নষ্ট করবেন। সাদ ভাইয়া এখন আর আগের মতো নেই। উনি কিন্তু নেহার কাছ থেকে কোনোকিছু লুকাননি। নেহাকে সব বলেছে। উনি আগে কেমন ছিলেন, কি করতেন, সব। উনি যদি উনার ভালোবাসায় সৎ না হতেন তাহলে কি এসব বলতেন, বলুন? আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো নেহা উনাকে খুব ভালোবাসে। খুব কষ্ট পাচ্ছে মেয়ে টা। প্লীজ নৈরিথ, মেনে নিন না।’

নৈরিথ পাত্তা দিল না মিথির কথায়। হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,

‘এবার বাড়ি ফেরা দরকার। চলো।’

মিথি মুখ ঘুরিয়ে নিল। রাগ দেখিয়ে বললো,

‘যাবো না আমি।’

নৈরিথ বললো,

‘আচ্ছা চলো তবে অন্য কোথাও যাই।’

‘না।’

নৈরিথ এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,

‘এদিকে তেমন মানুষ নেই। আর সন্ধ্যাও নামছে। আমার মনে হচ্ছে না জায়াগাটা আমাদের জন্য খুব একটা সেইফ হবে। তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াই বেটার।’

মিথি এখনও আগের মতোই গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নৈরিথ তার হাত ধরে বললো,

‘কি হলো, চলো?

মিথি ঠোঁট উল্টে অভিমান করে বললো,

‘প্লীজ নৈরিথ, আমার কথাটা শুনুন। সাদ ভাইয়া কে মেনে নিন প্লীজ।’

নৈরিথ চোখ বুজে নিশ্বাস ফেলল। বললো,

‘ঠিক আছে, এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন আপাতত চলো এখান থেকে।’

মিথি তাও না নড়াতে নৈরিথ তার হাত ধরে টেনে টেনে স্কুটি পর্যন্ত নিয়ে গেল। তারপর বললো,

‘নাও স্টার্ট দাও।’

মিথি মুখ কালো করে বলে,

‘পারবো না।’

বলেই মেয়েটা আবারও গাল ফুলালো। নৈরিথ বুকের উপর হাত দুটো ভাজ করে অনেকক্ষণ নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে রইল তার দিকে। হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি পরেছে মেয়েটা। এই স্নিগ্ধ পরিবেশে তাকেও খুব স্নিগ্ধ লাগছে। খোলা চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হচ্ছে। সুন্দর লাগছে মেয়েটা কে। সেই সৌন্দর্য কে আরো বাড়িয়ে দিল তার ফুলিয়ে রাখা গালগুলো। নৈরিথ তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। হয়তো এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারবে না। মেয়েটার নেশা যেন তাকে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। আর না পেরে নৈরিথ আচমকাই মিথিকে টেনে তার খুব কাছ নিয়ে এল। হঠাৎই ঠোঁট জোড়া দিয়ে চেপে ধরলো মিথির কোমল ওষ্ঠাধর। প্রথমেই যেন কিছু বুঝে উঠতে পারলো না মিথি। তার মস্তিষ্ক তাকে সঠিক তথ্য জানান দিতে দিতে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। ততক্ষণে তার অধরজোড়া নৈরিথ পুরোপুরি তার আয়ত্তে নিয়ে নিল। স্তব্ধ হয়ে গেল মিথি। কিছু সময়ের জন্য থমকে গেল সে। চোখ বুজে কেবল একটাই কথা ভাবল,

‘আদৌ এটা বাস্তব তো? নাকি কেবল স্বপ্ন?’

চলবে..