তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
1000

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৪০.(অন্তিম পর্ব)
~
ঠোঁটে হাত দিয়ে আয়নার দিকে অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আছে মিথি। এখনও তার কাছে সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সেই মুহুর্তের কথা মনে পড়তেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে যেন। নৈরিথের প্রথম ছোঁয়া, স্মৃতিতে আটকে থাকবে সারাজীবন। লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল তখন। মুহুর্ত টা অবর্ণনীয়। এখনও মিথি লজ্জা পাচ্ছে। বাসায় আসার পর বারবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অধর জোড়া দেখছে। শুধু দেখছে বললে ভুল হবে, যতবার দেখছে ততবারই লজ্জায় লাল হচ্ছে। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে সে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করছে। কিন্তু, পারছে কই? লজ্জা তো তার আর পিছু ছাড়ছে না।
.
.
বর্ষার শেষ সময়। বৃষ্টির বেগ কমেছে কিছুটা। আকাশে শুভ্র সাদা মেঘ। দূরের মাঠগুলোতে কাশফুলগুলো মাথা চেরে উঠছে। শরৎ আসবে বলে..।
.
বাড়িতে আজ হৈ চৈ। নৈরিথ ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটছে। তবে মাঝে মাঝে আবার একটু বিরতি নিয়ে তার প্রেয়সী কে দেখতে ভুলছে না যেন। মিথিও ভীষণ ব্যস্ত, নেহা কে সাজাতে। বাড়িতে মেহমান আসছে। নতুন আত্মীয়, সম্বন্ধ পাকা করবে। নেহার মুখের মিষ্টি হাসিটা যেন আজ তার পিছুই ছাড়ছে না। ভালোবাসার পূর্ণতায় যে সুখ রয়েছে সেই সুখ আর অন্য কিছুতে নেই। মিথিও আজ ভীষণ খুশি। অবশেষে সবকিছু ভালো ভাবে হচ্ছে। নেহা আর নৈরিথ যেখানে খুশি সেখানে মিথির খুশিও অনিবার্য। নেহাকে সাজিয়ে মাত্রই নৈরিথের রুমে এসেছে মিথি। এই বাড়িতে এর আগে অনেকবার এলেও এই রুমটাতে কখনো আসা হয়নি তার। যেন একটা সুখের খনি এই রুমটা। আর কিছুদিন পরই সেও এই রুমটার ভাগীদার হয়ে যাবে। উত্তরের দেয়ালটায় নৈরিথের বেশ বড়ো একটা ছবি টানানো। মিথি বেশ মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখছে। হয়তো তার কলেজ লাইফের ছবি এটা। ইশ, সেসময়ও মারাত্মক ছিল। না জানি তখন কত মেয়ে তাকে প্রপোস করেছিল। মিথির হিংসে হচ্ছে। আবার ভালোও লাগছে। তার বর টা ডেশিং। একেবারে তাকিয়ে থাকার মতো। মনে মনে খুব খুশি হলো সে। তাকিয়ে রইল গভীর ভাবে। ঠিক সেই সময়ই সে কারোর উপস্থিতি টের পেল। অনুভব করলো সেই মানুষটা তার খুব কাছে। এতটাই কাছে যে তার উষ্ণ শ্বাস প্রশ্বাসগুলো ইতিমধ্যেই তার মধ্যকার ধুকধুকানি বাড়িয়ে দিয়েছে। মিথি পেছন ফিরে তাকাতেই নৈরিথ তার কোমর ছড়িয়ে ধরল। মিথি চমকে গেল। অপ্রস্তুত হেসে বললো,

‘আপনি?’

নৈরিথে বাঁকা হেসে বললো,
‘রুম টা যেহেতু আবার সেহেতু আমিই থাকব, তাই না?’

মিথি বোকার মতো মাথা নাড়াল। নৈরিথ তখন তার কোমর টা আরো শক্ত করে জড়িয়ে তার কিছুটা কাছে নিয়ে এল। ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠল,

‘সুন্দর লাগছে।’

মিথি যেন নিশ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছে। সামন্য সুন্দর বলাতেই দম আটকে আসছে তার। এর থেকে বেশি কিছু বললে হয়তো সে মরেই যাবে। মিথি কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে তাকাল। মৃদু সুরে বললো,

‘আপনাকেও।’

নৈরিথ হাসল। বললো,

‘ফর্মালিটি দেখাচ্ছো?’

মিথি অনুনয়ের সুরে বললো,

‘না না সত্যিই সুন্দর লাগছে। আর সত্যি বলতে আপনাকে বরাবরই সুন্দর লাগে।’

মিথি কথাটা শেষ করে মাথা নিচু করে ফেলল। ছোট চুলগুলো তখন তার কপালে এসে পড়ল। নৈরিথ সেই চুলগুলো যত্ন করে কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বললো,

‘যে যাকে ভালোবাসে, তার চোখে সে বরাবরই সুন্দর থাকে। যেমন আমার চোখে তুমি আর তোমার চোখে আমি।’

মিথি তখন তাকাল। বললো,

‘এই ছবিটাতে আপনাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। এটা কি আপনার কলেজ লাইফের ছবি?’

নৈরিথ মিথির পেছনের ছবিটার দিকে তাকাল। বললো,

‘হ্যাঁ, কলেজে থাকা অবস্থায় একবার পিকনিকে গিয়েছিলাম সেখানে গিয়েই ছবিটা তোলা। তবে ছবিটা আমার এক ফ্রেন্ড তুলেছিল। তার কাছেই ছবিটা ছিল। তার পরের বছর আবার আমার জন্মদিনে সে আমাকে এটা ফ্রেম করে গিফ্ট করে। বেশ পছন্দ হয়েছিল, তাই এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছি। তবে ওকে রাখতে পারেনি। তার দুবছর পরেই একটা কার এক্সিডেন্টে ও মারা যায়। আর জানতো তারপর থেকে আজ অবধি আমার আর কোনো ফ্রেন্ড হয়নি। আমি বানায়নি। ওর জায়গাটা যে আমি আর কাউকে দিতে পারতাম না।’

নৈরিথ থমকে যায়। নিশ্বাস নেয় ঘন ঘন। মিথি নিষ্পলক চোখে চেয়ে থাকে তার মুখপানে। নৈরিথের চোখের কোণটা যেন টলমল করছে। সে কি কেঁদে ফেলবে? কিন্তু, ছেলেদের তো কাঁদতে নেই। নৈরিথও তাই কাঁদল না। বরং হাসল। বললো,

‘নিচে চলো, মেহমানরা এখনই চলে আসবেন।’

এইবলে নৈরিথ মিথিকে ছেড়ে নিচে চলে যায়। মিথি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে, ‘ইশ, নৈরিথও যদি তার মতো একটু কাঁদতে পারতো। তাহলে হয়তো তার মনটাও হালকা হতো। কিন্তু আফসোস! ছেলেদের চোখে মেঘ জমলেও সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝড়ে না।’
.
.
সাদ তার পুরো পরিবার নিয়ে নেহাদের বাসায় এসেছে। সাদরে নৈরিথ তাদের বরণ করে নিল। নেহার মা বাবা নতুন কুটুমদের আপ্যায়নে ব্যতি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মিথি ব্যস্ত হয়ে পড়ল নাস্তার আয়োজনে। কিছুটা সময় যাওয়ার পর সাদের মা বাবা এবার পাত্রী দেখতে চাইলেন। মিথি তখন সেখান থেকে উঠে নেহার রুমে এল তাকে নিতে। মিথিকে দেখা মাত্রই নেহা মাথায় কাপড় টা ভালো করে টেনে দিয়ে বললো,

‘আমাকে ডেকেছে? চল চল।’

মিথি ব্রু কুঁচকে বললো,

‘এই মেয়ে তোর তো দেখছি খুব তাড়া। আজব তো! নিচে তোর হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজন আছে। তোকে দেখতে এসেছেন উনারা। কই একটু লজ্জা পাবি, লাজুক লাজুক হাসি দিবি তা না করে তুই চল চল করছিস কেন? এত কিসের তাড়া তোর?’

নেহা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,

‘আরে দোস্ত, বুঝোনা কেন? নিচে আমার কুটুস টা আমার জন্য অপেক্ষা করছে না। ওকে দেখার জন্যই তো আমার আর তর সইছে না।’

মিথি বিরক্ত হয়ে বললো,

‘এই কুটুস টা আবার কে?’

‘উফ, বুঝিস না। আমি সাদের কথা বলছি।’

‘সিরিয়াসলি! টুকুস?’

‘হ্যাঁ, টুকুস। এখন এত কথা না বলে চলতো।’

মিথি জোরে নিশ্বাস ফেলল। নেহাকে আলতো করে ধরে বললো,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চল চল তোর টুকুসের কাছে যাই।’

নেহা কে নিয়ে গিয়ে একটা সোফায় বসালো মিথি। সাদের পাশে। নেহা কে এক পলক দেখেই সাদের হৃদ কম্পন বেড়ে গিয়েছে। কালো রঙের ভারি পাথরের শাড়িতে মারাত্মক লাগছে তাকে। সাদ পারছে না, যেন যেন বারবার তার বেশরম চোখগুলো নেহার দিকেই যাচ্ছে। নেহারও সেইম অবস্থা। না পারছে দেখতে, না পারছে চোখ সরিয়ে রাখতে।
.
অনেক কথাবার্তা হলো। দুই পক্ষেরই সবকিছু পছন্দ হলো। বিয়ের কথাও পাকাপাকি হয়ে গেল। সামনের মাসেই বিয়ে। তার আগে মিথি কে এই বাড়িতে আনতে হবে। আর তারপরই তাদের বিয়ের আয়োজন শুরু হবে।
.
বাতাসে আজ খুশির ঘ্রাণ বইছে। চারদিকে আনন্দের মেলা বসেছে। মিষ্টি নিয়ে হুড়াহুড়ি লেগেছে। নেহা আর সাদ খুশি হয়েছে। খুশি হয়েছে মিথি আর নৈরিথও। তাদের মতো পূর্ণতা পেয়েছে সাদ আর নেহার ভালোবাসাও। নৈরিথের চোখের অনুরাগে মিথি যেভাবে ডুবেছিল নেহার গভীরতায় সাদও সেইভাবে ডুবেছে। পূর্ণতা পেয়েছে দুই জোড়া ভালোবাসা। পূর্ণতা পেয়েছে ‘তুমি’ নামক সত্তাটাও। সত্যিই এই ভালোবাসা টা ‘#তোমাতেই_পরিপূর্ণ’।

___________________সমাপ্ত___________________