তোমার আসক্তিতে আসক্ত পর্ব-০৩

0
408

#তোমার_আসক্তিতে_আসক্ত
#সুবহী_ইসলাম_প্রভা
#পর্ব-০৩

আর্শিকার কথা পাত্তা না দিয়ে রাদাফ একটা অভাবনীয় কাজ করে ফেললো।রাদাফ আর্শিকার কাছে গিয়ে আর্শিকার পেছনের লেহেঙ্গার ওড়নাটা আর্শিকার মাথায় দিয়ে দিলো।আর্শিকা তো রাদাফের এই কাজে অবাক। রাদাফ রাগান্বিত হয়ে আর্শিকার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,

“মিষ্টি দেখলে মাছিরা ভন ভন করবে এটাই স্বাভাবিক তাই মিষ্টির উচিত মাছিদের থেকে নিজের দূরুত্ব বজায় রাখা।”

“মানে?”

রাদাফ বিরক্তি চোখে আর্শিকার বিস্ময় চোখ দেখে,তা দেখে রাদাফ আরও বিরক্ত হয়।কোনো প্রতিউত্তর করে না।আর্শিকার রাদাফের করা আচরণ মনে পড়তেই হাতের আঙুল নাড়াতে নাড়াতে বলে,

“এই আপনার সাহস তো কম না?আমার অনুমতি না নিয়ে আমার ওড়না ধরে টান দিয়ে আবার আমারই মাথায় পড়িয়ে দিয়েছেন।”

আর্শিকার এমন ক্ষিপ্ত রুপ দেখে রাদাফ নিজ মনে মনে বলে,”কই ওই ছেলেগুলো যখন আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলো তখন তো অনুমতির দরকার হয় নি অথচ আমি ভালো কাজ করেছি তাতে অনুমতি লাগবে। রিয়েলি আর সি ম্যাড?”

“দুঃখিত আমার ব্যবহারের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”

রাদাফের কথায় আর্শিকা আর কিছু বলে না। আর্শিকা আবার বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।এবার আর আর্শিকা ঘুমায় না,কখন না কখন আবার তাকে এই ছেলেটা ডাক দেয়। আর্শিকা বাহিরেই তাকিয়ে ছিলো তখনই হটাৎ করে বাস থেমে যায়।আকস্মিক বাস থামায় আর্শিকা কন্ট্রাক্টরের দিকে তাকালে কন্টাক্টর বলে,

“গাড়ির টায়ার পাংচার হইয়া গেছে।গাড়ি আর যাইবো না।”

এতে যাত্রীরা বেশ বিরক্ত হয়।কেউ কেউ বাসওয়ালা আর কন্ট্রাক্টরকে উচ্চ মাত্রায় গা/লি দিতেও শুরু করে। আসতে আসতে সমস্ত যাত্রী বাস থেকে নেমে যায়।আর্শিকা নামতে গেলেই দেখে পাশের ছেলেটা কানে ইয়ারফোন লাগিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।আর্শিকা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায়।

বাহিরে ঝড়ের প্রকোপ বাড়ছে বই কমে নি। বৃষ্টির বেগও তুমুল। এরই মধ্যে এক জোড়া পা সমস্ত বাধা অতিক্রম করে যাচ্ছে।বৃষ্টিতে ভিজে আর্শিকা জুবু জুবু হয়ে গেছে, মুখের সমস্ত সাজ ধুয়ে গেছে।আর্শিকা নিজের ব্যাগটা নিয়ে গহীন জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছে।বৃষ্টির সাথে সাথে আর্শিকার কান্নার বেগটাও যেনো বেড়ে গেলো।আর্শিকা কিছুদুর হেটে আসতেই খপ মেরে বসে পড়লো।আর সহ্য হচ্ছে না আর্শিকার চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো,

“আমি আবারও আমার প্রিয় জিনিস হারিয়ে ফেললাম আম্মু,আবারো।আমি এমন কেনো আম্মু, সবাই আমার কাছ থেকে কেনো হারিয়ে যায় আম্মু?প্রথমে তুমি হারিয়ে গেলে আর এখন জোহা প্রতীকও।আচ্ছা আম্মু জোহা যখন জানতে পারবে ও আমার প্রাক্তনকে বিয়ে করেছে কিভাবে থাকবে আম্মু?আমাকে তো অবিশ্বাস করবে?আমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি আম্মু।এর চেয়ে মৃত্যু অধিক শ্রেয় আম্মু।আমি বাঁচতে চাই আম্মু, বাঁচতে চাইইইইই।”

আর কিছু বলতে পারলো না।মাথাটা ভীষণ ভার লাগছে। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ায় আগেই একটা বলিষ্ট হাতের আয়ত্তে চলে এলো।

✨✨

নিভু নিভু হারিকেনের আলোয় চারিদিক স্পষ্ট না হলেও কিছুটা দেখা সম্ভব হচ্ছে। বাহিরে প্রবল আকার প্রকৃতি তার তেজ বর্ষণ করছে। আর ভিতরে এই কুড়েঘরে রয়েছে এক অবচেতন নারী আর এক তৃষ্ণার্ত চোখ।রাদাফ এক দৃষ্টিতে আর্শিকার পুরো মুখ ফুলে গেছে।চুলগুলো হাটু অব্দি যা এখন ভিজে অবস্থায় পড়ে রয়েছে,মুখে বিধদ্ধতার চিহ্ন,চোখ দু’টো ফুলে রয়েছে হয়তো বেশিক্ষণ কান্নার ফলে।রাদাফ মনে মনে বলছে,

“মেয়েটা কি সত্যিই পাগল?নইলে ওভাবে মাঝ রাস্তায় বসে কাঁদে কেউ?অচেনা জায়গায় একবার বের হতেও কি মেয়েটার ভয় করলা না?খাওয়ার সময় মেয়েটাকে বাহিরে ডেকেছিলাম কই তখন তো বের হয় নি অথচ এখন গভীর রাতে নিজের ব্যাগ পত্র নিয়ে একা একা বের হয়ে গেলো?একবারও কি ভাবলো না ওর সাথে কি কি হতে পারে?আরে পাগলেও তো নিজের ভালো বুঝে অথচ এই মেয়ে বুঝলো না কেনো?আর শেষে কি বলছিলো মেয়েটা,মেয়েটা বাঁচতে চায়?আচ্ছা মেয়েটা কি কোনো কিছু নিয়ে গভীর শোকাহত?”

রাদাফের ভাবনার মধ্যেই সেই নারী চোখ খুলে সজ্ঞানে ফিরে আসে।চারিদিকে তাকিয়ে নিজের স্থানটা ঠিক উপলদ্ধি করতে পারলো না।সামনের ব্যক্তিটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো।

“আপনি? আপনি এখানে?”

“আমি ছাড়া আপনাকে এখানে নিয়ে আসবেই বাহ কে?”

মেয়েটা আনমনে হাসলো কোনো কথার উত্তর দিলো না।রাদাফ একটু চিন্তিত হয়েই ডাকলো,”আর্শিকা?”

আর্শিকার এতোক্ষণে নিজের হুস ফিরলো।রাদাফের দিকে তাকাতেই এক জোড়া তৃষ্ণার্ত চোখ দেখলো।এই তৃষ্ণার্ত চোখ তো সে আগেও দেখেছে তবে কি সে ফিরে এসেছে?না না আর ভাবতে পারছি না,মাথাটা যে বড্ড ধরেছে।আর্শিকা দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরেছে।

“আর্শিকা এনি প্রবলেম?তোমার কি মাথায় ব্যাথা করছে?”

আর্শিকা অবাক চোখে রাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?আমি তো বলি নি?আর আমাকে এখানে কেনো এনেছেন?আনলেনই বাহ কেনো?আমার কি হয়েছিলো?আমি তো মাটিতে পড়ে ছিলাম এখানে এলাম কি করে?আর আমার মাথায়ই বাহ ব্যাথা করছে কেনো?”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলল আর্শিকা।রাদাফ আর্শিকার এতোগুলো প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায়।তারপর শান্ত স্বরে বলে,

“দাঁড়ান দাঁড়ান। এতোগুলা প্রশ্ন একসাথে এন্সার দেই কি করে বলুন তো?এক একটা করে দিচ্ছি।আপনার নাম আমি আপনার ব্যাগ থেকে পেয়েছি।বাস থেকে নামার আগে আপনি আপনার পার্সটা বাসে রেখে এসেছিলেন।ভাগ্যক্রমে আপনি নামার কিচ্ছুক্ষণ পরেই আমার ঘুম ভাঙে আর আমি আপনার পার্স নিয়েই বাস থেকে বেরিয়ে আসি আর রাস্তায় আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাই। ভাগ্যক্রমে আপনি আমার হাতেই জ্ঞান হারান তারপর আপনাকে আমি এই কুড়েঘরে পাজঁকোলে করে নিয়ে এসেছি।আপনাকে এখানে আনার কোনো অসৎ কিংবা সৎ কোন উদ্দেশ্যই আমার নেই। ওভাবে রাস্তায় একটা মেয়েকে আমি ছেড়ে রেখে আসবো এতোটা অমানবিকও আমি নই। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ভিজা আর কান্না করার ফলে আপনার মাথা ব্যাথা করছে।আশা করি আপনি আপনার সব উত্তর যথাযথভাবে পেয়েছেন।”

রাদাফের কথায় আর্শিকা কিছুক্ষণ নিরব থেকে নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে বের হতে গেলেই রাদাফ আর্শিকাকে আটকে দেয়।

“আরে আরে পাগল আপনি? বাহিরে ঝড় হচ্ছে বুঝতে পারছেন না?এই ঝড়ের রাতে বের হয়ে কি ম/রতে চান নাকি?”

“আপনার সাথে এক ঘরে থাকলে সে আমি বেঁচে যাবো তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে।”

আর্শিকার নিলপ্ত জবাবে রাদাফের হাসিসহ অবাক হলেও তা দমন করে আর্শিকার প্রশ্নের জবাব দিলো।

“কেনো আমি বুঝি বাঘ নাকি ভাল্লুক যে আপনি আমার সাথে এক ঘরে থাকতে নিজের জীবন নিয়ে সংশয় জ্ঞাপন করছেন?”

“বাঘ ভাল্লুকের সাথে থাকলেও জীবনটা শুধু যায় কিন্তু পুরুষ মানুষের সাথে থাকলে জীবনের সাথে সাথে অনেক কিছু হারায়।তা নয় কি?”

“যে মানুষটা ঝড় বৃষ্টি রাতে সমস্ত বিপদ অতিক্রম করে আপনার মাথা ঠাইঁয়ের ব্যবস্থা করতে পারে সে মানুষ আর যাই হোক আপনার জীবন বাহ কিছু ছিনিয়ে নিতে পারে এমন নয়?আপনি তার সাথে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। আর এমনিতেই আপনি অসুস্থ তাই ভালো এটাই হবে আপনি আপাতত এখানেই থাকুক।”

আর্শিকা বুঝলো রাদাফের প্রস্তাব মন্দ নয়।এমনিতেও বৃষ্টিতে ভিজে তার যে জ্বর আসবে তা নিশ্চিত আর এই ঝড় বৃষ্টি রাতে সে কোথাই বাহ যাবে।এছাড়া রাদাফকে যতটুকু দেখেছে তার খারাপ মনে হয় নি। আর্শিকা ব্যাগটা একপাশে রেখে খাটে বসে মাথা দু’হাত দিয়ে চেঁপে ধরে রেখেছে।মাথা ব্যাথায় মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে এমন।

“শেষ কখন খাবার খেয়েছেন?”

রাদাফের প্রশ্নে আর্শিকা ভ্রু কুচকে উত্তর দেয়,”ভোরে।”

রাদাফ অবাক হয়ে বলে,”কি?এতক্ষণ ধরে পেটে কিচ্ছু পড়ে নি।”

আর্শিকা কোন প্রশ্নের উত্তর দেয় না।রাদাফ তার ব্যাগ থেকে একটা পাউরুটি বের করে বলে,”নিন এটা খেয়ে নিন।”

“আমার ক্ষুধা নেই।”

“আপনার ক্ষুধা না থাকলেও এটাই খেতে হবে।কোনো কিছু না খেলে তো আর আপনাকে মেডিসিন দিতে পারছি না।আর মেডিসিন না নিলে শরীর ক্রমশ খারাপ হবে।তখন কিন্তু আমি আপনাকে টানতে পারবো না।”

রাদাফ শেষ কথাটা মজা করে বললেও আর্শিকা বেশ বিরক্ত হয়।আর্শিকা বিরক্ত হয়েই বলি,

“আমি বলেছি আপনাকে টানতে?”

“ওকে ওকে সর‍্যি আপনি প্লিজ নিজের কোনো প্রকার ক্ষতি করবেন না তাহলে আমি এখান থেকে বের হতে পারবো না।”

আর্শিকা রাদাফের কথা মেনে পাউরুটিটা খেতে থাকে। এমনই সময় একজন দরজায় টোকা মারে।রাদাফ গিয়ে দরজা খুলতেই এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখতে পায়।মহিলাটার পরনে সাদা ময়লা শাড়ি, এক হাতে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর অন্য হাতে একটা স্টিলের গ্লাস।মহিলাটা ভিতরে ঢুকেই প্রথমে আর্শিকার দিকে নজর দেয়।এতে আর্শিকা বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে।মহিলাটা রাদাফকে বলে,

“কি রে ছোকরা বউয়ের হুস আইছে মোরে জানাস নাই কেন রে?মুই যে চিন্তা করি এইডা তোগো চোখে কি পড়ে না নাকি?”

রাদাফ মুচকি হেসে বলে,”ক্ষমা করো বুড়ি’মা। এক্কেবারে ভুল হয়ে গেছে। এই রাতে তুমি যদি ঠায় না দিতে আমরা কোথায় যেতাম বলো?”

“হইছে হইছে।এই ল তোর বউয়ের লিজ্ঞা গরম দুধ আনছি।গিয়া খাওয়ায় দে।”

“বুড়ি’মা এটার কি খুব দরকার ছিলো?”

“যা কইতাছি তাই কর।তোরা হইলো মেহেমান তোগো খাতির যত্নে ত্রুটি রাখমু না। যা খাওয়াইয়ে শুইয়া পড়।”

বলেই মহিলাটি পুনরায় লাঠিতে ভর দিয়ে চলে গেলো।মহিলাটি চলে যেতেই উৎসুক দৃষ্টিতে আর্শিকা রাদাফের দিকে তাকালো।আর্শিকার তাকানিতেই রাদাফ সমস্ত প্রশ্ন খুঁজে পেয়েছে।রাদাফ পুনরায় নিজের জায়গায় বসে বলে,

“এই রাতে আপনাকে নিয়ে কোথায় যাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না তাই আপনাকে নিয়ে এই কুড়ে ঘরের সামনে আসতেই এই বুড়ি’মা তার ঘরে আমাদের ঠায় দেয়।”

“উনি আমাকে বউ কেনো বললো?”

“কারণ আপনাকে আমি আমার বউয়ের পরিচয় দিয়েছি।”

“কিইইই?”

“এছাড়া কি আর কোনো উপায় আছে।এই রাত বেরোতে দু’টো অপরিচিত লোক তার উপর সাথে যদি থাকে মেয়ে তো তাকে কে ঠায় দিবে।তাই আপনাকে বউ বলতে বাধ্য হয়েছি।”

আর্শিকা কিছু না বলে রাদাফের কাছ থেকে গ্লাসটা মিয়ে ঢকঢক করে সমস্ত দুধ খেয়ে নেয়।তারপর রাদাফের দেওয়া মেডিসিনও খেয়ে নেয়। আর্শিকা খাটে ঘুমায় আর রাদাফ নিচেই কাপড় বিছিয়ে শুয়ে পড়ে।

✨✨

সকাল বেলায় রাদাফ উঠতেই…..
.

#চলবে