তোমার নামে হৃদয় পর্ব-০৫

0
297

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (০৫)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
সাদিবের সাথে প্রিয়ন্তির সম্পর্ক খুব দীর্ঘ সময়ের না হলেও এমন এক পর্যায়ের, যে যতটা গভীর সম্পর্কে জড়ালে কেউ কারোর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বহুবছর বাঁচতে পারে। এই তো সেদিন পাশের বাসার ভাড়াটিয়া হয়ে এসেছিলো প্রিয়ন্তির পরিবার। ততদিনে ভেতরে ভেতরে সাদিবের সাথে তামান্নার বিয়ের কথাবার্তা চলছিলো। সাদিবের বাবা আশফাক শিকদার এবং তামান্নার বাবা তালিব আবসার দু’জনের মাঝে মতামতের আদান প্রদান হয়ে গেছে। বাকি রইলো সাদিব তামান্নার মতামত। মিসেস সামিরা শিকদার শুরুতে একটু আপত্তি করলেও পরক্ষণে তিনি সবটা মেনে নিয়েছিলেন। সাদিবকে জানালে সাদিব বললো সে প্রিয়ন্তিকে নিজের সঙ্গীনি হিসেবে বেছে নিয়েছে। সুতরাং তামান্নার সাথে সে বিয়েতে মত দিতে পারছেন না। সামিরা শিকদারের একটা মাত্র ছেলে। তিনি ছেলের এক কথায় পুনরায় বেঁকে বসলেন। সাদিবের পছন্দের মেয়েকেই তিনি ঘরে তুলবেন। আশফাক শিকদার কথা দেওয়ার দিয়েছেন এখন ছেলের দিকে তাকিয়ে সেটা তুলেও নিতে বাধ্য হবেন। ছেলে আর বউয়ের গোঁ ধরে বসাতে আশফাক শিকদার কিছুই বলতে পারেননি। সাদিবের আর সামিরার জোরাজোরিতে বাধ্য হয়ে রাজি হলেন প্রিয়ন্তিকে পুত্র বধূ রূপে শিকার করতে।
.
.
রাত ১১টা!
সাদিব বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পুরনো স্মৃতি সমূহের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইছে। তার রুমের বরাবর পাশের ফ্ল্যাটের রুমটার লাইট গত কয়েকদিন যাবত বন্ধ রয়েছে। বেলকনিতেও কারোর আনাগোনা নেই। এইতো বিয়ের আগের দিন রাতেও দু’জন প্রায় সারারাত গল্প করে কাটিয়েছে। ভাবতেই ভেতরে জমিয়ে রাখা চাপা আর্তনাদগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে। ওপর থেকে যতটা কঠোর এবং ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে আসলে ভেতরটা তার ততটাই কষ্টে ভরপুর। বাবার কথা মতো তামান্নার সাথে সংসার গুছিয়ে চলার জন্য তো ঠিকই পা বাড়িয়েছে কিন্তু মনটা তো এখনো পড়ে আছে প্রাক্তন প্রেমিকার কাছে। প্রিয়ন্তিকে ভুলবার তাড়নার নিজেকে সারাদিন ব্যস্ত রাখার অব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেও দিনশেষে ঘুরে ফিরে সেই একই জায়গায় এসে পৌঁছায় সাদিব। যার দরুন অতীতকে ভুলতে গিয়ে সে বর্তমানকেও উপেক্ষা করে চলছে।

প্রিয়ন্তির বিশ্বাসঘাতকতা সাদিবকে কঠোর হতে বাধ্য করলো। মনকে শান্তনা জানালো,’ যে আমার কথা একটিবারের জন্যে ভাবেনি তাকে আমিও ভাববো না। সে যেমন নিজের বর্তমান ভেবে আমায় ছেড়ে চলে গেছে! তেমনি আমাকেও পারতে হবে নিজের বর্তমানের জন্য প্রিয়ন্তিকে ভুলে তামান্নাকে নিয়ে বাঁচতে। এক ছলনাময়ীর জন্য পারবো না বর্তমানে যাকে নিজের সাথে জড়িয়েছি তার জীবনটা নরকে ঠেলে দিতে! ‘

মনকে শান্ত করে সাদিব নিজের মুঠোফোনটি তুলে নিলো। তামান্নাকে রেখে আসার পর একটিবারের জন্যেও খবর নেওয়া হয়নি। ভাবলো তাকে একবার ফোন করবে। তার পর মুহূর্তে মনে হলো মুঠোফোনে তো তামান্নার নাম্বারটাই নেওয়া হয়নি। নিশ্চয়ই সাদিয়ার কাছে গেলে পাওয়া যাবে হয়তো। পরক্ষণে হাত থেকে ফোনটি রেখে দিলো। ভাবলো এতো রাতে সাদিয়াকে ডিসটার্ব না করি! পরে নিয়ে নেওয়া যাবে।
.

.
তনিমা নিজের ফোন ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ লাফিয়ে শোয়া থেকে বসে পড়লো। পাশে ধাক্কা মেরে তামান্নাকে জানালো, ” এই আপু উঠ না! ”

ঘুমন্ত অবস্থায় তামান্নার জবাব দিলো, ” হু..

” আরে এই আপু…..!”

” কি সমস্যা তোর? ঘুমের ডিসটার্ব করিস না তনিমা। ঘুমোতে দে, কতদিন ঘুমাই না। ” ঘুমের ঘোরে তামান্না কথাগুলো আওড়াচ্ছিলো।

” আপু তুই এখন না উঠলে সব তোলপাড় হয়ে যাবে বলে দিলাম। দেখবি ছাঁদ ফুটো হয়ে আকাশ থেকে বৃষ্টি নামবে তোর মুখের ওপর। ”

” হলে হোক! ”

“এই যা কেটে গেছে। “বলে তনিমা শান্ত হতে আবারো মেসেঞ্জারে কলে ফোনটি বেজে উঠলো।

তনিমার জোরাজোরিতে আর ঘুমিয়ে থাকার জো রইলো না, উঠে বসে রইলাম। কানের কাছে কেউ এতো চেঁচালে কি আর ঘুমিয়ে থাকা যায়! একটু পর নিশ্চিত মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে।

আমাকে উঠে বসতে দেখে তনিমা ভিডিও কল রিসিভ করলো। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এক যুবতীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। তাকিয়ে খেয়াল করলাম যুবতীটির মুখে স্পষ্ট হাসির চাপ লেপ্টে রয়েছে।

আমার চেহারা ফোনের স্ক্রিনে বিদ্যমান হতে মেয়েটি কিঞ্চিৎ রাগী স্বরে বললো, ” কি ব্যাপার ভাবি ও বাড়ি গিয়ে আমাকে একদম ভুলেই গেলে?”

সাদিয়ার কথা শুনে আমার ঠোঁট দুটো হালকা প্রসারিত হলো। ” আরে না তোমাকে ভুলি কিভাবে বলো? আসলে হয়েছে কি…..

” থাক ভাবি আর ব্যাখ্যা দিতে হবে না। তুমি জানো না তুমি চলে যাওয়ার পর আমি একদম একা হয়ে গেছি। ”

সাদিয়ার কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না। আমি এসেছি দু’দিনও হলো না ওমনি মেয়েটা এমন ভাব ধরলো যেন আমি তার বাসায় আগেও কতবার গিয়ে থেকেছি। মনের কথা মনে চেপে রেখে বললাম, ” সেকি কেন? বাকিরা কোথায়? ”

” কোথায় আবার! সবাই কি সব সময়ের জন্য থাকতে এসেছি নাকি। সেই কখন চলে গেছে! বাসায় এখন শুধু আমি, বাবা, আম্মু আর ভাইয়া আছি। ”

পাশ থেকে তনিমা জবাব দিলো, ” তো কি হয়েছে? আগেও তো এমন থাকতি এখনও কয়দিন থাকবি। আপু চলে গেলে আবার যে আমি একা হয়ে যাবো সে বেলায়? যদিও আমি এতো তাড়াতাড়ি ওরে ছাড়তেছি না রে সাদু! ”

শুনে সাদিয়া তনিমাকে জানালো, ” আগে তোর বোন থাকলেও সে বর্তমানে আমার ভাবি। এটা এখন থেকে ওনারই বাড়ি বুঝলি? তাই তার বাড়িতে তারে আসতে বলতেছি তোর তাতে কি? ”

জবাবে তনিমা ভেঙচিয়ে বললো, ” ইসস কইলেই হইলো! শোন তোরে কি বলি, তোর ভাইরে বলবি কয়দিন পরে নিতে আসতে কারণ একবার গেলে তো আর সহজে পাবো না! ”

দু’জনের মাঝে কথা কাটাকাটি করতে করতে এক প্রকার ঝগড়াঝাটি হওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছিল দেখে পাশ থেকে তনিমাকে মৃদু ধমকে উঠলাম।
” তনিমা তুই চুপ করবি? এই দেখি দু’জনের গলায় গলায় খাতির একজন আরেকজন ছাড়া চলতে পারিস না। তাহলে দু’জন ঝগড়া লাগিস কেন? ছোট আছিস এখনো? কলেজ শেষ হতে চললো তোদের কথাটা মাথায় রাখিস! ”

ধমক শুনে দু’জনেই চুপ করে রইলো। দুজনের কাজই এটা। কথা বলার ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ ঝগড়ার পরিবেশ তৈরি হয়ে যায় পরক্ষণে দুইজন এমন ভাবে মিশে যায় যেন একটু আগে তাদের মধ্যে কিছু হয়নি।

সাদিয়ার কথা বলার ফাঁকে একটি প্রশ্ন বারবার মনে উঁকি মারতে থাকলো। ভাবনাচিন্তা ছাড়া সাদিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ” সাদিয়া তোমার ভাইয়া বাড়ি ফিরেছে? ”

” হ্যাঁ ফিরেছে। খেয়েদেয়ে এখন বিশ্রাম নিচ্ছে হয়তোবা ঘুমোচ্ছে। দেখলাম রুমের ডোর বন্ধ। কেন তোমার সাথে কথা হয়নি? ”

সাদিয়ার প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছে হলো না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললাম। ” কবে আসবে কিছু বলেছে? ”

সাদিয়া দুষ্টুমির ছলে তনিমাকে চোখ দিয়ে ইশারায় বললো, ” কি ব্যাপার তনিমা? তুই না বলছিলি তোর বোনকে সহজে আসতে দিবি না এখন তো দেখছি তোর বোন-ই তোর দুলাভাইকে ছেড়ে থাকতে পারছে না। হুম হুম! ”

মহা মুশকিলকে পড়লাম তো! হ্যাঁ না এর জবাবে মেয়েটা তিল থেকে তাল বানিয়ে বসে আছে। এতো পাকা বর্তমান যুগের পোলাপান! হায় আল্লাহ! নিজেকে নিজে ধিক্কার জানালাম।

” সমস্যা নেই ভাবি খুব শীগ্রই যাবে তোমাকে নিয়ে আসতে সাথে আমিও নাহয় গেলাম। আমি গেলে বুঝছিস তনিমা তোর খবর আছে। ”
.

.
তালিব আবসার অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু দেরি করলেন। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হতে নিজের স্ত্রীর মুখে মেয়ে আসার খবর শুনতে ফেলেন। খবরটা শুনে বেজায় খুশি হলেন। বুঝলেন সব তাহলে স্বাভাবিক গতিতে চলছে। স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন, ” তো কি বুঝলে? ”

” এতো খুশি হয়ো না তামান্নার বাবা। তামান্না একা এসেছে সাথে কিন্তু তোমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুর ছেলে আসেনি। ”

তালিব আবসার অবাক হলেন না। বরং তাকে একটু অসন্তুষ্ট দেখালো। তবে উপর থেকে স্ত্রীর সামনে প্রকাশ করলেন না। ” সে ব্যস্ত মানুষ জানোই তো। তাই আসেনি এতে এতো রিয়েক্ট করার কি আছে? ”

নীলিমা তালিব আবসারের কথায় হাল ছেড়ে দিলেন। হতাশ হয়ে বললেন, ” আমার মেয়েটা হাসতে ভুলে গেছে তামান্নার বাবা। তুমি জানো না ও সেই যে এসেছে এখনো রুম থেকে বের হয়নি। আমার সাথেও আগের মতো কথা বলছে না। ”

” আহ্ নীলিমা তুমি শুধু শুধু এতো কিছু ভাবছো৷ দুইবোন একসাথে গিয়ে দেখো গল্প করছে তাই তোমাকে সময় দিচ্ছে না। এতো অস্থির হওয়ার কি আছে। ”

তালিব আবসারের ভাবলেশহীন জবাবে নীলিমার চোখের পানি টলমল করছে। জবাবে তিনি বললেন, ” বুঝলাম আমি নাহয় ওর মা না। এমনকি রক্তের সম্পর্কের কেউ হইও না কিন্তু তুমি তো ওর আসল বাবা। একজন বাবা কিভাবে নিজের মেয়ের ব্যাপারে এতো উদাস থাকতে পারে আমার বুঝে আসে না! ”

চলবে……?