তোমার নামে হৃদয় পর্ব-৬+৭+৮

0
292

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (০৬)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
তালিব আবসারের ভাবলেশহীন জবাবে নীলিমার চোখের পানি টলমল করছে। তিনি বললেন, ” বুঝলাম আমি নাহয় ওর রক্তের সম্পর্কের কেউ হই না কিন্তু তুমি তো ওর আসল বাবা। একজন বাবা কিভাবে নিজের মেয়ের ব্যাপারে এতো উদাস থাকতে পারে আমার বুঝে আসে না! ”

নীলিমার কথায় তালিব আবসারের চেহারায় বিরক্তি চাপ ফুটে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ” আহ্ নীলিমা কি হচ্ছে? কথাগুলো আস্তে বলা যায় না? নাকি ওকে শুনাতে চাচ্ছো? ”

নীলিমা চুপসে গেলেন। তালিব আবসার বললেন, ” ও যদি ব্যাপারটা জানতে পারে তাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে সেটা তুমি ভালো মতোই জানো। তাই যা হচ্ছে হতে দেও। আমার মেয়ের চিন্তা আমি ঠিকই করছি। ”

” হিতে বিপরীত হলে আর কি হবে? মেয়েটার জীবনটা তুমি নিজের হাতে ধরে শেষ করে দিয়েছো! দেখছি তো মেয়েটা আমার গত দুইদিনে কতখানি শুকিয়ে গেছে। ”

” ঘুরে ফিরে সেই একই কথা বলছো। বলেছি না কান্নাকাটি না করে যা হচ্ছে হতে দেও। একদিন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে দেখে নিও। ”

নীলিমা শান্ত হয়ে বললেন, ” আল্লাহ করুণা করুক, যেন তাই হয়। ”

” এখন যাও ওকে ডেকে দেও। দেখি কেমন শুঁকিয়েছেন ভাবি তোমার মেয়েকে! ”

” এতোক্ষণে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল সকালে কথা বলো। ”

” আচ্ছা তাহলে ঘুমোতে দেও। ”
.

.
স্বভাবসুলভ প্রতিদিনের মতো ঘুম ভাঙতে বড্ড দেরি করে ফেললাম। গত দুইদিন তাড়াতাড়ি উঠার দরুন হয়তোবা আজকের দিনের ঘুমখানি একটু বেশি চাঁড়া দিয়েছে। বাহ্ ঘুমও বুঝে কোনটা বাপের বাড়ি কোনটা শ্বশুর বাড়ি! অন্যসময় হলে এতোক্ষণে মামনি একগাদা কথা শুনিয়ে দিতো। সকাল সকাল মায়ের বকাঝকা খেয়ে ঘুম থেকে উঠা আমার রোজকার রুটিন হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিদিনের মতো মা আজ চেচামেচি করে ডেকে তোলেননি। বরং উঠে দেখি সব শান্ত। ফ্রেশ হয়ে রুমের বাহিরে যেতে দেখলাম বাবা সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছেন। পাশে তকি বসে ফোনে গেমস খেলতে ব্যস্ত। আর রান্নাঘরে তনিমা মামনির সাথে ছোটাছুটি করে কাজে হাত লাগাচ্ছে। সবার কাজ কর্মে অবাক না হলেও তনিমার কাজ আমাকে বেশ অবাক করে দিয়েছে।

বাবার দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষিপ্ত হলে বাবা হাসি মুখে কিছু বলতে চাইলেন। আমি সেদিকে না তাকিয়ে মামনির কাছে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলাম। বাবার ওপর যে অভিমান করে আছি একটু বুঝুক বাবা।

” কি ব্যাপার মামনি? আমি কবুল বলার পর দেখি সম্পর্কের সাথে সাথে সব কিছুর পরিবর্তন ঘটে গেছে? তোমার ছোট মেয়েও দেখি আজকাল কাজেকর্মে বেশ ব্যস্ত থাকে। কই আগে তো বললেও কানে শুনতো না! ”

” আগেই বলেছিলাম তুই শ্বশুর বাড়ি গেলে আমি কানে শুনবো। অন্যথায় আমার বয়ারর সাথে সাথে কানি থাকতেও সমস্যা নেই। এতোদিন তুই ছিলি সেজন্য করতাম না। এখন তুই নেই তাই করছি। তাছাড়া তোর মা বলে দিয়েছে যে, সে আমাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারবে না। ”

” ঠিকই আছে। কতকাল আজাইরা খাবি৷ আলসেমি ঝেড়ে তারচে কাজকাম করে খা। কিছু না হোক ব্যায়ামটাও তো হবে। ”

আমার আর তনিমার কথার মাঝে মামনি আমার পাশে এসে বসলেন। বাটিতে করে খানিকটা পায়েস নিয়ে মুখের সামনে ধরলেন। বললেন, ” খোঁচাখোঁচি পরেও করা যাবে। আগে খেয়ে নে। অনেক বেলা হয়ে গেছে। নে হা কর দেখি! ”

বাটিতে থাকা পায়েসের দিকে নজর যেতে চোখদুটো চকচক করে উঠলো। শেষ কবে মায়ের হাতের পায়েস খেয়েছি ঠিক মনে করতে পারছি না। দেরি না করে চট করে মুখে তুলে নিলাম। বৃদ্ধাঙ্গুল আর তর্জনী একসাথ করে বৃত্তাকার করে মায়ের দিকে দেখালাম। বললাম, ” উমম মা, কতদিন পরে। দারুণ হয়েছে! ”

মামনি তৃপ্তির হাসি হাসলেন। ” তোর জন্যই বানিয়েছি। আরো খেতে চাইলে নিয়ে খাস রান্নাঘরে রাখা আছে। ”

” আচ্ছা তুমি আজ আমাকে ডেকে তুললে না? তুমি তো কখনো আমার সাথে চিল্লাচিল্লি না করে থাকতে পারো না। তাহলে আজ কীভাবে এ ভুল হলো? ”

মামনি হাসলেন। ” এখন থেকে প্রতিদিন কি আর এভাবে ঘুমোতে পারবি নাকি! ও বাড়ির লোকজন কি বলবে? ”

মায়ের কথাটা শুনে মনটা বেজায় খারাপ হয়ে গেছে। ভাবলাম সত্যি তো! এখন আমি এ বাড়ির অতিথি। চাইলেও যখন তখন এ বাড়িতে না তো পা ফেলতে পারবো আর না তো ঔ বাড়িতে নিজের মতো চলতে পারবো। মেয়েদের জন্য জগতের এ নিয়মটা এতোটা জটিল না হলেও পারতো!

আমার ভাবনার মাঝে অপর পাশের খালি চেয়ারে এসে বাবা বসলেন। মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” নীলিমা আমাকে আর তোমার বড় মেয়েকে দুই কাপ চা দিও তো। বাপ বেটি চা খেতে খেতে একটু গল্প গুজব করি। কি বলো মা? ” আমার দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন।

আমি নিশ্চুপ। বাবার ওপর অভিমানের পাল্লাটা এখনো ভারি হয়ে আছে। বাবার অনুরোধে বিয়েতে সেদিন রাজি হলেও আসলে মন থেকে রাজি হতে পারিনি। বাবা হয়তো আমার অভিমানটা বুঝতে পেরেছি। মাকে সবসময় বলতে শুনেছি, আমি নাকি বাবার ফটোকপি। চেহারা, কাজকর্মের পাশাপাশি রাগ অভিমানটাও নাকি তার থেকে পাওয়া। তাই হয়তো তিনি অভিমান বুঝতে পেরে আদর করে মেয়ের অভিমান ভাঙাতে এসেছেন।

মা মাথা নেড়ে চা বানাতে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলেন। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ” কেমন আছে আমার মা-টা? বাবার উপর অভিমান করেছে বুঝি? ”

বাবার আদর মিশ্রিত কণ্ঠে নিজেকে শক্ত রাখতে পারলাম না। জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। বাবাও সেরকম জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ রইলেন। বুঝতে পারলাম আমার কান্নায় উনার চোখের কোণেও পানি এসে জমেছে। সেকেন্ড পাঁচেক পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
” কাঁদছো কেন? কি হয়েছে বলো আমায়? কেউ কিছু বলেছে? ”

চোখের পানি মুছে নিজেকে সামলে নিলাম, না সূচক মাথা নাড়ালাম। বোঝাতে চাইলাম, ‘ কেউ কিছুই বলেনি! ”

” তাহলে কাঁদছো কেন? ”

” এমনি! ”

” ও বাড়ির সবাইকে কেমন দেখলে? ”

” হ্যাঁ ভালোই। সবাই তো আমার পূর্ব পরিচিত। নতুন করে কি দেখার আছে। ”

” হুম তা তো অবশ্যই। এবার তাহলে পড়াশোনাটাও শুরু করে দেও কেমন? বিয়ে হয়েছে বলে যে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে এমন কিন্তু না! ”

” কিন্তু বাবা উনারা কি মেনে নেবেন। ” মনে সংশয় থেকে বললাম।

” সাদিবের বাবার সাথে সকালে কথা হয়েছে। সে নিজে থেকেই বললো আমাকে। অনেকদিন তো হলো ভার্সিটি যাও না। আজ তো ছুটির দিন কাল থেকে যাওয়া শুরু করে দেও। ”

চলবে……..!

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (০৭)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
সবচেয়ে তিক্ত শব্দ কোনটি জানেন? প্রতিদিন সকালে বেজে উঠা এলার্মের শব্দ! আরেকটা হচ্ছে যখন আপনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকবেন এবং সে মুহূর্তে কানের কাছে মুঠোফোনটি সশব্দে বেজে উঠবে। অতঃপর শান্তির ঘুম বাদ দিয়ে ফোন রিসিভ করতে দেখবেন সেটা গ্রামীণফোন সিম কোম্পানি থেকে আসা ফোন। গভীর রাতের ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার পর ঠিক সকালের দিকে আবারো সেই মুঠোফোনের তিক্ত শব্দটা কানে আসতেই শান্তির ঘুম চোখ থেকে উধাও হয়ে গেছে। কানের ওপর বালিশ চেপে তিক্ত শব্দটাকে পরিহার করতে চাইলেও পরক্ষণে তা আর সম্ভব হয়নি। এভাবে বারকয়েক আপনাআপনি বেজে বন্ধ হয়ে গেলে কি হয়েছে? যে ঘুমের জন্য এতো সহ্য করলাম সেই ঘুম তো ঠিকই ভাঙলো। বিরক্তি চেপে ঘুম জড়িত কণ্ঠে রিসিভ করে বললাম, ” সমস্যা কি? কে আপনি? এতো সকাল সকাল অভদ্রের মতো ফোন দিচ্ছেন কেন? দেখছেন না রিসিভ করছি না? ”

লোকটা জবাব দিলো, ” সকাল সাড়ে নয়টা যে এতো সকাল হতে পারে তা তো কোনোকালেও শুনিনি। ”

” কে আপনি? পরিচয় জানতে চেয়েছি তা না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করছেন কেন? ভারী আজব লোক তো! ”

লোকটা সেকেন্ড দুয়েক নিরব থেকে বললো, ” আমি সাদিব। ”

” সাদিব ” নামটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতে শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লাম। আমাকে হুট করে ফোন করে লোকটা অবাক করে দিয়েছে বটে! অথচ আমি ভেবেছিলাম ইনি হয়তো আমাকে ভুলেই গেছেন বা কখনো মনে করতে পারেন বলে ধারণার বাহিরে ছিলো। সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করলাম,
” স্যরি স্যরি আমি আসলে বুঝতে পারিনি অভদ্র বলা লোকটি যে আপনি হবেন। ”

” কেউ যেহেতু এতো বার কল করছে তার মানে নিশ্চয়ই কোনো ইম্পরট্যান্ট কাজেই করেছে। সেক্ষেত্রে এভাবে পড়ে পড়ে না ঘুমিয়ে থেকে আগে উচিত ছিলো তোমার কলটা রিসিভ করার। পরেরবার থেকে এ বিষয়টি মাথায় রাখবে আশা করছি। যদিও তোমাকে আমি এই নিয়ে দু’বারই কল করেছি। ”

” আচ্ছা বুঝেছি। ”

” তো যা বলার জন্য কল দেওয়া- বিকেলে রেডি থেকো আমি এসে নিয়ে যাবো। যেন দেরি না করো তাই আগে থেকেই বলে রাখছি। ” কথাটা শেষ করে সাদিব আমার জবাবের অপেক্ষা করলো না। মুখের ওপর লাইনটা কেটে দিলো।
.

.
ক্যাম্পাসে পা রাখতে শুরুতেই দেখা হয়ে গেলো তন্ময়ের সাথে। তন্ময় তখন ক্লাস রুমের দিকেই যাচ্ছিলো। আমাকে দেখতে পেয়ে মুচকি হেসে এগিয়ে এলো। ” তুই ঠিক আছিস? ”

” হ্যাঁ দেখতেই তো পাচ্ছিস! ”

” তাহলে কই ছিলি এতোদিন? ক্যাম্পাসে আসিস নি যে? ”

” বাসায় ছিলাম না! ”

” বাসায় ছিলি না তো কই ছিলি? তুই তো হুটহাট কোথাও যাস না, বিশেষ করে কোনো ভ্যাকেশন ছাড়া! ”

তন্ময়ের কথা শুনে বুঝলাম তার মনে অনেক প্রশ্ন। তাকে এ মুহুর্তে সত্যিটা জানানোর মতো সাহস বা মানসিকতা কোনোটাই আমার হলো না। অন্যদিকে আমি গুছিয়ে মিথ্যে বলার মতো যথেষ্ট অপরিপক্ক। তারচে বরং কথাগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা চালালাম।

” তা টপার স্টুডেন্ট আজ এতো দেরি করে ক্যাম্পাসে এলো বিষয়টা তো বেশ ভাবাচ্ছে আমায়! কি ব্যাপার হুম? ” ভাবুক ভঙ্গিতে বললাম।

তন্ময় মুচকি হাসলো। বললো, ” চল! এক সাথেই যাই। ” তন্ময় পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, ” তোর ফোনের কি হয়েছে? ”

” কি হবে? ” পরক্ষণে সকালের কলের কথা মনে পড়লো, সাদিবের আগের কলগুলো তন্ময় করেছিলো। ফিরতি কল না করে ভাবলাম ক্যাম্পাসে এসেই কথা বলে নেবো। তন্ময়কে বললাম, ” ও হ্যাঁ তুই ফোন দিয়েছিলি কি?”

“তোকে এতোদিন আসতে না দেখে ভাবলাম একটা ফোন দিয়ে দেখি। সকালে এতোগুলা ফোন দিলাম একটা কলও তো রিসিভ করিস নি। ”
.

.
বিকেল গড়াতে সাদিবের এ বাড়িতে উদয় হলো। লোকটাকে দেখেই মনে হচ্ছে বেশ তাড়াহুড়োর মধ্যে এসেছে। যদিও আমি আশা করিনি সে এতো তাড়াতাড়ি নিতে চলে আসবে। ভেবেছি হয়তো তনিমার কথামতো আমার এ বাড়িতে সপ্তাহ খানিক থাকার সময় গড়াবে।

সাদিবের কেনা প্রিয়ন্তির জন্য শাড়িগুলো ছাড়া ও বাড়িতে পরিধান যোগ্য আর কোনো জামাকাপড় নেই। শাড়ি পড়ে আর কতক্ষণই বা কাটানো যায়। একে তো আবহাওয়ায় ভ্যাপসা গরমাভাব তার ওপর মন থেকেও চাইছি না অন্য কারোর জন্য কেনা কাপড় আমি পরিধান করে বেড়াবো।

আমাকে তৈরি হতে দেখে তনিমার মুখখানি জুড়ে আধার ঘনিয়ে এলো। গোমড়া মুখে মেয়েটা আমার তৈরি হওয়া পরখ করছে। যার সবটাই আমি আয়নার ভেতরে লক্ষ্য করছি। তার মনের মতো আমার মনেও যে অমাবস্যার মধ্যরাত চলছে তা তাকে বুঝতে দেইনি। ভাবনায় তনিমার সাদিয়াকে বলা কথাগুলো উঁকি দিতে শুরু করলো। তনিমা সাদিয়াকে সেদিন বলেছিলো, সাদিব যেন গুণে গুণে এক সপ্তাহ পরে নিতে আসে। তনিমার কথার বিরোধিতা সাদিয়া করে বসেছিলো নাকি! তার জন্য দেখা গেলো আমি চলে যেতে তনিমা সাদিয়ার ওপর বোমা ফাটাবে।
.
.
” আঙ্কেল আন্টি এখন তাহলে আসছি! ” সাদিবের জবাবের বিরোধিতা জানালেন বাবা। বললেন, ” এটা বললে তো হয় না বাবা। তুমি প্রথম এ বাড়িতে এসেছো তোমাকে তো এভাবে যেতে দিচ্ছি না। অন্তত আজ রাতটা থাকো। বেশি জরুরী হলে নাহয় কাল সকালে যেও! ”

সাদিব অবাকের সাথে জানালো, ” কোথায় প্রথম এসেছি। এইতো সেদিনও তো এসে অনেকক্ষণ থেকেছি। ”

” সেদিন আর এদিনের মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। সেদিন অব্ধি ছিলে বন্ধুর ছেলে আর এদিন হচ্ছো মেয়ের জামাই। তাই তুমি চাইলেই তো যেতে পারছো না। ”

বাবা মায়ের জোরাজোরিতে সাদিব সেদিন রাতটা এখানে কাটালেও সকাল হতে দু’জন একসাথে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম দু’দিকে। সাদিব রওয়ানা দিলো হসপিটালের দিকে আর আমি চললাম ক্যাম্পাসের দিকে। দু’জনের সম্পর্কটা বাসা অব্ধি সীমাবদ্ধ রইলো। কয়েকজন পরিচিত আত্মীয় ব্যতিত কেউ জানতেও পারলো না আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে এমনকি আমার বন্ধুমহলও নয়! যাদের সাথে কিনা এ যাবত আমার সুখ দুঃখের সব গল্প করতেই সারাদিন কেটে যায়!

চলবে…………

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (০৮)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
বিয়ে দুই অক্ষরের শব্দ! বিয়ে দুটি প্রাণের আপন হওয়ার এক বরকতময় অধ্যায়। দুটি অক্ষরের এ শব্দটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের জীবনের ইহ-পরকালীন কল্যাণ, অকল্যাণ, সফলতা-ব্যর্থতার অনেক হিসাব-নিকাশ। এ শব্দটির সাথে জুড়ে আছে দু’জন মানুষের মনে গেঁথে রাখা কত শত আবেগ আকাঙ্খা। বিশেষ করে দু’জন মানুষের মনের মিলন। কিন্তু এই বিয়েটা যদি কারোর জন্য ঠিক উল্টোটা হয় তখন কেমন হবে?

সাদিবের সাথে আমার বিয়ের সময়কাল চলছে তিনমাস। এই তিনমাসে কেউ কারোর সাথে দরকার ব্যতিত কোনো কথাই বলিনি। সে নিজের মতো আমি আমার মতো থাকি। কেউ কারোর ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন বোধ করি না। অবশ্য মাঝে মধ্যে সাদিব সময় ফেলে আলাপ করতে আস, হয়তো আমার সাথে নিজের বাকি জীবন কাটাতে হবে কিনা এই ভেবে! এ বাসায় আমার সময়গুলো ভালো কাটানোর জন্য সাদিয়াই যথেষ্ট। তার সাথে আগে থেকেই ভালো পরিচয় রয়েছে বিধায় মেয়েটা আমার সাথে কাটাতে পছন্দ করে। যতক্ষণ সে বাসায় থাকবে ততক্ষণ আমার সময়টুকু বেশ ভালো কাটে। সেদিক থেকে সাদিবের মায়ের সাথে এখনো ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। কেন জানি না তিনি সেই শুরুর মতোই এখনো আমাকে এড়িয়ে চলেন। তবে বাবা বাসায় থাকলে বাবার সাথে আমার এবং সাদিয়ার জম্পেশ আড্ডা জমে। সেদিন রাতে ডিনারের টেবিলে আমি যখন উনাকে বলেছিলাম, ” আঙ্কেল আপনার কি আর কিছু চাই? মাছের কারিটা কি আরেকটু দেবো? ”

কথাটা আমার বলতে দেরি হলেও উনার ধমক শুনতে দেরি হলো না। ধমকের সাথে তিনি বললেন,” এই মেয়ে কে তোমার আঙ্কেল? আমি এখন আর কারোর আঙ্কেল নই! বাবা বলবে আজ থেকে বুঝেছো? ” সাদিবের মাকে দেখিয়ে বললেন, ” আর হ্যাঁ এনাকে মা বলে ডাকবে, যেমন নিজের বাবা মাকে ডাকো। মনে থাকবে? ”

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে উনি বাসায় থাকলে দু’মেয়েকে সাথে নিয়ে আসর জমিয়ে তোলেন আবার কখনো সখনো বাহিরে বেড়াতে নিয়ে যান।
.
.
পৌষের বিকেল বেলা! সাদিয়া সেই যে সকালে বেরিয়েছে এখনো বাসায় ফেরেননি। যখন ফিরলো তখন দেখলাম মেয়েটা খুব খুশি মনে বাসায় ফিরলো। বাসায় ঢুকেই নিজের রুমে ফ্রেশ হতে না গিয়ে সরাসরি আমার কাছে চলে এলো। প্রফুল্ল মনের কণ্ঠস্বরটা অনেকটা উত্তেজিত শোনালো। বললো, ” ভাবি জানো আজ কি হয়েছে? ”

” না বললে কি করে বুঝবো বলো তো? ”

” তাইতো! তো কি হয়েছে শোনো। তোমার ইরিনার কথা মনে আছে? ঐ যে আমাদের আরেক ফ্রেন্ড? ”

” হ্যাঁ! সেদিনও তো তনিমা বলেছিলো। কি হয়েছে ওর? ”

” হয়নি হবে বুঝলে? ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ”

” ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে মানে? ওর না রিলেশন ছিলো একজনের সাথে? ”

” আরে শোনোই না আগে! ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথেই ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। এতোদিন ফ্যামিলি ক্রাইসিস এর মধ্যে দিয়ে চলছিলো দু’জন। ওর পরিবার তো রাজি হতেই চাচ্ছিলো না শুরুতে। আচ্ছা তুমি বলো তো ওর বয়ফ্রেন্ড কোন দিক দিয়ে খারাপ? দেখতে শুনতে তো ভালো। তার ওপর বড় লোক বাপের একমাত্র ছেলে। ”

সাদিয়ার শেষে দেওয়া যুক্তিটুকু মনে ধরলো না। অবশ্য তাকে দোষ দেওয়াও যায় না। একে তো টিনএজার তার ওপর বর্তমান যুগের বেশিরভাগ মেয়েরাই ছেলের যোগ্যতার চেয়ে বাপের টাকা পয়সা দেখে তাদের পেছন পেছন ছুটে। আশেপাশের ঘটনা প্রত্যক্ষ করে বাবা দু ‘ বোনকে সর্বদা সাবধান করে দিতেন। বলতেন, ‘ যদি কখনো কোনো ছেলেকে পছন্দ করতেই হয় তবে যেনো ছেলের যোগ্যতার মাপকাঠি দেখে করি। অন্যথায় বড়লোক বাপের ছেলেরা সর্বদা বিগড়ে যাওয়া হয়!’

সাদিয়ার কথার জবাবে বললাম, ” শোন যাই করো কখনো ছেলের বাপের টাকা পয়সা দেখে পছন্দ করবে না বরং ছেলের যোগ্যতা দেখে করবে। দেখা যায় এমন বেশিরভাগ ছেলেরাই বখাটে টাইপের হয়। এদের পেছনে ছুটে নিজের হাসি খুশি জীবন বরবাদ করার কোনো মানে হয় না। ”

আমার কথায় সাদিয়ার মুখখানি চুপসে গেছে। তার এমন প্রফুল্ল মন এক নিমিষে খারাপ হওয়াটা দেখতে নিজের কাছে ভালো লাগলো না। তাই তাকে সান্ত্বনা দিতে বললাম, ” আমি সবার কথা বলিনি কিন্তু! তুমি মন খারাপ কেন করছো? ”

” তুমি অবশ্য এক দিকে ঠিকই বলেছো। তবে ইরিনার বর ছেলে হিসেবে কিন্তু বেশ ভালো। ”

” ভালো হলেই ভালো। বিয়ে কবে? ”

” সামনের সপ্তাহে ঠিক হয়েছে। কিন্তু….

” কিন্তু কি? ”

” বিয়ে তো রাতে হবে। বাসা থেকে কি ওর বিয়েতে আমাকে এটেন্ড করতে দেবে?”
.

.
পরের দুদিন পেরুতে ইরিনার দেখা মিললো এ বাসার চৌকাঠে। যেহেতু ইরিনা আমার পূর্বপরিচিত তাই তাকে নতুন করে পরিচয় দিতে হয়নি। কিন্তু সে এসে নিজের বিপত্তির কথা আগে জানালো বললো, ” তোমাকে কি বলে সম্বোধন করা যায় বলো তো? ভাবি নাকি আপু? ”

আমি মৃদু হেসে জানালাম, ” আপুই ডাকো। ”

দুপুরের পর আশফাক শিকদার বেশিরভাগ সময় বাসাতেই কাটান। সাদিব সচরাচর রাতের আগে বাসায় ফেরে না। ইরিনা আশফাক শিকদার এবং সামিরার কাছে সাদিয়ার ব্যাপারে নিজের আবদারখানি জুড়ে বসলো।

ইরিনার কথা শুনে সাথে সাথে সামিরা নিজের মেয়েকে একা ছাড়তে আপত্তি জানালেন। ইরিনা বললো, ” আন্টি সাদিয়া একা কোথায় যাচ্ছে? তামান্না আপু আর সাদিব ভাইয়াও তো যাচ্ছেন আমার বিয়েতে। আপনারা প্লিজ এবার অন্তত আপত্তি করবেন না! ”

ইরিনার কথা শুনে হকচকিয়ে গেলাম। ইরিনাকে ইশারায় বোঝালাম, ” ইরিনা মিথ্যে কেন বলছো? আমি তো তোমাকে এ ব্যাপারে কিছু জানাইনি! ”

আশফাক শিকদার সন্তুষ্টচিত্তে জবাব দিলেন, ” তাহলে ঠিক আছে। সাদিব আর তামান্না গেলে তাদের সাথে সাদিয়াও যাবে। তুমি এ নিয়ে আর চিন্তা করো না। ”

আশফাক শিকদারের ইতিবাচক জবাব শুনে সামিরা তামান্নার দিকে তাকালেন। উনার চোখে তখন স্পষ্ট বিরক্তর চাপ বোঝা যাচ্ছিলো। তবে তিনি মুখে কিছুই বললেন না।
.

.
ইরিনা চলে যেতে সাদিয়াকে সামিরা অনেকক্ষণ বোঝালেন। কিন্তু সাদিয়া তার সিন্ধান্তে অনড়৷

” সাদিয়া আমি বলছি না তুই যাবি না? ”

” কেন মা? ভাইয়া তো যাচ্ছে তাহলে আমি গেলে কি সমস্যা? একা তো যাচ্ছি না! ”

সামিরা শাসিয়ে বললেন,
” মিথ্যা কথা কাকে বলছিস? তোর মাকে? কি মনে করেছিস আমি জানি না কিছু? ”

সাদিয়া জানে সামিরা তাকে কি জানার কথা বলেছে। তবুও অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
” কি জানো? ”

” শোন সাদিব যদি বিয়েতে না যায় তাহলে তুইও যাবি না। ব্যস! ”

” ঠিক আছে, ভাইয়া আসলেই আমি তার কাছে যাবো। দেখো ভাইয়া কিভাবে রাজি না হয়! ”

সাদিয়া চলে যেতে সামিরা আনমনে বলেন,
” সাদিবকে সব ব্যাপার বোঝানো যদি এত সহজই হতো তাহলে প্রিয়ন্তিকে ভুলে এতোদিনে ছেলেটা ঠিক তামান্নার সাথে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারতো। আমারও আর তাকে নিয়ে এতো চিন্তা করতে হতো না। মাঝখান থেকে তামান্নাকেও এভাবে অসম্ভাবনার দিকে ঠেলে দিতে হতো না। ”

চলবে………

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]