তোমার নামে হৃদয় পর্ব-১২+১৩+১৪

0
271

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (১২)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
ক্লাস শেষে অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছি। যাওয়ার জন্য সেরকম কোনো ইচ্ছেও হয় নি। পরমুহূর্তে মনে হলো সারাদিন বাসায় তো থাকি। সারাদিন বিরক্তিকর কাঁটে। তারচে তাদের সাথে একটু বেরিয়ে আসি। তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হওয়ায় তাৎক্ষণিক সবাই বসে পরিকল্পনা করে ফেললো। ঘুরাঘুরি শেষে সবাই খানিকটা ক্লান্তিবোধ করলাম। এদিকে লান্সের সময় হওয়ায় সবাই পাশের এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। আমার ডানপাশে তন্ময় আর বা পাশে আমার কাছের বান্ধবী দোলা।

অর্ডার করার সময় হঠাৎ তন্ময় জানালো, ” অর্ডার করার আগে শোন সবাই, আজকের ট্রিটটা আমি দিচ্ছি। সুতরাং কে কি খেতে চাচ্ছো ভেবে চিন্তে অর্ডার করবা কিন্তু। পরে বলতে পারবা না তন্ময় কিপ্টা। ”

মেনু দেখে সবাই কাচ্চিটাকেই আগে বেছে নিলো। কারণ এখানকার কাচ্চি বেশ ভালো মানের পাওয়া যায়। খাবার খাওয়ার মাঝে সবাই নানান কথাবার্তা বলছিলাম। বলা যায় বন্ধুরা সবাই একসাথে হলে অবশ্যই সেখানে কথার ফুলঝুরি খুলে বসা হয় কিনা! তাই খাওয়ার মাঝেও সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় দোলা পাশ থেকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে বললো, ” তামান্না সামনে দেখ তো লোকটাকে চিনিস কিনা? ”

প্রত্যেক বন্ধুমহলে এমন একজন ফাজিল বন্ধু অথবা বান্ধবী থাকবে যে কিনা যেখানেই যাক না কেন? সব জায়গায়ই একজনকে পছন্দ করে বসে থাকবে। আমাদের বন্ধুমহলের সেই ফাজিলটা হচ্ছে দোলা। অন্যসময় হলে তাকে সঙ্গ দিয়ে ভালো মন্দ মন্তব্য করতাম। কিন্তু এ মুহুর্তে সবার সামনে সেটা করতে পারছি না। মেয়েটার হিতাহিতজ্ঞান বুদ্ধি লোপ পেতে দেখে বিরক্ত হলাম। বললাম, ” খাওয়ার সময়ও বেটা মানুষের মুখদেখা বাদ দিবি না তুই? চুপচাপ বসে খাবার শেষ কর তো, এতো দিকে তাকাতে হয় না। ” বলে আমি নিজের মতো খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।
.

.
মধ্যাহ্নের সময়টা লান্সের সময় হওয়ায় হসপিটালে তেমন একটা ভীড় থাকে না। এসময় অনেকটা হসপিটালে রোগীদের যাতায়াত মুক্ত থাকে। অন্যথায় বিকেল থেকে রাত আটটা নাগাদ রোগীদের ভীড় জমে হসপিটালের করিডোরে। সাদিব এবং তার একজন কলিগ সম্পর্কে তাদের বন্ধুও বলা চলে। নাম ডাক্তার আহসান মাসুদ। কাজের ফাঁকে দু’জন একসাথে প্রায়শই এখানে লান্স করতে আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

” বুঝলে সাদিব স্টুডেন্ট লাইফটা অনেক ভালো ছিলো। প্রফেশনাল পর্যায়ে এসে জীবনের আনন্দটাই যেন মাটি হয়ে গেলো। দিনগুলো হয় চেম্বারে কাটে নয়তো বাসায় গেলে বউয়ের মান ভাঙতে কেটে যায়। ” কতগুলো বলার সময় আহসানকে হতাশ শোনালো।

আহসানের কথা শোনে সাদিব কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না দেখে আহসান বললো, ” তা তুমি তো নতুন বিয়ে করলে। বিবাহিত জীবন কেমন উপভোগ করছো? ”

সাদিব ওপরে চোখ না তুলেই টেবিলে নিবদ্ধ অবস্থায় বললো, ” ভালোই। ”

” সামনে তাকাও! বুঝলে এদের দেখে এ মুহুর্তে আমার ভীষণ হিংসা হচ্ছে। ইসস জীবনের সব ব্যস্ততা পেরিয়ে এদের মতো সব বন্ধুরা মিলে যদি এমন আড্ডার আসর জমিয়ে তুলতে পারতাম! ”

আহসানের কথায় কৌতুহলবসত সাদিব সামনের টেবিলে তাকালো। তাকাতেই পরিচিত কাউকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে সেখানেই থমকে গেলো। সামনের টেবিলে অন্য কেউ নয় বরং তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী বসে আছে। সাদিব যতদূর জানে সে এ মুহুর্তে ক্যাম্পাসে থাকার কথা। হয়তো দ্রুত ক্লাস শেষ হওয়ায় এখানে এসেছে। থাকনা নিজের মতো ঘুরুক ফিরুক। তাই সে সেদিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ করলো না।

কিন্তু হঠাৎই এক অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্য কানে ভেসে আসতে সাদিব আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না।
.

.
দোলার খোঁচাখুঁচিতে বেশ বিরক্ত হয়ে সামনে তাকাতে সেখানেই জমে গেলাম। দেখলাম সাদিব আমার বরাবর সামনের টেবিলে বসে আছে। তবে তার দৃষ্টি টেবিলের দিকে নত। এতোক্ষণেও হয়তো সে আমাকে খেয়াল করেনি। পরক্ষণে ভাবলাম করলেও বা কি আমরা তো আর দু’জন অন্যসব স্বামী স্ত্রীদের মতো নই। কেবল নামমাত্র স্বামী স্ত্রী। সে তো বললোই সে তার মতো আমি আমার মতো। কারোর ব্যক্তিগত জীবনে কেউ অধিকার ফলাতে যাবে না। নামে কি বা এসে যায়। দোলা কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ” দেখ অদূরে বসে আছে তোর এককালীন ক্রাশ। যে এখন আরেকজনের জামাই আহারে ছ্যাকাখোরনি! থাক দোস্ত আপসোস করিস না তোর জন্য তন্ময়ই বেস্ট। ”

দোলার কথাটা দুষ্টুমির ছলে বলার উদ্দেশ্য হলেও আমার গায়ে তা কাঁটার মতো বিঁধেছে। সাদিবকে যে এক সময় আমার ভালো লাগতো ব্যাপারটা একমাত্র দোলাই জানতো। তখন সিএসই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। সাদিবের বাবা আশফাক শিকদার সাদিবের সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বললেও তা আর সে সম্পর্কে গড়ায় নি। সেবার সাদিব তার বাবা মায়ের সাথে আমাদের বাসায় এসেছিলো। সাদিবকে প্রথম দেখাতে আমার ভালো লেগে যায়। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিলো একবারে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসার। বাবাকে অনুরোধ করেছিলাম বিয়েটা পেছাতে অন্তত আমার চূড়ান্ত পরীক্ষা অব্ধি। বাবা বলেছিলেন এ বিষয়ে সাদিবের বাবা সাথে কথা বলবেন। চাইলে তিনি নিজেই এ বিষয়ে মত দিতে পারতেন তা সত্ত্বেও তিনি সাদিবের বাবার ওপর বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছেন। কারণস্বরূপ সাদিব অন্যদের থেকে আলাদা, তার চোখের সামনে বেড়ে ওঠেছে অনেকটা নিজের ছেলের মতো। তাই তিনি এ পাত্র হাতছাড়া করতে চাননা। বাবার কথায় সেসময় ধরে নিয়েছিলাম বিয়েটা বুঝি হয়েই গেলো। তখন এ কথাটা আমি কাউকে জানাইনি একমাত্র দোলা ছাড়া। তন্ময়ের সাথে তখনো আমার ঠিক মতো পরিচয় হয়নি। কয়েকদিন পরে শুনি সাদিব বিয়েতে রাজি হয়নি সে অন্য একজনকে পছন্দ করে এবং সে বিয়ে করলে তাকেই করবে। পরবর্তীতে বুঝতে পারি মেয়েটি প্রিয়ন্তি ছিলো। প্রিয়ন্তি ছিলো আমার ব্যাচমেট। তবে আমাদের ডিপার্টমেন্ট ছিলো আলাদা। সাদিব প্রায়ই প্রিয়ন্তির সাথে দেখা করতে ক্যাম্পাসে আসতো। চতুর্থ বর্ষের সময় গুলো অব্দি ক্যাম্পাসের কম বেশি সবার কাছে প্রিয়ন্তি পরিচিত মুখ হয়ে গিয়েছিলো। সে সুবাদে অনেকেই জানতো সাদিব প্রিয়ন্তির বাগদত্তা।

দোলার বলা কথায় সে মুহূর্তে কোনো জবাব খুঁজে পেলাম না। আমাদের মধ্যে থেকে একজন সাদিবকে দেখে বলে উঠলো, ” আরে এটা প্রিয়ন্তির হাসবেন্ড না? ”

দোলা সায় জানিয়ে বললো, ” আমিও তো সেটা বলতে যাচ্ছিলাম তামান্নাকে। ”

আমাকে চুপটি করে বসে থাকতে দেখে দোলা হয়তো ভেবেছে আমি তার কথায় মর্মাহত হয়েছি। তাই কথার প্রসঙ্গ পাল্টে ঠাট্টায় মেতে উঠলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ” সবাই বিয়ে করে ফেলতেছে। কয়েকদিন পরে দেখবো তামান্না তন্ময়ও করে ফেলবে। আমার পালা যে কবে আসবে…..

চলবে…….

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (১৩)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
বসন্তে অসময়ের বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ। বাহিরে দমকা হাওয়া বইছে। করিডোরে বসে বৃষ্টি বিলাশে ব্যস্ত তামান্না। হাতে একখানা উপন্যাসের বই। মাথার উপর এনার্জি বাল্বের আলো সারা করিডোর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টির ফোঁটা এসে গায়ে লাগছে অথচ সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে মগ্ন উপন্যাসের পাতায় চোখ বুলানো নিয়ে।

এতো ব্যস্ততার মাঝেও কর্ণকুহর অব্ধি একজনের ভারী কণ্ঠস্বর ঠিকই পৌঁছাল। ” এতো রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কি করছো? ”

” এইতো বই পড়ছিলাম! ” তামান্নার সহজ সরল স্বীকারোক্তি।

” বই পড়ার জন্য রুমে এতো জায়গা থাকতে এখানে? বৃষ্টিতে তো গায়ের অর্ধেকটা ভিজে গেছে। ”

সাদিবের কথায় তামান্নার নিজের দিকে খেয়াল গেল। মৃদু হেসে বলল, ” সমস্যা নেই। এসবে অভ্যস্থ আমি। তা আপনি কখন এসেছেন? ”

” বেশিক্ষণ হয়নি। তোমাকে রুমে দেখতে পাইনি। লাইট জ্বলছে দেখে এখানে এলাম। জামা বদলে এসো এক সাথে ডিনার করবো! ”

সাদিবের ব্যবহার তামান্নাকে দিনকে দিন অবাক করতে বাধ্য করছে। তবে সাদিবকে বুঝতে না দিয়ে মাথা নেড়ে চলে গেল।
.
.
” তন্ময় কে তামান্না? ” সাদিবের মুখে তন্ময়ের নাম শুনে আচমকা কাশি উঠে গেল। পানি গলায় নামার পরিবর্তে নাকের আগায় উঠে গেছে। মনে মনে বিড়বিড় করে বললাম, ” আচ্ছা বাছাধন তাহলে এই ব্যাপার? তাই তো বলি আসার পর থেকে এতো খাতিরযত্ন করছে কেন? ”

” আস্তে পানিটা খেয়ে শেষ করো। কোথায়ও যাচ্ছি না আমি। তোমার সব কথা শুনবো। ” সাদিবকে কথাটা বলার সময় অনেক শান্ত শোনালো।

” তন্ময়কে আপনি কিভাবে চেনেন? ” যদিও জেনে-বুঝে প্রশ্নটি করেছি। দেখি না তার জবাবটি ঠিক কতটা সঠিক হয়!

” তোমার সাথে দেখেছিলাম রেস্টুরেন্টে। তোমার বাকি বন্ধুরা বলাবলি করছিলো তন্ময়ের ব্যাপারে।”

” ফ্রেন্ড! ”

” শুধুই কি ফ্রেন্ড। ” সাদিবের চোখে কৌতুহল।

” ডাক্তার সাহেব আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন? ”

” না। তোমার সাথে বাকি দিনের চলার পথটা সহজ করতে চাইছি! যাতে কখনো কোথাও বিন্দুমাত্র সন্দেহের উপদ্রব না দেখা যায়। ”
.

.
সাদিবের আর আমার মধ্যকার সম্পর্ক সেদিনের পর থেকে স্বাভাবিক ধারাতে অব্যাহত চলল। প্রতিদিন আমাকে ক্যাম্পাসের গেটের বাহিরে নামিয়ে দিয়ে তারপর সে নিজের গন্তব্যের দিকে এগোয়। এতোসব কিছুর মাঝে দিনকে দিন তন্ময়ের সাথে মিশতে নিজের কাছেই ইদানীং অস্বস্তি লাগে। ক্লাসের কমবেশি সবাই জানে তন্ময় আমার বেস্টফ্রেন্ড ব্যতিতও আমাদের মধ্যকার নিশ্চয়ই প্রণয় গঠিত সম্পর্ক রয়েছে! অথচ আমার চোখে তন্ময় আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ব্যতিত কিছুই নয়। এমনকি তন্ময়ও সেটা বিশ্বাস করে। দোলা আগে প্রায়শই বলতো, ” তন্ময় তোকে পছন্দ করে মিলিয়ে নিস একদিন আমার কথা! ”
প্রতিবারই আমি দোলার কথা হেসে উড়িয়ে দেই।

ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাস থেকে বেরুচ্ছিলাম। আজ তন্ময় আর দোলাকে কোথাও দেখতে পাইনি। দু’জন ক্লাস শেষ করে আমাকে রেখে পালিয়েছে। অবশ্য আমারও এতে দোষ আছে। আমিও তাদের খুব একটা সময় দিতে পারি না। গেটের বাহিরে আসতে আসতে দোলা আর তন্ময়য়ের উদয় হলো। দু’জন এক সাথে দাঁড়িয়ে কোনো ব্যপারে আলোচনা করছিল। আমাকে দেখে থেমে চোরের মতো একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।

এগিয়ে গিয়ে শুধালাম,
” কিরে কি লুকচ্ছিস দুটোয় মিলে? ”

তন্ময় আমতা আমতা করে, ” কই কিছু না তো। হাতে কিছু দেখেছিস লুকোতে? ”

” হাতে না দুইজন মুখে লুকচ্ছিস! ”

” মানে? ”

” দু’জন কি এমন কথা বলছিলি আর আমাকে দেখতে পেয়ে চুপ হয়ে গেছিস? ”

দোলার দিকে তন্ময় ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। দোলা তাকে অভয় দেখিয়ে আমাকে শাসানোর ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, ” তার আগে বল তোর প্রিয়ন্তির জামাইর সাথে এতো কি? ”

” প্রিয়ন্তির জামাইকে কই ফেলি? ”

” হেয়ালি করিস না তামান্না। তন্ময় তোকে কিছু বলছে না তারমানে এই না যে আমি চুপ করে থাকবো। সত্যিটা বল আমাদের তামান্না। আমাদের সত্যিটা জানা জরুরী। বিশেষ করে তন্ময়ের জন্য। তুই ওকে দিনের পর দিন এভাবে ঠকাতে পারিস না। ”

দোলার অবান্তর কথাবার্তায় নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। একে তো মেয়েটা তন্ময়ের ব্যাপারে সব সময় যাচ্ছেতাই বানিয়ে বলে তার ওপর এখন তাকে ঠকানোর কথা বলছে শুনে মেজাজটা তাৎক্ষণিক বিগড়ে গেল।

” কি যা-তা বলছিস এসব। তোকে আমার প্রতিদিন কেন এক কথা বোঝাতে হয় তন্ময় আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তারপরেও তুই গল্প বানিয়ে বেড়াস। সমস্যাটা কি বোঝা আমায়? ”

দোলাও সমান তালে রেগে গেছে। উচ্চস্বরে সেও চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ” আমার কি সমস্যা তুই ভালো করেই জানিস তামান্না। তন্ময় যেমন তোর ফ্রেন্ড তেমন আমারও। তাই ওর কিছু হলে সেটা আমার ওপরেও সমান ইফেক্ট ফেলবে। ”

দু-জনের রাগারাগি দূর থেকে অনেক শিক্ষার্থীরাই দেখছে। কয়েকজন সেখান থেকে যাচ্ছে তাই বলাবলি করছে। তবে সেসব আমাদের কানে পৌঁছাচ্ছে না। হিতে বিপরীত হবে ভেবে দু’জনকে থামাতে তন্ময় বাঁধা দিতে আসলে দোলা তন্ময়ের ওপর আঙ্গুল তাক করে আর চেঁচিয়ে বলে, ” তুই একদম চুপ থাকবি। এসব তোর জন্য হচ্ছে। তুই কিছু না বললে না বল কিন্তু আমি চুপ করে থাকার পাত্রী নই। ভুলে যাস না। ”

তন্ময় অবাক হয়ে বললো, ” আমি? আমি কি করেছি আবার? ”

তন্ময়কে সরাতে বললাম,
” তন্ময় তুই সরে যা। ওকে বলতে দে। ও কি বলে আমিও শুনবো। ”

আমাদের থামাতে না পেরে তন্ময়ের এবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ” থামবি তোরা? বাচ্চা আছিস এখনো? সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে বাচ্চাদের মতো তখন থেকে ঝগড়া করে যাচ্ছিস। আবার আমাকে বলছিস সরে যেতে। এবার কি মারামারি করবি? তাকিয়ে দেখ একবার সবাই কি তোদের ভালো চোখে দেখছে? ”

তন্ময় আমাদের রেখে এবার সবার উদ্দেশ্যে বললো, ” আপনারা দাঁড়িয়ে কি দেখছেন এখনো? এখানে কি কোনো সার্কাস হচ্ছে? যান নিজেরা যে যার কাজে। ”

তন্ময়ের কথায় দু’জন থেমে গেলেও আমার রাগ তখনো থামেনি। তন্ময় আমাকে কিছু বলতে যাবে তার আগে তাকে বাহবা দিয়ে বলে উঠলাম, ” দোলা আমাকে এতোক্ষণ যা নয় তাই বলল আর তোর কাছে এটাকে সামান্য ব্যাপার লাগলো তন্ময়? বাহ্ বন্ধুত্বের ভালো প্রতিদান দিলি। ”

” দেখ তুই ভুল বুঝছিস আমাকে! ”

” আমি কাউকে ভুল বুঝছি না। তবে তোরা একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, প্রিয়ন্তির হাসবেন্ডের সাথে না তো কখনো আমি মিশেছি আর না তো সে কখনো আমার সাথে মিশেছে। যাকে আমার সাথে দেখেছিস সে স্বয়ং আমার ব্যক্তিগত পার্টনার ছিল। আমার হাসবেন্ড ডাঃ ইরফান সাদিব! আশা করি তোদের আজকের পর এ নিয়ে আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ থাকবে না। ” কথাটা বলে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলাম না। চলে এলাম নিজের গন্তব্যের দিকে। সাদিবকে আজকে সবার সামনে নিজের হাসবেন্ড বলতে একটুকুও দ্বিধা লাগেনি বরং সাচ্ছন্দ্যে বলে দিতে পেরেছি।
.
চলবে………

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (১৪)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
তন্ময় হতভম্ব হয়ে তামান্নার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ওর পৃথিবী উলোটপালোট হয়ে গেছে। নিজেকে নিজে বোঝাতে লাগলো, ‘ এটা সত্যি হতে পারে না। তামান্না নিশ্চয়ই আমার সাথে প্র্যাঙ্ক করছে। কাল মনখারাপ করে বসে থাকতে দেখলে এসে ঠিকই বলবে, ” আরে আবুল আমি তো তোর রিয়াকশন দেখতে চেয়েছি। বুঝতে চেয়েছি তুই আমাকে নিয়ে কতটা সিরিয়াস!’ মনকে ব্যর্থ শান্তনা দিতে চাইল। কিন্তু সে পারবেনা কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তাকে যে করে হোক আজই তামান্নার অভিমান ভাঙ্গাতে হবে। হ্যাঁ আজই এবং এখনই।

তন্ময় সময় অপচয় করলো না। সাথে সাথে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে তামান্নার পেছন পেছন ছুটে চললো। তামান্নাকে আশেপাশে দেখতে না পেয়ে নিজের বাসা ছেড়ে তামান্নার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।
.

.
নির্বিকার মনে রাস্তার দু’ধারে হাঁটছি আর কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির কথা ভাবছি। সবই তো ভালো চলছিলো। হঠাৎ এমন কি বা ঘটে গেলো যার জন্য দোলা, তন্ময় আমাকে ভুল বুঝবে? পরক্ষণে মনে হলো, আমার ওদের সাদিবের ব্যাপারে আগেই জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো। তাহলে এতো ভুল বোঝাবুঝির তৈরি কখনোই হতো না।

আমার হাঁটার মাঝ দিয়ে ক্যাম্পাসের এক জুনিয়রের সাথে দেখা হয়ে গেলো। ছেলেটি আমার পেছন পেছন আসছিলো যা আমি কিছুক্ষণ যাবত খেয়াল করছিলাম। শুরুতে ভেবেছিলাম একই পথে যাচ্ছি তো কি হয়েছে? হয়তো সামনের মোড়ে এসে সে আলাদা হয়ে যাবে কিংবা কোনো এক জায়গা থেকে ঠিকই স্থানের বিচ্যুতি ঘটবে। তাই ততটা মাথা ঘামাইনি বিষয়টি নিয়ে। ভাবতে হলো তখন যখন ছেলেটি হঠাৎ করেই সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়ল।

” আসসালামু আলাইকুম আপু! ”

সালামের জবাব দিয়ে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ” কিছু বলবে? ”

” না মানে আপু আপনার মন মেজাজ ভালো আছে তো? ” কথাটি যে ছেলেটির বিদ্রুপাত্মক ছিলো সেটা বুঝতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি।

” মানে রাস্তার মাঝখানে পথ আগলে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছো মন মেজাজ ভালো কিনা? অভদ্রতামির জায়গা পাচ্ছো না? ”

” অভদ্রতা তো বটেই। তবে সেটার কিছুই তো আপনি এখনো দেখেননি সিনিয়র আপু। ”

” আমার পথ থেকে সর। যেতে দেও। ”

” কেন? সরবো কেন রাস্তা কি আপনার বাপের? ”

ছেলেটির বেহায়াপনা আমাকে তেতে উঠতে বাধ্য হলাম, ” তো রাস্তা কি তোর বাপের? যে রাস্তার মাঝখানে এসে আমার পথ আটকাবি? ”

আমাকে তেতে উঠতে দেখে ছেলেটি অশালীন গালি উচ্চারণ করলো। ” মা**গীর তেজ দেখছো? ভালোয় ভালোয় ভাব জমাইতে আইলাম মানলি না। এবার খারাপ কথাই কওয়া লাগবো মনে হইতাসে। প্রতিদিন যে গাড়িওয়ালার লগে আসোছ না তার সাথে থাকা হইয়া গেলে চইলা আসিস। এর থেকে ডাবল রেট দিমু তোরে! ”

ছেলেটি ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র তাও মাত্র এক ব্যাচের। অথচ ছেলেটার ব্যবহার এতোটা নোংরা হবে সেটা যেন ভাবনাতীত। মনে হচ্ছে আমার সারা শরীরে কেউ আগুন জ্বালিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে লাঠি চাটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হাতের কাছে বড় এক খন্ড ইট খুঁজেও পেলাম। ইটখানি হাতে নিয়ে ছেলেটির দিকে এগিয়ে যেতে ছেলেটি পিছিয়ে যেতে যেতে বলল, ” দেখ ভালো হবে না কিন্তু। আমার কিছু হলে তোর অবস্থা খারাপ করে ছাড়বো। ”

” আগে নিজে বেঁচে তো ফির। ” আমাকে থামাতে না পেরে ছেলেটি জানের ভয়ে তাৎক্ষণিক দৌড়ে সেখান থেকে পালালো। আমি জোরে চেচিয়ে ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে ইটটি ছুড়লাম আর বললাম, ” তোর ঘরে মা বোন নেই তাদের এভাবে অফার করে দেখিস। ”

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সেদিনের মতো বাড়ি ফিরে এলেও কারোর প্রতি মান অভিমান এতটুকুও কমেনি।
.

.
বাসায় ফিরতে ঘটে গেলো আরেক ঘটনা। কলিংবেলের শব্দে সাদিবের মা সামিরা দরজা খুলে দিলেন। উনার চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম তিনি কোনো বিষয় নিয়ে ভীষণ রেগে আছেন। আমাকে দেখে সরাসরি মুখের ওপর কিছু না বলে বাবাকে নিয়ে পড়লেন।দরজা খুলে তিনি চলে যেতে উদ্যত হলেন। সাথে মুখে চিরাচরিত বুলি ঝাড়তে ভুললেন না।

” আরেকজন তো এনেছেন বন্ধুর মেয়ে তাকে কিছু বলতেও পারি না। বললেই সব দোষ আমার। ভেবেছি ছেলেকে বিয়ে করিয়ে কোথায় শান্তি মতো পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করবো। তা আর হয়েছে কই! যত জ্বালা হয়েছে তো আমার, থাকবো না আমি এ বাসায়। আজি আমি চলে যাবো সব ফেলে। ”

ব্যাগপত্র সোফায় ফেলে মায়ের পেছন পেছন গেলাম উনার রাগ করার উৎস খুঁজতে। উনার সাথে কথা বলতেও আমার আজকাল ভয় লাগে। তবুও বললাম, ” মা কিছু হয়েছে? ”

আমার গলার স্বর শুনে তিনি চুপ হয়ে গেছেন। হয়তো ভাবলেন কথা বলবেন না। অস্বাভাবিক কিছু না। তিনি এমনিতেও আমার সাথে খুব একটা কথা বলেন না। ” মা বলুন না কি হয়েছে? ”

তিনি ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। বুঝলাম শ্বাশুড়ি মায়ের রাগ এখনো কমেনি। মামনির কাছে শুনেছি হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ রাগ করে, তখন সে দাঁড়ানো থাকলে, সে যেন বসে পড়ে। এতে যদি তার রাগ চলে যায় ভালো। না হয়, তবে সে যেন শুয়ে পড়ে।

সাথে তিনি আরো বলেছেন, ” নিশ্চয়ই রাগ শয়তানের পক্ষ থেকে। আর শয়তান আগুনের তৈরি। নিশ্চয়ই পানির দ্বারা আগুন নির্বাপিত হয়। অতএব তোমাদের কেউ যদি রাগান্বিত হয়, সে যেন ওযু করে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৭৮৬)

উনাকে তো এ মুহুর্তে রান্নাঘরে শুতে বলতে পারি না কিংবা ওযু করতে বলার কথাও বলতে পারি না। যদি হিতে বিপরীত কয়েকবাক্য শুনিয়ে বসেন। তাছাড়া আসার পথে যেসব কিছুর সম্মুখীন হতে হয়েছে তাতে করে নতুন কিছু শোনার মানসিকতাও নেই। উনার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে টুল টেনে বললাম, ” মা আপনি একটু এখানে বসুন এবং পানিটা খান। ”

মা কি মনে করলেন জানি না। তিনি আমার মুখের দিকে একবার তাকালেন। তারপর বসে পানিটুকু তিন চুমুকে খেয়ে দম নিলেন। এরপর উনাকে খানিকটা শান্ত হতে দেখে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, ” মা কি হয়েছে একটু বলবেন প্লিজ? ”

সামিরা গম্ভীর গলায় বললেন, ” সকালে কাজের মেয়েটি আসেনি। এদিকে মতির মাও ছুটিতে গেছে। একা একা সব কাজ সামলানোর জো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ”

আমি উনার কথায় স্তব্ধ হয়ে রইলাম। হয়তো আমি আজ বাহিরে না গিয়ে উনাকে সাহায্য করলে এতোকিছুর সম্মুখীন হতাম না। আড়ালে নিজেকে নিজে ধিক্কার দিলাম। ” মা আপনি এ কথাটা আমায় সকালে একবার যদি বলতেন! ”

মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কপাল ভাঁজ করে ফেললেন। ” থাক তার দরকার হয়নি। আমি একাই সব সামলেছি। যাও তুমি ফ্রেশ হও! ”

চলবে…….

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]