তোমার নামে হৃদয় পর্ব-৯+১০+১১

0
297

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (০৯)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
ইরিনা চলে যাওয়ার পর সারা সন্ধ্যা হাসফাস করতে করতে কেটেছে সাদিয়ার। কতক্ষণ নিজের রুমে তো কতক্ষণ ড্রয়িং রুমে পায়চারি করছে মেয়েটা এ আশায় যে, কখন তার ভাই আসবে কখন তাকে সে রাজি করাতে পারবে! আমি আর বাবা বসে বসে সাদিয়ার বাচ্চাসুলভ কান্ডকারখানা দেখছি। বাবা একটু পর পর চোখের ইশারায় আমাকে সাদিয়াকে দেখাচ্ছেন আর মুখ চেপে হাসছেন। মা নিজের মেয়ের কান্ডে বিরক্ত হচ্ছেন।

সেদিন রাতে বাসায় ফিরতে সাদিয়া সাদিবকে চেপে ধরলো। সাদিব তখনো বাসার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে এমতাবস্থায় যে কারোরই মেজাজ খিটখিটে হওয়ার কথা। কিন্তু সাদিবের মধ্যে এমনটা লক্ষ্য করা গেলো না। বরং সাদিয়াকে দৌড়ে আসতে দেখে সাদিব আগেই বুঝে গেছে।

সাদিব সাদিয়াকে এমন তারিকা দৌড়ে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতে সাদিয়া বললো, ” ভাইয়া আমার বান্ধবী ইরিনার বিয়ে সামনের শুক্রবারে। ”

” আলহামদুলিল্লাহ। মেয়ে বড় হলে বাবা মায়ের মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হয় ঘরে রাখতে হয় না। আমারও তোর জন্য পাত্র দেখা শুরু করতে হবে এই জন্যেই আসছিলি তাই না? চিন্তা করিস না যা খুঁজে দেবো তুই যেমন চাস। কি বাবা ঠিক বলছি না? ”

আশফাক শিকদার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

সাদিয়া শিশু সূলভ হাত পা ছুড়তে ছুড়তে বললো, ” ভাইয়া এবার বেশি হচ্ছে কিন্তু! ”

” আচ্ছা তাহলে তুই বল কি চাস? ”

সাদিয়া বিকেলের দিকে ঘটে যাওয়া সবটা বলতে সাদিব কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। উপায়ান্তর না দেখে সাদিয়া আশফাক শিকদারের দিকে করুণ চাহনিতে তাকাতে তিনি সাদিবকে বললেন, ” সাদিব সাদিয়া যখন এতো করে বলছে তাহলে তাদের নিয়ে ঘুরে আয়। বিয়ের পর তোদেরও তো কোথাও যাওয়া হয়নি। অন্তত এখানে তো যেতে পারিস। ”

ছোটবোনের অনুরোধ এবং বাবার আদেশে অগত্যা সাদিবকে বিয়েতে যেতে রাজি হতে হলো। পুরো ব্যাপারটায় আমার অংশগ্রহণ ছিলো নিরপেক্ষ।
.
.
ইরিনার গায়ে হলুদ আর বিয়েতে বান্ধবীদের সবার পোশাক পরিধান রীতি ঠিক হলো শাড়ি। এবং বন্ধুদের মধ্যে ছেলেরা অবশ্যই পাঞ্জাবি পরিধান করবে। শুধুমাত্র গায়ে হলুদে সবার একই রঙের শাড়ি পাঞ্জাবির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাদিয়া সোনালী পাড়ের সাদা শাড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সামিরার কাছে কিছুসময় যাবত ঘুরঘুর করছে তিনি যেন শাড়িটা তাকে পরিয়ে দেন। সামিরা শুরুতে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও বেশিক্ষণ কাঠিন্য প্রকাশ করতে পারলেন না।

সাদিয়াকে সামিরা অতি যত্নের সহিত শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছেন। পরানোর পাশাপাশি এটা ওটা বলে সাবধান করে দিচ্ছেন।

” সাদিবের আশেপাশে থাকবি সাদিয়া! ছেলেদের সাথে একদম বেশি মিশবি না, তোর ভাইয়া কিন্তু এসব একদম পছন্দ করে না। এ আমি বলে দিচ্ছি! ”

” যাবো না বাবা আর কতবার বললে বিশ্বাস করবে বলো তো? ”

” তোকে আমার মোটেও একা ছাড়তে ইচ্ছে করে না সাদিয়া। বড় হচ্ছিস, কবে নিজের ভালো মন্দ বুঝবি? ”

” আচ্ছা তোমার আমার ওপর ভরসা নেই তো ঠিক আছে! তুমি বরং ভাবিকে বলো যেন আমাকে দেখে রাখে আর আমি কি কি করেছি সব যেন এসে তোমাকে বলে, তাহলেই তো হিসেব মিটে গেলো। ”

সাদিয়ার কথা শেষ হতে সামিরার হাত থেমে গেলো। বললেন, ” তাকে আর কি বলবো। সে তো পরের মেয়ে, তার হাতে নিজের মেয়ে তুলে দিতেও ভয়। কি জানি তোকে সাবধান করতে গিয়ে আবার সে নিজে না এসবে জড়িয়ে পড়ে। ”

সামিরার কথায় সাদিয়া অবাক হয়। সামিরার চেয়ে অন্তত একটু বেশি মাত্রায় সাদিয়া তামান্নার সাথে মিশেছে। যতদূর সে জানে তা দ্বারা আর যাই হোক নিজের মায়ের মুখে এমন মন্তব্য শুনে তামান্নার জন্যে খারাপই লাগে সাদিয়ার মনে। নিরব প্রতিবাদস্বরূপ জানতে চাইলো, ” এসব কি বলছো মা। ভাবি কেন এসবে জড়াতে যাবে? যেখানে জানে সে বিবাহিত পাশে তার হাসবেন্ড রয়েছে? ”

” তারপরেও বলা তো যায় না। শয়তানের পাল্লায় পড়ে যে জড়ায় সে আগে পরে কিছু ভাবে না। ”

” তারপরেও বলবো তুমি ভুল ভাবছো মা। আমি ভাবিকে আরো আগে থেকে চিনি। ভাবি এরকম কখনো করবে না। তুমি দেখে নিও! ”

” হয়েছে হয়েছে! যা তৈরি হয়ে নে। ”

শাড়ি পরানো শেষ হতে মেয়ের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে দেখলেন কিছুসময়। মেয়ে হয়ে জন্মেছে যেহেতু আজ ইরিনা কাল ইরিনার মতো সাদিয়াকেও এভাবে বিদায় দিতে হবে কিনা! ভেবে আবেগে চোখের কোণে পানি জমে এলো সামিরার।
.

.
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে তামান্না। সাদিব বাসায় ফিরেছে অনেকক্ষণ। সাদিয়ার ফোনের ওপর ফোন পেয়ে সাদিবকে না চাইলেও সব কাজ ফেলে জোরপূর্বক চলে আসতে হলো। সাদিয়া গুটিগুটি পায়ে রুমে প্রবেশ করলো। রুমের আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখলো কাউকে নজরে পড়লো না। কেবল ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। সাদিয়া ভাবলো তামান্না এখনো সাওয়ারে ব্যস্ত। বিরক্তি বোধ করে চলে যেতে নিলে বেলকনি থেকে তামান্নার কণ্ঠস্বর শুনে দরজার সামনে পুনরায় দাঁড়িয়ে পড়লো।

সাদিয়াকে দেখে তামান্না ডেকে বললো,” সাদিয়া ভেতরে এসো। ”

সাদিয়ার চেহারা থেকে বিরক্তি সরে গিয়ে স্বস্তি ফিরে আসে। তামান্নার দিকে এগিয়ে এসে মুখে হাসি টেনে বললো, ” তুমি এখানে? আমি ভাবলাম তুমি বোধহয় এখনো সাওয়ার নিচ্ছো। যাকগে এবার ফটাফট আমাকে সাজিয়ে দেও তো। শাড়ির সাথে একদম ম্যাচিং হতে হবে বলে দিলাম কিন্তু! ”

তামান্না মুচকি হেসে সায় জানালো। ” ঠিক আছে। তার আগে এটা বলো আমায়, যে তোমার এতো মিষ্টি একটা চেহারা থাকতে শুধু শুধু চেহারায় ভারী মেকাপের আবরণ কেন ফেলতে হবে? তুমি তো ন্যাচরালি অনেক সুন্দর। ”

দু’জনের কথার মাঝে সাদিব সাওয়ার শেষ করে বেরিয়ে আসে। টাওয়েল মেলবার উদ্দেশ্যে বেলকনির দিকে আসে। সাদিয়ার কথার জবাবে বলে উঠলো, ” এটা তোমাদের আজ অব্ধি বোঝাতে পেরেছে কে? কত বলি এতো মেকাপ করতে নেই। মেকাপে ক্ষতিকারক কেমিক্যাল থাকে। পরে চেহারার নানান রকমের ডিজেজ দেখা দেবে। শুনে কে কার কথা? ”

সাদিয়া সাদিবকে শাসানোর ভঙ্গিতে বললো,
” ভাইয়া তুমিও না! এখানে ননদ ভাবির মধ্যে কথোপকথন চলছে তুমি কেন তৃতীয় ব্যক্তি বা-হাত দিচ্ছো? ”

” শুনলি না তো ঠিক আছে দেখবোনি পরে এই ভাইয়ের কথাগুলোই কাজে লাগে। বুঝলে তো তামান্না এ আর প্রিয়ন্তি দু’জনেই একই রকম ঘাড়ত্যাড়া। যখন যা বলে তাই….. ”

কথার মাঝখানে মুখ ফসকে প্রিয়ন্তির নাম বেরিয়ে আসতে সাদিব কথা থামিয়ে গম্ভীর হয়ে যায়। অন্যদিকে সাদিবের কণ্ঠে প্রিয়ন্তির নাম শুনতে তামান্না অবাক না হলেও সাদিয়া খানিকটা অবাক হয়েছে। হয়তো মনে প্রশ্ন জেগেছে, ‘ ভাইয়া কি এখনো নিজের অতীত আগলে বর্তমানকে অবহেলা করছে না তো? ‘ সাদিয়া সাদিবকে কিছু বলতে যাবে তার আগে সাদিব থামিয়ে দিয়ে বলে, ” স্যরি তোদের বিরক্ত করলাম। তোরা রেডি হয়ে নে আমি আসছি। ” বলে সাদিব সেখান থেকে প্রস্থান করে।

সাদিব চলে যেতে সাদিয়া তামান্না দিকে তাকায়। তামান্নার দিকে সান্ত্বনার বাণী ছোঁড়ার আগ মুহূর্তে তামান্না বলে উঠে, ” চলো সাদিয়া দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঔদিকে তনিমাও রেডি হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বললো। ”
.

.
শিকদার ভিলার সামনের গলি থেকে ঠিক এক গলি পরে ইরিনাদের বাসা। হেঁটে গেলে দশ থেকে পনেরো মিনিট খানেক সময় লাগে। সন্ধ্যার পরপর হওয়ায় হেঁটে যেতেও খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবুও সাদিয়ার বায়না সে রিক্সায় যাবে। শাড়ি পরে সে মোটেও হাঁটতে পারবে না। সাদিয়ার সুবিধা বুঝে সাদিব রিক্সা ডাকলো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল রিক্সায় বসার জায়গা নিয়ে। রিক্সায় বসার জায়গা দুইজনের কিন্তু আমরা তো তিনজন। যুক্তি হলো তিনজনের মধ্যে একজন রিক্সার উপরের সিটে বসবে নয়তো কোলে বসবে। এদিকে সাদিয়া আর আমার পরণে শাড়ি। শাড়ি পরে নিশ্চয়ই রিক্সার ওপরে সিটে বসা যাবে না! বাকি রইলো সাদিব। অবশেষে তিনজনের দ্বিধাদ্বন্দের মাঝে সাদিবকে বাধ্য হয়ে ওপরে বসতে হলো। সাদিব ওপরে তার নিচে সাদিয়া এবং সাদিয়ার পাশে আমি। রিক্সার ঝাঁকুনিতে সাদিবের বেহাল দশা। বেচারা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বারবার আমার হাতের বাহু আঁকড়ে ধরছে আর সাদিয়া রিক্সার সিট না ধরে তাকে। সাদিব সারা রাস্তায় যে ভয়টা পাচ্ছিলো ইরিনাদের বাসার গলির মোড়ে এসে ঠিক সেটাই হলো। অনেকটা তীরে এসে তরি ডোবায় কাহিনি ঘটলো যেন……

চলবে……

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (১০)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
রিক্সার ঝাঁকানিতে সাদিবের বেহাল দশা। বেচারা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বারবার আমার হাতের বাহু আঁকড়ে ধরছে আর সাদিয়া রিক্সার সিট না ধরে তাকে। সাদিব সারা রাস্তায় যে ভয়টা পাচ্ছিলো ইরিনাদের বাসার গলির মোড়ে এসে ঠিক সেটাই হলো। অনেকটা তীরে এসে তরি ডোবায় কাহিনি ঘটলো যেন! গলির সামনে আসতে সাদিয়ার সেলফোন বেজে উঠে। সাদিয়া ফোন রিসিভ করতে গিয়ে বাম হাতে ধারণকৃত ফোন ডানহাতে রিসিভ করে কানে ঠেকায়। ঠিক তখনই রিক্সাটাও থেমে যাওয়ার ফলে অসাবধানতা বসত সাদিয়া রিক্সা থেকে নিচে পড়ে যায়। সাদিয়াকে ধরতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে পরপর সাদিব নিজেও হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। দু’ভাইবোনের এভাবে পড়ে যাওয়া দেখে নিজে আর স্থির থাকতে পারলাম না। ভাগ্যিস সাদিব পড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় অন্যদিকে সাদিয়া মাটিতে বসে নেকি কান্না শুরু করে দেয়। আপাতত জনমানবশূন্য হওয়ায় পড়ে যাওয়ার কেলেঙ্কারির জন্য লোকলজ্জার ভয়ে পড়তে হয়নি ঠিকই। কিন্তু রাস্তার আবছা আলোয় সাদিবের চেহারা দেখে বেশ বুঝতে পারছি লোকটা আমার সামনে এভাবে পড়ায় বেশ লজ্জা পেয়েছে। তাকে মেয়েদের মতো লজ্জা পেতে দেখে নিজের হাসি বহু কষ্টে কন্ট্রোল করে রেখেছি তবুও না হেসে পারলাম না।

সাদিয়ার কান্নার শব্দ কানে আসতে সেদিকে দৃষ্টিপাত করলাম। বাম হাতের কনুই ধরে কাতরাচ্ছে বেচারি। হয়তো রাস্তার ভাঙ্গাচুরা পিচের ওপর পড়ে আঘাত লেগে ছিলে গেছে। তার এভাবে কাতরানো দেখে ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা অন করে দেখলাম আমার ধারণাই ঠিক। কনুইয়ের পাশটা একটুখানি ছিলে গেছে৷

সাদিব ততক্ষণে রিক্সাওয়ালার ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। কোমরে হাত দিয়ে রাগী গলায় সাদিয়াকে বললো, ” শাড়ি পরতে না পারলে পরতে হবে কেন তোর? মানে ত্যাড়ামি না করলেই নয়? ”

” ভাইয়া আমি হাতে কিন্তু ব্যথা পেয়েছি তুমি দেখছো না? ” নেকি স্বরে কান্না করতে করতে বললো।

” আর তোর জন্য যে আমি পড়লাম তার বেলায়? ”

” পড়েছে কোথায় তুমি তো দাঁড়িয়ে ছিলে। পড়েছি তো আমি দেখছে পাচ্ছো না এখনো সেভাবে বসে আছি। ”

” একেবারে উদ্ধার করলেন আমাকে। একটা দোষ করলে হতো করেছিস তো দু’টো। শুধু শাড়ি পড়লে এক কথা ছিলো তোকে ফোন রিসিভ করতে বলেছিলো কে? নেমে করা যেতো না? ”

” ইসস রে ভালো কথা বলেছিস ভাইয়া। দাঁড়া দেখি তনিমাকে একটা ফোন করে দেখি মেয়েটা কই আছে? এলো কিনা! ” বলে সাদিয়া কনুইয়ের ব্যথা ভুলে গিয়ে ফোনে মনোযোগ দিলো।

সাদিয়া ফোনে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করে দিলো। সাদিয়া যেতে সাদিব এবার আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ” খুব হাসি পাচ্ছে না? আমার জায়গায় তুমি হলে বুঝতে। ”

” যাব্বাবা এখন সব দোষ আমার হয়ে গেলো? আমি কি আপনাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছি নাকি যে আমার ওপর দোষ চাপাচ্ছেন? ”

” অনেকটা সে-রকমই করেছো। ”

” মানে?? ”

” মানেটা পানির মতো পরিষ্কার। আমি তোমাকে ধরে বসেছিলাম সেটা তো দেখেছো। তাহলে আমি যখন তোমায় ছেড়ে দিয়ে সাদিয়াকে ধরতে গেছিলাম তখন তুমি কি পেছন থেকে টেনে ধরতে পারতে না আমাকে? ”

” হ্যাঁ ধরে তারপর কি হতো? আমি নিজেও আপনাদের সাথে পড়তাম তাই না? ”

” তাহলে একদম হাসবে না বলে দিচ্ছি। হাসলে খবর আছে.। ”

” বারে আমার মুখ দিয়ে আমি হাসবো আপনি বললেই হলো? হাসবো এবার থেকে বরং বেশি করে হাসবো। ভয় পাই যেন আপনাকে হুহ! ” বলে ভেংচি কেটে চলে এলাম।
.

.
ইরিনাদের বাসার বিপরীত পার্শ্বের মাঠটাতে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য ডেকোরেশন করা হয়েছে। অতিথিদের আগমনে এতোক্ষণে ভিড়ভাঙা জমে গেছে। এখানে আসার পর সেই থেকে একবারের জন্যেও সাদিয়াকে দেখতে পাই নি। তাকে খোঁজার জন্য আশেপাশে চোখ বুলালাম। এমন সময় এক জোড়া হাত আমার চোখ জোড়া চেপে ধরলো বলে অনুভব করলাম। অনুমান করতে একটুকুও কষ্ট হয়নি হাত জোড়া ঠিক কার হাত হতে পারে! ঠোঁট জোড়া আমার আপনাআপনি প্রসারিত হয়ে গেলো, মুখে জপলাম,
” তকি! ”

তকি হাত ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। ” কিভাবে বুঝলি এটা যে আমি? ”

” বারে তুই আমার একটা মাত্র ভাই। আমার কলিজার ভাই। তোকে চিনবো না ভাবছিস? তা কি কখনো হয়? ”

” হুমমম বুঝেছি। আমি তো ভাবলাম তুই বুঝি তোর বড় ভাইকে ভুলেই গেছিস। ”

তকির বড়দের মতো কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গিমার ধরণ দেখে না হেসে পারলাম না। ” তনিমা কই? ”

” ইরিনা আপুকে আনতে গেছে দেখলাম। আমাকে দিয়ে তো আরো ইরিনা আপু তোমাকে ডেকে নিতে পাঠালো। ”

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, ” আমাকে কেন? ”

তকি গা ছাড়া ভাব এনে বললো, ” সে তোমাদের মেয়েদের ব্যাপার স্যাপার তোমরা বোঝো। আমি এতো শত বুঝি না বাপু। তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে চলো আমার সাথে। ”
.

.
ইরিনার মাথার ওপর পাতলা হলুদ রঙের ওড়না ছাউনির মতো দিয়ে চারকোণায় তার চার বান্ধবী মিলে ধরে ধীরগতিতে হেঁটে স্টেজের দিকে এগুচ্ছে। সামনে থেকে তাদের কার্যক্রমগুলো ক্যামেরাম্যান নিজের ক্যামেরায় ধারণ করছে। পেছন পেছন বাকিরা ফুল, ফলমূল, হলুদ, কেক ইত্যাদি হরেকরকম জিনিসপাতি সাজিয়ে নিয়ে আসছে। ইরিনাকে হলুদের দিনেই নতুন বউয়ের মতো লাগছে। না জানি বিয়েতে কেমন দেখাবে! মেয়েটাকে দু’দিন আগে যেমনটা দেখেছি হলুদের সাজসজ্জায় চেহারার একদম পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে।

এক এক করে সবাই এসে ইরিনাকে হলুদ লাগিয়ে যাচ্ছে। আমি আর সাদিব দুজন পাশাপাশি চেয়ারে বসে সবার কার্যক্রম দেখছি। সাদিব নিজের ফোন স্ক্রল করে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর পর ফোন থেকে চোখ তুলে আশেপাশে চোখ বুলচ্ছে। চোখমুখে স্পষ্ট বিরক্ত প্রকাশ পাচ্ছে তার। হয়তো সে চাচ্ছে না অযথা এখানে বসে এতো সময় কাটাতে।

সাদিবের ফোনে কল আসায় এদিকের শব্দ এড়াতে সাদিব এপাশ থেকে সরে অন্যপাশে চলে গেলো। সাদিব চলে যাওয়ার মিনিট দুয়েক পর কানে এক অপরিচিত লোকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ” এক্সকিউজ মি! শুনছেন? ”

চারপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে না দেখে জবাব দিলাম, ” জ্বি আমাকে বলছেন? ”

” জ্বি আপনাকেই বলছি। আপনার সাথে একটু দরকারি কথা ছিলো। ”

” বলুন কি বলবেন? ”

লোকটি বললো, ” আমি কি এখানে একটু বসতে পারি? ”

” না। এখানে তো অন্য আরেকজনের জায়গা। আপনার যা বলার আপনি এভাবে বললেই ভালো হয়। ”

লোকটা নিজেকে ধাতস্থ করে বললো। ” আসার পর থেকে অনেকক্ষণ ধরে আপনাকে লক্ষ্য করছি। ”

লোকটার পরের বাক্য কি হতে পারে তা মোটামুটি বুঝে গিয়েছি। আমাকে বলার সুযোগ না দিয়ে লোকটি আমতাআমতা স্বরে বললো, ” মানে কিভাবে যে বলি, আপনাকে আমার প্রথম দেখাতেই খুব ভালো লেগেছে। আমরা কি পরিচিত হতে পারি? সমস্যা নেই আপনি আমার সাথে আগে পরিচিত হয়ে নিন তারপর নাহয় ভাববেন! ”

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লোকটা নিজে নিজেই সব বললো। অতঃপর আমি জবাবে কিছু বলতে যাবো তার আগেই……

চলবে……..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (১১)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
আমি জবাবে কিছু বলতে যাবো তার আগেই লোকটি চলে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো, ” আপনার ভাইয়া আসছে পরে কথা বলবো। ”

ভাইয়া বলাতে শুরুতে ভেবেছিলাম তকিকে বলেছে। তকি উচ্চতার দিক দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে গেছে কিনা! পরক্ষণে পাশে এসে সাদিব বসতে টনক নড়ে উঠলো। দূর থেকেও লোকটিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। তার মানে লোকটি সাদিবকে আমার ভাই ভেবেছে। বাহ এতোদিন ভাবতাম মেয়েদের পছন্দের ছেলেরা ভাইয়া থেকে ছাইয়্যা হয়ে যায় কিন্তু ছাইয়্যাকেও যে মানুষ ভাইয়া বানিয়ে দিতে পারে তা আজ নতুন দেখলাম।

রাত পৌনে বারোটা।
অনুষ্ঠান শেষে এবার ফেরার পালা। সমস্যা বাঁধলো তনিমা আর তকিকে নিয়ে। সাদিয়া অনেক জোরাজোরি করলো তনিমা আর তকিকে রাতটা এ বাসায় কাটাতে। তকি ছোট মানুষ। এ বয়সে সে কোনো বিপদ আপদে পড়লে সহজে সামলানোর মতো বুঝ বুদ্ধি এখনো ওর হয়ে ওঠেনি। তনিমার থেকে ইতিবাচক জবাব পেলাম না কিন্তু এতো রাতে একা ছাড়তেও সাহস হচ্ছিলো না বিধায় সাদিয়ার সাথে সহমত জানালে তনিমা বললো, ” কোন পরিচয়ে নিবি ঐ বাসায়? যেখানে তোর নিজের অবস্থানটাই এখনো পাকাপোক্ত হয়নি! ”

কিছু সত্য কথা তিক্ত শোনালেও তা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তনিমার কথার জবাবে কিছু বলতে পারলাম না। আমাকে নিরুত্তর থাকতে দেখে তনিমা পুনরায় বললো, ” যেদিন তোর মনে হবে ওটা তোর নিজের বাড়ি, ও বাড়ির মানুষগুলো তোর পরিবারের অংশ! সেদিন বলিস, আমি না করবো না। ”

তারপরেও সাদিয়া কম চেষ্টা করেনি তনিমাকে রাখার কিন্তু তনিমা নিজের সিন্ধান্তে অটুট। তা সত্ত্বেও আমি তার বড় বোন হই। সে যদি জেদি হয় তাহলে আমিও কম কিসে! তৎক্ষনাৎ মামনিকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম বাবাকে যেন পাঠিয়ে দেয়। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বাবা এসে তকি আর তনিমাকে নিয়ে যায়।।
.

.
বিয়ের দিনটাও কোনোভাবে কেটে গেছে। সাদিব আমাকে নিজের সাথে সাথে নিয়ে ঘুরেছে। একবারের জন্যেও কেন যেন একা ছাড়েনি। হয়তো গতকালের ঘটনার কিছুটা ইঙ্গিত পেয়েছে।
বৌভাতের দিন হলো আরেক ঝামেলা। সাদিব নিজের গাড়ি নিয়েই বেরিয়েছে। সে গাড়িতে আমরা নিজেরা পাঁচজনই ছিলাম।

গাড়ি থেকে নেমে তনিমারা আগে ভেতরে চলে গেছে। সাদিব গাড়ি পার্ক করতে গেছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সাদিবের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন সেদিনের লোকটি আবারো এসেছে।

” হাই! চিনতে পেরেছেন আমাকে? ”

লোকটির মুখের ওপর না বলে মনে মনে বললাম ” ছাইয়্যাকে ভাইয়া বানিয়ে দেয়া লোক আপনি। চিনবো না আবার? ” কিন্তু মুখে সৌজন্যতা বজায় রেখে বললাম, ” চিনতে পেরেছি। ”

শুনে ছেলেটি মুখে বিশ্বজয় করা হাসি টানলো। বললো, ” সেদিন যে আপনাকে বলেছিলাম সে ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন কি? ”

কথার মাঝখানে সাদিব এসে পড়ে। তাকে গম্ভীর কণ্ঠে বলতে শোনা যায়, ” কি হচ্ছে এখানে? ” কথাটা বলতে ছেলেটি সাদিবকে সালাম দিয়ে সেখান থেকে ছুটে চলে যায়। সাদিব দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বললো, ” আসলাম বোনকে পাহারা দিতে এখন দেখছি বোনকে কম বউকেই বেশি দিতে হচ্ছে। ” বলে আমার দিকে তাকালো।

আমাকে আগে থেকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, ” কি হলো হা করে কি দেখছো? জানি আমি দেখতে ভালো তাই বলে এভাবে একদম দেখবে না। ”

সাদিবের কথায় কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
” ইসসস্ আপনাকে দেখতে বয়ে গেছে আমার। আপনার জন্য দাঁড়ানোই ভুল হয়েছে আমার! ”

” একবারে উদ্ধার করেছে। না দাঁড়ালে তো আমি পথ চিনতাম না যেন! ”
.

.
সাদিবের পাহারায় থাকতে থাকতে দিনগুলো কেটে গেছে। তবে এই তিনদিনে সাদিবের মধ্যে আমার জন্য কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। মনের ভেতরে কমন এক প্রশ্ন ভীষণভাবে উঁকি দিতে লাগলো তা হচ্ছে, সাদিব কি তাহলে আমাকে মেনে নিলো? নাকি শুধুই নিজের দায়িত্ব থেকে এতোকিছু করা?

আমার ভাবনার মাঝে সেলফোনটি সশব্দে বেজে উঠলো। ফোনটি হাতে নিতে দেখতে পেলাম তন্ময়ের ফোন। রিসিভ করতে ছেলেটি ব্যস্ত স্বরে বললো, ” কিরে কই তুই কি আজ ক্যাম্পাসে আসবি না? ”

” কেন আজ কি আছে ক্যাম্পাসে? ”

আমার কথার জবাবে তন্ময়কে অবাক শোনালো। ” সেকি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেছিস? নাকি প্র্যাক্টিক্যাল মার্কের দরকার নেই? ”

” ইসস আমি ভুলেই গেছিলাম। আচ্ছা আমি এক্ষুনি বের হচ্ছি। ”

” আচ্ছা আমি তোর বাসার সামনে দিয়ে আসছি। তুই ব্যস্ত হোস না। ”

তন্ময়কে কি করে বোঝাই আমি নিজের বাসাতেই নেই। বললে নিশ্চয়ই জানতে চাইবে কোন বাসায় আছি। ” না তোকে আসতে হবে না। তুই বরং যা আমি একাই চলে আসছি। ”

” কিন্তু…..

তন্ময়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যাওয়ার আগে একবার সাদিবের মুখোমুখি হয়েছিলাম। দেখে বুঝেছে কোথায় যাওয়ার কথা। ” আসছি ” বলে চলে আসতে নিলে আমাকে অবাক করে দিয়ে পেছন থেকে তাকে বলতে শুনেছি, ” বাসার নিচে গিয়ে দাঁড়াও আমি আসছি। ”

চলবে…….?

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]