তোমার নামে হৃদয় পর্ব-১৫+১৬+১৭+১৮

0
285

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (১৫)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
জেদের বসে পরের দুইদিন ক্যাম্পাসে আমাকে ছায়াও মাড়াইনি। বাসায় থাকলে আগে সেলফোন নিয়ে পড়ে থাকতাম বিধায় মামনির রেডিওটি সারাদিন কানের কাছে বাজতো। সেই সেলফোনটি পর্যন্ত বন্ধ করে দম খিঁচে বসে ছিলাম। কারোর সাথে কন্টাক করার চেষ্টা নিজেও করিনি আমার সাথে যেন কেউ করতে না পারে সেটার ব্যবস্থাও রাখিনি। আমাকে ক্যাম্পাসে যেতে না দেখে সাদিবও তেমন ঘাটেনি।

শুধু একবার জানতে চেয়েছিলো শরীর খারাপ করলো কিনা নয়তো যাচ্ছি না কেন? বলেছি তেমন গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস নেই তাই অযথা যাওয়ার মানে হয় না।

দুইদিন পর ফোন অন করতে তন্ময়ের কন্টাক নাম্বারটি ফোনের স্ক্রিনে দেখা দিচ্ছিলো। দশটার অধিক মিসড কল দিয়ে ফেলেছে। দেখেও ফিরতি কল দেইনি। থোড়াই কেয়ার করি এসবে। আমার তো খুব ভালো চাস তোরা অথচ সেদিন এতোকিছু ঘটে গেলো একটিবার বাচবিচার ছাড়াই সেই তোরাই আমাকে দোষারোপ করে বসেছিলি। এতো ভালো বন্ধুত্ব অথচ বিশ্বাসের বেলায় কৌটা শূন্যস্থানের!

বিকেলবেলা তনিমার সাথে কথা বলছিলাম। তনিমা কথার ফাঁকে তন্ময়ের কথা তুলতে অবাক না হয়ে পারলাম না। ” আপু তোর কি তন্ময় ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে? ”

তনিমা তন্ময় এবং আমার ব্যাপারে শুরু থেকে সবই জানে। মাঝে কয়েকবার তার সাথে তন্ময়ের দেখা হয়েছিলো। তন্ময় আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বিষয়টি তনিমা অব্ধি সীমাবদ্ধ থাকেনি। মামনিও এ ব্যাপারে অবগত ছিলো। মামনি আর তনিমার সাথে পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তন্ময় কখনো আমি ব্যতিত বাসার কারোর সাথে কথা বলেনি। নিসন্দেহে বলা যায় ছেলেটা মেয়েদের চাইতে অধিক লাজুক। আমার নিজের মাঝেও এতোটা জড়তা কাজ করেনা কারোর সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে। স্বভাবেও আমি বেশ মিশুক! এ নিয়ে সবার মুখে কম বেশি শুনতে হয়েছে। সেখানে এ ডিজিটাল যুগে এসে আমার দেখা সবচেয়ে লাজুক ছেলের খেতাব একমাত্র সে-ই অর্জন করেছে। যে কিনা কারোর সাথে খুব একটা মেশা তো দূরের কথাটুকু বলতে জড়তা কাটাতে অক্ষম।

তনিমার মুখে তন্ময়ের কথা শুনে কৌতুহলী মন জানতে চাইলো, ” কেন তন্ময় তোকে কিছু বলেছে আমার ব্যাপারে? ”

” তোদের মধ্যে কি কিছু হয়েছে? ”

পূর্বের রাগ থেকে বললাম,” কিছু থাকলে তো হবে।” এরপর তনিমাকে পুরো ঘটনার আগামাথা সবটা খুলে বললাম।

সব শুনে তনিমা স্বাভাবিক রইল। বলল, ” তোর অগোচরে অনেক কিছু ঘটে গেছে আর তোর রাগের কারণে তুই কিছুই জানতে পারিস নি। ”

” এতো কিছুর পর জানার মতো কোনো আগ্রহ নেই। তুই জানিস ওদের বিহেভিয়ার আমার ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছে? ঐ ছেলেটা পর্যন্ত আমাকে এভাবে খারাপ ভাষায় গালি দিয়ে দিলো। প্রস্রয়টা তো তারাই দিয়েছে। ”

” মানছি এখানে তাদের একটু হলেও দোষ আছে। কিন্তু সবটা তো নয়। তুই কি জানিস তন্ময় ভাইয়া তোকে খুঁজতে বাসা পর্যন্ত এসেছিলো। আমার সাথে গলির মোড়ে দেখা হয়েছিলো শেষে আমার সাথেই এসব ব্যাপারে কথা বলেছে। ”

” ও বাসায় গেছে কেন? ”

” এটাই তো তোকে এতোক্ষণ বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে তোর বোন। কিন্তু তোর মেজাজটাই তো তোকে কিছু জানতে দিচ্ছে না। ”

তনিমার মুখে তন্ময়ের ব্যাপারে সব শুনে নির্বাক। পুরো ব্যাপারটি বুঝতে কিয়ৎপরিমাণ সময় নিলাম। অতঃপর তনিমার সাথে সন্তপর্ণে ফোনালাপের পর্ব সমাপ্তি ঘটালাম।
.

.
তনিমার সাথে কথা শেষ করে নিজের আত্মসম্মানকে সাইডে রেখে তন্ময়ের উদ্দেশ্যে ফোন লাগালাম। কিন্তু তন্ময় ফোন রিসিভ করেনি। বার দুয়েক পর রিসিভ হলো। রিসিভ করে মহিলা কণ্ঠে একজন কথা বললেন। সালাম দিয়ে ভদ্র মহিলার থেকে জানতে চাইলাম তন্ময়কে পাওয়া যাবে নাকি।

মহিলা গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, ” তন্ময়ের সাথে আপনার কি দরকার? ”

তন্ময়ের মুখে ওর মায়ের শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের কথা গত দুই বছর যাবত শুনছি। তাইতো বুঝতে এতটুকুও অসুবিধে হয়নি মহিলা ওর জন্মদাত্রী হবেন। পরিচয়ে কি বলবো মনে করতে শেষে বলে দিলাম, ” আন্টি আমি তন্ময়ের ক্লাসমেট। ওকে তো আজ ক্লাসে দেখি নি তাই ভাবলাম একবার খবর নিয়ে দেখি। ” শেষেরটুকু মিথ্যা বানিয়ে বললাম। নয়তো তিনি যদি সন্দেহ করে বসেন। যদিও পুরো কথাটাই আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো ছিলো। তবে ভাবছি সে যদি সকালে বাসা থেকে ক্যাম্পাসের কথা বলে বের হয় তাহলে নির্ঘাত কপালে শনি আছে।

আমাকে অবাক করে দিয়ে আন্টি জানালেন, ” তন্ময় একটু অসুস্থ তাই যায়নি। সামনের কয়েকদিনও যেতে পারবে না। ”

ভদ্রমহিলার সন্দেহের কথা আপাতত বিবেচনা করা জরুরি মনে করলাম না। সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ” তন্ময়ের কি হয়েছে আন্টি? ”

” আগে বলো তোমার নাম কি? যাকে তাকে তো আর আমার ছেলের ইনফরমেশন দিয়ে দেওয়া যায় না তাই না? ”

পরিচয় জানিয়ে দিতে ওপাশ থেকে কয়েক সেকেন্ড কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না৷ পরক্ষণে শোনা গেলো, ” দুই দিন আগে তন্ময়ের রোড এক্সিডেন্ট হয়েছে। এখনো হসপিটালেই আছে। ”

” আন্টি কাইন্ডলি আমাকে কি একটু হসপিটালের নামটা বলবেন প্লিজ? ”

ভদ্রমহিলা হসপিটালের নাম বলে কথোপকথনের ইতি টানলেন। হসপিটালের নামটি শুনে চমকপ্রদ লেগেছে। কারণস্বরূপ এই হসপিটালেই তো সাদিব থাকবে। থাকলে থাকুক। আপাতত কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করছি না। একেবারে গিয়ে বুঝিয়ে বলবো নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না সে!
.

.
আশ্চর্যজনকভাবে আমি হসপিটালের করিডোরে পা রাখতেই সাদিবের সাথে দেখা হয়ে গেলো। আমি তাকে দেখে অবাক হলেও সে আমাকে দেখে একটুকুও অবাক হলো না। যেন সে আগে থেকেই জানতো আমি এখানে আসবো। এতোক্ষণ তন্ময়ের সাথে দেখা করার প্রবলতর উৎসাহ কাজ করলেও সাদিবকে দেখার পর সব কোথাও যেন উধাও হয়ে গেলো। সাদিবের চেহারা দেখে নিজের মাঝে বেশ সংকোচ বোধ কাজ করছিল।

ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে সাদিবের দিকে এগিয়ে গেলাম , ” সাদিব আসলে আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম! ”

” আমার কাছে কেন? তুমি তো সহজে আমার সাথে খুব একটা কথা বলো না। আর হঠাৎ করে তোমার যে এতো উন্নতি হলো? ”

সাদিবের বিস্মিত চেহারা দেখে বুঝলাম তাকে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছি আমি। এরপর তাকে কি বলবো সেটা ভাবতে গিয়ে এবার কথাগুলো গলা পর্যন্ত এসে আটকে গেছে। বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, ” ঠিক বুঝলাম না! ”

” এইযে আমাকে তুমি আগে ডাকতে ডাক্তার সাহেব। এমনকি সকালেও এ নামে ডেকেছিলে। এখন এক দৌড়ে নাম ধরে সম্বোধন তারওপর আপনি থেকে তুমি! ভাববার বিষয় না বলো? ”

গায়ে পরিধানকৃত ওড়নাটির এক কোণা তর্জনীতে প্যাঁচাতে লাগলাম। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছি, ” প্লিজ আল্লাহ আমার ভুলের জন্য এবার সাদিব যেন ভুল না বুঝে আমায়! ”
.
চলবে……

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (১৬)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
আমার বিষন্ন মুখখানি নজরে পড়তে সাদিব শব্দ করে হেসে ফেললো। তার চেহারার ভাবখানি এমন যেন কেউ ওর সামনে খুব হাসির কৌতুক বলেছে। হতবিহ্বলের সাথে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে সাদিবের পানে চেয়ে আছি। হঠাৎ হাসির মতো কি করলাম যে লোকটা আমাকে ঘাবড়াতে দেখে ভীষণ মজা পাচ্ছেন।

সাদিব হাসি থামিয়ে বলল, ” তুমি এতো ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন? আ’ম জাস্ট কিডিং! ”

নিশ্চুপ থেকে সাদিবের হাবভাব বুঝতে চেষ্টা চালালাম। আমাকে স্বাভাবিক হতে না দেখে হাত ধরে টেনে সামনের দিকে অগ্রসর হলো আর মুখে বলল, ” চল তোমাকে তোমার গন্তব্যে পৌঁছে দেই! ” বলতে বলতে সামনের এক কেবিনের সামনে গিয়ে থেমে গেলো। যে কেবিনটার খোঁজ আমি হসপিটালের করিডোরে ঘুরে ঘুরে এতোক্ষণ যাবত খুঁজে চলছিলাম। কেবিনের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলল, ” ভেতরে যাও এখানেই তন্ময় আছে। ”

সাদিবের কথায় অবাক না হয়ে পারলাম না। ও কি করে জানলো তন্ময় এ কেবিনে থাকতে পারে? ও কি তবে সেদিন তন্ময়কে ভালোভাবেই খেয়াল করেছে? হয়তো এমনটিই হবে। সাদিব পুনরায় ইশারা করতে দেরি না করে ঢুকে পড়লাম। পেছন থেকে সাদিব ঢুকতে নিয়েও কি মনে করে ঢুকলো না। কেবিনের ভেতরে চোখ বুলিয়ে দেখলাম তন্ময়ের মা নেই। যাক হাফ ছেড়ে বাঁচা গেলো। ভদ্রমহিলাকে আমি যমের মতো ভয় পাই। তন্ময়ের হাতে এবং মাথায় ব্যান্ডেজ করা। আমাকে দেখে মুখখানি পেচার মতো বানিয়ে ফেলেছে।

” এতোদিনে গুমানওয়ালির গুমান ভাঙছে। মরছি আর পরে খবর নিতে আইছে! ”

” কই মরছিস? এখনো জলজ্যান্ত মানুষ বসে আছিস দেখতেই তো পাচ্ছি। ”

” ওপর দিয়ে তো ঠিকই দেখবি। কিন্তু ভেতরটা তো ঠিকই জ্বালিয়ে ছারখার করে দিছিস! ” কথাটা গোমরা মুখে আস্তে করে বলল তন্ময়।

তন্ময় ভেবেছিলো ওর কথা আমার কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছাতে পারবে না। অথচ ও না বললেও আমি বুঝতে পারি তার মনের অবস্থা। দীর্ঘ শ্বাস চেপে বললাম, ” বুঝলাম নাহয় ছ্যাকা খাইছিস। কিন্তু এসব কিভাবে ঘটালি? ”

” এখন কি আবার ঘটিয়ে দেখাবো? যদি বলিস তাও দেখাতে রাজি আছি। ”

তন্ময় অতোটা অবুঝ না সেটা জানি। কিন্তু তার চোখে মুখে আমার জন্য সে মুহূর্তে আমি স্পষ্ট ক্ষোভ দেখতে পাচ্ছি। ক্ষোভ কমাতে ঠাট্টার ছলে বললাম, ” বাব্বাহ তোর আবার রাগও আছে? জানতাম না তো! ”

” জানবে কি করে। ওর যত রাগ সব তো আমার ওপরই দেখায়। এখন বুঝুক যার পেছনে এতো এতো সময় ব্যয় করেছে তাকে চিরতরে হারিয়ে কেমন লাগে! যত নিষেধ করতাম আমার কথা শুনলে তো ছেলেটা! ” পেছন থেকে তন্ময়ের মায়ের গলা শুনে চুপসে গেলাম। তিনি যে কথাগুলো আমাকে ইঙ্গিত করে বলেছেন তাতে এতটুকুও সন্দেহের অবকাশ নেই।

ভদ্রমহিলার কথায় তন্ময়ের পাশে বসা টুল থেকে উঠে গিয়ে উনাকে সালাম দিলাম। সালামের জবাবে তিনি কিছুই বললেন না। উল্টো সেরকম গুরুগম্ভীর হয়েই রইলেন। মহিলা যে স্পষ্টবাদী তা এতোদিন তন্ময়ের মুখে শুনলেও আজ সামনে থেকে দেখলাম। তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” তা তোমার হাসবেন্ড জানে তো, যে তুমি তোমার প্রাক্তন প্রেমিককে দেখতে এসেছো? ”

” জানে! ” মাথা নিচু অবস্থায় জবাব দিলাম।

আমার ইতিবাচক জবাবে তিনি আশ্চর্য হলেন। আমার মাথা থেকে পা অব্ধি আগাগোড়া একবার খুঁতিয়ে দেখলেন। বললেন, ” বেশ ভালো তো! তোমার ভূত আমি ওর মাথা থেকে গত দুই বছরেও বের করতে পারিনি বুঝলে তো? তাই তো যখন এখানে আসার আগ্রহ প্রকাশ করলে দেরি না করেই তোমাকে আসতে বলে দিলাম। তোমাকে দেখার বহুদিনের সখ ছিলো আমার। জানি না ছেলেটা কি এমন দেখেছে তোমার মাঝে। আহামরি সুন্দরীও তো নও। ”

ভদ্রমহিলার কথাগুলো আমার গায়ে কাঁটার মতো ফুটছে যেন! উনার কথায় কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না।

তন্ময় ওর মায়ের কথায় বিরক্ত হলো। ” থাক না মা এসব কথা। ও আমার ভাগ্যে ছিলো না তাই ওকে আমি পাইনি। ভাগ্যে থাকলে ওকে কেউ কখনোই আমার থেকে আলাদা করতে পারতো না। ”

ছেলের কথার তোয়াক্কা না করে তিনি আরো বললেন, ” মায়ের দোয়া সত্যিই কবুল হয়। প্রায়ই দোয়া করতাম তোমার ভূতটা যেন আমার ছেলের ঘাড় থেকে চটজলদি ছেড়ে যায়। এতোদিন শান্তিতে নিশ্বাস নিতে পারছি। ”
.

.
আন্টি নিজের মনের ভেতরে এতোদিনে পুষে রাখা সকল ক্ষোভ উগ্রে ফেলতে চাইলেন। সেটাও নূন্যতম ঝগড়াবিবাদ কিংবা চেচামেচি ছাড়াই। সাক্ষী হিসেবে রইল কেবল তন্ময়। তন্ময় চেয়েও নিজের মাকে সেসময় থামাতে পারেনি। আমিও উনার কথায় রা শব্দটিও করিনি। বলুক উনি মা হিসেবে ছেলের দুর্দশায় কথাগুলো আমাকে বলতেই পারেন৷ তাতে যদি তার চোটে যাওয়া আত্মার শীতলীকরণ হয়!

সে মুহুর্তে নিজের কাছে নিজেকে সবথেকে বেশি অসহায় লাগলো। এতোটা অসহায় অবস্থার সম্মুখীন আমার জীবনে এর আগে কখনো হতে হয়েছপ বলে মনে পড়ছে না। আমার সেদিনের ব্যবহারের কারণে পানি যে সমুদ্রের স্রোতের মতো এতদূর গড়াগড়ি খাবে সেটা যদি ঘূনাক্ষরেও টের পেতাম তাহলে কিছু বলার আগে নিশ্চয়ই ভেবে চিন্তে ঠান্ডা মাথায় বলতাম। তন্ময়কে পরে অবশ্য বুঝিয়ে বলতে পারতাম কিন্তু তার আগেই এতোসব ঘটনার সূত্রপাত ঘটলো। আমার অসহায়ত্ব বোধহয় মহান আল্লাহর দরবারে গিয়ে ঠেকেছে। তাইতো সেসময় তন্ময়ের মায়ের কাঁটা বিঁধানো কথাগুলোর হাত থেকে বাঁচাতে সাদিব এসে হাজির হলো। সাদিবের হাসোজ্জল কণ্ঠে সবার দৃষ্টিপাত সেদিকে ঠেকলো, ” এখন কেমন বোধ করছো তন্ময়? ”

তন্ময়ও মৃদুস্বরে জানালো, ” আগের থেকে ভালো!”

তন্ময়ের মা সাদিবকে জিজ্ঞেস করলেন,
” তন্ময়কে কি তাহলে আজ বাসায় নিতে পারবো? কি বুঝলেন ডাক্তার? ”

তন্ময়ের মায়ের এবং সাদিবের কথোপকথনের মাধ্যমে এতোক্ষণে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। তখন এজন্যই তাহলে সাদিব আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু তাতেও সন্দেহ একটু রয়েই গেলো, যে তন্ময়কে সাদিব চিনলো কিভাবে দেখেছে তো তাও এক ঝলক। তারওপর দূর থেকেই সেটা বলা চলে। তন্ময় কি তবে আমার ব্যাপারে সাদিবকে সবটা খুলে বলেছে? যদি সাদিব সবটা জেনেও থাকে তাহলে এতোটা স্বাভাবিক থাকছে কেমন করে লোকটা?

তন্ময় ওর মাকে লক্ষ্য করে বলল, ” মা ইনি মানে ডক্টর ইরফান সাদিব-ই হলো তামান্নার হাসবেন্ড। ওর পাশাপাশি ওর হাসবেন্ডকেও দেখে নেও। নতুবা পরবর্তীতে উনাকে দেখারও সখ জাগতে পারে তোমার৷ ”

তন্ময়ের কথা শুনে তিনি চমকালেন ঠিকই কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না। বরঞ্চ আড়চোখে দুজনকে মিলিয়ে দেখেছেন।

চলবে……

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (১৭)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
গায়ে শুভ্র এপ্রোন, গলায় স্টেথোস্কোপ জড়িয়ে সামনের চেয়ারে বসে থাকা লোকটির দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছি। কিন্তু তার ধ্যান রয়েছে সম্পূর্ণ অন্যদিকে। সাদিব পেশায় একজন অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ। চোখে জুড়ে দেওয়া চশমার ফাঁক ঘেষে সে দেখতে ব্যস্ত হাতে থাকা রিপোর্টের দিকে। যেটা কিনা তন্ময়ের রিপোর্ট। তন্ময় দুইদিন আগে বাইকের ব্রেক ফেল করে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। ভাগ্য ভালো থাকায় শরীরে মারাত্মক ভাবে জখম হয়নি। নয়তো দেখা যায় বেশির ভাগ বাইক দুর্ঘটনায় যুবসমাজকে প্রায় বেশিরভাগেরই বড় ধরনের ক্ষয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। চারিদিকে এমন অহরহ ঘটনা নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারে। কিন্তু যার যায় সেই বুঝে কি হারিয়েছে। তন্ময়ের মায়ের তন্ময়কে নিয়ে অনেক আশা। একা হাতে মানুষ করেছেন তিনি ছেলেকে। তন্ময় ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। সেই থেকে তন্ময়ের মা ভীষণ শক্তপোক্ত একজন মানুষে পরিণত হয়েছেন। কথায় আছে অতি শোকে মানুষ পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে যায়! উনার ব্যাপারটা ঠিক সেরকম।

তন্ময়েরও সেরকম কিছু হতে পারতো। আল্লাহর অশেষ রহমত আর তখন ওর মায়ের বলা উনার দোয়ার কথা! মায়ের দোয়ায় উনার ছেলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেলো।

তন্ময়কে রিলিজ দিয়ে দেওয়া হয়েছে সাথে সাদিব তন্ময়কে আগামী এক সপ্তাহের জন্য বেড রেস্টে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। তন্ময়রা চলে যাওয়ার আগে আন্টি আমাকে আর সাদিবকে নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানালেন। অন্যদিকে তন্ময় মুখ ঘুরে অন্য পাশ ফিরে ছিল। মুখে কোনো কথা না বললেও ওর চোখ জোড়া অনেক কিছুই বলতে চাইছিল।
.
.
তন্ময়রা চলে যাওয়ার পর এতোক্ষণ যাবত লুকিয়ে রাখা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লাম। তন্ময় চলে যাওয়ার পর সাদিবও আগের তুলনায় খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেছে। আমাকে বলল, ” টায়ার্ড লাগছে নিশ্চয়ই! বাসায় যাবে না? ”

” না তেমন কিছু না। তুমি কখন ফিরবে? ”

যদিও সাদিব ইদানীং বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরে যায়। যা দেখে বাবা আর সাদিয়ার আশঙ্কা সাদিবের মতিগতির পরিবর্তন ঘটেছে।

আমার মুখে তুমি সম্বোধন শুনে সাদিবের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো। হাত ঘড়িটির দিকে নজর বুলিয়ে দেখলো। দুপুর পেরিয়েছে অনেকক্ষণ।

” লান্সটা কি বাসায় ফিরে করবে নাকি বাহিরেই করবে? ”

এতোক্ষণ তন্ময়ের মায়ের কথাগুলো ভেবে খারাপ লাগছিলো। কিন্তু এখানে সাদিবের কথা শুনে বরং খারাপ লাগা থেকে মেজাজ বিগড়ে যেতে চাইল। বহু কষ্টে সংযত করছি। ইচ্ছে করছে মুখের ওপর দু’চারটা কথা বলে বসি। আগে তন্ময়কে আজীবন আবুল বলে এসেছি। বলতাম, ‘তুই আসলেই একটা নিরামিষ। কিছুই বুঝিস না। ‘ ছেলেটাও মজার ছলে বলতো, ‘ আমাকে এখন নিরামিষ বলছিস দেখে নিস তোর জামাই এর থেকে বড় নিরামিষ হবে। ‘ তার বদদোয়া যে সত্যি ফলে যাবে যদি আগে ঘূনাক্ষরেও টের পেতাম। মানে আমি বুঝি না কেমনে কেউ বলবে,’ না আমি বাহিরে খাই না, প্লিজ ঘরে ফিরে চলুন! ‘

মনের কথা মনে ধামাচাপা দিয়ে বললাম, ” তোমার তো বাসায় ফিরতে দেরি হবে তাই না? আমি বরং বাসায় চলে যাই। ”

সাদিবের হেলদুল না দেখে হাঁটা ধরলাম। এখানে আর থেকে কাজ নেই। তন্ময়কে দেখার দরকার ছিলো দেখেছি। সাথে অবশ্য উনার সাথেও দেখা হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিনকার সাদিবের সাথে আজকের সাদিবের মধ্যে একটু অমিল খুঁজে ফেলাম। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের লোকটাকে একেক পরিবেশে একেক রকম লাগে। উনি কি দেখতে আসলেই এতো সুন্দর। নাকি উনার অর্ধাঙ্গীনি হওয়ার উসিলায় আল্লাহ তায়া’লা আমার চোখেই উনাকে সবচেয়ে সুদর্শন করে দিয়েছেন! কই বিয়ের আগে যে কয়দিন দেখেছি তখনও তো এতো ভালো লাগতো না।
.

.
হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে আছি একটা সিএনজির জন্য। পরিবেশে রোদের তীব্রটা তেমন নেই। সূর্য আস্তে আস্তে পশ্চিম দিকে হেঁলে যাচ্ছে। সাদিব পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কখন খেয়াল করিনি। কর্ণকুহরে তার শান্ত গলায় ধ্বনি পৌঁছাতে মৃদু কেঁপে উঠলাম। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ” তুমি কখন নিচে নেমে এলে? ”

লোকটার চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” তোমার পরপরই। দেখলাম তোমার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়! ”

সাদিব পরম যত্নে আমার হাত তার হাতের দ্বারা আঁকড়ে ধরলো। হুটহাট অধিকারবোধ দেখানোতে রাগ করা উচিত কিনা জানি না। আমার কাছে বরং তার অধিকারবোধ প্রয়োগ করাটাই এক আলাদা শান্তি দিচ্ছে। সবথেকে বেশি অবাক লাগছে তার এতো সহজে সবটা মানিয়ে নেওয়া দেখে।

এভাবে বলা কওয়া ছাড়া সামনের দিকে অগ্রসর হতে দেখে কৌতুহলী মন জানতে চাইলো,
” আমরা কোথায় যাচ্ছি? ”

” চলো, গেলেই দেখতে পাবে। ”
.

.
গাড়ি চলছে অজানা গন্তব্যের দিকে। যে গন্তব্যের শেষটা আমার জানা নেই। কিয়ৎক্ষণ সময় চলার পর গাড়িটি একটি রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। ভেতরে ঢোকার সময় ভাবলাম, ‘ যাক, তন্ময়ের দোয়া বিফলে গেলো তাহলে। ‘ এতোক্ষণ খিদের প্রকোপ বেশি প্রকাশ না পেলেও এখন মনে হচ্ছে খিদায় আমার পেটের ভেতর ইঁদুর বাঁদর সব ছোটাছুটি করতে শুরু করেছে। মেনু কার্ডে চোখ যেতে সবার আগে নজর পড়লো কাচ্চির দিকে। কাচ্চি আর বিরিয়ানি দেখলে আমার মাথা এমনিতেই ঠিক থাকে না। সাদিব সামনে বসে ফোনে মনোযোগ দিয়ে বলল, ” কি খাবে অর্ডার করো! ”

ক্ষুধার্ত পেট বলছে তোকে এই কাচ্চিটাই খেতে হবে। কিন্তু মন মস্তিষ্ক বলছে, ‘ সামলে তামান্না! সামনের লোকটার কাছে তো নিজের ভদ্রতা বজায় রাখতে হবে নাকি! নয়তো মান ইজ্জত সব তো ধুলোয় উড়িয়ে দিবি। ‘

ভদ্রতাসূচক বললাম, ” তুমি অর্ডারটা করে দেও না! ”

সাদিব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ” সিউর তুমি? আমি দেবো বলছো? ”

এতো সিউরের কি আছে। মনের অবস্থাটা বুঝে কাচ্চিটাই দিয়ে দিন না! আমাকে খোঁচা দিয়ে ভদ্র মহিলার মুখোশ থেকে বের করিয়ে আনবে নাকি লোকটা? কিন্তু মাথা নাড়িয়ে সমস্যা নেই বলে সম্মতি জানালাম।

সাদিব ফোন রেখে মেনুতে মনোযোগ দিলো। ওয়েটারকে ডেকে সাদা ভাত, মাছ, সবজি, মাংসের অর্ডার দিয়েছে। ওয়েটার চলে গেলে আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় জানতে চাইল,
” ঠিক আছে? এগুলোতে কোনো আপত্তি নেই তো? ”

সাদিবের এহেন কান্ডে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম। মনে মনে মাথা চাপড়ালাম। দূর কচুর ভদ্রতা দেখাতে গেলাম। কোন কুক্ষণে যে বললাম না কাচ্চির কথা। তবুও সাদিবকে বুঝতে না দিয়ে বললাম, ” না সমস্যা নেই। ”
.

.
সেদিন সারা বিকেল বাহিরে সাদিবের সাথে কাটিয়েছি। এই প্রথম এতোটা সময় ধরে দুজনে বাহিরে বেরিয়েছি। কখনো ভাবিনি সাদিব এতো হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ। তার বাহির এবং ভেতরটা সম্পূর্ণ আলাদা। এতোদিন নিজের ভেতরে হাসিখুশি মানুষটাকে যে কিভাবে সে লুকিয়ে রেখেছে কে জানে! নিজেই নিজের ভাগ্যকে নিয়ে গর্ববোধ করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। প্রিয়ন্তিকে সেই মুহূর্তে কাছে ফেলে নিশ্চিত খুশিতে আত্মহারা হয়ে এত্তগুলা ধন্যবাদ জানিয়ে দিতাম। সন্ধ্যার পরপর দুজনকে একসাথে বাসায় ফিরতে দেখে সবার চোখ ছানাবড়া। লক্ষ্য করলাম বাসায় বাবা আর মামনির উপস্থিতি। আমাদের দেখে সকলের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল। শুধুমাত্র একজনের ব্যতিত…..

চলবে……

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (১৮)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
মনে মনে নিজের ভাগ্যকে নিয়ে গর্ববোধ করছি। প্রিয়ন্তিকে কাছে ফেলে মন চাইছে এত্তগুলা ধন্যবাদ জানিয়ে দেই। সন্ধ্যার পরপর দুজনকে একসাথে বাসায় ফিরতে দেখে সবার চোখ ছানাবড়া। সাথে লক্ষ্য করলাম বাসায় আমার বাবা এবং মামনির উপস্থিতি। আমাদের দেখে সকলের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল। শুধুমাত্র একজনের ব্যতিত। তিনি হচ্ছেন আমার শ্বাশুড়ি অর্থ্যাৎ সাদিবের মা। উনি দু’জনকে পাশাপাশি দেখে আড়ালে সটকে গেলেন। কেন জানি না একমাত্র তিনিই আছেন যিনি আমার আর সাদিবের বনিবনা পছন্দ করেন না!

বাবা মামনি সন্ধ্যার পরপরই চলে যান। তনিমা আর তকি আসেনি। তারা বাসায় একা আছে বিধায় বাবা মা আমার সাথে দেখা হতে চলে গেছেন। তনিমা না আসার পেছনে বড়সড় কারণ আছে। তাই তো বিয়ের দিন ব্যতিত তনিমা এ বাসার মুখো হয়নি। রুমে এসে আমি বিছানার বুকে ঝাপিয়ে পড়লাম৷ সাদিব তখনো আসেনি। হয় ড্রয়িং রুমে নয়তো তার মায়ের কাছে আছে। আস্ত এক মা পাগল ছেলে। এখনো সবার আগে এসে তার মাকেই চাই। শ্বাশুড়ী হয়তো এজন্যই ছেলেকে সারাদিন চোখে হারান সাথে ছেলের বউকে মনে করেন চক্ষুশূল! এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমে চোখটা প্রায় লেগে এসেছে। প্রায় আধঘন্টা খানেক বাদে দরজা খোলার শব্দ কানে ভেসে এলো। এতোক্ষণে সাদিব চলে এসেছে। যাকগে সে আসুক বা না আসুক তাতে আমার কি? আমার ঘুম হলেই হলো। চোখে ঘুম লেগে থাকলেও পুরোপুরি হুশ হারাইনি তখনো।

আমার পাশে সাদিবের উপস্থিতি টের পাচ্ছি। পিটপিট করে চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করছি কি করছে। চোখ খুলতে দেখি সে এদিকে তাকিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে। যদিও চশমার ওপরের গ্লাসে তার চোখ জোড়া স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না যে, সে ঠিক কোন দিকে তাকিয়ে আছে। আদৌও কি এদিকে কিনা সে বিষয়েও না। আমাকে চোখ খুলতে দেখে বলল, ” ঘুমাও নি? ”

সন্দিহান হয়ে বললাম, ” তার আগে বলুন আপনি কোন দিকে তাকিয়ে ছিলেন? ”

সাদিব মুচকি হাসলো। চোখ দিয়ে ইশারা দিলো। যাতে সম্পূর্ণ আলাদা অর্থ বহমান রয়েছে। জিজ্ঞেস করলো, ” কেন? কোন দিকে তাকিয়েছি?”

তার হাসিতে আমার নিজের দিকে খেয়াল হলো। তাকিয়ে দেখলাম পায়জামা অনেকটা পায়ের ওপর উঠে গেছে, ওড়নারও অবস্থা ঠিকঠাক মতো নেই। ধাতস্থ হয়ে বললাম, ” আপনাদের চোখ এতোদিকে যায় ইশ! একটুও লাজ লজ্জা নেই। ”

সাদিব ভ্রু কুঁচকে বলল,” আপনাদের? ”

” হ্যাঁ, আপনাদের। ”

” তা আপনাদের বলতে কাদের বুঝিয়েছ? আমার আগে কি অন্য কারোর সাথে রাত কাটিয়েছো নাকি? ”

সাদিবের কথায় থতমত খেয়ে গেলাম। ” না তো! ”

” তাহলে আপনাদের কেন বললে? ”

” আপনাদের বলতে পুরুষ মানুষদের বুঝিয়েছি। যারা মেয়ে মানুষের দেখলে এমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ”

সাদিব কি বুঝল জানি না। আমার কথার দ্বারা তার কপালে ভাঁজ পরিলক্ষিত হলো। ” তুমি এভাবে বেসামাল হয়ে থাকবে আর কেউ তাকালেই বলবে দোষ? আর তাকালে এতই যখন লাগে তখন নিজের দিকে খেয়াল রাখতেও জানতে হয়। ”

” আমি দেখালেই তোমার দেখতে হবে কেন? তুমি দেখবেন না। পরেরবার থেকে যেভাবেই থাকি না কেন, অন্যদিক ফিরে তাকিয়ে থাকবে বুঝেছ? ”

” পারবো না! ”

” পারবেন না মানে? তুমি পারবে তোমার ঘাড় পারবে। ”

সাদিব আমার কথায় বিরক্ত বোধ করল, ” তামান্না এবার একটু বেশি হচ্ছে না? আমি প্রচন্ড টায়ার্ড। আমাকে সাইড দেও। ”

সাদিবের ক্লান্তির কারণ বুঝতে পেরে নিজেকে নিজে ধিক্কার জানালাম। সত্যি একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে বেচারা ক্লান্ত বোধ করারই কথা। কবে যে মাথায় জমিয়ে রাখা নূন্যতম বুঝ বুদ্ধিগুলো কাজে লাগাতে পারবো হায় আল্লাহ!
.

.
রাতের ঘুম যে সেই ভেঙেছে তারপর আর ঘুম আসেনি। এপাশ ওপাশ ছটপট করছি খালি। কিছুতেই চোখে ঘুমের ধরাছোঁয়া নেই। তারওপর যেদিন রাতে ঘুম হয়না, দেখা যায় সেদিনের রাতটার মতো দীর্ঘ রাত বোধহয় আর একটাও হয়না। বিছানার পাশ থেকে হাতড়ে ফোনটা বের করলাম। রাত তিনটে বাজে। উপায়ান্তর না পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাহিরে চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে৷ জানালা থেকে সরে বেলকনির দিকে পা বাড়ালাম। উদ্দেশ্য ঘুম না আসলে সারারাত বেলকনিতে বসে চাঁদ দেখতে দেখতে রাত কাটিয়ে দেওয়ার৷ যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বেলকনির কোণায় থাকা রকিং চেয়ারে বসে একা একা মনের সুখে চাঁদনিরাত উপভোগ করতে লাগলাম। এটা আমার একটা বিশেষ গুণ কিনা জানা নেই। হামেশাই যখন আমার রাতে ঘুম আসে না। তখন আমি চাঁদ দেখি আর একা একাই চন্দ্রবিলাস করে কাটিয়ে দিতে পারি।
.
.
.
সকালে সূর্যের সোনালি রোদের আবছা আলো চোখে পড়তে ঘুমটা ভেঙে গেলো। চোখ খুলে আশ্চর্য হলাম যখন দেখতে পেলাম বেলকনির যে অংশে আমি ফিরে শুয়ে আছি সেখানে অর্থ্যাৎ আমার চোখের সামনের অংশে কাপড় দেওয়া যেন রোদের আলো এসে চোখে না পড়ে। উঠে আড়মোড়া ভাঙতে দেখলাম সাদিব ভেজা চুল টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছতে বেলকনির দিকে এসেছে। উন্মুক্ত বুক, পরণে টাউজার। সামনে আসতে লজ্জায় চোখ নিচে নামিয়ে ফেললাম৷

” গুড মনিং! ঘুম কেমন হয়েছে? ”

” গুড মর্নিং। ভালো হয়েছে। ”

” এখনো বসে আছো কেন? রুমে যাও ফ্রেশ হও। নাকি আজও কলেজে যাবে না। ”

” না আজ যাবো৷ কালও যাইনি। কিন্তু তার আগে তুমি সামনে থেকে সর! ”

” কেন আমি তোমাকে আবার কি করেছি? ”

” এভাবে এসেছ কেন.? তোমার লজ্জা না থাকতে পারে আমার যথেষ্ট আছে। ”

” আমি যেভাবেই থাকি৷ তুমি দেখবে কেন? ”

” বাহ্ রে এভাবে উন্মুক্ত শরীর নিয়ে যে কারোর সামনে ঘুরঘুর করবে কেন? ঘুরলে সবারই নজর যাবে। ”

” কেন কাল না বলেছিলে তুমি যেভাবে খুশি থাকবে খালি আমি তাকাতে পারবো না? তাই এখন আমিও যেভাবে খুশি থাকবো তুমি তাকাবে না ব্যস! ”

সেকি লোকটা তো দেখছি আমার জালে আমাকেই ফাঁসিয়ে দিয়েছে। কি চালাক ভাবা যায়? উপায়ান্তর না পেয়ে চলে যাচ্ছিলাম। সাদিবের সামনে থেকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সাদিব পেছন থেকে আমার এক হাত টেনে ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। অতঃপর তার উন্মুক্ত বুকে আমার পিঠ ঠেকে গেছে। কানের কাছে মুখ এনে বলল, ” একেই বলে টিট ফর ট্যাট!”

চলবে……..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]