তোর অনুরাগে পর্ব-১১

0
299

#তোর অনুরাগে
#লেখনীতেঃতানজিলা_খাতুন_তানু
#পর্ব_১১

_________

নীলি রোশানের দিকে তাকিয়ে আছে কৌতুহল দৃষ্টিতে।

রোশান নীলির দিকে তাকিয়ে বলতে চালু করলো।

রোশানঃ আমি মেয়েদের সাথে ফ্ল্যাটিং করলেও কখনোই কারোর সাথে রিলেশনে যেতাম না। আর কিভাবেই বা রিলেশনে যাবো বলো মা বাপি বলেই রেখেছিলো তোর জন্য মেয়ে ঠিক করা আছে তাই অন্যকারোর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরবি না। কখনোই সেই মেয়েটা কে আমি জানার চেষ্টা করিনি। কারন জানতাম আমি না চাইলেও সে আমার হবে, নিজের জীবনটা নিজের মতো করে চালাতাম কিন্তু যেদিন প্রথম তোমাকে দেখি আমার সবকিছু উলোট পালট হয়ে যায়। আমি কেন জানিনা কোনো মেয়ের দিকে আর তাকাতে পারতামনা,,, ফ্ল্যাটিং করা তো দূরের। যেদিন তুমি আমাকে সবার সামনে কথা শোনালে সেদিন আমার তোমার উপরে রাগ হয়নি নিজের উপরে রাগ হয়েছিলো,কষ্ট হয়েছিলো খুব তোমার মুখে ওই কথা গুলো শুনে। আমি ওখান থেকে চলে যায়,, তোমার সাথে কথা বলা এমনকি তোমার মুখোমুখি হওয়া বন্ধ করে দিই কারন ছিলো দুটো,, তোমার কথা দেখে মনে হয়েছিলো তুমি আমাকে খুব অপছন্দ করো সেই কারনে। আর একটা কারন হলো,, আমি নিজের মনের অজান্তেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলি,, এইদিকে বাপির দেওয়া প্রতিশ্রুতি আর অন্যদিকে নিজের ভালোবাসা।‌সব মিলিয়ে তোমার থেকে দূরে থাকা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিলো না। যেদিন বাপির পছন্দের মেয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম সেদিন, তোমাকে দেখে মনে হয়েছিলো ওট আমার ভ্রম। আমি ওইজন্য তোমাকে ওখান থেকে চলে যেতে,,তারপরে যখন জানলাম তোমার সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে,বাপির দেখা মেয়েটা তুমি আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না। আর আজকে তুমি আমার বিবাহিত স্ত্রী। আমি খুব খুশি,,তোমাকে নিজের জীবনসঙ্গী পেয়ে।

নীলি রোশানের কথাশুনে চুপ করে বসে রইল। নীলির চোখ ছলছল করছে,নীলি নিজেকে আর সামলাতে পারলো না রোশান কে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। রোশান পরম আবেশে নীলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

রোশানঃ কি ম্যাম সারারাত কি এভাবেই বসে থাকবে নাকি।

নীলি লজ্জায় রোশানের বুকে মুখ গুঁজে দিল।

১মাস পরে….

নীলির বিয়ের পরে আহসান আর আদ্রিকার দেখা হয়নি কিন্তু ওদের ফোনে যোগাযোগ ছিলো। আহসানের মা ওকে বিয়ের জন্য জোড়াজুড়ি করছে,, আহসান বাধ্য হয়ে বিয়েতে রাজি হয় কিন্তু একটা শর্ত রাখে।

আহসানের দেখাশোনা চলছে ওইদিকে, আদ্রিকার মাও অসুস্থ হয়ে পড়েছে,আদ্রিকাকে দিয়ে কথা দিয়ে নিয়েছেন। বিয়েতে রাজি হবার জন্য। আদ্রিকা বিয়েতে রাজি হয়েছে ঠিকই কিন্তু ওর শর্ত ওর সাথে অর্কের ওহ বিয়ে দিতে হবে। বোনের খুশির জন্য অর্ক সবকিছু করতেপারে তাই অর্ক ওহ রাজি হয়ে যায়।

আজকে সন্ধ্যায় অর্ক আর আদ্রিকার এনগেজমেন্ট কিন্তু কার সাথে কার এনগেজমেন্ট এটা সিক্রেট। আদ্রিকা বিয়ে করবে ওর দাভাই এর পছন্দ মতো আর অর্ক বিয়ে করবে বোনের পছন্দ মতো। অর্ক ভালো করেই জানে আদ্রি কার সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছে, কারন আদ্রি ওর বোন কম বন্ধু বেশি। আদ্রিকে অর্ক কিছু না বললেও আদ্রি সবটাই জানে বলে অর্কের বিশ্বাস।

আদ্রিকে একটা সাদা রঙের লেহেঙ্গা পড়িয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে চার বান্ধবী।

নীলিঃ আদ্রি এটা কিরকম পাগলামি অর্ক দার কথাতে তুই পাত্রকে না দেখেই বিয়ে করে নিবি।

আদ্রিঃ আজকে তো দেখবোই।

মাহিয়াঃ দ্যাখ আদ্রি বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা নয়। এনগেজমেন্ট হয়ে যাওয়া মানেই অর্ধেক বিয়ে হয়ে যাওয়া।

আদ্রি হেসে বললোঃ দাভাই যখন আমার উপর বিশ্বাস করে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায় তাহলে আমি কেন হতে পারবো না।

নুপূর চমকে উঠলো।

মারিয়াঃ অর্ক দার বিয়ে কবে।

আদ্রিঃ বিয়ের ডেট এখনো ফাইনাল হয়নি,,তবে দাভাই এর আজকে এনগেজমেন্ট।

নুপূর থমকে গেলো। নুপূর আর অর্কের মাঝে কোনোরকমের সম্পর্ক না থাকলেও অর্ককে নুপূর ভালোবাসে। তার ভালোবাসার মানুষটির এনগেজমেন্ট অন্য একজনের সাথে এটা ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠছে নুপূরের।

নীলি খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললোঃ এই তোরা কি শুরু করেছিস বলতো।

আদ্রিঃ পরে বলবো সবটা এখন তোরা সবাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।

নুপূর রেডি হয়ে অনুষ্ঠানের ওখানে গিয়ে দেখলো, আদ্রি অর্ক আর একটা মেয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা বলছে আর হাসছে। নুপূর মেয়েটা কে চেনে মেয়েটা অর্কের অফিসের স্টাফ এছাড়াও একটা পরিচয় আছে মেয়েটা আর অর্ক খুব ভালো বন্ধু।নুপূর বেশ কয়েকবার ওদেরকে একসাথে দেখেছে। অর্কের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটা হাসছে দুজনকে কি সুন্দর লাগছে ভাবতেই নুপূরের চোখজোড়ায় পানি জমা হলো।

অর্ক স্টেজে এন্ট্রি নিলো। মাইকটা হাতে দিয়ে আলতো করে হেসে বললোঃ লেডিস এন্ড জেন্টালম্যান,, আজকে আপনাদের এখানে আনার উদ্দেশ্য হলো ,, অনেকেই কারনটা জানতে চান। উদ্দেশ্য টা বলার আগে আমি ডেকে নেবো আমার আদরের একমাত্র বোন আদ্রিকা রায়জাদা কে।

আদ্রিকা স্টেজে উঠতেই সকলেই ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো।

অর্ক আবারো বলতে চালু করলোঃ আদ্রিকা কখনোই আমার পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইনি তাই কখনোই আমার কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতো না। এ.আর গ্রুপ এগিয়ে নিয়ে যাবার পেছনে আমার যতটা হাত ঠিক ততটাই অবদান আদ্রিকার। আমাকে যথেষ্ট পরিমানে সাহায্য করেছে আদ্রিকা,ওর সহায়তা না থাকলে আমি কখনোই এই জায়গাটা তৈরি করতে পারতাম না। এখানে অনেক বড়ো বড়ো কোম্পনির মালিক আছেন যারা আদ্রিকাকে আমার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হিসাবে জানেন,, অনেক ডিল আমার পরির্বতে আদ্রিকা সামলেছে, কিন্তু কখনোই নিজের পরিচয় দেয়নি সবসময় বলে এসেছে আমি একজন সাধারন স্টাফ।এমনকি আদ্রিকার বন্ধুরা পর্যন্ত জানতো না ওর আসল পরিচয়। আজকে সবকিছু সামনে নিয়ে আসার একটাই কারন আজকে আমার আদরের ছোট বোন আদ্রিকার এনগেজমেন্ট আর তার সাথে আমার ও। আদ্রি তুই কিছু বলবি।

আদ্রি মাথা নাড়লো।অর্ক আদ্রির হাতে মাইকটা তুলে দিলো।

আদ্রিঃ দাভাই আমাকে প্রতিবার বলতো নিজের পরিচয় প্রকাশ্যে আনতে কিন্তু আমি আনিনি আমার সাধারন ভাবে থাকতেই ভালো লাগে।আমার সবকিছু অন্যায় আবদার গুলো পূরন করেছে আমার দাভাই,, কখনোই আমার কোনো আবদার ফেলেনি। আমি জানি আজকেও ফেলবে না।আমি আমার দাভাই এর জন্য একজন মিষ্টি বউ আনতে চাই ,,আর সেই জন্যই আজকে এই আয়োজন আমি একজনকে এই খানে আস্তে বলবো সেই হবে আমার ভাবি আমার দাভাই এর স্ত্রী…

সবাই চুপ কাকে বলবে সবাই ভাবছে।

আদ্রিঃ সেই মেয়েটা আর কেউ নয় আমার বান্ধবী,, নুপূর আহমেদ।

নুপূর চমকে উঠলো,,সাথে ওর বন্ধুরাও। অর্ক মুচকি হাসলো, বোনের উপরে বিশ্বাস ছিলো। আদ্রি নুপূর কে নিয়ে স্টেজে আসলো। অর্ককে উদ্দেশ্য করে বললোঃ দাভাই ঠিক আছে তো।

অর্ক হাসলো। নুপূর তো কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।অর্ক মাইকটা হাতে নিয়ে বললোঃ আমি ও চাই আমার আদরের বোন টাকে যোগ্য একজনের হাতে তুলে দিতে তাহলে দেরি কেন। আহসান চলে আয় ভাই।

আহসানের নাম শুনে আদ্রি আকাশ থেকে পড়লো। আহসানের সাথে ওর দাভাই ওর বিয়ে ঠিক করেছে এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। আদ্রি মুখটা গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে। আহসান স্টেজে এন্ট্রি নিলো। আহসানকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে।আহসান স্টেজে এন্ট্রি নিয়েই আদ্রির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো।

অর্ক আদ্রিকে ইশারা করলো,,আদ্রি নীলি কে ইশারা করতেই নীলি একটা জায়গা করে দুটো আংটির বক্স আনলো। ওইদিকে রোশান ও ওই একই কাজ করলো। অর্ক ও আহসান আংটি গুলো নিয়ে তাদের হবু বউ কে পড়িয়ে দিলো। দুই জোড়া কপোত- কপোতির এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো। আদ্রি তো এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। তার জন্য তার দাভাই আহসানকে ঠিক করবে এই ভাবনাটা কখনোই মাথাতেই আসেনি আদ্রির।

অর্ক আদ্রির একটা হাত ধরে আহসানের হাতে দিয়ে বললঃ আমার আদরের ছোট বোন টাকে তোর হাতে তুলে দিচ্ছি আমি। দেখে রাখিস কখনোই কোনো কষ্ট পেতে দিস না, আমার কলিজার টুকরো ও ওর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না।

আহসান আদ্রির হাতটাকে শক্ত করে চেপে ধরে,আদ্রির চোখের দিকে তাকিয়ে বললঃ কথা দিলাম,সবসময় আগলে রাখবো। কখনোই কষ্ট পেতে দেবো না। ওর বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়াবো আমি।

এই সবকিছু দেখে কেউ একজন নিরবে চোখের পানি মুছলেন। চোখের পানি মুছে চলে যাবার সময়ে আনিকা অর্থাৎ আদ্রিকার মা বলে উঠলেনঃ কেন দূরে থাকো।

– কি করবো,তুমি তো সবটাই জানো আনিকা। আদ্রি মামনি তো আমাকে পছন্দই করে না।

আনিকাঃ সবকিছুর পেছনে তো দায়ী আমরাই। কেন ওর মনের ভুলটা ধরিয়ে দিচ্ছো না।

– সত্যি গুলো তো ও নাও মেনে নিতে পারে। আর যদি সবকিছু জেনে বিয়ের জন্য না করে দেয় তখন।

আনিকাঃ কিন্তু সত্যি টা কতদিন ওর থেকে লুকিয়ে রাখবো একদিন না একদিন তো ও সবটাই জানবে।

– জানি না। ওর সুখের জন্য এতদিন সবটা করেছি।

আনিকাঃ কিন্তু আর কতদিন এইভাবে নিজেকে কষ্ট দেবে। নিজেও তো শেষ হয়ে যাচ্ছো,বয়স হচ্ছে একা সবকিছু করতে কষ্ট হচ্ছে। আর বলো তো আমার ও তো বয়স হচ্ছে এইভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে আর কতদিন সবকিছু করবো। অর্ক অফিস কাজ বাড়িতেই থাকে না। আমার স্কুল, এইবাড়ি ওই বাড়ি করতে করতে সময় শেষ।

– আমি তো বারন করি তোমাকে,যে আমার কাছে যাবার প্রয়োজন নেই।

আনিকাঃ আমার না মাঝে মধ্যে মনে হয়,আমরা এখনো যৌবনে আছি আর ইয়াং জেনারেশনের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছি।

– সবকিছু তো স্বাভাবিক হতো কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেলো।

আনিকাঃ সবকিছুর জন্য আমি দায়ী।

– না আনি তোমার দোষ নেয়,তুমি তো এইসব ইচ্ছা করে করোনি আর আমার ভুল,আমি যদি সবকিছু সঠিক সময়ে করতাম বা বলতাম তাহলে এইগুলো হতো না।

আনিকাঃ তোমার এই স্বভাবটা বদলাতে পারলে না আর।

– যায় বলো আনি, এই লুকিয়ে প্রেম করার মজাটাই আলাদা।

আনিকাঃ বুড়ো বয়সে প্রেম করার শখ জাগছে মশাইয়ের।

– আমি কি বুড়ো হয়েছি নাকি,এখনো কত ইয়াং আমি।

বলেই লোকটা হাসতে লাগলো। আনিকাও হাসলো।লোকটার হাসির দিকে তাকিয়ে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেনঃ কখনোই কি আমার পরিবারটা পূর্ন হবে না। এই মানুষটার মুখে কি হাসি দেখতে পাবো না। আমাদের শেষ জীবনটা কি এইভাবেই বিচ্ছেদের মাঝে কাটবে।

#চলবে…..