তোর নামের রোদ্দুর ২ পর্ব-২০+২১+ বোনাস পর্ব

0
591

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২০

-বিয়ে!এক পবিত্র বাধনের নাম।দুটো মনের ভালোবাসার পুর্নতা।দুটো আত্মার মিলনের স্বীকারোক্তি।দুটো পরিবারের নতুন এক সম্পর্কের সেতুবন্ধন।অনেকগুলো মানুষের দোয়ার সম্মেলন।কাছের মানুষটাকে আরো কাছে পেয়ে তার ভালোবাসা,যত্ম,পাশে থাকার এক অনন্য প্রতিফলন নিয়ে নতুন সম্পর্কের সুচনা।বিয়ে!এই দু অক্ষরের সম্পর্কের মাঝেই লুকিয়ে সেই আপন মানুষটির প্রতি অর্পিত সমস্ত বিশ্বাস,ভরসা,ভালোবাসা,স্বচ্ছতা,দায়িত্ব,মান-অভিমান,বুঝতে শেখা,বুঝাতে শেখা,মানিয়ে নেওয়া সবকিছু!এগুলোতেই তো জীবনের সার্থকতা।ভালোবাসা।আর বিয়ে।

নানুভাই কথা শেষ করতেই তালি বাজিয়ে উঠলো সবাই।ধ্যান ভাঙলো আমার।আজও আকাশে বড়সড় একদম গোল চাদ উঠেছে।এজন্য আর কুপি জ্বালিয়ে বসিনি আমরা।এতো আলো,এতোবড় চাদ।পুর্নিমাই হবে হয়তো।পুর্নিমা সম্পর্কে ধারনা আমার এটুকোই।উঠোনে বসে নানুমনি নানুভাইকে সাথে নিয়ে আড্ডা বসেছে আজও।কেন্দ্রবিন্দু সীমা ভাবি আর সিফাত ভাইয়া।একথা সেকথায় ওদের উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলছিলো নানুভাই।তন্ময় হয়ে শুনছিলাম তার কথাগুলো।সে কথাতেই এখনো হারিয়ে আছি যেনো।রিফাত ভাইয়া বললো,

-ওয়াহ্ নানুভাই।কি দিলে!তোমার কাছে বিয়ের সঙ্গা শুনে আমারই খুব বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে বিশ্বাস করো!

ইমরোজ ভাইয়া বললো,

-ভুল বলিস নি রিফাত।আমারো সেইম ফিলিংস্ হচ্ছে।

এবার ইশান ভাইয়া বললো,

-ওমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুষিও না শ্যালকগন।এই বিয়ে যে করেছে সেই বুঝেছে এর কি ফল!

তাপসী আপু বললো,

-তা ঠিক কি ফল পেয়েছো তুমি ইশান?আমিও একটু শুনি!

ইশান ভাইয়া উশখুশ করতে লাগলো।সিফাত ভাইয়া বলে উঠলো,

-এইতো,ডেমো পেয়ে গেছো গাইস?এই বিয়ের সঙ্গাটঙ্গা বাদ দিয়ে নানুভাইকে এটা তো জিজ্ঞাসা করো বিয়ের পরে বউয়ের টর্চার কেমন ছিলো।তাহলেই বুঝবে!

নানুভাই হেসে বললেন,

-হাহ!শোনো নানুভাইয়েরা।বিয়েটা হলো তোমাদের যুগের ভাষায় দিল্লি কা লাড্ডু।যো খায়া,য়ো পাস্তায়া।যো নেহি খায়া,য়ো ভি পাস্তায়া।তাই খেয়ে পস্তানোটাই বেশি চালাকির কাজ বলে আমি মনে করি।

-আমি কিন্তু নানুভাইয়ের কথায় একমত!

সবাই শুদ্ধর কথায় তারদিক তাকালো।আমিও তাকালাম।কিন্তু আমার দিক তাকিয়ে থেকে তার ওই বাকা হাসি দেখে চোখ‌ নামিয়ে নিলাম।সিফাত ভাইয়া বললো,

-ভাই!তোর এখনো ফুললি বিয়ে হয় নি।তুই সিঙ্গেল সমাজের সাথে একমত হবি সেটাই স্বাভাবিক।

-ফুললি বিয়ে?আমার তো….

চোখ বন্ধ করে নিলাম।কানে আঙুল দেওয়ারও তীব্র ইচ্ছা ছিলো।কিন্তু যীনাত আপু শুদ্ধকে শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলো,

-গাইস?শুদ্ধর ইনসুকে আংটি পরানোর সেরেমনি কিন্তু আমরা মিস করেছি।সে খেয়াল আছে তোদের?

সবাই জোরে জোরে সুর তুলে হ্যাঁ বলে সায় দিলো।ওদের ওই সুরেলী আওয়াজ একদম সুবিধের লাগেনি আমার।একটু শক্তভাবেই বললাম,

-আ্ আমার ঘুম পাচ্ছে।যাচ্ছি আমি।

সীমা ভাবি হাত ধরে ধীর গলায় বললো,

-যেও না।এভাবে নানুভাইদের সামনে থেকে গেলে খারাপ দেখাবে ব্যাপারটা।

ওরদিক তাকিয়ে বসেই রইলাম।নানুমনি বললো,

-তাহলে আজ হয়েই যাক‌ দ্বিতীয়বারের মতো?সবার সামনে?

হয়ে যাক মানে?কি হয়ে যাক?বিস্ময়ে তাকালাম নানুমনির দিকে।নানুভাই বললেন,

-হ্যাঁ।শুদ্ধ নানুভাই?আজ সবার সামনে ইনসিয়াকে আংটি পরাও তবে?সে সাহস রাখো তো?

শুদ্ধর দিকে তাকালাম।সে তখনও আমার দিকেই তাকিয়ে।ডানহাতে বা হাতের সাদা শার্টের হাতাটা টান মেরে বললেন,

-অলওয়েজ।

ইয়ে বলে শব্দ করে তালি বাজালো সবাই।আমার কপালের ভাজ যেনো চোখে পরছে না কারোরই।ছোটমামী বললো,

-ইনসিয়া?আংটিটা খুলে শুদ্ধর হাতে দাও।ওটা আজ ও সবার সামনে পরিয়ে দিক তোমাকে।

আমি জামা মুঠো করে ধরলাম।শুদ্ধ শান্তভাবে বললেন,

-ওটা খুলতে হবে না।আমি আসছি।

এটুক বলেই উনি উঠে গেলেন।অবাক হয়েছি কিছুটা।বড়মামী বললেন,

-কোথায় গেলো ও?

ইমরোজ ভাইয়া বিরবিরিয়ে বললো,

-দেখো গ্রামের স্যাকড়াবাড়িতে হয়তো।মাঝরাতে স্বর্নকারকে ঘুম থেকে তুলে আংটি বানিয়ে নিয়ে আসবে।

কয়েকসেকেন্ড পরেই শুদ্ধ হাজির।সবাইকে পাশ কাটিয়ে আমার সামনে এসে এক হাটুতে ভর করে বসলেন উনি।আমি আরো কিছুটা গুটিসুটি হয়ে বসলাম।শুদ্ধ বললেন,

-আংটি রেডি আছে।আর আমিও।হাতের মালিকের অনুমতি চাচ্ছি।

সবাই মিলে হাত উঠানোর জন্য বলছে আমাকে।এদিকে অদ্ভুত শিহরন হচ্ছে শরীরজুড়ে।হাত পা কাপছে।ভয় হচ্ছে কেমন যেনো।চোখ বন্ধ রেখে কাপতে কাপতে বা হাত তুললাম আমি।পাশ থেকে তাপসী আপু বলে উঠলো,

-এতো সহজে হাত পাচ্ছিস না তুই শুদ্ধ!

আমি চোখ মেললাম।আমার হাতের উপরে,পাশে আরো সাত আটটে হাত।তাপসী আপু,যীনাত আপু,সীমা ভাবি,যুথি,নানুমনিও বাদ যায়নি।দুহাত তুলে সবগুলো ঢেকে দিয়েছে আমার হাত।যীনাত আপু বললো,

-পারলে ইনসুর দিকে তাকিয়েই ওর হাত বের করে আংটি পরিয়ে দে শুদ্ধ!

আমি শুদ্ধর দিকে তাকালাম।তার সেই‌ টেডিস্মাইল।আমার দিকে তাকিয়েই আমার হাতটা উপরে তুলে ধরলেন উনি।ওভাবে শব্দহীন হেসেই বললেন,

-এ বিষয়ে চ্যালেন্জ না করলেও পারো যীনাত আপু!

ভাইয়ারা আরেকদফা তালি বাজালো।আমি আবারো চোখ নামিয়ে নিলাম।নানুভাই বললেন,

-বেশ!এবার আংটি তো দেখাও শুদ্ধ! দেখি কেমন আংটি নিয়ে এসেছো?

উনি বা হাত সামনে তুলে ধরে মুঠো খুললেন।ঘাস পেচিয়ে বানানো একটা রিং।ওর উপর একটা জোনাকি পোকা বসে মিটমিটে জ্বলছে।তামিম ভাইয়া বললো,

-এ শুদ্ধ?এটা কি হলো?ভাবলাম কতো না স্পেশাল কোনো আংটি হবে হয় তো!আর তুই কি আনলি?ঘাসের প্যাঁচ?

তাপসী আপু ওর মাথায় চাটি মেরে বললো,

-গর্দভ!এজন্যই আজও তোরা সিঙ্গেল!রোমান্টিকতার র টাও বুঝিস না।দেখেছিস কতো সুন্দর লাগছে জিনিসটা!

ইশান ভাইয়া বললো,

-আরে,তোমরা মারামারি পরে করিও।শুদ্ধ?তুমি তাড়াতাড়ি পরিয়ে দাও ওটা!জোনাকিটা আবার উড়ে না যায়!

শুদ্ধ মুচকি হেসেই বললেন,

-জোনাকি জানে,ঠিক কখন ওর ওড়ার অনুমতি আছে।

উনি আমার মধ্যমা আঙুলে আংটিটা পড়িয়ে দিলেন।অনামিকা আঙুলে থাকা হীরের আংটিটার চেয়ে জোনাকির আলোটা আরো বেশি সুন্দর,বেশি উজ্জল।হাতটা একটু এগিয়ে চোখের সামনে ধরলাম।জোনাকিটা উড়ে গেলো।তবে শুদ্ধর হাত দিয়ে আলোকিত করে দিয়ে গেলো আমার চারপাশ।তার নামের উজ্জলতায়!

____________

মাঝরাতে ফোনের রিংটোনের শব্দটা যেনো শত হাজার হার্টজ কম্পাঙ্কে কানের কাছে বেজে উঠলো।এমনিতেও দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম,তার উপর কাচা ঘুমটা নষ্ট হওয়ার পথে।ইচ্ছা করছিলো ফোনটা ছুড়ে মারি।নিজেকে অতিকষ্টে সামলে ঘুমঘুম চোখে চরম বিরক্তিতে রিসিভ করলাম কলটা।ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,

-জলদি বাইরে আয়!

ধরফরিয়ে উঠে বসলাম।চোখ কপালে আমার।এটা তো শুদ্ধের গলা!মোবাইল কান থেকে সরিয়ে দেখি সাইকো নামে সেইভ করা নাম্বার।উনি ঘুমোন নি এখনো?আর কি বলে কি লোকটা?পাগল হয়ে গেছে নাকি?

-আ্….

-হুশ!জেগে যাবে সবাই।তুই কথা বলিস না।কল কাটছি আমি।ম্যাসেজ চেইক কর!

কলটা কেটে দিলেন উনি।একটুপরই ম্যাসেজ,

“তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে আয়।কেউ যেনো টের না পায়।আজ যীনাত আপুকেও বলি নি”

কোথায় যাবো?কি বলেননি উনি যীনাত আপুকে?রিপ্লাই লিখতে যাবো,আরেকটা ম্যাসেজ!

“একটা প্রশ্নেরও উত্তর পাবি না ঘরে বসে।বেরিয়ে আয় চুপচাপ!”

হুহ!বললো,আর হলো!এতো রাতে সে পাগল হয়েছে বলে আমিও পাগলের মতো বেরোবো রুম থেকে?যাবো না!ম্যাসেজ টাইপ করাও শেষ।সেন্ড করার সময়ই আরেকটা ম্যাসেজ!

“দেখ সিয়া! ভালোয় ভালোয় বাইরে না আসলে এই টিনের ঘরের বেড়ায় এমন বারি লাগাবো,সারা গ্রাম জেগে যাবে।তারপর ঘরে ঢুকে সোজা তোকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসবো।ভাল্লাগবে?”

আর কোনো উপায় নেই।যেতেই হবে।একটা শ্বাস ফেলে নিজের দিকে তাকালাম।আবারো ম্যাসেজ!

” কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে।এজ পার আই নো,এই ঘর থেকে বেরোতে পনেরো সেকেন্ডের বেশি সময় লাগার কথা না!”

তব্দা মেরে তখনও বসে আমি।এবার মোবাইলটা ছুড়ে বিছানায় ফেলে দিলাম।রাগ উঠলো।তবুও “রাগ করে‌ লাভ নেই,রওনা হ!” কথাটা কেউ যেনো বলে দিয়ে গেলো আমার কানে।উকিঝুকি দিয়ে তাকালাম যীনাত আপুর দিকে।কে জানে ও জেগে আছে কি না!ইরাম,যুই ঘুমিয়েছে,তাতে কোনো সন্দেহ নেই।ফিসফিসিয়ে ডাক লাগালাম,

-য্ যীনাত আপু?

….

-আপু?

….

-যীনাত আপু!

শেষবার জোরেই চেচালাম।জাগে নি ও এখনো।যাক।ঘুমিয়েছে তার মানে।ম্যাসেজ আসলো,

“অলরেডি আট সেকেন্ড!”

একটা জোরে‌ শ্বাস ফেলে ওড়নাটা মাথায় দিয়ে ইয়া বড় ঘোমটা টেনে নিলাম।চোরের মতো পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসলাম ঘর থেকে।দরজাটা লাগিয়ে সবে পিছন ফিরতে যাবো,কেউ হাত ধরে টান লাগালো আমার।চেচানো আগেই সে মানুষটার পেছনের অবয়ব দেখে থেমে গেলাম।সেই সাদা শার্ট।শুদ্ধ!মোটামুটি দৌড় লাগিয়েছেন উনি আমাকে নিয়ে।কোনোদিক না তাকিয়ে পা চালালাম তার সাথেই।

#চলবে….

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২১

সিফাত ভাইয়ার নানুবাড়ি থেকে সকালেই শেহনাজ মন্জিলের জন্য রওনা হলাম সবাই।একটাবারের জন্য শুদ্ধের দিকে তাকাইনি এ অবদি।তবে আশেপাশে নেভি ব্লু শার্ট পরিহিত চেনা অবয়বের উপস্থিতিকে অনুভব করেছি।সেও বলেনি কিছু আর।সারারাস্তা চুপচাপই ছিলাম।পায়েলটা রাতেই খুলে ব্যাগে পুরেছি।এ নিয়ে কথা উঠলেই আবার কাল রাতের কথা মনে পরে যাবে আমার।অস্বাভাবিক লাগতে শুরু করবে।

শেহনাজ মন্জিল পৌছে সবাই যার যার মতো ফ্রেশ হতে চললাম।পরদিনই দাদুভাইয়ের মৃত্যবার্ষিকী।কাজ অনেকটা গোছানোই এদিকে।তবুও শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতিতে সবাইকেই হাত লাগাতে হবে কিছুটা হলেও।দুপুরে খাওয়ার টেবিলে আব্বুকে চিন্তিত দেখলাম কিছুটা।খাওয়া ছেড়ে খাবার নাড়ছিলেন শুধু উনি।ওনার হাতে নাড়া দিয়ে বললাম,

-আব্বু?

উনি ধ্যান ছেড়ে বলে উঠলেন,

-হুম?

-খাচ্ছেন না কেনো আপনি?

-কই?এইতো,খাচ্ছি তো!খাচ্ছি।

স্বাভাবিকভাবে খেতে লাগলেন উনি।তার গম্ভীরতাতেই কেমন যেনো ভয় হচ্ছিলো মনে।এবার ঠিক লাগছে।এতোক্ষনে আবারো শুদ্ধের কথা মনে পরলো।মনে হচ্ছে কয়েকজন্ম পার হয়ে গেছে তার মুখ দেখি নি।আড়চোখে তারদিক তাকিয়ে দেখলাম সে মুখের খাবার না চিবিয়ে কপাল কুচকে আব্বুকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করছে যেনো।আমি তাকিয়েছি সেটা টের পেতেই হুট করে আমারদিক ফিরলেন উনি।চোখাচোখি হওয়ার আগেই চোখ সরিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।

লান্চ শেষে বেরোইনি রুম থেকে।বিকেলের দিকে জানালা দিয়ে দেখলাম বাগানে আব্বুকে বড়কাকু কিছু বলছেন চেচিয়ে।আব্বু শুধু কথাগুলো চুপচাপ শুনছেন।এভাবে কোনোদিন দেখিনি মেজোকাকু বা বড়কাকুকে আব্বুকে এভাবে বলতে।বিস্ময় আর আগ্রহ নিয়ে রুম থেকে বেরোলাম।শুনতে পেলাম বড়কাকু আব্বুকে বলছেন,

-তুমি এতোটা দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ করবে আমি ভাবতেও পারি নি ইয়াদ।আমি না হয় অফিসিয়াল কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম।মেজোজন তো গিয়েছিলো শশুড়বাড়ি।আসাদও চলে গেলো ওদের সাথে।তা বলে তুমি তো বাসায় ছিলে?তাইতো তোমাকেই এই দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছিলো।আর তুমিই এতোবড় একটা মিসক্যালকুলেশন করে ফেললে?কোনোদিন যা হয়নি আজ তা কেনো ইয়াদ?কিসের এতো চিন্তায় আছো তুমি?এতোটা কেয়ারলেস কেনো?কি হয়েছে?কি চলছে কি তোমার ভেতরে?

-কাকু?

আমি কিছু বলার আগেই শুদ্ধর গলা।পেছন ফিরলাম।আব্বু কাকুও তাকিয়েছেন পাশে।শুদ্ধ দাড়িয়ে আছেন পেছনে।হাতে কিসব কাগজপত্র।উনি একপলক আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে বড়কাকুর দিকে এগোলেন।হাতের কাগজটা ধরে বললেন,

-কাকু,এখানে কিছু ডিটেইলস্ এড করা হয়নি।যেসব এন্টি দেওয়া ছিলো,তাতে আমাউন্টগুলোও ঠিকমতো বসানো হয়নি।আমি সবেমাত্র চেক করলাম সবটা।এবার হিসেবটা মিলেছে দেখো।আর তোমাকে পরেরবার যেসব জিনিসপত্র আনার বিষয়ে বলা হলো,সেগুলো আগেই আনা হয়ে গেছে।স্টোররুমে ছিলো ওগুলো।জামাল মামাই এনে দিয়েছে নাকি।আমার মনে হয় ছোটকাকু ভুলে গিয়েছিলো যে সে ড্রাইভার মামাকে ওসব আনতে পাঠিয়েছিলো।

বড়কাকু তার হাত থেকে কাগজগুলো নিলেন।তারপর ওগুলোতে চোখ‌ বুলাতে লাগলেন।আব্বু শুদ্ধর দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে।তারপর মাথা নিচু করে বিরবির করে বললেন,

-আমি তো জামালকে ওতোসব আনতে দেইনি।ওকে তো জাস্ট…

-মামা বললো পরে নাকি তুমি আরেকটা লিস্ট দিয়েছিলে তাকে ছোটকাকু?

-হ্যাঁ,কিন্তু ওটা তো…

বড়কাকু বললেন,

-যাক!সবটা ঠিকই আছে।ভাগ্যিস শুদ্ধ তুমি দেখেছিলে।যাই হোক।ইয়াদ?এবার চলো,এখনো কয়েক জায়গায় খবর পৌছানো বাকি।

উনি চলে গেলেন।আব্বু আবারো বললেন,

-ওই‌ লিস্ট তো আমার ছিলো না।রাধুনীর ছিলো!ও অতিরিক্ত জিনিস এড কেনো করবে?

শুদ্ধ বললেন,

-এখন রাধুনীর যদি মনে হয়ে থাকে এগুলো দরকার,ও তো এড করবেই লিস্টে,তাইনা?আর লিস্টটা তুমি দিয়েছিলে মামাকে,তাই মামা ক্রেডিটটাও তোমাকেই দিলো।

একটু চুপ থেকে আব্বু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন একটা।সে স্বস্তির কারন শুদ্ধ।আমার ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী।ভেবেই ঠোটের কোনে হাসি ফুটলো আমার।পা বাড়িয়ে হাসি লুকিয়ে চলে আসলাম ওখান থেকে।

সন্ধ্যায় কাজ করে সবাই ক্লান্ত ছিলো।আব্বু কাকুরা বেরিয়েছেন কোথাও।ইমরোজ ভাইয়াও নেই।শুদ্ধও গায়েব।এলোমেলোভাবে ড্রয়িংরুমে পরে ছিলাম সবাইমিলে।কোনো কথা নেই কারো মুখে।একপ্রকার ঝিমোচ্ছি।আম্মু,ফুপি বড়মাও আমাদের সাথেই বসে।হঠাৎই শুদ্ধ হাতে কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে বাসায় ঢুকলেন।ঠিকঠাকমতো উঠে বসে দেখলাম পিছনে ইমরোজ ভাইয়ার হাতেও কয়েকটা প্যাকেট।শুদ্ধ বললেন,

-গাইস!সবার জন্য রিফ্রেশমেন্ট হাজির!একটু রিল্যাক্স করো এবার সব।

তাপসী আপু বললো,

-এখন আবার কি শুদ্ধ?

যীনাত আপু বললো,

-আরে,শুদ্ধ যখন এনেছে,স্পেশাল কিছুই হবে।চলো গিয়ে দেখি!

ওরা এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটগুলো নিলো।প্যাকেটগুলো খুলতেই সবার মুখে হাসি।ওগুলোর ভেতরে পিৎজা।ইশান ভাইয়া বললো,

-শালাবাবু?ফুল ফ্যামিলি প্যাক পার্সেল এনেছো?

শুদ্ধ বললেন,

-হুম।সবার জন্যই তো আনা।

আম্মু,বড়মা মিলে সার্ভ করে দিলো সবাইকে।এরমধ্যে ফুপি মেজোমা,সেজোমাকেও নিয়ে এসেছে।আমি দীদুনকে নিয়ে এসে দেখি কাকুরাও বসে খাচ্ছেন সবার সাথে।আব্বু একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে।উনি খান না ওসব।দীদুনকে ডাইনিংয়ে বসিয়ে তার দিকে এগোতে যাচ্ছিলাম।যীনাত আপু আব্বুর সামনে একটা প্লেট ধরলো।আব্বু সেটাতে চোখ বুলিয়ে বললেন,

-পিৎজার সাথে পাস্তাও ওর্ডার করেছো যীনাত?শেহনাজ মন্জিল তবে আজ আমার পছন্দ অপছন্দের কথাও মনে রেখেছে?

আব্বু খুশি হয়ে হাতে নিলেন প্লেট।যীনাত আপু বললো,

-এসব শুদ্ধ এনেছে ছোটমামা।

একপলক শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে খেতে লাগলেন আব্বু।এককোনে দাড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দুটো মানুষকে দেখে চলেছি।একজন আজীবন আগলে রেখে এসেছেন।তারপর আর এমন একজনকে চুজ করেছেন আমার জন্য,যাকে চোখ বন্ধ করে আজীবন ভরসা করার আশ্বাস তৈরী হয়ে গেছে আমার ভেতরে ভেতরে।সবাইকে নিয়ে ভাবেন উনি।এতোটা সুখ?আর এ সুখের সবটাই আমার!সবটা!

_____________

কাল দাদুভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো।সে কাজগুলোতেই কাল সারাটাদিন ব্যস্ততা ছিলো,কিন্তু প্রায় প্রতিমুহুর্তে মনে পরেছে তাকে।কান্না পেয়েছে প্রচন্ড।গত দু বছর আংটি পরানো নিয়ে তার প্রতি অভিমান ছিলো আমার।আর এখন আত্মগ্লানী হয়।সে যা করে গেছে,তাতে সবার ভালোই ছিলো।আমার অন্তত এখন অনুধাবন এটাই,ওই আংটিই আমার জীবনের সবথেকে বড় পাওয়া ছিলো।তার মাধ্যমে শুদ্ধ এসেছেন আমার জীবনে।মন খারাপ করে জানালার থাই গ্লাস সরিয়ে উপরে বসে ছিলাম।হয়তো গাল বেরিয়ে কয়েকফোটা পানিও‌ বেরিয়ে গেছে এসব ভাবতে ভাবতে।কাধে কারো স্পর্শে নিজেকে সামলে গাল মুছে পাশ ফিরলাম।যীনাত আপু দাড়িয়ে।আপু মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

-নানুভাইকে মিস করছিস তাইনা?

ওর কোমড় জরিয়ে ধরে হুহু করে কেদে দিলাম আমি।আপু আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

-পাগলী মেয়ে!কাদছিস কেনো ওভাবে?তোর কান্না যে নানুভাইয়ের সহ্য হতো না মনে নেই?

-আ্ আপু… আমি….

আপু আমার হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে দিলো।চোখ মুছে দিয়ে বললো,

-শোন ইনসু,একদিন না একদিন সবাইকে মরতেই হবে।মৃত্যু প্রকৃতির নিয়ম।আর তার থেকে বড় কথা নানুভাই সম্পুর্ন সন্তুষ্টি নিয়ে চোখ বুজেছিলো।তার সন্তুষ্টির কারন তুই ছিলি ইনসু!তার কথা রেখেছিলি তুই।হাতে তুলেছিলি শুদ্ধর পরানো আংটি।তাই এখন আর নিজেকে এতোটুকো কষ্ট দিস না।তুই ভালো থাকলে সেও খুশি হবে।নিজেকে ভালো রেখে তার জন্য দোয়া কর,দেখবি,সবটাই ভালো হবে।

আপুর কোলে মাথা রাখলাম।কান্না কমে আসলো আমার ধীরেধীরে।বেশ কিছুটা সময় পর আপু শান্তভাবে বললো,

-আমরা সবাই কাল চলে যাচ্ছি ইনসু।

সবাই,কাল,চলে যাওয়া তিনটা কথাই কয়েকবার কানে বাজলো আমার।আস্তে করে মাথা তুললাম আমি।আপু আমার গাল ধরে কিছুটা করুনভাবেই বললো,

-সকালে তুই চলে আসার পরই তোর আর শুদ্ধর বিয়ের ব্যাপারে দীদুন কথা তুলেছিলো।ছোটমামা বলেছে সবেমাত্র সিফাত ভাইয়ার বিয়ে হলো,আরেকটা বিয়ের প্রিপারেশনের জন্য কিছুটা সময় দরকার।আর তাছাড়া বাসায় কালই একটা শোকের আয়োজন ছিলো,তাই এরমধ্যে তেমন কোনো অনুষ্ঠান করা ভালো দেখাবে না।বড়মামা,মেজোমামা এমনকি সেজোমামাও একমত তার কথার সাথে।সেজোমামারও নাকি জরুরি কাজ পরে গেছে ঢাকায়।মেবি অফিসিয়াল ঝামেলাও হয়েছে কোনো।তোদের বিয়েটা আরো কয়েকদিন পেছোবে ইনসু!

ওকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলাম আমি।আপু আমার হাত মুঠো করে বললো,

-দীদুন অনেক করে বলেছিলো জানিস তো তোদের….

-তোমরা কালই চলে যাবে?

-হুম।

-আপু,আর কয়েকটা দিন থেকে যাও না তুমি!

যীনাত আপু বিস্ময় নিয়ে বললো,

-ইনসু?বিয়েটা এখন হচ্ছে না!আর তুই সে কথাকে ছেড়ে আমার যাওয়াটাকে প্রায়োরিটি দিচ্ছিস?

এবার আমি ওর হাত মুঠো করে ধরে বললাম,

-এখন হচ্ছে না।একদিন হবেই।কেউ তো আর হারিয়েও যাচ্ছি না,পালিয়েও …

আপু ভ্রু বাকিয়ে তাকালো আমার দিকে।কি বলেছি বুঝ আসতেই তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাতে বললাম,

-ত্ তোমাকে খুব মিস করবো।তুমি চলে গেলে আমি কি করে থাকবো বলোতো?

-আমাকে?নাকি….

-ইনসু?

আপুর কথা শেষ করার আগেই ডাক পরলো।দীদুন এসেছে ঘরে।উঠে এগিয়ে তার হাত ধরে বললাম,

-বাব্বাহ!তেপায়া মানুষটা অসময়ে এ ঘরে?কিছু বলবে দীদুন?

দীদুন মৃদ্যু হাসলো।বললো,

-একটা কাজ করে দে তো ইনসু!ছাদে রাখা আচারের কৌটাগুলো নিয়ে আয় তো!রোদ পরে গেছে।তুলে রেখে দেই এবার।

মাথা নেড়ে একপলক যীনাত আপুর‌ দিকে তাকিয়ে পা বাড়ালাম ছাদের দিকে।ছাদে উঠে কৌটাদুটো হাতে নিতেই চোখ পরলো বাসার সামনের রাস্তায় বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটায়।একদম টুকটুকে লাল হয়ে আছে ফুলে ফুলে।কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম ওইদিক।কৌটাদুটো কোলে করে পিছন ফিরতেই ভেতরটা ধক করে উঠলো আমার।ছাদের দরজায় পিঠ লাগিয়ে তাতে এক পা ঠেকিয়ে দাড়িয়ে শুদ্ধ।এপাশ থেকে লাগিয়ে দিয়েছেন উনি দরজাটা।উস্কখুস্ক চুল,মেরুন শার্টটার উপরের বোতামদুটো খোলা,তৃতীয়টাও ঠিকমতো লাগানো না।নিচদিক একধ্যানে তাকিয়ে আছেন উনি।দু পা পিছিয়ে গেলাম।

শুদ্ধকে এতোটা বিধ্বস্তভাবে এরআগে কখনো দেখি নি আমি।যে ছেলেটা তার পার্সোনালিটির জন্য সবখানে সমাদৃত,তার এই অবস্থা দেখে ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো আমার।কোটোদুটো দুহাতে বুকের সাথে আরো শক্তভাবে জরিয়ে ধরে গুটিগুটি পায়ে কিছুটা এগোলাম আমি।ওনার কোনো হেলদোল না দেখে থেমে গেলাম।বিয়েটা কয়েকটা দিন পিছিয়েছে শুনে এই অবস্থা করে ফেলেছেন উনি চোখমুখের।নাকি অন্য কোনো কারন?

#চলবে…

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
✨স্পেশাল পর্ব✨

পূর্নিমার চাঁদের আলো গলে পরছে পদ্মপুকুরে!সে আলোতে চিকচিক করছে বাতাসের ফলে পানিতে সৃষ্ট ছোটছোট তরঙ্গগুলো।গোলাপী রঙের বড়বড় পদ্মফুল ফুটে চাঁদের আলোকে পুরোটাই লুফে নিচ্ছে নিজেদের মধ্যে।কোনো কোনে থাকা হিজল গাছের ফুল পানিতে পরে লালের চাদর বিছিয়েছে খানিকটা জুড়ে।চারকোনা পুকুরটির চারপাশে বাকা হয়ে দাড়ানো নাড়িকেল গাছগুলোর আবছা অবয়ব যেনো নতমস্তকে বলছে,এ সৌন্দর্যের অববাহিকায় স্বাগতম তোমাকে।সিড়ি বাধানো ঘাট যেনো নিয়ে যাবে ওই চাঁদকে ছুইয়ে দেওয়ার কোনো স্বাপ্নিক রাজ্যে।

নানুবাড়ি থেকে দুমিনিটের পথও নয় এই পুকুরটা।দিনের আলোতে কয়েকবার দেখেছি।তবে এখন সম্পুর্নই অচেনা লাগছে জায়গাটা।এখানে এনেই শুদ্ধ ছেড়ে দিয়েছিলেন আমার হাত।কতোক্ষন হলো সবটা মনপ্রান ভরে শুধু দেখেই চলেছি তার হিসেব নেই।।বারবার মনে হচ্ছে,কোথায় হারালাম আমি?কোথায় নিয়ে আসলেন আমাকে শুদ্ধ?তার কথা মনে পরতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম তারদিক।কিছুটা দুরে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে একপায়ে আরেকপা পেচিয়ে দাড়িয়ে উনি।

তিমির!তবে তমসা নয়!রাত্রিবেলার কোনো আধারের উপস্থিতি মনেই হচ্ছে না আমার।চাঁদ যেনো আজ জেদ করেছে,মনমোহিনীকে অন্য দুনিয়ার অনুভুতিতে আসক্ত করে নিবে আজ।একটু দুরে দাড়ানো ব্যক্তিটির ঠোটের হাসিটা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে,তার মোহনীয় মুখটা দেখতে পারছি,সাদা শার্টের মতো ফর্সা চেহারাটাও চাদের উজ্জল আলোতে পুর্নপ্রকাশ্য।বাকি সবটাই এবার আবছা হয়ে এসেছে আমার।শুদ্ধ সোজা হয়ে দাড়ালেন।আমি চোখ সরিয়ে গুটিগুটি পায়ে নামতে শুরু করলাম সিড়ি দিয়ে।

পানির কাছে এসে সিড়িতে বসে দুবার পানি হাতে নিয়ে উপরে ছুড়ে মারলাম।মুক্তোদানার মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো প্রতিটা পানিকনা।পানিতে শুদ্ধর প্রতিবিম্বে চোখ পরতেই ভেতরটা ধক করে উঠলো।পানি নাড়িয়ে দিয়ে এলোমেলো করে দিলাম সেই অবয়ব।শুদ্ধ ওভাবে দাড়িয়ে থেকেই বললেন,

-আর কতোবার কতোভাবে শুদ্ধকে উলোটপালোট করে দিয়ে শান্ত হবি তুই শ্যামাপাখি?

একটা শুকনো ঢোক গিললাম শুধু।জবাব দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার কাছে।দুহাত একসাথে করে আজলা ভরে পানি তুলতেই তার নিচে আরো একজোড়া হাত।হাতের মালিক ফিসফিসিয়ে বললো,

-আজ এই হাতে চাঁদ নেমে আসতে বাধ্য!

শুদ্ধ স্পর্শ করলেন আমার হাত।ডানপাশে আমার অনেকটাই কাছে হাটু গেরে বসেছেন উনি।আবেশে বন্ধ করে নিচ্ছিলাম চোখ।উনি বললেন,

-এই না না!চোখ বন্ধ করবি না একদম!সবটা যে সেজেছে শুধু ওই দু চোখের দৃষ্টিগোচর হবে বলেই!আচ্ছা বেশ!স্পর্শ করছি না আমি!সরিয়ে নিচ্ছি হাত!তুই তোর হাতদুটো আরেকটু বা দিক নে।

হাত সরে গেলো।আমি একপলক বিস্ময়ে তারদিক তাকিয়ে হাত সরালাম কিছুটা।সত্যিই চাদের প্রতিবিম্ব হাতে এসে পরেছে বলে মনে হচ্ছে।ঝিকঝিক করছে পানিটুক।পুকুরে তাকিয়ে সেই থালার মতো চাঁদের বিম্বটাকেও দেখলাম।সে তার জায়গাতেই স্থির।শুদ্ধ হুট করে হাতের কাছেরই একটা পদ্ম ছিড়ে কানে গুজে দিলেন আমার।তারপর প্যান্ট গুটাতে গুটাতে বললেন,

-কানে ফুলটা বেশি ভারী লাগছে?

মাথা ডানেবামে নাড়লাম।শুদ্ধ পানিতে পা ভিজিয়ে বসলেন।সোজা সামনে তাকিয়ে বললেন,

-বোর লাগছে?

মানা করলাম।উনি সোজা বসেই বললেন,

-ঘুম পাচ্ছে?

মাথা নিচু রেখে এবারো মাথা নাড়িয়ে না সুচক উত্তর দিলাম আমি।হঠাৎই শুদ্ধ একহাতে আমার কোমড় জরিয়ে ধরে কাছে টেনে নিলেন আমাকে।কেপে উঠলাম।হাতের পানি পরে গেছে।উনি আমার দিক তাকিয়ে বললেন,

-প্রেম প্রেম পাচ্ছে?

মাথা নাড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি যেনো।মুখের কথা তো আগেই গায়েব।শুদ্ধ ঠোট কামড়ে ধরে রেখে হাসি দিলেন একটা।চোখ নামিয়ে‌ নিলাম আমি।উনি কোমড় ছেড়ে হাত বাড়ালেন সামনে।জ্বলজ্বল করে উঠলো তার হাতে দুলতে থাকা পায়েলটা।ওনারদিক তাকালাম।পা বাড়ানোর জন্য ইশারা করলেন আমাকে।একটু মাথা নেড়ে মানা করলাম,কটমটে চোখে তাকালেন উনি।খানিকটা ভয় পেয়েই জামা উচিয়ে পা এগিয়ে দিলাম।

শুদ্ধ নিজহাতে পায়েলটা পরিয়ে দিলেন আমার পায়ে।যদিও আমি চাইনি পায়ে হাত দিক উনি,তবে উনি চেয়েছিলেন।মানতেই হতো।শুদ্ধ বললেন,

-দামী নয়।হাটে চোখে পরেছিলো।তাই নিয়ে এসেছি।

কিন্তু আমার ভেতরটা তো অন্য কথাই বললো।সে যে বললো,ওটার দাম নিজেকে বিলীন করেও দিতে পারবি না তুই ইনসু।আচমকাই শুদ্ধ পানি ছিটিয়ে দিলেন আমার পায়ে।শরীরের শিহরন লুকিয়ে সমস্ত শক্তিতে উঠে দাড়িয়ে ছুট লাগালাম।কিন্তু সিড়ির শেষপ্রান্তে এসেই থেমে গেলাম।ওড়নায় টান পরেছে।গলা আটকে আসছে আমার।তবুও কাপাকাপা গলায় বললাম,

-ছ্ ছাড়ুন!ক্ কেউ দেখে…

-রাত দুটো বাজে।আর তুই আমার বউ!

আর কি বলবো?মাঝরাত,কেউ আসবে না।তার বউ,কেউ দেখলেও কিছু বলবে না।তার বউ?আবারো শুকনো ঢোক গিললাম আমি।শুদ্ধ ততক্ষনে ঠিক পিছনে দাড়িয়েছেন আমার।টের পাচ্ছি।উনি বললেন,

-তোর অনিচ্ছাকৃত ছোয়াও আমার কাছে ঠিক কি তা তুই জানিস না সিয়া।পাঁচবছর আগের সেই শার্ট খামচে ধরা থেকে শুরু করে এমনটা কয়বার হয়েছে তার গুনে গুনে প্রতিটা মুহুর্তের হিসাব দিতে পারবো আমি।কতোটা আনন্দের ছিলো সে মুহুর্তগুলো!আমার জীবনকে এমন আনন্দে ভরিয়ে দিতে একটা তুইই যথেষ্ট শ্যামাপাখি।

চুপ রইলাম।উনি বললেন,

-এমনই একটা রাত!এমনি একটা চাঁদ!এমনই মোহনীয় চাঁদের আলোতে আলোকিত হওয়া অবনী!আর তার মাঝে আমার রোদ্রময়ীর উজ্জ্বলতা!সে সময়টার জন্য অপেক্ষার প্রহরগুলো এতোটা কঠিন কেনো সিয়া?

চোখ বন্ধ রেখেই পা বাড়ালাম আমি।নিতে পারছি না তার এসব কথা।দম বন্ধ লাগছে আমার।শুদ্ধ এক হাত টেনে কোনো একটা গাছের সাথে আটকে ধরলেন আমাকে।

-আজ যে শুনতেই হবে তোকে সিয়া!একটু অংশীদার হ?আমার এই অপেক্ষার রোদ্দুরের উত্তাপের?একটু?

আর এতোটুকো নড়াচড়া করি নি আমি।উনি হাত ছেড়ে দিলেন আমার।চোখ বন্ধ রেখে শুনতে পেলাম শুদ্ধ বলছেন,

-জানিস সিয়া?সে সময়টা,সে সময়টা একান্তই আমাদের হবে!একান্তই আমাদের দুজনার!পাঁচবছর অপেক্ষার রোদ্দুরে পুড়ে বিশুদ্ধ হওয়া শুদ্ধের সবটুকো পাগলামী ভালোবাসায় জরিয়ে নেবো তোকে।কাছে এসে আমার সবটুকো প্রেমের বর্ষন তোকে উজার করে দেবো।হৃদয় প্রাঙনে তোর আগমনকে রাঙিয়ে নেবো আমার ভালোবাসার রঙে।দগ্ধ মনকে ভরিয়ে নেবো তোর শীতল হৃদস্পন্দনে।অশান্ত হৃদয়ের সব ব্যাকুলতাকে বদলে দেবো তোকে বুকে জরানোর স্বস্তিতে।চন্দ্রিমার নির্জন আলোকে আপন করতে রাতজাগা একজোড়া চকোরকে সাক্ষী রেখে সে রাতের চাঁদের আলো হবে তোর নামে।আর আমি বিলিন হবো আমার রোদ্রময়ীর নামের রোদ্দুরে।এমনটাই হবে সিয়া!এমনটাই হবে দেখিস!

জমে গেলাম।দু হাতে খামচে ধরে রেখেছি জামাটা।শুদ্ধর উষ্ণ নিশ্বাস চোখেমুখে লাগছে।গা ঘেমে উঠেছে।গলা দিয়ে গরিয়ে পরছে ঘাম,টের পাচ্ছি।তার বলা কথাগুলোতে নিজেকে এলোমেলো লাগছে।ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে,আবার এই কথাগুলো বারবার শুনতেও ইচ্ছে করছে।চোখ মেলে তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে,আবার চোখ বন্ধ করে রেখে এভাবেই তার শ্বাসপ্রশ্বাস গুনতে ইচ্ছে করছে।

অতিকষ্টে এলোমেলো চাওনিতে তাকালাম তার দিক।সে মুচকি হেসে হাত বাড়ালো আমার দিকে।আবারো চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম।গালটা গাছের গায়ে ঠেকিয়ে লেপ্টে গেলাম একদম।শুদ্ধ আমার দুগাল ধরে আবারো নেশালো কন্ঠে বললেন,

-তুই‌ এমন কেনো সিয়া?আমাকে‌ দুর্বল করে‌ দেওয়ার জন্য সদাপ্রস্তুত যাকে বলে।তুই জানিস?যখন এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিতে গিয়ে তোর দ্রুতচলা উষ্ণ শ্বাস একটু ছুইয়ে দেয়,পাগল হয়ে যাই আমি।কখনো কখনো শুনতেও পাই তোর হৃদস্পন্দন,ইচ্ছা করে সেগুলোর ঢিপঢাপ আওয়াজকে আজীবনই শুনতে থাকি।যখন এভাবে চোখ খিচে বন্ধ করে নিয়ে ভয়ে‌ চুপসে যাস,তোর ওই চোখে ঠোট ছুইয়ে তাদের কম্পন থামিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।যখন লজ্জায় নুইয়ে শ্যামারঙা গালদুটো লাল করে ফেলিস,সেগুলোকে দুহাতে আকড়ে ধরে তোকে আরো কাছে নিয়ে আসতে ইচ্ছা করে।ওই ঠোটজোড়া যখন…

উনি হাতের আঙুল ছুইয়েছেন আমার ঠোটে।তৎক্ষনাৎ চোখ মেললাম আমি।উনি সেহাত নামিয়ে নিলেন।কম্পিত শরীরে তার আবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে দৌড় লাগিয়ছি,শুদ্ধ হাত ধরে ফেললেন আমার।শ্বাস প্রশ্বাস জেটবিমানের গতি পেলো যেনো।উনি এগিয়ে এসে আমার পিঠের সাথে বুক ঠেকিয়ে দাড়ালেন।চুলে নাক গুজে দিয়ে ঘোর লাগা গলায় বললেন,

-এতোটা ভয় মিসেস ডট ডট ডট?জেনে রাখুন,আপনার অনুমতি ছাড়া আপনাকে‌ কিছু করবে না শুদ্ধ।শুদ্ধের যে বড্ড ইচ্ছা!ওই দু চোখে শুদ্ধের জন্য তৃষ্ণা দেখার!যে দুই চোখ শুদ্ধকে পুড়িয়েছে,তাদের ওই শুদ্ধকেই কাছে পাওয়ার ব্যকুলতা দেখার বড্ড ইচ্ছা!খুব ইচ্ছা,আপনার চোখে একরাশ ভালোবাসার পাগলামী দেখার!খুব ইচ্ছা!খুব!

উনি ছেড়ে‌ দিলেন আমার হাত।শান্তভাবে বললেন,

-ঘরে ফিরে যা!

বিস্ময় নিয়ে পিছন ফিরলাম আমি।শুদ্ধ দুহাত পকেটে গুজে দাড়িয়ে।ঠোটে মৃদ্যু হাসি।তবে কি উনি রাগ করেছেন?তা যে সইবে না আমার।মানতে পারবো না আমি।ফাকা মাথা নিয়ে দু পা এগোলাম তারদিকে।গাছের পাতা কিছু অংশে আটকে দিয়েছে চাঁদের আলো।তার গালে পরেছে শুধু কিছুটা।ভেতরের ঢিপঢাপ শব্দকে তোয়াক্কা না করে অজান্তেই তার গালের চাপ দাড়িগুলো ছুইয়ে দিতে যাচ্ছিলাম।উনি আমার হাত ধরে ফেললেন।আলতো চুমো দিয়ে বললেন,

-রাগ করিনি শ্যামাপাখি!বলেছি তো,সবার সামনে নিজের করে নেবো তোকে।এই পদ্মপাড় তো শুধু শুদ্ধের প্রেমের সাক্ষী রইলো।বাকিটুক তোলাই থাক?

মুগ্ধতায় মনপ্রান ছেয়ে গেলো।চোখ ভরে উঠতে লাগলো আমার।শুদ্ধ একটু শব্দে হেসে দুগালে হাত রাখলেন আমার।বললেন,

-এখন আবার রাগ করি নি,তারও প্রমান দিতে হবে তাইতো?টিপিকাল বেঙ্গলি ওয়াইফ!ফাইন!

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে।শুদ্ধ একটু হেসেই ঠোট ছোয়ালেন আমার কপালে।কপালের পরে থাকা কিছু চুল কানে গুজে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,

-জানিস শ্যামাপাখি?ইচ্ছে করে সবটা ছাড়ছুড় দিয়ে তোকে নিয়ে কোথাও চলে যাই।যেখানে শুধু আমি আর তুই!শুধু শুদ্ধ,আর ওর সিয়া!যেখানে তোর নামের রোদ্দুরে আমি প্রেমের বর্ষন ঝড়াবো!যেখানে ভালোবাসার কোনো উত্তল প্রবাহে ভাসিয়ে নেবো তোকে!দুজনে মিলে হারাবো,স্বপ্নের কোনো পৃথিবীতে!খুব তাড়াতাড়ি এমন একটা পৃথিবী হবে আমাদের শ্যামাপাখি!আমার সবটুকো ভালোবাসাকে সহ্য করার জন্য তৈরী হ সিয়া!শুদ্ধের ভালোবাসার স্পর্শে,কোনো অতল সুখসমুদ্র পারি দিতে তৈরী হ!

উনি আমার গাল ছাড়তেই একছুটে চলে আসলাম বাড়িতে।তাকাইনি আর পিছনে।নইলে তার কথাগুলো…আমার শ্বাস থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো ওগুলো।রুমে ঢুকে ঘুমন্তই পেলাম সবাইকে।বিছানায় বসে হাপাচ্ছি।গালে হাত দিলাম।যেনো এখনো তার স্পর্শ লেগে আছে সেখানে।পায়ের পায়েলটা রিনরিন করে উঠলো।থাম!কেউ জেনে যাবে!আমার হৃদস্পন্দনও কেউ শুনে নেবে তোর এই শব্দের সাথে।শুদ্ধর বলা কথাগুলো মনে পরতেই দুহাতে ঢেকে নিলাম মুখ।ভেতরটা যেনো চেচিয়ে বলছে,ভাগ্যিস চলে এসেছিস!আর কিছুক্ষন ওখানে থাকলে তার কথায় মরন হতো তোর ইনসু।মরন হতো তোর!

#চলবে….