তোর নামের রোদ্দুর ২ পর্ব-৩৮ এবং শেষ পর্ব

0
1087

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
অন্তিম পর্ব

আকাশে‌ আজ পূর্নচাঁদ।জ্বলজ্বল করতে থাকা অসংখ্য তারার চাঁদরে আজ আকাশ সাজিয়েছে নিজেকে।আজাদ ম্যানশনের দেয়ালে দেয়ালে রঙিন বাতিগুলো তারাগুলোর মতোই মিটমিটিয়ে জ্বলছে।বাসার সামনের সুইমিংপুলটায় চাঁদের আলো পরেছে।উজ্জ্বল হীরের মতো সে আলোতে পানি চিকচিক করছে।আলোটাও পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়ে ব্যালকনির দেয়ালে লাগছে।চোখেও লাগছে,তবুও সেদিকেই দৃষ্টি স্থির আমার।

-নতুন বউয়ের মতো আধহাত ঘোমটা টেনে বিছানায় বসে না থেকে ব্যালকনিতে?

শুদ্ধর আওয়াজে পিছন ফিরলাম।গোল্ডেন কালারের শেরওয়ানি তার গায়ে।রঙটা আমার লেহেঙ্গার সাথে পুরোপুরিই যাচ্ছে।তবে তার মুখের হাসিটা আমার এক্সপ্রেশনের সাথে একদমই যাচ্ছে না।উনি এগিয়ে এসে বললেন,

-কিরে?ঘোমটা,লজ্জা,নিয়মকানুনের কোনোটাই একফোটা দেখছি না তোর মাঝে!আজ আমাদের ফার্সটনাইট।মাথায় বড়সর ঘোমটা দে,লজ্জা পা,আমাকে সালাম কর!

কিছু না বলে ঝুকে পা স্পর্শ করতে যাচ্ছিলাম তার।উনি হাত ধরে থামিয়ে দিলেন আমাকে।বললেন,

-এবার একটু লজ্….

-আপনি আব্বুর কথায় রাজি হয়ে গেলেন?

ভ্রুকুচকে তাকিয়ে রইলেন উনি আমার দিকে।আমার নিজের চেহারায়ও‌ বিরক্তি।বললাম,

-এই দ্বিতীয়বার ধুমধাম করে বিয়েটা করার খুব দরকার ছিলো?

-হ্যাঁ,অবশ্যই!আগেরবার তো….

আরেকপা তারদিক এগিয়ে বললাম,

-এজন্য পুরো একটা সপ্তাহ আমাকে শেহনাজ মন্জিল থাকতে হয়েছে!

-হ্যাঁ,তো?

-হ্যাঁ তো মানে?

-মানে তাতে কি হয়েছে?

-কি হয়েছে মানে?

-মানে বিয়ের আগে তো মেয়েরা বাপের বাড়িই থাকে।তুইও….

আবারো এগিয়েছি তারদিক।শুদ্ধ হুড়মুড়িয়ে পিছিয়ে গেলেন।বুকে থুতু দিয়ে বললেন,

-এমন করছিস কেনো?ভয় করছে আমার!

কান্না পাচ্ছে আমার!এই একটা সপ্তাহ আমার কিভাবে কেটেছে তা আমিই জানি।সেদিন হসপিটালে ফেরার পর জানতে পারি দুদিন পরেই আম্মুকে ছেড়ে দেবে।আব্বু বলেছিলেন উনি আম্মু খানিকটা সেরে উঠলেই চান আমাদের বিয়েটা আবারো ধুমধাম করে হোক।আমার মত ছিলো না।জানতাম এটা হলে আবারো দুরে থাকতে হবে আমাকে শুদ্ধর থেকে।কিন্তু ওই মানুষটা ধেইধেই করে রাজি হয়ে যায়।সাত সাতটা দিন আলাদা থেকেছি‌ তার থেকে।আর ইনি?কতো স্বাভাবিক।আলাদা থাকার এতোটুকো কষ্ট নেই এর মাঝে!

কাদোকাদো মুখ বানাতেই শুদ্ধ সামনে থেকেই বিছাটা ধরে একটানে কাছে টেনে নিলেন আমাকে।কেপে উঠলাম মৃদ্যু।হাত গিয়ে তার বুকে পরেছে।উনি হাত উপরে তুলে ধরে আলতোভাবে চুমো খেলেন।রাগ গায়েব আমার।উনি বললেন,

-ভালোবেসে সাতদিনের কষ্টটাতেই অভিমান করছিস?আমার এই ছ বছর?এর কি নাম দিবি?

চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম শুধু তারদিক।হুট করেই ফু দিলেন উনি চোখে আমার।চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম আমি।উনি ঠান্ডা গলায় বললেন,

-এই চোখজোড়ার এভাবে বন্ধ হয়ে থাকাই প্রথমবার পাগল করে দিয়েছিলো আমাকে।

আবারো চোখ তুলে তাকালাম আমি।কপালে পরে থাকা সিল্কি চুলগুলো নড়ছে শুদ্ধের।ওগুলোকে হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিতে ইচ্ছে করছে।গালের চাপ দাড়িটায় হাত ছুইয়ে দিয়ে তাদের সৌন্দর্যকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।ঠোটের অসম্ভব তৃপ্ত হাসিটাকে আরো তৃপ্তিতে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।ইশ!এতোটা কাছে তুই তার ইনসু!সে যদি তোর মনের কথাগুলো শুনে নেয়?মুখ লুকানোর জায়গা থাকবে না তোর!লজ্জায় আবারো চোখ নামিয়ে নিলাম।শুদ্ধ বললেন,

-আজ আর পাগলটাগল না হই!ঘুম পাচ্ছে!গুড নাইট!হুম?

কপাল কুচকে আসলো আমার।গুড নাইট?ঘুম পাচ্ছে ওনার?

-ঘুমোবেন?

-তো?রাত কতো হয়েছে হিসেব আছে?

-আজকের রাতটা ঠিক তেমন,যেমনটা আপনি চেয়েছিলেন।দেখুন শুদ্ধ!

-আমি চেয়েছিলাম?

-হ্যাঁ।আপনি তো…

-ঘুমাবো!

-ফাইন!গুড নাইট!

এটুক বলেই সরে আসলাম।সব রোমান্টিক কথাবার্তার ঝুলি ফুরিয়ে গেছে এর।যাকে বলে স্টক ফুরিয়ে গেছে।ঘুমোবে!ঘুমোক!এই লোকটা রোদ্দুরই ডিসার্ভ করে!ফুসতে ফুসতে আয়নার সামনে বসে মাথার ঘোমটা খুলে ফেললাম।শুদ্ধ ব্যস্ত হয়ে বললেন,

-আরে আরে,সাজ নষ্ট করছিস কেনো?

-তো কি করবো?আপনি তো ঘুমোবেন!ঘুমোন!

উনি হাত টেনে দাড় করালেন আমাকে।তাকাইনি তার দিকে।উনি বললেন,

-সো ইউ ওয়ান্ট, ঘুমোনো ছেড়ে তোর সাজ আমিই নষ্ট করে দেই।

বড়বড় করে তাকালাম তারদিকে।কোন কথার কি মানে বের করছেন উনি?শুদ্ধ বললেন,

-ডোন্ট ওয়ারি,তোর সাজ নষ্টের জন্য আজকের কেনো?আজীবনের জন্য,প্রতিটা রাতের ঘুমকে ব্যান করে দিতে পারি আমি!

আরো বড় হয়ে গেলো আমার চোখ।শুদ্ধ একটা টেডিস্মাইল দিয়ে বললেন,

-কথায় রোমান্টিকতা দেখানো ভুলে গেছে আজ শুদ্ধ।যা হবে,কাজে!

চোখ বন্ধ করে নিলাম।কান গরম হয়ে গেছে আমার।হাতও ঘেমে গেছে।আস্তেধীরে গয়নাগুলো খুলে যেতে লাগলো গা থেকে।কেপে কেপে উঠছিলাম তার প্রতিটা স্পর্শে।ওনার নিশ্বাস নিকট থেকে নিকটতর হতে লাগলো।আর ভারি হতে লাগলো আমার নিশ্বাস।অনুভব করতে পারছি,মাঝের দুরুত্বটা খুব বেশিক্ষন রইবে না।এরমধ্যেই শুদ্ধর মোবাইল বেজে উঠলো।চোখ মেললাম আমি।শুদ্ধ পাশ ফিরতে যাবেন,ডানহাতে তার শেরওয়ানির কলারের নিচদিকটা মুঠো করে ধরলাম।উনি ভ্রু নাচিয়ে বোঝালেন,কি?রাগ নিয়েই বললাম,

-কোথথাও যাবেন না আপনি!

-আরে ফোনটা….

একমুহুর্ত দেরি না করে বাহাতে লেহেঙ্গা উচিয়ে ধরে তার পায়ের উপর উঠে দাড়ালাম।হাইটের তবুও কমতি।গোড়ালি উচু করে আঙুলের উপর ভর করে দাড়ালাম এবার।দুহাতে শুদ্ধর চুলগুলো মুঠো করে ধরেছি।ফাকা মাথা নিয়ে চোখ বন্ধ করে আটকে দিলাম তার ঠোটজোড়া।দুসেকেন্ড পরই কি করছি সে হুশ আসতেই চোখ খুলে ফেললাম।নেমে আসার আগেই শুদ্ধই আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরলেন আমাকে।

কতোক্ষন কেটে গেছে হিসেব নেই।নিচদিক তাকিয়ে জোরেজোরে শ্বাস ফেলতে লাগলাম আমি।পিঠটা দেয়ালে আটকে দাড়িয়েছি।শুদ্ধ পাশ দিয়ে হাত দেয়ালে ঠেকিয়ে দাড়ালেন।বললেন,

-মোবাইলে টাইমার সেট ছিলো।ইচ্ছে করেই বাজিয়েছি।আর আজকের রাতটা শুধু আমি যেমন চেয়েছিলাম তেমন না।তুইও চাস,তেমন।এ কথার প্রমান পেয়ে গেছি আমি!

দুহাতে মুখ ঢেকে নিলাম আমি।লোকটা জেনেবুঝে সবটা করেছে!ছি ইনসু?এটা কি করে করলি তুই?নিজে থেকে তাকে….!শুদ্ধ আমার দুগাল ধরে বললেন,

-ভালোবাসি শ্যামাপাখি!ভালোবাসি!

মাথা তুললাম আমি।সেদিনের মতো সাহসটা নিয়ে বলেই ফেললাম,

-ভালোবাসি শুদ্ধ!আমিও ভালোবাসি!

উনি আমার থুতনি ধরে মাথা উচু করে ধরলেন।গলায় তার দেওয়া সরু চেইনটাও খুলে দিলেন উনি।ফতুয়ার পিঠের ফিতাটায় আলতোভাবে টান লাগালেন।ফতুয়ার নিচ দিয়ে উন্মুক্ত পেটে হাত পরতেই কেপে উঠলাম।জমে যেতে লাগলাম ওই‌ স্পর্শে।লেহেঙ্গা খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে‌ রইলাম। দ্রুতচলা শ্বাসপ্রশ্বাসকে রাগ নিয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম,এ স্পর্শে নিজেদের এই গতি পাওয়া ঠিক কতোদিন পর বন্ধ হবে তোদের?কতোদিন পর আমার লজ্জাটাকে‌ শুধু আমার মাঝেই‌ সীমাবদ্ধ থাকতে দিবি তোরা?এই দ্রুমদ্রাম শব্দ যে শুদ্ধ শুনতে পান!এতোটাই যে কাছে উনি আমার!তখন‌ যে আরো বেশি করে লজ্জায় পরে যাই আমি!শুদ্ধ ফিসফিসিয়ে‌ বললেন,

-শুদ্ধের এই স্পর্শ আজীবন মুড়িয়ে রাখবে তোকে সিয়া!আর তোর এই ধুপধাপ শব্দের হৃদস্পন্দন!আজীবন এভাবেই একদম কাছে থেকে শুনতে চাই তাদের।দ্রুত চলতে মানা করিস না ওদেরকে সিয়া!বাধা দিস না!

শুদ্ধের শেরওয়ানিটা খামচে ধরে আবারো মুখ লুকালাম তার বুকের মাঝে।বরাবরের মতোই,তার কথা আর কাজ আজও আমাকে শেষ করে দিতে উদ্যত।তবুও,তবুও বারবার শেষ হতে চাই তার কথায়,তার কাজে,তার মাঝে,তারই নামে!আজ না আছে নিজেকে তার থেকে এতোটুকো দুরে রাখার উপায়,নাইবা আছে ইচ্ছা।হ্যাঁ।কথা রেখেছদ সে।পরিশিষ্টে সে আমার।আর আজ শুদ্ধর সিয়াও শুদ্ধরই!আজীবন থাকবে!আজীবন!

🍂
ছ বছর পর,

-মাম্মাম?দেখো তো?বাবাই দেখতে বেশি হ্যান্ডসাম?নাকি আমি দেখতে বেশি হ্যান্ডসাম?

একটা শ্বাস ফেলে দরজায় একহাত কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইলাম।সাদা শার্ট,কালো প্যান্ট,শার্টের উপর কালো ব্লেজার,শার্টের হাত গুটানো,চুলগুলো দেখাচ্ছে যেনো স্পাইক করা।পরিপুর্ন ভাব নিয়ে খাটের উপর সিয়াদ দাড়িয়ে।চার বছরের এই এতোটুকো ছেলের এতো এটিচিউড কোথথেকে আসে?

কথাটা মাথায় আসতেই চোখ গেলো পাশেই আয়নার সামনে চুল নাড়তে থাকা শুদ্ধের দিকে।শুদ্ধও সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার পরেছেন।শার্টের বড় হাতাটা এলোমেলো।হাতে সাদা ঘড়ি।চুলগুলো সেট করা হয়নি এখনো তার।তবুও আমার অবাধ্য চোখ আটকাতে বাধ্য।যেমন বাপ,তার তেমন ছেলে!এটুকো মস্তিষ্ক অতিক্রম করতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।এগিয়ে এসে বললাম,

-অন্নেক হ্যান্ডসাম লাগছে আজ সিয়াদকে।কিন্তু তুই তোর বাবাইয়ের সাথে তুলনা কেনো করছিস?কে বলেছে তোর বাবাই হ্যান্ডসাম?

শুদ্ধ চুল সেট করতে করতে বললেন,

-হাহ!শোন সিয়াদ!তোর মিথ্যেবাদী মাম্মামের কথা শোন!

-আমি মিথ্যেবাদী?

-নয়তো কি?তুইই তো বলিস,আমার এই লুকের জন্য তোর অনেক টেনশন হয়।হাজারটা মেয়ের চোখ থেকে আমাকে বাচাতে বাচাতেই চুল পেকে যাবে তোর!এই কথা অস্বীকার করতে পারবি?

কাহিনীটা এমনই।ইতস্তত করে তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাতে বললাম,

-অব্ এতো সাজছেন কেনো?আমি একটা মেয়ে হয়েও আপনাদের বাবা ছেলের চেয়ে একঘন্টা আগে রেডি হয়ে গেস্ট এটেন্ড করছি।আর আপনি?সিয়াদকে তো রেডি করিয়েই গেছিলাম,আবার ওর চুলগুলোর ওই হালাত বানিয়ে দিয়েছেন কেনো?

-সাজবো না তো কি?সিক্স ইয়ার ম্যারেজ এনেভার্সেরি!এটুক সাজ তো বান্তা হে!

কিছু বলতে যাবো এরমধ্যেই যীনাত আপু রুমে ঢুকলো।সাথে তানজুও।তানজিনা।তামিম ভাইয়া আর যীনাত আপুর মেয়ে।এই ঝগড়াটে দুটোর পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়ে গেছে পাঁচবছর আগেই।বড়কাকুই নাকি ফুপির কাছে বলেছিলো ওদের বিয়ের বিষয়ে।যীনাত আপুর মত থাকা নিয়ে কনফিউশন ছিলো আমার।জিজ্ঞাসাও করেছিলাম বিয়েতে রাজি হয়েছিলো কেনো।আপু বলেছিলো পরিবারের কথাই শেষ কথা ছিলো ওর কাছে,অবশ্য ওর অমতে বিয়েটা হতো না।তবে তামিম ভাইয়া নাকি আপুকে বলেছিলো,”সিক্রেট লাভার নই,তবে আজীবন ঝগড়ার সাথে ভালোবাসার মাসালাও মিক্সড্ রাখবো,প্রমিস করছি ভিজেবেড়াল।রাজি হয়ে যাও।”তাই নাকি ওর মানা করা হয়ে ওঠেনি।বুঝতে বাকি ছিলো না,এই ছোটছোট ঝগড়ার আড়ালে দুজনের মাঝে দুজনের জন্য ভালোলাগাও তৈরী হয়েছিলো।তানজু এগিয়ে সিয়াদকে বললো,

-সিয়াদ?তোকে তো শুদ্ধ মামুর মতোই লাগছে দেখতে!বেশ হ্যান্ডু!

-থ্যাংকস্ তানজুপু!তবে তোমাকে লাল জামায় একদম মানায় নি!

তানজুটা ভ্রুকুচকে তাকিয়ে থেকে সরে এলো।আমি চোখ পাকিয়ে তাকালাম সিয়াদের দিকে।ওর সেই বাবার মতোই ডোন্ট কেয়ার ভাব!সত্যি বলতে ভয় পায় না সে!আমি তানজুকে বললাম,

-না তানজু,সিয়াদ এমনি মজা করে বলেছে।তোকে তো লাল গাউনে একদম ডিজনে প্রিন্সেসের ‌মতো লাগছে!

তানজু আমাকে জরিয়ে ধরে বললো,

-থ্যাংক্স মনি।ইরাম মনিও এটাই বলেছে!

স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।যাক,কিছুই মনে করে নি ও।মেয়েটা আপুর মতোই ঠান্ডা স্বভাবের হয়েছে।যীনাত আপু‌ এগিয়ে সিয়াদের গাল টিপে দিয়ে হেসে বললো,

-তো মিস্টার ইরফান আজাদ সিয়াদ?আপনাকে এতো সুন্দর করে সাজালো কে?

-বাবাই!

ডাহা মিথ্যে কথা।আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম,

-এই?তোকে আমি রেডি করালাম না?

শুদ্ধ ততক্ষনে রেডি।হাতাটা গুটিয়ে এগিয়ে এসে বললেন,

-শুধু ড্রেসটা পরালেই রেডি করিয়ে দেওয়া হয় না!

-তো আপনার ছেলেকে কি দুচারবার ফেসিয়াল করানো দরকার ছিলো?

যীনাত আপু হেসে বললো,

-আচ্ছা আচ্ছা,হয়েছে।চল নিচে,ডাকছে সবাই তোদের!এসে গেছে সব গেস্ট!

কথা‌ না বাড়িয়ে চলে এলাম সবাই।আজাদ ম্যানশন আত্মীয়স্বজনে ভরপুর আজ।শেহনাজ মন্জিলের সবাইও এসেছে।আব্বু,আম্মু,ইরাম,দীদুন,কাকুরা,বড়মা,মেজোমা,তাপসী আপু,ইশান ভাইয়া, তায়্যিব,ইমরোজ ভাইয়া,রিফাত ভাইয়া,সিফাত ভাইয়া,সীমা ভাবি,ওদের জমজ মেয়ে সিমি,সিনহা।শুদ্ধর নানুবাসা থেকে সবাই এসেছে।মাহিও।আয়ানের সবটা জানার পর নিজেকে নতুনভাবে তৈরী করে নিয়েছে ও।ভালোলাগার জায়গাগুলো গুটিয়ে নিয়েছে,সবটা বুঝে চলতে শিখেছে।পড়াশোনা নিয়েই আছে আপাতত।আয়ান চৌধুরী এখনো জেলে।মুনিয়া সুস্থ্য হয়ে ওর মাকে নিয়ে কানাডা চলে গেছে।শুদ্ধ নিজেই সবটা গুছিয়েছেন।মুনিয়া বলেছে,ও সুস্থ্য অবস্থায় কোনোদিনই আয়ানকে বলেনি শুদ্ধকে ওর কাছে এনে দিতে।শুদ্ধ অন্যকারো সাথে সুখী থাকুক এটা মানতে পেরেছিলো ও,কিন্তু প্রথম ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রনা সুইসাইডের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো ওকে।তাই ওকে আর দোষারোপ করে নি শুদ্ধ।

আব্বুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম একবার শুদ্ধর পরিচয়ই তার রাগের কারন কি না।সবটা জানি শুনে অবাক হয়েছিলেন উনি।কথাটা স্বীকারও করেছিলেন।তার কাছ থেকে এটাও জানতে পারি সেজোকাকু শুদ্ধকে সেজোমার কসম দিয়েছেন,তার পরিচয় নিয়ে আমাকে বা কাউকে কিছু না বলতে।তাই এবিষয়ে কোনো কথাই বলেননি উনি আমাকে।আমার ফরেইন ডিগ্রির বিষয়ে শুদ্ধ জানতেন আগে থেকেই।মনুকে দিয়ে ফোনটা উনিই করিয়েছিলেন সেদিন।আমাকে‌ না জানিয়ে এপ্লাইও‌ করেছিলেন।কিন্তু আমার জেদের কাছে হার মানতে হয় তাকে।যাইনি কোথাও,তাকে ছেড়ে!সার্থক ছিলাম এই পাঁচবছর,আমার ভালোবাসায় তাকে বাকিসবটা ভুলিয়ে দিতে।আর আজীবন এভাবেই কাটাতে চাই আমি।কোনো কষ্টই যাতে শুদ্ধকে স্পর্শ করতে না পারে।

সবার সাথে কথা‌ বলা শেষে কেক কাটার জন্য বলা হলো আমাদের।সিয়াদকে মাঝে রেখে তিনজন মিলে কেক কাটলাম।শুদ্ধর মুখভর্তি করে কেক মাখিয়েছে সিয়াদ।মুছতেও দেয়নি।এটা ওকে আমিও শিখিয়ে দিয়েছিলাম।বেচারা ওই‌ মুখ নিয়েই ছিলো পুরোটা সময়। অনুষ্ঠান শেষে সবার সাথে অনেকক্ষন আড্ডা দিয়ে ভয়ে ভয়েই সিয়াদকে নিয়ে রুমে আসলাম।সবাই ঘুমোতে চলে গেছে।রুমে এসে দেখি‌ শুদ্ধ ফ্রেশ হয়ে সাদা গেন্জি আর ট্রাউজার পরে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে।সিয়াদকে চেন্জ করিয়ে দিলাম আগে।এবার চুপচাপ রুমের বাইরে পা বাড়াবো দুজন,শুদ্ধ ডাক লাগালেন,

-সিয়াদ?

দুজনেই থামলাম।পিপাসা পিপাসা পাচ্ছে কেমন যেনো।সিয়াদকেও দেখলাম শুকনো ঢোক গিলতে।ফিসফিসিয়ে ওকে বললাম,

-ক্ কাকে ডাকলো রে?

-ত্ তোমাকে!আর কাকে?আমি যাচ্ছি!দীদুন আজ আমাকে ছাড়া ঘুমোবে না বলেছে!বাই!

দৌড় লাগাতে যাচ্ছিলো ও।হাত টেনে ধরে বললাম,

-আজ্ঞে না!ফাসলে আপনাকে নিয়েই ফাসবো!পিছন ফিরেন!

-মাম্মাম আমি….

-তাকা পিছনে!

গাল ফুলিয়ে পিছনে তাকালো ও।শুদ্ধর আওয়াজ আসলো,

-তোকে ডাকি নি সিয়াদ।

চকচকে চোখ করে একপলক সামনে পিছনে দুজনের দিকে তাকালো।দাত কেলিয়ে বললো,

-তোমাকে ডেকেছে মাম্মাম!

কপাল বেয়ে ঘাম গরিয়ে পরলো আমার।সিয়াদের হাত আলগা হতেই একদৌড়ে বেরিয়ে গেলো ও রুম থেকে।একটু দম মেরে দাড়িয়ে থেকে সবে পা বাড়াতে যাবো,শুদ্ধ ঝড়ের বেগে এসে দুম করে দরজা লাগিয়ে‌ দিলেন।সামনে দাড়িয়ে,বুকে হাত গুজে,বাকা হেসে বললেন,

-পালাচ্ছিলি?

-অব্ ন্ না!না তো!পালাবো কেনো?

-ডাকলাম তোকে,সিয়াদকে কেনো ঠেললি?

-ইয়ে আপনি আমাকে সিয়া ডাকেন,ওকে সিয়াদ,এ নিয়ে এ্ একটু কনফিউজড্ হয়ে যাই আমি।এই আর কি!

-সিয়াদকে ডাকার কোনো কারন ছিলো না আমার!যাই হোক,আম্মু আজ ওকে ছাড়া ঘুমোবে না কেনো বলতো?

-আ্ আমি ক্ কি করে….

শুদ্ধ কোমড় জরিয়ে ধরলেন আমার আচমকাই।কিছুটা চমকে উঠেছি।উনি সেই এক টেডিস্মাইল দিয়েই বললেন,

-বাচ্চার মায়ের বাচ্চামোগুলো বড্ড কিউট লাগে।যাই হোক,এবার আমার চেহারায় কেক লাগানোর শাস্তি ভোগ কর!

-ও্ ওটা তো সিয়াদ….

-তো?তুইই বলেছিস ওকে,আমি কি জানি না ভেবেছিস?মাস্টারমাইন্ড তুই!

গাল ফুলিয়ে বললাম,

-প্রতিবার ছেলেকে ছেড়ে আমাকেই‌ শাস্তি দেন আপনি!প্লান আমি করি ঠিকই,কিন্তু সেটা তো ওই ইনিশিয়েট করে তাইনা?কিন্তু ফল শুধু আমাকেই ভোগ করতে হয়!

-ইটস্ ইউর ফেইট!আমি কি করতে পারি?

মাথা নিচু করে চুপ রইলাম।এ ছয় বছরে তাকে নিজে জ্বালাই নি,তবে সিয়াদকে দিয়ে অনেক জ্বালিয়েছি।আর প্রতিবার ধরা খেয়ে শাস্তিভোগও করেছি।শাড়ির নিচ দিয়ে পেটে স্পর্শ পেতেই চোখ‌ বড়বড় করে তাকালাম তারদিক।উনি বাকা হেসে বললেন,

-সো মিসেস ডট ডট ডট?আর ইউ রেডি?

তার হাসিটা দেখেই নুইয়ে গেলাম আমি।এ‌ শাস্তি আজীবন শিরধার্য আমার।শুদ্ধ হাত ধরে টেনে ব্যালকনিতে নিয়ে আসলেন আমাকে।পিছন থেকে জরিয়ে ধরে চুপ রইলেন কিছুক্ষন।আকাশে আজও অনেক বড় চাঁদ।সবটা আলো যেনো আজ এই বারান্দাতেই উৎসর্গ করছে ওই চাঁদ।শুদ্ধ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে হঠাৎই গেয়ে উঠলেন,

Na jiya,jindegi,ek pal bhi
Tujhse hoke juda,sun jara…

তার দিক ফিরে তার গালে একহাত রেখে গাইলাম,

Bin tere,khudse naraj,tha dill
Tu mila hai,to hai,keh raha…

উনি হাটু গেরে আমার হাত ধরে মাটিতে বসে পরলেন।গাইলেন,

Main to tere rang mein,rang chuka hu
Baas tere baan chukha hu
Mera mujhme kuch bhi nehi…
Sab tera,sab tera…

শুদ্ধর হাটুর উপর বসে আমি গাইলাম,

Main to tera dhang mein,dhang chuki hu
Baas tera,baan chuki hu
Mera mujhme kuch bhi nehi…
Sab tera,Sab tera….(ii)

গলা জরিয়ে ধরলাম শুদ্ধর।সত্যিই আমার সবটাই সে।আর তার সবটাই আমি আর সিয়াদ।বিছানার পাশেই রাখা আমার,শুদ্ধর আর সিয়াদের ছবিটা।কিছুদিন আগে তোলা ছবিটা।স্থির ছবিটা তখনকার পুরো মুহুর্তটাকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
তিনজন একসাথে হাসছিলাম না বলে ছবি তুলতে কষ্ট হচ্ছিলো তামিম ভাইয়ার।বলেছিলো সিয়াদকে কাতুকুতু দিয়ে দুজনে একসাথে হাসতে।হাটুগেরে বসে মাঝে সিয়াদকে দাড় করিয়ে দুপাশ থেকে আমি আর শুদ্ধ মিলে কাতুকুতু দিয়েছিলাম ওকে।

খিলখিল করে পেট ধরে হেসেছিলো ও।আমিও।এরমাঝে আমার কানে গোজা চুল সামনে চলে আসলে শুদ্ধ ডানহাতে তা আবারো কানে গুজে দিচ্ছিলেন আমার।ছবিটা ঠিক তখনি ক্লিক হয়।আমি সিয়াদকে কাতুকুতু দিতে গিয়েও শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে।সিয়াদ পেট ধরে হাসছে।আর শুদ্ধ?সে একহাতে আমার কানে চুল গুজছে,আরেকহাতে সিয়াদকে জরিয়ে সিয়াদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।হাটু থেকে আমাকে নামিয়ে উঠে দাড়ালেন শুদ্ধ।কোলে তুলে নিলেন।কপালে ঠোট ছুইয়ে রুমের দিকে এগোতে এগোতে বললেন,

-এইতো!আমার…না,আমাদের প্রেমের সার্থকতা।অপেক্ষার রোদ্দুরে পোড়ার সার্থকতা।সার্থক আমার ভালোবাসার রোদ্দুর!সার্থক শুদ্ধকে পোড়ানো সেই সব অপেক্ষা,দুরে যাওয়া,কাছে আসা,কিছু শিহরনে ভরা মুহুর্ত,আর হয়তো অনেকগুলোই কষ্টে মোড়ানো,তবুও ভালোবাসার শ্রান্ত রোদ্দুর।সবই সার্থক সিয়া!সবই সার্থক!এই পুর্নতাতে আজ সবটাই নিজের সার্থকতা খুজে নিয়েছে।নিতে হতোই তাদের!কারন শুদ্ধর কাছে,ওকে জুড়ে ওর অস্তিত্বকে বাচিয়ে রাখা সে রোদ্দুর শুধুই তোর নামের রোদ্দুর সিয়া!

গলা জরিয়ে রেখে তার বুকে মাথা রাখলাম।সে হৃদস্পন্দন প্রতিটা মুহুর্তের মতো এ মুহুর্তেও দামামা বাজিয়ে বলছে,

“শ্যামাপাখি,
শত অপুর্নতার ভীড়ে,
তুইই আমার পূর্নতার কারন…
তোকে ছাড়া এ হৃদস্পন্দন
কল্পনাও যে বারন…
আর ভালোবাসা?
সে তো অপেক্ষার পথ চলেছে বহুদুর,
জ্বালিয়েছে,পুড়িয়েছে
তবুও প্রাপ্তির স্বস্তি আর
ভালোবাসার আভায় রাঙিয়েছে,
তোর নামের রোদ্দুর!
তোর নামের রোদ্দুর!

🌸সমাপ্ত🌸

#মিথি