তোর নামের রোদ্দুর ২ পর্ব-৩৬+৩৭

0
584

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৩৬

-শুদ্ধ তো শুদ্ধই নয়!ইরহাম আজাদ শুদ্ধ নামে যে মানুষটাকে চিনে এসেছো এতোদিন,সে আসলে কেউই হয়না তোমাদের ইনসিয়া।ওই মানুষটা নাম,পরিচয়হীন একটা মানুষ।কোনো পরিচয় নেই ওর।আসাদুজ্জামান আজাদের সাথে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই ওর।ওকে তো অ্যাডপ করা হয়েছিলো।কোনো এক এতিমখানা থেকে!

আয়ানের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।চোখের সামনে থাকা ওনার হাতের পেপারটায় সত্যিই বাচ্চা এডপশনের সবরকমের ফর্মালিটিজ লেখা।তাতে আব্বুর সইও আছে।টুপ করে দুফোটা জল গরিয়ে পরলো চোখ থেকে।হুশ ফিরতেই চেচিয়ে বললাম,

-হাউ ডেয়ার ইউ?আপনি আবারো আমাকে জাল কাগজপত্র দেখিয়ে ভুল বোঝানোর চিন্তায় আছেন?শুদ্ধ আসাদুজ্জামান আজাদেরই সন্তান!উনিই ইরহাম আজাদ শুদ্ধ!আর…

আয়ান আবারো মুখ বেধে দিলেন আমার।ছটফট করতে লাগলাম।উনি বললেন,

-আমাকে শেষ করতে দাও আগে!বলেছি তো,বলার হিউজ অপারচুনেটি করে দেবো তোমাকে।কি যেনো বলছিলাম?ও!হ্যাঁ,এইতো!আমার তরফ থেকে তোমার জন্য গিফট্!সারপ্রাইইইজ!

….

লিসেন ইনসিয়া,এতিমখানার সমস্ত ডিটেইলস্ ওখানে দেওয়া আছে।মিসেস আজাদ প্রেগন্সিতে পরে টরে গিয়েছিলেন হয়তোবা।হসপিটালে সিজারিয়ান অপারেশনে মিসেস আজাদ যে শুধু প্যারালাইজড্ হয়েছিলেন তাই নয়,তার সন্তানও মৃত হয়েই জন্ম নিয়েছিলো।তাছাড়া ডক্টরেরা এটাও বলেছিলো,তার ওভারির কোনো প্রবলেমের জন্য নাকি সন্তানধারন ক্ষমতাও হারিয়েছিলেন উনি।তিনদিন সেন্সলেস অবস্থায় পরে ছিলেন উনি।এই সবটার মেডিকেল রিপোর্টও আছে।এই দেখো!

তবে হ্যাঁ,মিস্টার আজাদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়!ওয়াইফকে কষ্ট দেবেন না বলে কোনোভাবেই তাকে জানতে দেননি,বাচ্চাটা মৃত ছিলো।ইনফ্যাক্ট,কাউকেই জানতে দেননি।সবাই জানতো,তাদের সন্তান ভেন্টিলেশনে আছে।আর যুগটাও কিছুটা পিছানো ছিলো,ডক্টর একবার মানা করাতেই ভয়ে তোমাদের শেহনাজ মন্জিলের কেউ বাচ্চার দিকে পা বাড়ায় নি।মৃত সন্তান জন্ম দেওয়া সত্ত্বেও তিনদিন পর মিসেস আজাদের কোলে আসে ফুটফুটে,জীবিত সন্তান,অ্যাডপটড্!শুদ্ধ!

গায়ের জোর কমে আসতে লাগলো।সমস্ত ডিটেইলস্ ওভাবেই দেওয়া যেভাবে উনি বলছেন।শুদ্ধ,আব্বু,দীদুন,দাদুভাই সবার অদ্ভুত ব্যবহারগুলো চোখের সামনে ভাসতে লাগলো আমার।এজন্যই কি তবে শুদ্ধ সে রাতে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমাকে,সম্পর্ক কি দিয়ে বিবেচনা করা উচিত?এই কথাটা তবে উনি জানেন?আয়ান বললেন,

-হ্যাঁ,এখন তুমি বলতে পারো আমি এতোসব কিভাবে জানি।আসলে,কথাটা শুদ্ধই কোনোভাবে জেনে যায় দুবছর আগে।অনেকটাই ভেঙে পরে বলে ফেলেছিলো আমার কাছে এ কথাটা।হয়তো মিস্টার আজাদ সামলে নিয়েছিলেন ওকে।তাই আর এ নিয়ে কথা বাড়ায় নি ও।আর আমিও বরাবরের মতো ওর কোনো কষ্টকে পাত্তা দেইনি!

পুরোপুরিভাবে নুইয়ে গেলাম।যদি এটাই সত্যি হয়,তবে শুদ্ধ সবটাই জানেন!নিজেকে রক্তশুন্য বলে মনে হতে লাগলো।উনি জানেন,আম্মু ওনার নিজের আম্মু না।আব্বু ওনার নিজের আব্বু না।এটা জানার পর কি কি অনুভুতি হয়েছিলো তার?এতোবড় সত্যিটা শুনে কিভাবে সামলেছিলেন উনি নিজেকে?এই মানুষটা এতোটা কষ্ট বুকে রেখে কি করে সবার মধ্যে হাসিখুশিভাবে থাকেন?কিভাবে?আয়ান বলছেনই,

-তোমাদের বিয়ের পরথেকেই,আমি চেয়েছিলাম যেকোনোভাবে তোমাদের সম্পর্কটা নষ্ট করতে,তাই ইচ এন্ড এভরিথিং কালেক্ট করি শুদ্ধর বিষয়ে!জানতে পারলাম,তোমার দাদুভাইকে মিস্টার আজাদ বলেছিলো শুদ্ধর সত্যিটা।তাই তিনি ঠিক করে যান,মারা যাওয়ার আগে অন্তত তোমাকে শুদ্ধর পিছুটান করে যাবেন।এজন্যই সেদিন ছেলেখেলার মতো আংটি পরিয়েছিলো শুদ্ধ তোমাকে।ইফ আ’ম নট রং,হয়তো সেদিনই শুদ্ধ সত্যিটা জেনে যায়।কারন তারপরই একটু একটু করে বিধ্বস্ত হতে দেখছিলাম ওকে।গুটিয়ে রাখতে শুরু করেছিলো নিজেকে ও।

এরপর আসে তোমাদের বিয়ের দিন!সেদিন শেহনাজ মন্জিলে ঘটা ঘটনাগুলোর কিছুই জানায়নি শুদ্ধ আমাকে।তবে হ্যাঁ,জেনেছি অনেকটাই আমি।বিয়েটা যে তোমাদের অস্বাভাবিকভাবে হয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।আর পরে তোমার আব্বুর অমতের বিষয়ে মাহির কাছ থেকে জানতে পারি।যদিও ও জানে না কিছুই,তবুও যেটুক‌ বলেছিলো,ইট ওয়াজ প্রিটি এনাফ!

তোমাদের বিয়ের দিন যখন মিস্টার আজাদ আমাকে ফোন করেছিলো,কলটা মুন রিসিভ করেছিলো ইনসিয়া।শুদ্ধের বিয়ে শুনে সুইসাইড করতে যায় ও।আমি তখনও অফিসে,মোবাইল বাসাতেই ফেলে এসেছিলাম।অফিসের এক স্টাফ জানায় আজাদ ম্যানশনে চলে যেতে।তারপর সেখানে কোনোকিছু না জেনে পুরো বাসাকে নববধুর মতো সাজিয়েছিলাম আমি নিজের হাতে।বোনের সুখ মিস্টার আজাদের কাছে ভিক্ষা চাইবো বলে নিজের সবটুকো বিশ্বস্ততা দিয়ে কাজ করে এসেছি এতোগুলো দিন।নিজের পরিবারের খবরও নেইনি সেদিন।আর দিনশেষে?দিনশেষে খবর পাই শুদ্ধর বিয়ের আর মুনের সুইসাইড এটেমপ্টের।

তুমি ভাবতে পারো?ভাবতে পারো ইনসিয়া কি অবস্থা হয়েছিলো কথাদুটো শুনে আমার?পাগলের মতো চলে যাই হসপিটাল।তোমাকে বিয়ে করে ঢাকায় ফিরে শুদ্ধ ফোন করেছিলো‌ আমাকে।মুনকে হসপিটালে ফেলে‌ ছুটে যাই ওর কাছে।ওকে খুন করবো বলে।কিন্তু ওকে ড্রাংক‌ দেখে বুঝে গিয়েছিলাম,কিছু একটা হয়েছে,যাতে আমার কিছু করার আগেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে ও!

শুদ্ধ আমাকে দ্বিতীয়বারের মতো বলে ফেলেছিলো সেদিন,রক্তের সম্পর্ক নেই বলে সত্যিই কি আমি এসবের যোগ্য নই আয়ান?তারপর ওর ব্যাপারে আমি সবটা খোজ লাগাই।একদম জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে সবটা।যখন জেনে যাই,ও‌ অ্যাডপ্টড্,আই ওয়াজ ড্যাম শিওর!তোমার আব্বু শুদ্ধর মিথ্যে পরিচয়টা কোনোভাবে জেনে গিয়েছিলেন।এজন্যই চাননি একজন পরিচয়হীন কারো হাতে তোমাকে তুলে দিতে!কিন্তু আমার বোন?আমার বোনকে তো সবটা জেনেই আমি শুদ্ধর হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম।তাহলে আমার দোষটা কোথায় ইনসিয়া?বলো!আমার দোষটা কোথায়?

এতোক্ষনে সবটা পরিষ্কার হতে লাগলো আমার।আব্বু কেনো পছন্দ করতেন না শুদ্ধকে।আব্বুকে চিনি আমি।উনি যেকোনো সম্পর্কের বিষয়ে খুবই কঠোর।তা বলে একটা মানুষকে,শুদ্ধের মতো কাউকে তার সত্ত্বা দিয়ে বিবেচনা না করে,রক্তের সম্পর্ক আছে কি না সেই প্রশ্নে এভাবে দুরে ঠেলে দিলেন উনি?এমনটা আশা করিনি তার থেকে।এই ছোট বিষয়টার জন্য উনি শুদ্ধকে আমার জীবনেই চাননি।ভাবতেও নিজের কাছে নিজেকেই ছোট মনে হতে লাগলো।দীদুন ঠিকই বলেছিলো।বিয়ের দিন আব্বুর কাছে চাওয়া আমার দোয়া কবুল হয়েছে।আজ সত্যিই শুদ্ধর সেই রক্তের সম্পর্ক না থাকা কারনটাই আম্মুর জীবন বাচিয়েছে।আয়ান বললেন,

-শুদ্ধকে যতোদুর আমি চিনি,তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসলেও,আপন করাটা ওর কাছে অসম্ভব ছিলো।কারন তুমি ওকে ভালোবাসো না।আর ওউ ওর জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যিটা লুকিয়েছে তোমার থেকে।এই এতোবড় বড় দুটো কারনে,তোমরা একে অপরকে ডিসার্ভ করো না ইনসিয়া!

আয়ান মুখ খুলে দিলেন আমার।দম মেরে বসে আছি আমি।উনি আমার হাতটাও খুলে দিলেন।তারপর পায়ের বাধনও।বললেন,

-এবার বলো ইনসিয়া,আমি ভুলটা কি করছি?শুদ্ধও একতরফা ভালোবাসে তোমাকে,আর মুন ওকে।তোমার বাবা শুদ্ধকে মানেন না,কিন্তু আমি মানি।তাই তোমাকে নিয়ে কোনোদিনই খুশি হবে না শুদ্ধ!শুদ্ধর লাইফ থেকে তুমি সর্….

-শুদ্ধর ভালোবাসা একতরফা নয় মিস্টার চৌধুরী।আমিও ওনাকে ভালোবাসি।

নিচদিক তাকিয়ে একদম শান্তভাবে বললাম কথাটা।আয়ান কিছুক্ষন ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।তারপর জোর করে হেসে বললেন,

-ইউ আর কিডিং রাইট?মজা করছো তুমি?একজন বেনামী মানুষকে….

এবার উঠে দাড়িয়ে তারদিক শক্ত চোখে তাকিয়ে বললাম,

-মজা করার মতো সম্পর্ক নয় আমাদের মিস্টার চৌধুরী!আর শুদ্ধ বেনামী নন!উনি আমার বর!ইরহাম আজাদ শুদ্ধ!আমি ওনাকেই‌ ভালোবাসি!আপনার এইসব কথায়,এইসব ফালতু কাগজপত্রে তার পরিচয় বা আমার ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র আঁচ আসবে না মিস্টার চৌধুরী!আমি আসতে দেবো না!

আয়ানের কুচকানো কপাল‌ শিথিল হলো।বিরক্তির চেহারা করে আশেপাশে তাকালেন।জোরে একটা শ্বাস ফেলে চোয়াল শক্ত করে বললেন,

-কান খুলে শুনে নাও ইনসিয়া!এতোক্ষন যা যা বললাম তোমাকে,তার প্রতিটা বর্ন সত্যি।বাট ট্রাস্ট মি,আরো আকাশপাতাল এক করে এ কথার সত্যতা তোমার কাছে প্রমান করার মিনিমাম ইচ্ছে আমার নেই।তুমি তো সেটাই করবে,যেটা আমি করতে বলবো তোমাকে!শুদ্ধর জীবন থেকে সরে যাবে তুমি!

-যদি না করি?

-যদিও পালিত,তবুও শুদ্ধের সবচেয়ে কাছের,ওর আম্মুকে আর কোনোদিনও দেখতে পাবে না ও!

দু পা পিছিয়ে গেলাম।পরে যাচ্ছিলাম,চেয়ার ধরে কোনোমতে সামলালাম নিজেকে।আমি দুরে গেলে শুদ্ধ বেচে গিয়েও মরে যাবেন,আর আম্মুর কিছু হয়ে গেলে যে শুদ্ধ সত্যিসত্যিই মরে যাবেন!কি করবো আমি এখন?কোনদিকে যাবো?আয়ান টেবিলে রাখা পেপারওয়েটটা হাতে নিয়ে হাটতে হাটতে বললেন,

-তুমি শুদ্ধকে হ্যাকিং নিয়ে কিছু বললে সেটা খুব একটা গায়ে মাখতো না ও,আমি জানি।কারন তুমি নিজেই তা বিশ্বাস করো নি।তোমাকে দিয়েই বিশ্বাস জিনিসটা পরখ করা হয়ে গেছে আমার।তাই এবার ওকে তুমি শুধু ব্যাংক রোবারি না,পরিচয়হীন,ঠকবাজ বলে কথা শোনাবে।বলবে,ওর কোনো কিছুই নিজের না।আজাদ গ্রুপের উত্তরসুরী নয় ও।ওর যা আছে,কোনোকিছুই ওর প্রাপ্য না।আরো যেভাবে বললে ও নিজে থেকে দুরে সরিয়ে দেবে তোমাকে,সেভাবে বলবে।

শব্দ করে কেদে দিলাম।মাটিতে বসে পরে আয়ানের পা জরিয়ে ধরলাম আমি।বললাম,

-ছেড়ে দিন আমাদের আয়ান!প্লিজ যেতে দিন আমাদেরকে!পারবো না আমি!পারবো না শুদ্ধকে এসব বলতে!আপনি তো বললেন আপনি শুদ্ধকে আঘাত করবেন না।এসব বললে যে শুদ্ধ জীবন্ত লাশ হয়ে যাবে আয়ান!দয়া করুন!একটু দয়া করুন আমাদের উপর!

আয়ান তার পা সরিয়ে নিলেন।বললেন,

-হ্যাঁ আমি বলেছি,শুদ্ধকে আঘাত করবো না।কিন্তু এই সাময়িক ধাক্কা না দিলে তুমি ওর জীবন থেকে সরবে না,আর মুনও ওর জীবনে আসবে না।ইটস্ আ….

-সাময়িক ধাক্কা?উনি পাগলের মতো ভালোবাসেন আমাকে আয়ান!পাঁচ পাঁচটা বছর ধরে!আমি তার জীবন থেকে সর্….

-লিসেন,আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু নো ইউর লাভস্টোরি!কোনো ইন্টারেস্ট আমার নেই ওতে!আমি আমার বোনের জীবনের ভালোবাসাটা শুধু ফিরিয়ে দিতে চাই।দ্যাটস্ ইট!তোমাকে যখন শুদ্ধ ওর লাইফ থেকে সরিয়ে দেবে,আমি বুঝাবো ওকে,মুন ওকে কতোটা ভালোবাসে।তাছাড়া মুনের প্রতি যে ওর কোনো সফট্ কর্নার নেই,তাও নয়।ও বরাবরই টেক কেয়ার করতো মুনের।এখন তো জানে ওকে আবারো বিদেশ পাঠিয়েছি আমি।যখন জানবে ও হসপিটালাইজড্,ঠিক চলে যাবে ওর কাছে।তোমার কাছে আর এসব ব্যাখা করার প্রয়োজনবোধ করছি না আমি।

-কিন্তু আয়ান…

-এনাফ অফ ইট ইনসিয়া!আর কোনো কথা নয়!চয়েজ ইজ ইউরস্!হয় তুমি সরবে শুদ্ধর জীবন থেকে,নয়তো ওর পালিত মা!বিশ্বাস করো,যদি এমনটা না করো তুমি,তোমার আম্মুর চেয়ে মিসেস আজাদকে আরো বেশি কষ্ট পেতে হবে।তাকে….

-না!না আয়ান!কিছুই করবেন না আম্মুকে প্লিজ!কিছুই করবেন না!আপনি যা বলবেন,তাই করবো আমি!সবটা বলবো!ঠকবাজ বলবো,পরিচয়হীন বলবো,লোভী,হ্যাকার সব,সব বলবো শুদ্ধকে!ওনার ঘৃনা নিয়ে সরে যাবো ওনার জীবন থেকে!চিরতরে!

আয়ান বাকা হাসলেন।বুকে দুহাত গুজে চিৎকার করে কাদতে লাগলাম আমি।পৃথিবীটা এতো‌নিষ্ঠুর কেনো শুদ্ধ?সময়টা এতো বেসামাল কেনো?যেখানে আপনি ভালোবাসি শোনার অপেক্ষায়,সেখানে এতোগুলো কঠোর কথা শুনতে হবে আপনাকে শুদ্ধ।বিয়ের দিন আব্বু হয়তো এগুলোই বলেছিলেন আপনাকে।তাই আপনার ওই অবস্থা হয়েছিলো সেদিন।আজ আমি এগুলো বললে আপনি তো শেষ হয়ে যাবেন শুদ্ধ!কি করবো আমি বলুন?কি‌ করবো?করার কিছু আছে কি আমার?নিয়তি যে প্রতিবারই আমাদের সামনে এই অসহনীয় পরিস্থিতি দাড় করিয়ে দিচ্ছে।আর এবার হয়তো শেষবারের মতো!চিরতরে সরে যেতে হবে আমাকে আপনার জীবন থেকে!আজীবনের জন্য!

#চলবে…

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৩৭

আবছা অন্ধকারে সরু আলোরশ্নির প্রবেশ।গোডাউনের শার্টার খোলার আওয়াজ কানো আসলো।আর জ্বলতে থাকা চোখে এসে লাগলো বাইরের তপ্ত রোদ্দুরের ঝকঝকে আলো।মাটিতে বসে কাদছি আমি।আয়ান কাউকে বললেন,

-এখনই খোলার দরকার ছিলো না অশোক!ইনসিয়ার নিজেকে সামলাতে আরেকটু সময় লাগবে হয়তো!

অশোক নামের লোকটা বললেন,

-অনেক আগেই খোলার দরকার ছিলো স্যার!

তার কথা শেষে মাটিতে ছায়া দেখলাম কারো।সম্পুর্ন খোলা শার্টার দিয়ে গোডাউনের ভেতরে ঢুকছে সে।আয়ানের বিস্মিত কন্ঠে বেরোলো,

-শ্ শুদ্ধ?তুই এখানে?

আমি জলভরা চোখে নিচদিকেই তাকিয়ে ছিলাম।এটুক শুনেই কেপে উঠলাম।এই কথাটা যেনো সত্যি হয়।কোনোভাবে যেনো ভুল না শুনি আমি।পাশ ফেরার আগেই কেউ একজন ঝড়ের বেগে এসে আয়ানের গেন্জিটার ঘাড়ের দিকটা ধরে টেনে হিচড়ে চেয়ারে বসিয়ে দিলো তাকে।আরেকজন স্কচটেপে মুখ আটকেও দিয়েছে মুহুর্তেই।আরো একজন দৌড়ে এসে চেয়ারের পিছনে আয়ানের দুহাত বেধে দিয়েছে।কালো শার্ট পরিহিত সে মানুষটা চেচিয়ে বলে উঠলো,

-শুদ্ধ এখানে নেই আয়ান!হি ইজ ইন দ্যা হেল নাও!সেই জাহান্নামে বিশ্বাসঘাতকতার আগুনে জ্বলছে ও!এন্ড আই সোয়ার,তার থেকেও ভয়ংকর কোনো জাহান্নামে এভাবেই টেনে হিচড়ে পাঠাবো তোকে আমি আজ!

শ্বাস থামিয়ে বসেই ছিলাম।এটুক বলেই উনি পিছনদিক ফিরলেন।এটা শুদ্ধই!হাত মুঠো করে চোয়াল শক্ত করে দাড়িয়ে উনি।কালো শার্টের কলারের কাছের খোলা বোতামদুটো দিয়ে ফর্সা গলার রগগুলো সুস্পষ্ট।কিন্তু আমার দিকে শান্ত দৃষ্টি তার।উঠে দাড়িয়ে একছুটে গিয়ে জাপটে জরিয়ে ধরলাম তাকে।তার বুকে মুখ গুজে হুহু করে কেদে দিলাম আমি।ইন করা শার্টটার বুকের দিকে খামচে ধরে অস্ফুটভাবে বললাম,

-শ্ শুদ্ শুদ্ধ….

শুদ্ধ এতোক্ষনে মাথায় হাত রাখলেন আমার।আরো ফুপিয়ে কেদে উঠে মিশে যেতে লাগলাম তার বুকের মাঝে।এই আয়ান নামের লোকটাকে‌ কিছুক্ষন আগে চড় লাগালেও শুদ্ধর উপস্থিতি আমার আসল অনুভুতি,ভয়টাকে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দিয়েছে।শুদ্ধ আমার ঘাড়ের চুল মুঠো করে নিয়ে আরেকহাতে জরিয়ে ধরলেন।শান্তভাবে বললেন,

-কাদিস না সিয়া।তোর কান্না সহ্য হয় না আমার।প্লিজ কাদিস না।

আমি কান্না থামাতে ব্যর্থ।ফোপাচ্ছিই।আড়চোখে তাকালাম আয়ানের দিকে।হাত পা বেধে মুখ আটকে দেওয়া হয়েছে তার।ওনাকে দিশেহারার মতো লাগছে।কিন্তু তবুও ওই ভয়ানক মানুষটার কথাগুলো মনে পরতেই চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম আমি।আবারো খামচে ধরলাম শুদ্ধের শার্ট।উনি বললেন,

-ভয় পাস না সিয়া।আমি এসে গেছি তো!

আমি এসে গেছি তো!নতুনভাবে দেহে প্রান ফিরে পেলাম এই কথায়।তবুও‌ শক্ত করে ধরে আছি তাকে।অশোক বললেন,

-ম্যামের ভয়ের কারন এই আয়ান চৌধুরী স্যার!এই আয়ান চৌধুরী!আপনার আদেশ মানতে গিয়ে ম্যামকে এভাবে তুলে আনতে হয়েছে আমাকে,তাকে এই বদ্ধ জায়গাটায় আটকে দিতে হয়েছে আমাকে,মিস্টার চৌধুরীর হাতে ম্যামের চুল মুঠো করা দেখতে হয়েছে আমাকে,ম্যামকে কষ্ট পেতে দেখতে হয়েছে আমাকে স্যার!এবার আপনি এর সাথে ঠিক কি করবেন সবটাই আপনার ব্যাপার!

শুদ্ধর উষ্ণ নিশ্বাস!মাথা তুলে বললাম,

-শুদ্ধ…শুদ্ধ…আ্…আম্মু,মাহি….

-শান্ত হ।ওরা হসপিটালে ছোটমার কাছে আছে।কিছুই হয়নি ওদের।

অশোক বললেন,

-স্যার,এতোটা সময়….

-আম্মু ছাড়ছিলো না অশোক।মাহিকে সবটা বলতে নিষেধ করতে সময় না লাগলেও আম্মুকে বোঝাতে সময় লেগেছে।অনেক কষ্টে তাকে বুঝিয়েছি,কেউ তাকে টাকার জন্য কিডন্যাপ করেছিলো।চাইলেই সিয়াকে ওদের সাথেই ছাড়াতে পারতাম আমি।কিন্তু তাতে আম্মু আয়ানের আসল রুপটা জেনে যেতো,কষ্ট পেতো সে।কি করে আমার দুনিয়া,আমার পৃথিবীকে কষ্ট পেতে দেই বলো?তাই এতোক্ষন আমার আরেক পৃথিবীকে তোমার ভরসায় রেখেছিলাম।

আবারো ফুপিয়ে কেদে দিলাম আমি।শুদ্ধ হাত ধরতে যাচ্ছিলেন আমার,ব্যথায় কুকড়ে উঠলাম।ঠিক সেখানটাতেই আয়ান ধরে রেখেছিলেন।তার নখের আচড়ে জামার হাতার উপরেও ছোপ ছোপ দাগ হয়ে গেছে।শুদ্ধর চোখ রক্তবর্ন হয়ে গেলো তা দেখেই।অশোক বললেন,

-ম্যাম সাবধান করেছিলো মিস্টার চৌধুরীকে,তাকে স্পর্শ না করতে।শোনেন নি উনি স্যার!

শুদ্ধ দাতে দাত চেপে বললেন,

-সিয়াকে নিয়ে যাও অশোক!

অশোক এগোচ্ছিলেন।শুদ্ধকে আরো জাপটে ধরে জোরেসরে চেচিয়ে বললাম,

-কোথথাও যাবো না আমি!

উনি জোরে শ্বাস ফেললেন একটা।তারপর একহাতে আমার মাথা তার বুকে‌ শক্তভাবে চেপে ধরলেন।বেশ কিছুটা সময় পর চাপা‌ গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলাম আয়ানের।চোখ তুলে তাকাতেই খিচে বন্ধ করে নিলাম আবারো।আয়ানের ডানহাত বিভ্যৎষভাবে ঝলসে গেছে।ফুটন্ত পানি ঢালা হয়েছে তার হাতে।পাশেই অশোক ফ্লাক্স হাতে দাড়িয়ে আছেন।আয়ান শব্দ করতে পারছেন না,তবে তীব্র ব্যথায় গোঙরাচ্ছেন।শুদ্ধ বললেন,

-আজ তোর কষ্টে আমার এতোটুকো কষ্ট হচ্ছে না আয়ান!বিশ্বাস কর,যেটা কোনোদিন কল্পনাতেও ছিলো না আমার।তোর মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোতে দেবো না আমি আজ।যে মুখের কথা এতোগুলো দিন শুধুমাত্র আমাকে কষ্ট দিয়েছে,তাকে ছাড় দিতাম।কিন্তু ওই‌ মুখ‌ দিয়ে উচ্চারন হওয়া শব্দ আজ সিয়াকে কাদিয়েছে,কি করে ওকে আর আওয়াজ করতে দেই আমি?ওই হাত শুধু আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে প্রমান তৈরীতে ব্যস্ত থাকলে,তাকে ছাড় দিতাম।কিন্তু ওই হাত আজ সিয়াকে আঘাত করেছে,ওকে কি করে ছাড় দেবো আমি?কি করে?

তুই না মানলেও,আগে থেকেই তোকে বেস্টফ্রেন্ড মানতাম আমি।ভালোই চলছিলো আমার বন্ধুত্ব।কিন্তু মাঝখানে চলে আসে মুনিয়া।বুঝেছিলাম,খুবই চঞ্চল স্বভাবের আর জেদী ও।অল্প সময়েই আমাদের মধ্যে একটা ভালো বন্ডিংও হয়ে যায়।কিন্তু আমার চোখে শুধু তা ভাইবোনেরই ছিলো।মাহি,ইরাম আর মুনিয়ার মধ্যে কোনো তফাৎ অনুভব করিনি কোনোদিন।বিদেশ থেকে কিছু অপসংস্কৃতি মাথায় বসে গিয়েছিলো ওর।টুকটাক শাসন করতাম।বড় ভাই হিসেবে।কিন্তু আমার এই কাজগুলো ওর মনে কোনো আলাদা অনুভুতির সৃষ্টি করবে,তা আমি ভাবতেও পারি নি।

একদিন আশ্চর্যজনকভাবে মুনিয়া প্রোপোজ করে বসে আমাকে।তখন তখন ওকে বলে বেরিয়ে আসি,অন্যকাউকে ভালোবাসি আমি।ওকে তো শুধুই বোনের চোখে দেখেছি।যাতায়াত কমিয়ে দেই ও বাসায়।তারপর এই বিয়েটা!বিয়ের পরেরদিন জানতে পারি মুন সুইসাইড এটেমপ্ট করেছে,যদিও সেটা তুই বলিস নি আমাকে আয়ান।প্রচন্ডভাবে দোষী মনে হতো নিজেকে।হয়তো আমার ব্যবহারেই মেয়েটা আকাশকুসুম ভাবতে শুরু করেছিলো।তাই তোকে ভালো রাখার চেষ্টা করতাম।ভাবতাম তুই ভালো থাকলেই তোর বোনকে ভালো রাখতে পারবি।

কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিলো আয়ান।তুই কাউকেই ভালো রাখতে চাসনি।বোনের প্রতিশোধ হিসেবে আমার আর সিয়ার সম্পর্কটা তোর টার্গেট হয়,সেটাও জানতাম আমি।সিয়াকে ভুল বোঝাতেই আমার পিসি থেকে অফিসে বসে ব্যাংকের একাউন্ট হ্যাক করে নিলি তুই।যাতে সবটা দায় আমার উপর আসে তাইনা?

তুই কি ভেবেছিলি?সিয়ার বিশ্বাস আর আমার ভালোবাসা এতোটাই ঠুনকো যে তোর এই নকল কাগজপত্র দেখে সিয়া আমাকে ভুল‌ বুঝে চলে যাবে,আর আমি মুনকে গ্রহন করবো?দেন ইউ আর টোটালি রং আয়ান!কয়েকঘন্টা আগ অবদি আমার চেষ্টা ছিলো তোর কুকীর্তি লুকানো।যদিও তুই তার যোগ্য নস,তোর অসুস্থ্য বোন, যাকে নিজের বোনই ভাবি,তোর আম্মু,যাকে নিজের মা ভাবি,তাদের জন্য বাচাতে চেয়েছিলাম তোকে।কিন্তু আমার আম্মুকে এসবে জরিয়ে সবটা নষ্ট করে দিয়েছিস তুই!ভালোবাসার কোথায় কমতি রেখেছিলো সে তোকে আয়ান?নিজের ছেলের মতোই তো‌ ভালোবাসতো তোকে!তাহলে?তোর মনুষত্যবোধ এতোটা লোপ পেয়ে গেলো তুই ছোটমার এক্সিডেন্ট করানোর মতো জঘন্য কাজটা করলি তুই?

শুদ্ধ আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে দাড় করিয়ে বললেন,

-এই কুৎসিত মুখোশধারী লোকটার জন্য তোকে কষ্ট পেতে হয়েছে সিয়া।আর ও আমার লাইফের অংশ হয়েই তোর লাইফে এসেছে।ক্ষমা করে দে আমাকে সিয়া।আমি….

-না শুদ্ধ!আপনি….

-কি কি বলে ভয় দেখিয়েছে ও তোকে?

শুদ্ধর সোজা প্রশ্ন!চুপ করে আস্তেধীরে আবারো মুখ গুজতে লাগলাম তার বুকে।তার পরিচয় নিয়ে কোনো কথা চাইনা আমি আর।উনি আমাকে একহাতে জরিয়ে আরেকহাতে আয়ানের মুখ খুলে দিতে যাচ্ছিলেন।অশোক বলে উঠলেন,

-স্যার,মিস্টার চৌধুরী ম্যামকে….

তাকে থামিয়ে দিতে‌ তাড়াতাড়ি‌ বললাম,

-আপনি শুদ্ধর লোক?

উনি মাথা উপরেনিচে নাড়ালেন।বললেন,

-দুবছর আগে আয়ান চৌধুরীর কাছে শুদ্ধ স্যারই পাঠিয়েছিলেন আমাকে।উনি সময় দিতে পারছিলেন না মিস্টার চৌধুরীকে,তাই আমাকে বলেছিলেন তার পাশে থাকতে।জাস্ট এজ আ হেল্পিং হ্যান্ড।কিন্তু বিশ্বস্ততার জোরে আয়ান চৌধুরী যেমন স্যারের অনেকটা জেনে গিয়েছিলেন,আমিও তার মটো জেনে গিয়েছিলাম।শুদ্ধ স্যারকে জানালে উনি বলেছিলেন উনি ঠিক সময়মতো শুধরে যাবেন।কিন্তু না,আয়ান চৌধুরী অন্য ধাচেরই মানুষ।বোনকে ভালো রাখতে গিয়ে হিতাহিত বোধ লোপ পেয়েছে তার।সবটা জানতাম,শুদ্ধ স্যারকেও জানাতাম,তবে এগুলো তার অগোচরেই‌ ছিলো।আজ আপনাকে কিডন্যাপ করতে শুদ্ধ স্যারের কথাতেই এই গ্যাং হায়ার করি আমি।যেটা আয়ান চৌধুরীর জানামতে ভাড়াটে গুন্ডা নয়,শুদ্ধ স্যারের আজ্ঞাবহ,তার পার্ফেক্ট টুয়েল্ভ!

বিস্ময়ে তাকালাম চারপাশে।সত্যিই বারোজন ওনারা।সুন্দরমতো হাসছেন সবাই।শুদ্ধর দিকে তাকাতেই আশ্বাসের হাসি তার।তাচ্ছিল্য হলো আয়ানের উপর।বিয়ের পর শুদ্ধের অতীতকে নিয়ে ঘাটাঘাটি না করে বর্তমানকে যদি খেয়াল করে চলতেন,তাতে নিজেও বদলানোর সুযোগ পেতে পারতেন,তাকেও বুঝতে পারতেন,হয়তো সবটা অন্যরকমই হতো।শুদ্ধ ফোন বের করে কাউকে কল লাগিয়ে বললেন,

-ভেতরে আসুন আপনারা।

কয়েকজন পুলিশ ঢুকলেন ভেতরে।শুদ্ধ বললেন,

-হ্যাকিংয়ের সমস্ত প্রুভস্ গাড়িতে রাখা আছে অশোক।নিয়ে এসে হ্যান্ডওভার করো ওনাদের।আর হ্যাঁ,ছোটমার এক্সিডেন্ট কেইসও থাকবে ওর উপর!

অশোক বেরিয়ে গেলেন।আয়ান তখনো ওভাবেই ছটফট করছেন।শুদ্ধ এতোক্ষনে আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন।আয়ানের চেয়ারের দু হাতলে হাত রেখে ঝুকে দাড়িয়ে বললেন,

-চিন্তা করিস না আয়ান!তোর জেলে যাওয়ার কথা মুনিয়া বা আন্টি কেউই জানবে না।মিস্টার রায়হানের সমস্ত টাকা আমি ফিরিয়ে দেবো তাকে।এই রোবারির কেইস নিয়ে দুনিয়া জানবে না আয়ান।আই উইল মেক শিওর অফ‌ দ্যাট!আন্টি জানবে তুই‌ বিদেশ আছিস।কাজের চাপে একবেলাই শুধু কল রিসিভ করবি তার।তোর গলা নকল করার জন্য আমার পার্ফেক্ট টুয়েল্ভ আছে!মুনিয়ার চিকিৎসারও কমতি থাকবে না।ওর উপর এখনও কোনো রাগ নেই আমার।আশা রাখি সুস্থ্য হলে নিজের ভুল বুঝতে পারবে ও।ওর সাথে আমার বিহেভিয়ার কেমন হবে তা ওর উপরই ডিপেন্ড করে।

আরো নড়াচড়া করতে লাগলেন আয়ান।শুদ্ধর হেরফের নেই কোনো।উঠে এসে আবারো জরিয়ে ধরলেন আমাকে।মুখ বাধা অবস্থাতেই আয়ানকে টানতে টানতে নিয়ে যায় পুলিশ।শেষ অবদি উপযুক্ত জায়গাটাতেই জায়গা হলো তার।চোখ বন্ধ করে মিশে রইলাম শুদ্ধর বুকের মাঝে।অনেকটা সময় পর শুদ্ধ বললেন,

-চল সিয়া,ছোটমা আমাদের দুজনকে দেখবে বলে অস্থির হয়ে আছে।আম্মুও টেনশন করছে!ইমরোজকে দিয়ে কোনোমতে বুঝিয়েছি সবাইকে,তোকে নিয়ে দরকারে বেরিয়েছি আমিই।

আস্তেধীরে মাথা তুললাম।শুদ্ধ যদি সবটা না জানতেন,আজ আরো ভয়ানক কিছু হতে পারতো।এই মানুষটা থেকে দুরে যেতে হতো আমাকে।শুদ্ধ কপালে ঠোট ছুইয়ে হাটার জন্য ইশারা করলেন।পা বাড়াচ্ছিলাম।পাশের টেবিল থেকে একটা কাগজ উড়ে এসে পরলো শুদ্ধর পায়ের কাছে।উনি তা হাতে নিয়ে দেখে বললেন,

-ওহ্!এই রোবারির কাগজ!আচ্ছা?ঠিক কি কি জাল কাগজ দেখিয়ে তোকে ভুল বোঝাতে যাচ্ছিলো আয়ান?আমিও তো দেখি!

শুদ্ধ এগোতে যাচ্ছিলেন কাগজগুলোর দিকে।শক্তকরে জরিয়ে ধরলাম তাকে আবারো।শুদ্ধ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-এখনও ভয় করছে?

মাথা উপরনিচে নাড়লাম।শুদ্ধর পিছন থেকে কোনোমতে এডপশনের পেপার,হসপিটালের রিপোর্টস্ গুলো সরিয়ে ফেলেছি।আমার ভালোবাসায় এর কোনো প্রভাব নেই।আর তার জীবনেও এই সত্যিটার কোনো জায়গা আমি হতে দেবো না।তৃতীয়বার এর মুখোমুখি হয়ে এতোটুকো আঘাত পেতে দেবো না তাকে।উনি আমার দুগাল ধরে বললেন,

-আমার উপর ভরসা ছিলো না?

-নিজের উপর ভরসা হারাচ্ছিলাম শুদ্ধ।

-এতোটা ভিতু তুই?জানতাম না তো!

চোখ বন্ধ করে একটা জোরে শ্বাস নিলাম।পিছনের হাতে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলেছি কাগজগুলো।গালে রাখা তার হাতে হাত আর চোখে চোখ রেখে বললাম,

-আমি আপনাকে ভালোবাসি শুদ্ধ!

শুদ্ধ আটকে গেলেন।চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে তার।এদিক ওদিক তাকিয়ে,দু আঙুলে কপালে স্লাইড করে,জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে অতিকষ্টে সেই জলকনাকে আটকে দিলেন উনি।একটু সময় নিয়ে একটানে আমাকে বুকে জরিয়ে নিলেন শক্তভাবে।বললেন,

-এতোটা সাহসী তুই?আজই জানলাম!

কেদে দিলাম আমি।শুদ্ধর দুফোটা চোখের জলও কাধে পরেছে আমার।মাথা তুলে দেখি চোখে পানি নেই,তবে জনাব নাকচোখ লাল করে ফেলেছেন।তার গালে আলতোভাবে একহাত রেখে বললাম,

-আপনাকে ভালোবাসি শুদ্ধ!ভালোবাসি!অনেকটা!এই অনেকটা কথাটাকে বলে বুঝাতে গেলে সময় তার মতো চলে যাবে শুদ্ধ,অপেক্ষার রোদ্দুরের উত্তাপ রয়ে যাবে,চারপাশ নানারঙে বারংবার রদবদল করতে থাকবে,আমার ভাষায় শব্দ কম পরে যাবে,তবুও আমার এই অনেকটা প্রকাশে কমতি রয়ে যাবে শুদ্ধ!তাই এটুকোতেই গ্রহন করুন এই ভালোবাসাকে।কথা দিচ্ছি,এ ভালোবাসার রোদ্দুর আর কোনোদিন,এক মুহুর্তের জন্যও পোড়াবে না আপনাকে।যেভাবে চাইবেন,সেইরঙে এই রোদ্দুরের আভায় শুধু রাঙাবো আপনাকে আর বর্ননাতীত ভালোবাসাকে।কথা দিচ্ছি শুদ্ধ!কথা দিচ্ছি!

দুগাল ধরে সারা চোখেমুখে পাগলের মতো অজস্রবার ঠোট ছোয়ালেন উনি আমার।মিশিয়ে নিলেন নিজের বুকের মাঝে।চরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করে জাপটে জরিয়ে রইলাম তাকে।কথা রাখবো আমি শুদ্ধ!কোনোদিন এতোটুকো কষ্টের আঁচকে আপনার ধারেকাছে ঘেষতে দেবো না আমি।আপনাকে দুনিয়ার সব সুখ দেওয়ার দায়িত্ব আমি‌ নিলাম শুদ্ধ!ওই‌ দগ্ধ হৃদয়ে সবটা সুখবর্ষনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করলাম আমি!সে সব সুখ আপনি পাবেন,যেগুলো আপনি ডিসার্ভ করেন।কথা দিচ্ছি!

#চলবে…