তোর নামের রোদ্দুর ২ পর্ব-২২+২৩

0
883

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা ‌মাশরেকা
পর্বঃ২২

শুদ্ধ এখনো একধ্যানে নিচদিক তাকিয়ে।এতোক্ষন যাবত তার ওমন পাথর হয়ে দাড়িয়ে থাকা দেখে আমার মনের ভেতরে ওঠা ঝড় বেড়েই চলেছে।অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।আর পারছি না তাকে ওভাবে দেখতে।আর পারছি না তার মৌনতা মানতে।এগিয়ে গিয়ে ধীর গলায় বললাম,

-আ্ আপনি,এখানে,এভাবে….

….

-দ্ দীদুন কৌটোগুলো….

উনি চোখ তুলে তাকালেন আমার দিক।লাল হয়ে গেছে চোখজোড়া।ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আমার।ওমন কেনো দেখাচ্ছে তাকে?কান্না করেছেন?নাকি করতে চলেছেন?শুদ্ধ সোজা হয়ে দাড়িয়ে এগোলেন আমার দিকে।হাতের কোটোদুটো নিয়ে ফ্লোরে রেখে দিলেন নিরবে।শান্ত গলায় বললেন,

-আবারো অপেক্ষা।

….

-আবারো সেই দুরে থাকার যন্ত্রনা।

…..

-আবারো সেই অপেক্ষার রোদ্দুর।

চোখ নামিয়ে নিলাম।আজও তাকে বলার কিছু নেই আমার কাছে।শুদ্ধ বললেন,

-ঠিক কতোবার আর জ্বলবো?কতোবার পুড়বো তোর নামের রোদ্দুরে বলতে পারিস?কতোবার তোর এতোটা কাছে এসেও দুরে সরে যেতে হবে আমাকে?কতোবার সিয়া?কতোবার?

দু হাত মুঠো করে নিলাম।এবার কষ্ট হচ্ছে আমার।বলতে ইচ্ছে করছে,”এসব বলে আমাকে দুর্বল করে দেবেন না প্লিজ শুদ্ধ।তারচেয়ে এটা বলুন না,খুব তাড়াতাড়ি এসে তোকে একদম নিজের করে নিয়ে যাবো সিয়া!”কিন্তু আপনি তো সেই অপেক্ষার রোদ্দুরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন শুদ্ধ।ক্ষতবিক্ষত লাগছে আমার।

শুদ্ধ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আমার ওড়না ধরে মাথায় ঘোমটা তুলে দিলেন।আবারো পিছিয়ে দাড়িয়ে পা থেকে মাথা অবদি দেখে বললেন,

-তোর পিছনের কৃষ্ণচূড়ার সাজ দেখেছিস?রঙটা ফ্যাকাশে লাগছে ওটার।তোর ওড়নাটাই আরো বেশি লাল দেখাচ্ছে।মাথায় ঘোমটা দিয়ে একদম বউ বউ লাগছে তোকে!

এটুক বলে শুদ্ধ আমার ঘাড়ের চুলগুলো মুঠো করে ধরলেন।চোখ বন্ধ করে নিলাম।উনি আমার মাথা ঠেকালেন তার বুকের সাথে।অনেকটা শক্ত করে ধরে রেখেছেন।আর আমি নিজের জামা মুঠো করে ধরে রেখেছি।বেশ কিছুটা সময় পর উনি বললেন,

-কষ্ট হচ্ছে না তোর?

খুব কষ্ট হচ্ছে আমার শুদ্ধ!আপনাকে ছেড়ে থাকতে হবে সেটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে-কথাটা চিৎকার করে বলতে পারলে ভালো লাগতো আমার।শান্তি পেতাম আমি।কিন্তু এখন আমার দুর্বল হওয়া চলবে না।আপনিও তাহলে আরো বেশি কষ্ট পাবেন।আস্তেধীরে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালাম।মুখেও উহুম আওয়াজ করেছি।আলগা হয়ে আসলো শুদ্ধের হাত।আমাকে ছেড়ে উনি পিছিয়ে দাড়ালেন।চোখ তুলে তাকালাম।শুদ্ধ তাচ্ছিল্যে হেসে বললেন,

-এটাই বলার ছিলো তোর?

বিস্ময়ে তাকিয়ে আমি।উনি চোখ সরিয়ে অন্যদিক তাকিয়ে বললেন,

-ভেবেছিলাম তুই বলবি কষ্ট হচ্ছে শুদ্ধ!আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না!প্লিজ যাবেন না আমাকে ছেড়ে!আপনার থেকে দুরে থাকার কথা ভাবতেও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আমার!

-শুদ্ধ আমি….

-ভেবেছিলাম তোর কথাগুলো শুনে আমি কথা দেবো তোকে,আজ এটাই প্রথমবারের মতো,এটাই শেষবারের মতো ছিলো সিয়া।এরপর কোনোদিন আমার থেকে দুরে থাকার কষ্ট পেতে হবে না তোকে।আর কোনোদিন এ কষ্ট পেতে দেবো না তোকে!কোনোদিনও না!

একটু থামলেন শুদ্ধ।আবারো আমারদিক ফিরে দু পা এগিয়ে দুগাল ধরলেন আমার।কপালে কপাল ঠেকিয়ে অসহায়ের মতো বললেন,

-কিন্তু তুই তো উল্টোটাই বললি শ্যামাপাখি।তোর কষ্ট হচ্ছে না।আর আমার?তোকে ছেড়ে আরো কিছুদিন দুরে থাকতে হবে ভেবেই আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।দম বন্ধ লাগছে।মৃত্যুযন্ত্রনা অনুভব হচ্ছে আমার সিয়া!

-শ্….

-বিশ্বাস কর,আজ প্রথমবার তোর কষ্ট হচ্ছে শুনতে পেলে আমি খুশি হতাম সিয়া!বড্ড শান্তি পেতাম!

এটুক বলেই উনি আমার গাল ছেড়ে দরজা খুলে চলে গেলেন ছাদ থেকে।এবার টপটপ করে পানি পরতে লাগলো আমার।আর ধরে রাখতে পারি নি।নিচেই বসে নিরবে কাদতে লাগলাম।বলা কথা আর না বলা কথা!দুটোর ভাজেই আজ শুধু কষ্টটারই বিচরন।শুধুই দুরে সরে যাওয়ার যন্ত্রনা!

_____________

শেহনাজ মন্জিল পুরো শুনশান।কিন্তু তিনটেদিন আগেই সব্বাই মিলে কতো হৈ হুল্লোড়ে মেতে ছিলো এই বাসাতেই।যীনাত আপু,তাপসী আপুরা,সেজোমারা সবাই চলে গেছে।আজ সকালেই সিফাত ভাইয়া,সীমা ভাবি কক্সবাজারের জন্য বেরিয়ে গেছে।চুপচাপ লান্চ সেরে রুমে ঢুকলাম।ইরাম রুমে এসে বললো,

-অনন্যাদের বাসায় যাচ্ছি।এসাইনমেন্ট নিয়ে একটু ঝামেলায় পরেছি।আসতে দেরি হবে।

-আচ্ছা যা!

ও চলে গেলো।টেবিল থেকে ফিজিক্স বইটা নিয়ে বেডে এসে বসলাম।বই খুলতেই শুদ্ধর সেই‌ চিরকুট!যেটা উনি আয়নায় লাগিয়েছিলেন।ওটা দেখে টুপ করে দু ফোটা জল গাল বেয়ে পরলো।লোকটা অনেক নিষ্ঠুর একটা লোক।এতো ভালোবাসি ভালোবাসি করেও যাওয়ার দিন একটাবার তাকান নি পর্যন্ত আমার দিকে।আর এই তিনদিনে?একটা ফোন করেন নি।কোনো খোজ নেননি আমার।আদৌও বেচে আছি কি না!চোখ মুছে ওটা রেখে দিলাম আবারো।আমাকে মনে করে না যে,তাকে মনে করে কেনো কাদবো আমি?

অনেকক্ষন এটা ওটা করায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম।কিন্তু ভালো লাগছে না কিছুই।বেরিয়ে এলাম রুম থেকে।দুর থেকে দেখলাম,শুদ্ধর ঘরটা তালাবন্ধ।গুটিগুটি পায়ে ইমরোজ ভাইয়াদের ঘরের সামনে আসলাম।ইমরোজ ভাইয়া,তামিম ভাইয়া ওরা কেউ নেই বাসায়।ঘরে ঢুকে সারাঘরে চোখ বুলালাম একবার।ওয়াশরুমের দরজায় দিকে তাকাতেই হাসি পেলো।সেদিন ওই দরজাতেই শুদ্ধ সাবান মাখা গায়ে দাড়িয়ে ছিলেন।ফিক করে হেসে দিলাম আমি।বাস্তবতা মনে পরতেই চুপ করে গেলাম আবারো।টেবিলে রাখা হেলান দিয়ে রাখা গিটারটা নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলাম।

রুমে ফিরে এসে ব্যালকনির রেলিংয়ে উঠে গিটারটা কোলে নিয়ে বসলাম। এটা নিয়ে সেদিন গান গেয়েছিলেন শুদ্ধ।তার স্পর্শ এতে লেগে আছে।টুংটাং সুর তুলছিলাম চোখ বন্ধ করে।কান্নাও পাচ্ছিলো।কিন্তু ফোনের শব্দে স্বাভাবিক হলাম।যীনাত আপুর ফোন।তিনদিনে ওর ফোন কতোবার এসেছে তার হিসেব নেই।আলিফ মৌনতাও অনেকবার ফোন করেছে।কলটা রিসিভ করলাম।

-কিরে বুচি?এতো সময় লাগে ফোন রিসিভ করতে?কি করছিলি তুই?

-কিছু না।বলো কি বলবে?

-কি‌ বলবো মানে?কেমন আছিস?

-আধা ঘন্টা আগেই তো বললাম ভালো আছি।আর দিনের মধ্যে ছ বার ভালো আছি বলা হয়ে গেছে।

-আচ্ছা।এবার বল কি করছিলি?

-বসেছিলাম।

-বসে বসে কি করছিলি?

-কিছু না আপু।

-আচ্ছা বলবি না যখন,ফোন রাখছি।

-আরে,কল কেটো না।কথা বলি।

-তাহলে বল কি করছিলি?

-ব্যালকনির রেলিংয়ে তামিম ভাইয়ার গিটারটা নিয়ে বসে আছি।

-ওয়াও!ইনসু গিটার নিয়ে বসেছে।তাহলে এক কাজ কর,একটা গান শুনিয়ে দে!বোর লাগছে!

-আপু আমি গান গাওয়ার জন্য আনি নি গিটারটা।

-তাহলে?

-ক্ কিছু না।ইচ্ছে করছে না গাইতে।

-না।আমি শুনবোই!

-আপু….

-ইনসু!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।জেদ করেছে শুনবে,শুনবেই।ফোনটা পাশে লাউডস্পিকারে রেখে গিটারটায় সুর তুলে গাইতে লাগলাম,

দুরে যে ছিলে,ভালোই তো ছিলে
প্রেমের চিঠি,পুরোনো খামে
আড়াল রাখি,আমি সামলে দু চোখে
লুকিয়ে রাখা,পুরোনো নামে…
দেখা হবে,ভাবি নি আগে
দুর…দুরে বহুদুরে,পথ গেছে সরে
কেনো এলে,তবে ফিরে,
অচেনা এ তীরে,স্মৃতিদের ভীড়ে
হারিয়ে গেছি কবে যে….(ii)

দুরে থেকেও ক্ষনিকের কাছে আসা
অবুঝ সময়,মুহুর্ত অজানা
ও,আগলে গেছি যেটুকো,আছি বেচে
বলবো কি করে,যেটুকো বলার আছে
দেখা হবে ভাবিনি আগে…
দুর,দুরে বহুদুরে……হারিয়ে গেছি কবে যে(ii)

-ওয়াও ওয়াও ওয়াও!

কাদছিলাম আমি।চোখ মুছে গিটারটা ছেড়ে নিচে নামলাম রেলিং থেকে।ফোনটা কানে ধরলাম।যীনাত আপু বললো,

-খুউউউউব সুন্দর ছিলো ইনসু!

….

-এই গানটা কেনো গাইলি তুই ইনসু?

-এ্ এমনি।ভালো লাগছিলো না তাই…

-কেনো?ভালো লাগছে না কেনো?

…..

-বল না!কেনো খারাপ লাগছে?

…..

-শুদ্ধর কথা মনে পরছে তাইনা?

কিছুটা কেপে উঠলাম।সত্যিই তাই।নিজের কাছে অস্বীকার করার কিছুই নেই।তার কথা খুব মনে পরছে আমার।খুব!যীনাত আপু বললো,

-এতো লুকোচুরির কি আছে বলতো?তোর হবু বর ও!দুরে আছিস,কষ্ট তো হবেই।ফোন করে কথা বল!এজ সিম্পল এজ দ্যাট!

কান্নাপ্রায় আওয়াজে বললাম,

-সে কেনো ফোন করলো না আপু?

-পাগল‌ী মেয়ে!তা বলে তুইও ফোন করবি না?এমনিতেও ও ব্যস্ত থাকে সেজোমামার সাথে অফিসে।আর তাছাড়া এমনটাও তো হতে পারে যে ওউ তোর ফোনের জন্য অপেক্ষা করে আছে।ফোন করিসনি,অভিমান করেছে হয়তো!

…..

-এবার এসব বাদ দিয়ে ফোনটা কর বুঝলি?রাখছি আমি!

আপু কেটে দিলো ফোন।কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থেকে কাপাকাপা হাতে ডায়াল করলাম শুদ্ধর নাম্বার।বুকের ভেতর ধুকধুক ধুকধুক করছে।কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে যেনো।দুবার রিং হতেই কলটা রিসিভ হলো।নিশ্বাসের শব্দ কানে আসলো আমার।হৃদয়জুড়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো ওই নিশ্বাসের শব্দে।কিছুক্ষন নিরবতা।চোখ বন্ধ করে ওপাশের মানুষটার সেই নিশ্বাসের শব্দই অনুভব করছি শুধু।

-কিছু বলবি?

চোখ মেললাম।এই স্বর!এ তিনদিনে কতোটা খুজেছি এই গলার আওয়াজটাকে তা নিজেও জানি না।কাপাকাপা গলায় বললাম,

-ক্ কেমন আছেন?

-এইতো।

-কাকু?সেজোমা?ওরা কেমন আছে?

-ওরা ভালোই আছে।ও বাসার সব?

-ভালো আছে।

….

-আমি কেমন আছি তা জানতে চাইবেন না?

-কেমন থাকবি তার আন্দাজ আছে,তাই জিজ্ঞাসা করিনি।

-আপনার আন্দাজ আপনাকে কি জানান দিলো শুদ্ধ?কেমন আছি আমি?

-তিনদিন আগে যেমন দেখে আর শুনে আসলাম।তেমনি।কষ্টে নেই,ভালোই আছিস।

-আমি ভালো নেই শুদ্ধ!

-এক কাজ কর,ফোনটা রেখে কাকু বা ছোটমাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে চলে যা।নয়তো কাকুকে বল বাসায়ই ডক্টর নিয়ে আসতে।

-কেনো এমন করছেন শুদ্ধ?

-ভুলটা কি করলাম?নাকি এটুক উপদেশ দেওয়ার অধিকারও নেই?

এবার শব্দ করে কেদে দিলাম আমি।অনেকক্ষন হলো তার এতো কঠিন কঠিন কথা শুনছিলাম।ঠোট কামড়ে ধরে কান্নার আওয়াজ চেপে রেখেছিলাম।আর পারলাম না।কাদতে কাদতেই‌ বললাম,

-এমন করবেন না প্লিজ শুদ্ধ!আই মিস ইউ!আই মিস ইউ আ লট!

কলটা কেটে গেলো।কান্নার বেগ বাড়লো আমার।আরো কয়েকবার কল করলাম তার ফোনে।উনি রিসিভ করেন নি।ফোন বুকে জরিয়ে এবার চিৎকার করে কাদতে লাগলাম আমি।এর আগে কোনোদিন শুদ্ধের কোনো ব্যবহারে এতোটা কষ্ট হয়নি আমার।তার থেকে এই‌ তিন দিনের দুরুত্ব স্পষ্টভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে,এ দুরুত্ব ঠিক কতোটা জ্বালাচ্ছে আমাকে।অপেক্ষার রোদ্দুর ঠিক কতোটা পোড়াচ্ছে আমাকে।তার এই ইগ্নোরেন্স!খুব কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে তার এই ব্যবহারে মরে যাচ্ছি আমি।বুকের ভেতরটায় কেউ যেনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত হানছে।

বিচ্ছেদের এই যন্ত্রনা!এ যে শুদ্ধর ভাষ্যমতে শুধু ভালোবাসাতেই হয়।একমাত্র ভালোবাসার জন্য অপেক্ষার রোদ্দুরই এভাবে পোড়ায়।ভালোবাসার মানুষটার থেকে পাওয়া একটু অবহেলাতেই যে এতোটা কষ্ট হয়।তবে আর সন্দেহ কোথায়?আমি যে ভালোবাসি আপনাকে শুদ্ধ।ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে।আপনার সিয়া ভালোবাসে আপনাকে।ফোনটা রিসিভ করুন শুদ্ধ!বলতে দিন আমাকে!কাছে ছিলেন,বুঝিনি।দুরে গিয়ে যে অসম্ভব এক যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে আমাকে পরিস্কার করে বুঝিয়ে দিলেন আপনি,আপনাকে ভালোবাসি শুদ্ধ!ভালোবাসি!

#চলবে…

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২৩

-একবার ছাদে আসতে পারবি সিয়া?

শুদ্ধের কথায় শ্বাস যেনো থেমে গেলো আমার।ওয়াশরুমে দু ঘন্টা হলো কান্নাকাটি করে বাজতে থাকা ফোনের কাছে এসে দেখি আটাশটা মিসড্ কল।সবগুলো শুদ্ধের।খুব কষ্টে নিজেকে সামলে কলটা রিসিভ করতেই এমন কথা বলে উঠলেন উনি।ছাদে?ছাদে কেনো যেতে বলছেন আমাকে?তবে কি উনি…মোবাইলটা বিছানায় ফেলে দৌড় লাগালাম ছাদের দিক।ছাদের দরজাটা খোলাই‌ ছিলো।ওখানে যেতেই পা থেমে গেলো আমার।সত্যিই শুদ্ধ এসেছেন!

হালকা নীল রঙের শার্ট গায়ে তার।প্যান্টের পকেটে শুধু দু হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল বাঝিয়ে রেখেছেন।হাতা দুটোই সুন্দরমতো ভাজ দিয়ে গুটানো।কপালের চুলগুলো মৃদ্যু বাতাসে উড়ছে তার।আর ঠোটে সেই মুচকি হাসি।এতোটা পথ এভাবে আসার বিষন্নতা বিন্দুমাত্র নেই চেহারায়।চোখ পানিতে ভরে উঠলো আমার।কোনোমতে এদিক ওদিক তাকিয়ে কান্না সংবরন করলাম।কিন্তু নির্লজ্জ চোখ আবারো তার দিকেই ফিরে গেলো।

আকাশে কালো মেঘ করেছে।সময়টা বিকেল সন্ধ্যের মাঝামাঝি।দুরে কোথাও ক্ষীন শব্দে মেঘ ডাকছেও।শুদ্ধর পেছনে কৃষ্ণচূড়ার গাছটা লাল চাদরের মতো আস্তেধীরে হেলছে দুলছে।এই‌ কিছুটা অন্ধকারচ্ছন্ন আবহাওয়া চোখে পরার মতো শুধু এ দুটোই।কৃষ্ণচুড়ার লাল,আর শুদ্ধর গায়ের হালকা নীল রঙের শার্ট।হেরে গেলো সেই টকটকে লাল রঙটা।আমার চোখ‌জুড়ে সেই নীলের বিচরন।শুধুই শুদ্ধ!

শুদ্ধ এগোলেন আমার দিকে।চোখ নামিয়ে হাত মুঠো করে রইলাম।উনি কিছুটা ঝুকে বললেন,

-চোখমুখের এ কি হাল বানিয়েছিস তুই‌ সিয়া?

….

-শ্যামাপাখি এতোটা কেদেছে?

….

-শুদ্ধের নামের রোদ্দুরের উত্তপ্ততা একটু বেশিই ছিলো বুঝি?

চুপই ছিলাম।উনি আমার দু গাল ধরে বললেন,

-তাহলে ভাব,আমার জন্য গত পাঁচবছর কি ছিলো!

….

-যাওয়ার দিন ইচ্ছে করে তোকে ওভাবে বলেছি সিয়া।যাতে একটু বুঝতে শিখিস তুই আমাকে।এ তিনদিনে তোকে ফোন করি নি ঠিকই,কিন্তু তোর কাছে আলিফ,মৌনতা,যীনাত আপুর আসা প্রতিটি কলে আমি কনফারেন্সে ছিলাম।তোর আওয়াজ শুনতাম চুপচাপ।আজ যখন যীনাত আপুকে গান শোনাচ্ছিলি তুই,তখন আমিও শুনছিলাম।তোর ফোন পেয়ে জানিস না,খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।

…..

-কি বলেছিলি তুই?তুই‌ ভালো নেই?আই মিস ইউ শুদ্ধ?এতোটা কষ্ট পাচ্ছিস বলে কি আমার পাওনা শুধুই আই মিস ইউ শুদ্ধ?এটুকোই?আই লাভ ইউ শুদ্ধ কেনো নয় সিয়া?তোর মুখে আই মিস ইউ শুনে তখন তখনই বেরিয়ে এসেছি বাসা থেকে।জানিস?ভয়ও করছিলো আমার।যদি তখন আই লাভ ইউ শুদ্ধ বলে দিতি তুই?আমার তো আলাদীনের প্রদীপে থাকা জ্বীনির মতো তোর সামনে উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছে হতো।কিভাবে সম্ভব হতো বল তো সিয়া?এই মিস আর লাভ!দুটো শব্দের ব্যবধানে একেকবার একেকভাবে আত্মহারা হতাম আমি!

….

-ভালো হয়েছে ফোনে বলিস নি।শ্যামাপাখি?এবার তো বল!ভালোবাসিস আমাকে!এবার তো বল?এ তিনদিনে শুদ্ধের নামের অপেক্ষার রোদ্দুর তোকে বুঝিয়ে দিয়েছে,তুই আমাকে ভালোবাসিস!আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবি না!এবার তো বল সিয়া?এবার তো বল?একটাবার বল?ভালোবাসি!একটাবার?

প্রচন্ড জোরে মেঘ ডেকে উঠলো।বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে।এতোক্ষন আটকে রাখা চোখের পানি বেরিয়ে আসলো আমার।ভালো হয়েছে।এই অশ্রু চোখে পরবে না শুদ্ধর।শুদ্ধ আমার গাল ছেড়ে হাত ধরে বললেন,

-এই বৃষ্টিকেও এখনই আসতে হতো!ধ্যাৎ!চল সিয়া!বাসার ভেতরে চল!জ্বর হবে তোর!

উনি হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন আমাকে।ওভাবেই দাড়িয়ে রইলাম।এই বৃষ্টি ছেড়ে গেলে আমার চোখের জল চোখে পরবে তার।যাবো না।নিজেকে শক্ত রেখে চোখ বন্ধ করে বললাম,

-বিয়েটা হচ্ছে না শুদ্ধ!

কোনো সাড়াশব্দ নেই।হাতও ছাড়েন নি উনি আমার।চোখ মেলে দেখি শুদ্ধ কপাল কুচকে তাকিয়ে আছেন।বৃষ্টির বেগ বেড়েছে।আমার চোখের পানিও পরতে শুরু করেছে আরো বেশি।শুদ্ধ ব্যস্ততা দেখিয়ে বললেন,

-আবোলতাবোল পরে বকিস।চল ভেতরে।জ্বর হবে এভাবে ভিজলে।

উনি আবারো হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন আমাকে।মানে আমার কথা বিশ্বাস করেন নি উনি।আমি থেমে গিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে‌ নিলাম।একটা ঢোক গিলে আবারো বললাম,

-বিয়েটা সত্যিই হচ্ছে না শুদ্ধ!

বাজ পরেছে।আতকে উঠে জাপটে জরিয়ে ধরলাম শুদ্ধকে।মুখ গুজেছি তার বুকে।খামচে ধরেছি শার্টটা।এবার কেদে দিলাম শব্দ করে।ওই বুকটায় মাথা গুজে কান্নার আশ্রয় পেয়েছিলাম যেনো।শুদ্ধ হাত ছেড়ে একহাতে আমাকে জরিয়ে ধরে আরেকহাতে চুল মুঠো করে নিলেন আমার।হুশ ফিরতেই তার কাছ থেকে পিছিয়ে গেলাম আমি।উনি হাত মুঠো করে শান্তভাবেই বললেন,

-কেনো?

এই কেনো?এটার উত্তর যে আমার কাছেও‌ নেই শুদ্ধ।কিন্তু এই একটা কথায় আমার জীবনটায় ঝড় বয়ে চলেছে।সবটা শেষ হতে বসেছে।আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।আপনাকেও শেষ করে দিতে উদ্যত হয়েছি।আর পারছি না।আর সহ্য হচ্ছে না আমার।সবশেষে‌ ওই একটাই প্রশ্ন।সবটাই তো ঠিক ছিলো।তবে কেনো এমনটা হলো?কেনো?

.
শুদ্ধ ফোন কেটে দেওয়ার পর চিৎকার করে কাদছিলাম আমি।কষ্ট হচ্ছিলো তার ফোন রিসিভ না করায়।হঠাৎই দরজায় নক পরতেই চোখমুখ মুছে নিলাম।ইরাম এতো তাড়াতাড়ি আসবে না।তবে কে?নিজেকে সামলে দরজা খুললাম।আব্বু এসেছেন।অসময়ে তার আগমন দেখে বিস্মিত হলেও প্রকাশ না করে ঠোটে হাসি টেনে বললাম,

-আ্ আব্বু আপনি?আসুন না ভেতরে?

উনি গম্ভীরভাবে ভেতরে ঢুকলেন।অন্যদিক ঘুরে বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষন।কোনো কথা বলছেন না দেখে আমিই তার সামনে দাড়িয়ে বললাম,

-কিছু বলবেন?

আব্বু করুনভাবে আমার দিক তাকালেন।তার চেহারায় অসহায়তা।আমি তখনও হাসিমুখে তারদিক তাকিয়ে।উনি পরপরই নিজের চেহারায় রুঢ়তা এনে শক্তভাবে বললেন,

-আমি চাইনা শুদ্ধর সাথে তোমার বিয়েটা হোক ইনসিয়া!

হুট করে কথাটা কর্নগোচর হতেই পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো আমার।আব্বুর চেহারা পরতে পারি আমি।উনি বরাবরই সোজাসাপ্টা কথা বলেন।এই কথাতেও যে তার দ্বিমত ছাড়া অন্য কোনোরকম কিছু মিশানো ছিলো না তা পুরোপুরিভাবে টের পাচ্ছি আমি।আব্বু বললেন,

-জানি,একেকবার একেকভাবে তোমার উপর ডিসিশন চাপিয়ে দিয়েছি সবাই মিলে।অনেক বড় অন্যায় করেছি।কিন্তু সত্যিটা এটাই,যতো যাই কিছু হয়ে যাক,আমি চাইনা তোমার জীবন শুদ্ধের সাথে জরিয়ে যাক।

হাত পা জমে গেছে আমার।সবটা ঝাপসা হয়ে আসছে।শুনতে পাচ্ছি,তবে কোনো কথাই মাথায় ঢুকছে না।চারপাশটা যেনো থমকে আছে।আব্বু আবারো বললেন,

-দুবছর আগে মৃত্যুশায়ী বাবাকে মানা করতে পারি নি।তাই সেদিন শুদ্ধ আংটি পরিয়েছিলো তোমাকে।সেদিন একটা উৎসবমুখর পরিবেশে মা আর বাসার সবার হাসিমুখ দেখে কিছু বলতে পারি নি।চুপচাপ মেনে নিয়েছি সবটা।একটু সময় চেয়েছিলাম।তাই একথা সেকথায় সবাইকে স্বাভাবিক রেখেছি।এখন যখন সুযোগটা পেয়েছি,শুধুশুধু সবাইকে তোমাদের বিয়েটা নিয়ে কোনো মনোভ্রমে রাখতে চাইছি না আমি।তোমাদের বিয়েটা হচ্ছে না ইনসিয়া।সবটা আগের মতো হয়ে যাবে।শুদ্ধর ভুমিকা তোমার লাইফে ঠিক কি তা আরেকবার ভুলে যাও তুমি।বিষয়টা আগে তোমাকেই জানালাম,যাতে তোমার মানতে সুবিধা হয়।সেজোভাইয়ের সাথে কালই কথা বলবো আমি।তোমার দীদুন বা ফ্যামিলির অন্য সবাইকে নিয়েও ভাবতে হবে না তোমার।

….

-আমি সবসময় তোমার ভালো চেয়েছি ইনসিয়া।ভবিষ্যতেও চাইবো।তাই এসব ছেলেখেলা বিয়ে,শুদ্ধ কোনো কিছুকেই তোমার লাইফকে ইফেক্ট করতে দেবো না।এতেই তোমার ভালো।আমি এটাও জানি,আগেরবারের মতো আমার সিদ্ধান্তকে এবারও মেনে নেবে তুমি।এতোটা চিনি তোমাকে।

নিজের মতো বলে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন আব্বু।আমার সবটা ভেঙেচুরে দিয়ে।সহ্য হলো না।একছুটে গিয়ে পথ আগলে দাড়ালাম তার।প্রথমবার।প্রথমবারের মতো প্রশ্ন ছুড়ে দেবো তাকে।ছলছল চোখে তবে শক্তভাবে বললাম,

-কেনো আব্বু?

আব্বু কিছুটা অবাক হয়েছেন।স্বাভাবিক।আমাদের মাঝে কোনোদিন কেনো কথাটা ছিলো না।বরাবরই কোনো কেনো ছাড়াই তার মতামতকে সম্মান দেখিয়ে এসেছি আমি।আজ ব্যতিক্রম হওয়াটা তার জন্য বিস্ময়ের বিষয়ই বটে।উনি নিজেকে সামলে বললেন,

-সবটাই তোমার ভালোর জন্য।তোমার পাশে শুদ্ধকে মানতে পারবো না আমি।

-কেনো?

-আজ অবদি তো কেনো জিজ্ঞাসা করো নি।তবে আজ কি হলো তোমার?

-আব্বু আমি….

-আমি তো জানতাম তুমি বোঝো তোমার খারাপের জন্য কিছু করবো না আমি।তবে কি আমি ভুল ছিলাম ইনসিয়া?

-আমি এখনো বিশ্বাস করি,আপনি সবটা আমার ভালোর জন্যই‌ করবেন।কিন্তু আজ…

-তোমাকে শুদ্ধ আর আমার মধ্যে যেকোনো একজনকে চুজ করতে হবে ইনসিয়া!

দ্বিতীয়বারের মতো নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগলো সমস্ত ইন্দ্রিয়।শরীর নিজের ভর ছেড়ে দিচ্ছে যেনো।আব্বু আবারো বললেন,

-ওকে দেন।আজ তোমার কথাই শেষ কথা।যেটা তুমি চাও।আমি?নাকি শুদ্ধ?যদি উত্তর শুদ্ধ হয় তবে আজ থেকে জানবে তোমার আব্বু ম্….

-আপনি যা বলবেন তাই হবে আব্বু!

চোখ বন্ধ করে চেচিয়ে বলে দিলাম কথাটা।কান্না করছি জোরে জোরে।আব্বু আমাকে বুকে জরিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-কাদিস না মা!দেখবি,একদিন তুই ঠিক বুঝবি,তোর আব্বু কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি তোর জন্য।শুদ্ধ তোর জন্য নয়।একদিন ঠিক বুঝতে পারবি তুই‌ এটা।ঠিক বুঝতে পারবি!

কথাগুলো বলে আব্বু নিজেও চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।মেঝেতে বসে পরলাম আমি।সব শেষ হয়ে গেলো।সব!সবে বুঝতে শেখা ভালোবাসাটা ভালোবাসার মানুষটাকে বলতে পারলাম না।তা এখন ভুলতে হবে আমাকে।শুদ্ধ কি করবেন যখন এমনটা শুনবেন?পাগল হয়ে যাবেন উনি!আব্বুই বা এমন কেনো করলেন?কি দোষ শুদ্ধের?কেনো তাকে আমার পাশে মানতে পারবেন না উনি?কেনো?কে দেবে এই কেনোর উত্তর?

.
কেনোর উত্তর দিতে পারবো না আপনাকে শুদ্ধ।চোখ বন্ধ করে জামা খামচে ধরে শুধু কাদছি।বৃষ্টিতে চোখে পরবে না সে অশ্রু কারো।ভালোবাসি বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেও তাকে বলতে হলো বিয়েটা হচ্ছে না।শুদ্ধকে শুনতে হলো এই কথাটা!নিজেরটুকো ভুলে গেছি আমি।শুধু শুদ্ধের কথা ভাবতেই দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে ভেতরটা।এসব যে কখনোই তার প্রাপ্য নয়!সে মানুষটার ভালোবাসা যে তার মতোই বিশাল!বিশুদ্ধ!

শুদ্ধের ভেতরটাতে হওয়া তোলপাড় অনুভব করতে পারছি আমি।সে মানুষটা যে একবুক আশা আর ভালোবাসা নিয়ে ছুটে এসেছিলো শুধু আমার মুখ থেকে ভালোবাসি শুনবে বলে।হতোও তো তাই!কিন্তু হলো না। উলোটপালোট হয়ে গেলো সবটা।চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি শুদ্ধ ওভাবেই তার কেনোর উত্তরের জন্য আগ্রহ নিয়ে দাড়িয়ে।

আমার চাওনি দেখেই শুদ্ধর চাওনিরও বদল ঘটলো।খানিকটা টালমাটাল হয়ে দু পা পিছিয়ে গেলেন।একহাতে তার মাথার ভেজা চুলগুলো উল্টে অসহায়ের মতো আশেপাশে তাকালেন উনি।বৃষ্টিতে ভিজে ওই লাল হয়ে যাওয়া চোখদুটো চরম অবিশ্বাস জানান দিচ্ছে।এমনটা হতে পারে না।চোখদুটোর ভাষায় এ কথাটাই খুজে পাচ্ছি আমি।ফুপিয়ে কেদে উঠলাম।ভালোবাসি তাকে।কি করে সহ্য করবো তার কষ্টটা?আমার মতো তার সামনেও যে ধুলিসাৎ হয়ে গেলো সবটা।সবটাই!

#চলবে….

[ভুলত্রুটি মার্জনীয় 🙂]