তোর নেশায় মত্ত পর্ব-০৩

0
1417

#তোর_নেশায়_মত্ত
#লেখনীতে – আবরার আহমেদ শুভ্র
পর্ব- ০৩

শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক! সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলোছায়ার খেলা দিনভর- এইসব মিলেই তো শরৎ। শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় অসাধারণ! জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে তখন আমরা বুঝতে পারি শরৎ এসেছে। শরতের আগমন সত্যিই মধুর। ঝকঝকে কাচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশ আর তার মধ্যে পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘমালা- এসব নিয়েই প্রকৃতি বরণ করে নেয় শরৎকালকে। কাশফুলের রাশি অপরূপ শোভা ছড়ায়। কাশফুলের এ অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করেনি এমন মানুষ খুঁজে মেলা ভার। গাছে গাছে শিউলির মন ভোলানো সুবাসে অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। শরতের মেঘহীন আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুলের মতো সাদা মেঘের ভেলা কেড়ে নেয় মন। শরৎকালেও বর্ষণ হয়, তবে বর্ষার মতো অবিরাম নয়! বরং শরতের বৃষ্টি মনে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা যেন আনন্দ-বারি! বৃষ্টি শেষে আবারও রোদ। দিগন্তজুড়ে সাতরঙা হাসি দিয়ে ফুটে ওঠে রংধনু। প্রকৃতির এ অপরূপ যেন প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য চায়। হয়তো ইচ্ছা হয় গোধূলির ওপারে হারিয়ে যেতে প্রিয়জনের হাতটি ধরে!

ছাদে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আদ্র। প্রকৃতির পানে চেয়ে আছে মুগ্ধ নয়নে। শরতের মেঘহীন আকাশের দিয়ে তাকিয়ে আছে এক মনেই! কিছু দূরে সারি সারি মেঘের ছোট্ট ভেলা দেখা যাচ্ছে। এমনই এক গোধূলিতে হারিয়ে যেতে চায় আদ্র তার মিহুপাখিকে নিয়ে! তার প্রিয়সির হাত ধরে!

আদ্রের মনটা আজ বেশ খুশি, কারণ, তার মা নিজেই বলেছে সে মিহিয়াকে নিজের পুত্রবধু হিসেবে দেখতে চায়। যে মানুষটি প্রেম ভালোবাসাকে এতোটাই ঘৃণা করতো যে নিজ মেয়েকে পর্যন্ত মেনে নেন নি, আজ সেই মানুষটাই বলছে সে তার ছেলের পছন্দের মানুষকেই পুত্রবধূ হিসেবে চাইছে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কি আছে আদ্রের জন্য! এখন শুধু মিহিয়ার রাজি হওয়ার পালা। তাহলেই সে একেবারে তাকে আপন করে নিবে।

আদ্র কথাগুলো আনমনে ভাবতেই তার ফোনে কল এলো। আচমকা এমন হওয়াতে সে একটু বিরক্ত হলো। তবে স্ক্রিনে থাকা নামটা দেখে তার হুশ উড়ে যাওয়ার উপক্রম। যে মানুষের পিছনে ঘুড়তে ঘুড়তে সে আজ ক্লান্ত প্রায় আজ সেই মানুষটাই তাকে ফোন করেছে। ঠোঁটের সেই কিঞ্চিৎ পরিমাণ হাসিটা আরও গাঢ় হলো। খুশি মনে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ফুঁফিয়ে কান্নার আওয়াজ এলো,

-আ্ আ্ আদ্র ভাইয়া! মি্ মিহু…

আচমকা ছায়ার কান্না কণ্ঠে মিহুর কথা শোনে আদ্রের বুকের ধুঁপধুঁপানি শুরু হয়ে গেলো। কোনোকিছু হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে ঘিরে ধরল! কেমন অস্থির অস্থির লাগছে তার! ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। সে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল ছায়াকে ,,

-কি হয়েছে মিহুপাখির? ছায়া প্লীজ আন্সার মি!

-মি্ মিহুকে ও্ ওর ছোটমা প্রচণ্ড পরিমাণে মেরেছে যে মারা চোটে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তার সাথেই বাড়ীর থেকে বের করে দিয়েছে।

-ওয়াট! কখন হয়েছে এসব? এখন কোথায় আমার মিহুপাখি? আর তুমিই বা কোথায়?

-আপনি প্লীজ এখানে হসপিটালে চলে আসুন, আপনাকে ম্যাসেজে এড্রেস দিয়ে দিচ্ছি।

-ওকে, আ’ম কামইিং ইন টেন মিনিটস্।

আদ্র গাড়ী নিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে গেলো ছায়ার দেয়া ঠিকানায়। দশ মিনিটের কম সময়ে সেখানে উপস্থিত হলো। ভেতরে ঢুকে দেখতে পেলো ছায়া বারান্দায় বসে আছে। আদ্র সেদিকে এগিয়ে গিয়ে ছায়ার কাধে হাত রাখলো।

হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে তাকেতেই আদ্রকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আদ্র অস্থির হয়ে ছায়াকে জিজ্ঞেস করলো,

-ছায়া আমার মিহুপাখি কেমন আছে এখন? ডাক্তার কি বলেছেন? ঠিক হয়ে যাবে তো!

আদ্রের অস্থিরতা দেখে ছায়া মুচকি হেসে,

-ভাইয়া রিল্যাক্স! মিহু আলহামদুলিল্লাহ্‌ এখন ভালো আছে। তবে মাথায় আঘাত পাওয়াতেই সেন্সলেস হয়ে গেছিলো।

-থ্যাংকস্ গড, আমার তো প্রাণ বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম! যায়হোক, ও এখন কোথায়?

-কেবিনে শিফন করবে এখন মেইবি।

তাদের কথার মাঝে ডাক্তার এসে উপস্থিত হলো। আদ্র ডাক্তারের দিকে পিঠ করে দাঁড়ানোতে তাকে খেয়াল করে নি ডাক্তার। তিনি তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,

-মিস মিহিয়ার গার্জিয়ান কি আপনারা?

এবার ডাক্তারের দিকে ফিরে আদ্র জবাব দিলো,

-ওনি মিস মিহিয়া নয় ডাক্তার সাহেব, মিসেস মিহিয়া সার্ফারাজ। মাই ওয়াইফ! আর হা, আমরাই ওর বাড়ীর লোক। এখন কেমন আছে আমার ওয়াইফ?

আদ্রের কথায় বেশ অবাক হলো ছায়া। তার চেয়ে বেশি অবাক হলেন ডাক্তার। তবে ডাক্তার সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা হেসে বললেন,

-আলহামদুলিল্লাহ্‌, সি নাউ আউট অফ ডেঞ্জারাস!

-ওহহ, থ্যাংকস!

-দ্যাটস্ ফাইন মিস্টার আদ্র! যায়হোক, ওনাকে এখন কেবিনে শিফট করা হবে।

-ওকে।

-ইট’স মাই প্লেজার! তবে স্ত্রীর প্রতি খেয়াল রাখবেন।

আদ্র ডাক্তারের উদ্দেশ্যে মুচকি হেসে জবাব দিলো,

-ইয়াহ সিউর!
______________

পিটপিট করে চোখ খুলতেই নিজেকে একটা আবদ্ধ ঘরে আবিষ্কার করলো মিহিয়া। ধীরেধীরে উঠে বসল সে। তাকিয়ে দেখল চারদিকটা। ঘরটা বেশ বড় বললেই চলে। বেশ সুন্দর আর গোছালো রুমটা। কিন্তু ও এখানে কেন বুঝতে পারছে না। ওতো বাসায় না না, ওকে তো ওর ছোটমা মেরেছিলো। যার কারণে সে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল। তাহলে! এটা তো তাদের বাড়ীর কোনো রুম নয়। ছায়াদের! কিন্তু ছায়াদের বাড়ীর প্রত্যেকটা কোনা সে চিনে! তাহলে কার বাড়ী? সে এলোই বা কেমনে?

হঠাৎ ওয়াশরুমের দড়জা খুলতেই চমকে উঠলো মিহিয়া।
মিহিয়াকে চমকে দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে এলো আদ্র। আদ্রকে এমনাবস্থায় রুমে দেখে ভয় পেয়ে গেলো মিহিয়া। ভয় পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল। দুই হাটুর মাঝে মাথা দিয়ে ফুঁফিয়ে কান্না করে দিলো সে!

আদ্রের এতক্ষণ খেয়ালই ছিলো না তার রুমে আরেকজন মানুষের অস্থিত্ব বিরাজ করছে। কারো ফুঁফিয়ে কান্নার আওয়াজে ফিছনে ফিরতেই মিহিয়াকে দেখে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলল। কিন্তু বুঝতে পারলো না সে কেন কান্না করছে! দ্রুত কাবার্ড থেকে কাপড় নিয়ে চেন্জ করে নিলো।
আদ্রের ডাকে মাথা উঁচু করে তাকালো মিহিয়া। তার চোখে স্পষ্ট ভয়ের আভা ফুটে উঠেছে। মিহিয়ার কাছে গিয়ে দুগালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-মিহুপাখি! কেমন লাগছে এখন?

-আ্ আ্ আমি এ্ এ্ এখানে ক্ কেন? প্লীজ আ্ আ্ আমায় যেতে দিন। ফুঁফিয়ে কান্না করতে করতে বলল মিহিয়া।

-বেশ! যাবে, তবে সুস্থ হও।

-না আ্ আমি এ্ এখন যাবো!

-এতো কথা বলো কেন তুমি?

আদ্রের ধমকে চুপসে গেলো মিহিয়া। আদ্র এবার গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-মিহু, সেদিন কি হয়েছিল? আই মিন, তোমার এমন অবস্থা কে করেছিল?

আদ্রের গম্ভীরতা মিহিয়ার মনে ভয় ধরিয়ে দিলো। এমনিতেই কিছুক্ষণ আগের ধমকে চুপসে গিয়েছিল। না জানে এখন যদি উত্তর না দেয় তাহলে…

মিহিয়ার ভাবনার মাঝে আদ্র রেগে বলে উঠল,,

-এই মেয়ে কথা কানে যায় না? কি হয়েছিল বললাম সেদিন? সবটাই বলবা, মানে সবটাই!

মিহিয়া এবার চোখ ছোট করে রেগে বলে উঠল,

-এই মিস্টার তিতকরলা! কথায় কথায় এতো ধমক দেন কেন? বলছি এবার শোনুন.. তারপর সব ঘঠনায় বলল। প্রতিটা সেকেন্ডের হিসব দিলো আদ্রকে।

মিহিয়ার কথাগুলো শোনে আদ্র রাগে বোম হয়ে গেলো। যেন এখনই ব্লাস্ট হবে। সে হাতযুগল মুষ্টিবদ্ধ করেও নিজেকে দমাতে পারছে না। তার প্রিয়তমর সাথে করা অন্যায় সে কখনও মেনে নেবে না। এর প্রতিশোধ সে নিবেই। মিহিয়ার কথা শেষ হতেই একজন সার্ভেন্ট খাবার নিয়ে দড়জায় নক করলো।

-‘কাম ইন।’ শান্ত কণ্ঠে আসার অনুমতি দিলো আদ্র।

সার্ভেন্ট খাবারগুলো রেখে চলে গেলো। রাগটাকে সে অনেক কষ্টে দমিয়ে নিজেকে শান্ত করে মিহিয়ার সামনে প্রেজেন্ট করছে। তাকে বুঝতে দেয়া যাবে না সে যে তার প্রতি করা প্রতিটা অন্যায়ের জবাব দিবে। তাই সে শান্ত হয়ে
হাত ধুয়ে এসে বাবু হয়ে বসলো মিহিয়ার সামনে। মিহিয়ার মুখের সামনে এক লোকমা তুলে তাকালো ওর দিকে,,

-নাও, হা করো।

মিহিয়া নাকমুখ কুঁচকে জবাব দিলো,,

-খাবো না।

-নো মোর ওয়ার্ডস! চুপচাপ হা করো নাহলে জোড় করে খাওয়াবো।

আদ্রের কথায় মিহিয়ার মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেলো আদ্র সুবিধামতো লোকমাটা মিহিয়ার মুখে চালান করে দিলো। এভাবে একে একে সবগুলো মিহিয়াকে খাইয়ে সে প্লেট নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিল। কি মনে করে পিছনে ফিরে তাকালো মিহিয়ার দিকে। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,,

-চুপচাপ শোয়ে থাকো। আমি এখনই আসছি।… বলে বেড়িয়ে গেলো আদ্র।

এতক্ষণ আদ্রের সামনে কিছু বলতে না পারলেও এখন বসে বসে আদ্রের চৌদ্দবংশ উদ্ধার করতে লাগল মিহিয়া।
____________

রাত ১২:৩৭ মিনিট। এসময় তেমন কেউই ফোন দেয় না মাহবুব আলমকে। কিন্তু আজ ফোন পেয়ে বেশ অবাক হলেন তিনি। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা অপরিচিত গম্ভীর নারীকণ্ঠস্বর ভেসে এলো মাহবুব আলমের কানে। আর সেটা হলো,

-কাজটা ভালো করলে না মাহবুব! এর প্রতিটার ফল তুমি ভোগ করবে। (অপরিচিতা)

-কে আপনি?.. ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো মাহবুব আলম

-সময় হলেই জানতে পারবে। সি ইউ সোন।.. বলেই কল কেটে দিলো মহিলাটি।

মাহবুব আলম বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু সে জানলো কেমন করে? আর তাকে তো সে নিজ হাতেই! কিছুই মেলাতে পারছে না মাহবুব আলম। তবে মিহিয়ার জন্য তার বেশ খারাপ লাগছে। আপন সন্তান বলে কথা। তবুও তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে শোয়ে পড়লো সে। আপাতত এসব ভাবতে চাইনা সে।

#চলবে