তোর নেশায় মত্ত পর্ব-০৪

0
1239

#তোর_নেশায়_মত্ত
#লেখনীতে- আবরার আহমেদ শুভ্র
পর্ব- ০৪

সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে শরৎ বিদায় নিয়েছে সদ্যই। হেমন্তের শিশির বিন্দুতে সাদা কাশফুলের রঙও এখন ধূসর প্রায়। শীতের আগমনী বার্তায় ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে ভোরের সোনারাঙা রোদ। বিকেল পাঁচটা না বাজতেই পশ্চিমে ঢলে পড়ছে সূর্য। গোধূলী লগ্ন পেরিয়ে জলদিই নেমে আসছে সন্ধ্যা। ভোরের আলো ফুটতেই স্নিগ্ধ শিশিরে ভেজা সবুজ ধানের পাতাগুলো নুয়ে পড়ছে বাতাসে। সাতসকালে বয়ে আসা হিমেল হাওয়ায় টের পাওয়া যাচ্ছে, ধীর পায়ে শীত নামছে প্রকৃতিতে। আর শিশির ভেজা ভোর যেনো জানান দিলো ধীর পায়ে শীত আসছে! ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রকৃতিতে আজ ভর করেছে ঘন কুয়াশা। চারিদিকে তাই আজ সূর্যের আভা ছড়াইনি। নেমে এসেছে শীতের আমেজ!

শীতের সকালে বাগানে খালি পায়ে শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর মনে হাটছে মিহিয়া। অনেকদিন পর এমন সুযোগ পেয়ে খুবই খুশি সে। শীতের জানান দিতেই কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারদিকটা! ঔ বাড়ীতে থাকাকালীন সময়ে শুধু অত্যাচারের কারণে একটুকু শান্তিতেও থাকতে পারে নি সে। সেখানে শিশির ভেজা সকাল তো দূরে থাক! আজ এই মিষ্টিময় মুহুর্তে মিহিয়ার সাথে আছে শাহানা ইয়াসমিন। আদ্রের মা! ওনি একেবারেই চলে এসেছিলেন সেদিনই, যেদিন মিহিয়া এসেছিলো ‘সালসাবিল মঞ্জিল’ -এ! সেদিনের পর থেকেই মিহিয়াকে নিজের মেয়ের মতোন আগলে রেখেছেন শাহানা ইয়াসমিন। হঠাৎ আজ সকালবেলা মিহিয়া আবদার করে বসল সে নাকি বাগানে হাটবে তাও খালি পায়ে! তিনি কি আর ফেলতে পারেন তার মেয়ের কথা! তিনিও সায় দিলেন মিহিয়ার কথায়। দুজন একসাথে হাটবে শিশিরভেজা সকালে! তাই তো আজ সকাল সকাল বেড়িয়ে বাড়ীর বাগানটাতে হাটছেন মিহিকে নিয়ে। মিহি বাচ্চামো গুলো, খিলখিলিয়ে হাসি সব মিলিয়ে একটা ভালোলাগার মুহুর্ত গড়ে তুলছে আদ্রের মায়ের জন্য।

-আন্টি, আজ সকালটা বেশ ফুরফুরে। তাই না?

-হুম রে মা। জানিস, তোর আংকেলের সাথে কতোই না সময় কাটিয়েছি এমন। বেশ রোমাঞ্চনীয় ছিল।

-তাই! তো আজ কেমন লাগছে?

-তোমার সাথেই বেশ লাগছে।

-আমারও আজ প্রথম শীতের সকাল তোমার সাথে খুব ভালো লাগছে। এভাবে কথা বলছে দুজন আর আশেপাশে ঘুরছে।

মিহিয়াকে নিজের পুত্রবধূ করার আরও একটা মোক্ষম সুযোগ নিলেন তিনি। এর হয়তো একটা কারণ আছে! যেটা সকলের অজানা! সবকিছু সঠিক হলে শাহানা ইয়াসমিন এর মোক্ষম চালটাই চালবেন! হঠাৎ আদ্রকে একধ্যানে মিহিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসলেন শাহানা ইয়াসমিন। নিজেই সেখান থেকে সরে এলেন। সুযোগ করে দিলেন আদ্রকে! আদ্রও বুঝতে পেরে সেই সুযোগে মিহিয়ার ঠিক পিছনে চলে এলো।

অনেক্ষণ ধরে শাহানা ইয়াসমিনের উপস্থিতি না পেয়ে পেছনে ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলো মিহিয়া। কারণ তার ঠিক পিছনে আদ্র দু’হাত গুঁজে দাড়িয়ে আছে। মুখে মুচকি হাসি! যেটা যেকোনো মেয়েকেই গায়েল করতে যথেষ্ট! আর সেটাই এখন মিহিয়ার একমাত্র ভয়ের কারণ! আদ্র ঘোর লাগা দৃষ্টিতে মিহিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে, মিহিয়াও তাকিয়ে আছে তার চোখের দিকে। কতোটা গভীর তার দুচোখ! সরু চ্যাপ্টা নাক! দু’ঠোঁটের ঠিক নিচে লালছে একটা তিল। সিল্কি চুল! যা ছেলেদের থাকতে নেই! সবমিলিয়ে একদম পারফেক্ট! মিহিয়া কখনও এতোটা সামনে থেকে কোনো পুরুষ মানুষের দিকে তাকায় নি যতোটা আজ আদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।

-শ্যামাপাখি! আর কতো ভাবো আমায় খুন করবে তুমি!

হঠাৎ আদ্রের এহেন কথায় অবাক না হয়ে পারলো না মিহিয়া। মুখ দিয়ে আপনাআপনি বের হয়ে এলো,

-মানেহ্?

-মানে হলো তুমি এমন চুল ছেড়ে দিলে কেন? জানো এই রূপে বারবার খুন হয় আমি! যতোবারই তুমি এই রূপে আমার সামনে আসো ততোবারই আমি নিজেকে সামলাতে পারি না যে? বারবার ইচ্ছে করে তোমার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিই!

-ইশশ! শখ কতো? আপনি কেন আমার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিবেন হুহ!… এবার আদ্রের কথায় মুখ ভেংচি দিয়প জবাব দিলো মিহি।

-ভালোবাসি তাই!

– কিন্তু আমি তে বাসি না!…. বলেই হঠাৎ সে লজ্জামাখা মুচকি হাসি দিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে চলে গেলো। আদ্র বোকার মতোন মিহিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণপর নিজেই নিজের মাথায় ছাপড় দিলো।

-আজও বোকা বানালো মিহুপাখি আমায়! উফ মেয়েটা নির্ঘাত খুন করবে আমায়!

আবারও একই কায়দায় মিহু তাকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বোকা বানিয়ে চলে গেছে। এমন করে গতো ২মাস যাবৎ যতোবারই আদ্র তার কাছে আসতে চাই ততোবারই সে তাকে বোকা বানিয়ে চলে যায়। হাঁ, সেদিনের পর থেকে এখন মিহিয়া আদ্রের বাসায় থাকে।
______________

রুমে এসে বুকে হাত দিয়ে হাপাচ্ছে সে। যতোবারই আদ্র তার মুখোমুখি কিংবা সামনে যায় ততোবারই তার হার্টবীট এতোটা ফার্স্ট চলে যে সে হার্টঅ্যাটাক করার উপক্রম।

-উফ, আরেকটুর জন্যই! নির্ঘাত আজ শেষ দিন ছিলো আমার জন্য। এই মানুষটাই না!

বলে কাভার্ড থেকে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো শাওয়ার নিতে। আজ ভার্সিটি যাবে। তাও দু’মাস পর! আদ্রের টোটালি নিষেধ ছিলো, কিন্তু মিহিয়ার জোড়াজুড়িতেই সম্মতি দিলো। তবে রিকশায় যাওয়া যাবে না।

টানা আধঘণ্টা পর শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো মিহিয়া। এখন সোজা শাহানা ইয়াসমিনের রুমে যাবে তারপর ব্রেকফাস্ট করে সোজা ভার্সিটি। অবশ্য গাড়ী নিয়ে যাবে। রিকশা করে যাওয়াটা আদ্রের সরাসরি নিষেধ।

ভার্সিটির গেইটের সামনে দাড়িয়ে আছে মিহিয়া। কতো অচেনা লাগছে ক্যাম্পাসটা। কতোদিন পর এলো ক্যাম্পাসে। সবকিছু যেন পাল্টে গেলো। আসলেই কোথাও বেশ কয়েকটা দিন যাওয়া না হলে পরবর্তীতে সেটা চিনতে বেশ অসুবিধা হয়। বাস্তবতা বলে কথা! চারদিকে তাকিয়ে দেখছে মিহি্। তার দেখার মাঝেই এসে উপস্থিত হলো ছায়া। মিহিয়া ছায়াকে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরলো। ফোনে টুকটাক কথা হলেও সামনাসামনি একদমই দেখা হয়নি একদমই!

-কেমন আছিস মিহু?

-বেশ ভালো, তুই?

-বেশ ভালোই, তবে তোকে ছাড়া একদমই ভালো ছিলাম নারে।

-উফস, বাদ দে ওসব কথা। এখন ক্লাসে চল।

-হুম।

দুজনেই হাটা দিলো ক্লাসের দিকে। মাঝপথে তাদের থামিয়ে দিলো একদল বখাটে। বখাটে বললে ভুল হবে! তারা সিনিয়র! ফাইনাল ইয়ারের। প্রায়শই মিহিয়াদের ডিস্টার্ব করে তারা। বিশেষত মিহিয়াকে। সেদিনের পর থেকে, যেদিন আদ্র মিহিকে সকলের সামনে কনসার্টে প্রপোজ করেছিল। প্রায় প্রতিটা দিনই এমন করতো। দু’মাস পরে এসেও শান্তি পেলো না তারা। আজও ঠিক একইরকম!

-মিহিজান! আমার প্রপোজাল কখন একসেপ্ট করবা?

-…….

-কি হলো জান? বলো!

-কি সমস্যা আপনাদের? এভাবে পথ না আপনাদের হয় না?… রেগে বলে উঠল ছায়া।

-নো শালিকা! আগে একসেপ্ট করুক তারপর আর আসবো না এভাবে পথ আটকাতে। হি হি হি।

মিহিয়া তাদের সাথে আর কথা না বলে ছায়ার হাত ধরে নিয়ে এলো ক্লাসরুমে। তারপর প্রতিটা ক্লাস শেষ করে যে যার বাড়ীতে চলে এলো।
_________________

সেদিনের পর থেকে কেউ আর ফোন না করলেও বেশ ভয়ে ছিলেন মাহবুব আলম আর রোকেয়া বেগম। তবে ভয়টা আরও বাড়িয়ে দিলো কিছুক্ষণ আগের ফোনটা। তাও রাত ০৩:৩৩ মিনিটে। এতো রাতে ফোন দিলে মানুষের নিশ্চয় ভয় হওয়ারই কথা। ঠিক একইরকম ভয় পেলেন তারা। ভাবছেন তাহলে কি নিশ্চয় কোনো গভীর চক্রান্ত ফেঁসেছেন তারা? কিন্তু তাদের এমন করে হুমকি দেয়ার মানে বুঝতে পারছে না তারা! সর্বশেষ যে ছিলো তাকে তো নিঃশেষ করো দিয়েছিল সবশেষে তার মেয়েকেও। কিন্তু কেন তাদের আবারও এমন হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে? তাহলে তাদের সাথে অন্যকারো শত্রুতা সৃষ্টি হয়ে গেলো নাকি পূর্বেকার জের ধরে কেউ তাদের এমন হুমকি দিচ্ছে? নাকি তাদের চেনাজানা কেউ? কেই বা হতে পারে? তাদের মনের ভিতর চলছে এসব আজবগুজি চিন্তা ভাবনা। সামনে কি ঝড় আসতে চলেছে সেটাই ভাবছেন মিস্টার মাহবুব ও মিসেস রোকেয়া। তবে আগুন্ত্বকের বলে শেষ কথাটার হিসাব কিছুতেই মেলাতে পারছে না তারা। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ানক কোনো শাস্তি! যেটা তাদের অজানা!

#চলবে