তোর নেশায় মত্ত পর্ব-০৫

0
1111

#তোর_নেশায়_মত্ত
#লেখনীতে- আবরার আহমেদ শুভ্র
পর্ব- ০৫
_______________

শীতের সন্ধ্যায় পাখীরা সব ফিরে যায় আপন নীড়ে!অন্ধকারের শুরুতেই কুয়াশায় আচ্ছাদিত হয়ে যায় চারদিকটা। শিশিরে ভিজে যায় তৃষ্ণার্ত প্রকৃতি! সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য শীতের বিকেলবেলা! সূর্যের অস্ত যাওয়া মুহুর্তের সময় টা। রক্ত লাল হয়ে উঠে পশ্চিমা আকাশ!আর সবচেয়ে লোভনীয় শীতের এই রাতখানা! যেথায় একদিকে কিছু মানুষ প্রিয়জনের সাথে সেরা মুহুর্তগুলো কাটানোর স্বপ্নে বিভোর হয়! অন্যদিকে কিছু মানুষ খুব কাছের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অবহেলা নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দেয়! নির্ঘুম রাত কাটানো মানুষদের মাঝে মিহিয়াও একজন হয়ে উঠেছে।

কিছুদিন যাবৎ স্বপ্নে নিজ বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যা হতে দেখে আতংকে আছে মিহি। স্বপ্নে অসহ্য মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতঁরায় মাহবুব আলম। কিন্তু তার বাবার এমন বেহাল দশা করা লোকটার চেহারা পুরোটাই ঝাপসা দেখে সে। অথচ সেই মুহুর্তে তার বাবার দিকে তাকালে স্পষ্ট মাহবুব আলমের রক্তাক্ত মুখখানা দেখতে পায় কিন্তু আগুন্ত্বক ব্যক্তির চেহারার সম্পূর্ণই ঝাপসা! কিন্তু কেন! লোকটি কি পুরুষ নাকি মহিলা সেটা বুঝতে না পারলেও এটা বুঝতে পেরেছে তার বেশভূষা অনেকটা মহিলার মতোন! তাহলে কি তার বাবার এমন দশার পিছনে অন্য কোনো রহস্য আছে? স্বপ্নটা তার শোনা রোকেয়ার কথাগুলোর সাথে অনেকটা মিলে যায়। যার কারণে রোকেয়া ভাড়াকরা লোকদের দিয়ে মেরে বাড়ীর বাইরের রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলো! তাহলে কি তার স্বপ্ন আর বাস্তবের রোকেয়ার মাঝে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? ভাবতে থাকে সে। ঘুমের ঘোরে এমন ভয়ংকর স্বপ্নটাই খালি দেখছে সে! সকালে নিজ রুমে বসে এসব নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। ভাবনার ছেদ পড়লো শাহানা ইয়াসমিনের ডাকে।

-মিহি মা, কি ভাবছো?

শাহানা ইয়াসমিনের ডাকে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে হালকা হেসে উত্তর দিলো,

-এই তো মামনি, কিছু না! এই এমনি বসে ছিলাম। আর সামনে পরীক্ষা তো তাই একটু টেনশনে হচ্ছে।

-ওহ আচ্ছা, এই ব্যাপার! টেনশন নিও না মা, আদ্র তো আছেই সেও ইকোনোমিকস এর স্টুডেন্ট। আদ্রই তোমাকে হেল্প করবে। এখন চলো ফ্রেশ হবা। আজ একটা বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাবো তোমায়।

-কোথায় মামনি?

-সেটা নাহয় গেলেই জানতে পারবে।

-হুম।

-লক্ষী মা আমার, যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।

-আচ্ছা, যাচ্ছি।

শাহানা ইয়াসমিন খুশি মনে মিহিয়ার রুম থেকে প্রস্থান করলেন। আজ মিহিয়ার সামনে রহস্যের কিছুটা খোলাসা করবেন বলে ভেবেছেন। তাই তার এমন প্রস্তুতি!
_______________

মাহবুব আলম ও রোকেয়া বেগম দু’জনই তাদের পার্সোনাল উকিল জামাল শিকদারের চেম্বারে বসে আছেন। দুজনই আজ আর্জেন্ট দেখা করতে চেয়েছিলেন এডভোকেট জামাল শিকদারের সাথে। প্রপার্টি সম্পর্কীত কিছু বিষয়ে। মাহবুব আলম বলে উঠলেন,

-মাহবুব সাহেব আজ এতো জরুরী তলব! কারণটা বলুন।

-হা, জামাল সাহেব ইমপোর্ট্যান্ট কিছু কথা নিয়ে আপনায় আর্জেন্ট দেখা করতে বলেছিলাম।

-তো শুরু করোন।

-আসলে আমরা চাই প্রপার্টিগুলো সব নিজেদের নামে করে ফেলতে। তো আমার মেয়ে মানে যে ছিলো মিহিয়া ওর সব কি এখন নিজের নামেই করা যাবে?

-ওয়াট! কি যা তা বলছেন? ওর ভাগের সবগুলো প্রপার্টি ওরই থাকবে। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধতা করে এসব নেয়া যাবে না। তবে একটা সুযোগ আছে।

সুযোগের কথা শোনে মাহবুব – রোকেয়া দু’জন দু’জনের দিকে তাকালো। শান্ত হয়ে বলল,

– কি সুযোগ?

-মার্ডার…

চমকে উঠলো দুজনেই। মার্ডার করতে হবে! কাকে? দুজনেই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো উকিল সাহেবের দিকে।

-মানেহ্?

-মানে টা হো আপনাকে আপনার মেয়ে মিহিয়াকে মার্ডার করতে হবে। কেউ যানবে না। এন্ড ইট হেজ টু বি ডান ইন সাচ আ ওয়ে দ্যাট নো ওয়ান ইভেন ফীল ইট!

-তারপর!

-তারপর আর কি সবকিছুর মালিক আপনারাই। এবং এটার সকল দায়িত্ব আমিই নেবো। ট্রাস্ট মি!

মাহবুব আলম ও রোকেয়া বেগমের চোখ চকচকিয়ে উঠলো তাদের চক্ষুশূলকে দূর করতে পারলেই খেল খতম!
হা, মাহবুব আলমের সকল সম্পত্তির মালিক মিহিয়া। যেটা মিহিয়ার দাদা ওর নামেই করে গিয়েছিলো। রোকেয়া বেগম হলো মিহিয়ার বাবার প্রাক্তন। যার সাথে কলেজ লাইফ থেকেই প্রেমে মত্ত ছিলো মাহবুব আলম। মিহিয়ার মায়ের মিসিং এ মাহবুব আলম আর রোকেয়া বেগমের হাত রয়েছে সেটাতে নিশ্চিত হলো মিহিয়া। কারণ, শাহানা ইয়াসমিন মিহিয়াকে সেখানেই নিয়ে গিয়েছিলো যেখানে মাহবুব আলম আর রোকেয়া বেগম আজ গিয়েছিলো। মানে জামাল শিকদারের কাছে। মিহিয়া আহত দৃষ্টিতে শাহানা ইয়াসমিনের পানে তাকালো। শাহানা ইয়াসমিন তাকে অভয় দিলেন আর শান্ত থাকতে ইশারা করলেন।

তাদের ভাবনার মাঝেই মাহবুব আলম বলে উঠলেন,

-আমি এখুনি চাই ওই মিহিকে মার্ডার করতে। আমার সম্পত্তির প্রয়োজন। এতে যদি নিজের আপন কেউকে বিসর্জন দিতে হয় তাতেও আমার হাত কাঁপেনি আর কাঁপবেও না। আ’ল ডু দ্যাট এট এনি কস্ট!

-ওকে, তাহলে নেমে যান নিজেদের কাজে। যতই তাড়াতাড়ি কাজ কমপ্লিট হবে ততোই আপনার লাভ মিস্টার মাহবুব।

-ওগো, তুমি যেভাবেই পারো মিহিকে বাসায় নিয়ে আসো। আমার মনে হয় মিহি এই শহরেই আছে। তাকে এনে কয়েকটা দিন ভালোমন্দ খাওয়াও তারপর না হয় বিদায় দিও পৃথিবী থেকে। হা হা হা।… বলে হো হো করে তিক্তময় হেসে উঠলো সে।

-হুম, মনের কথায় বললে! যায়হোক, মিস্টার জামাল আমরা তাহলে আজ উঠি। ঠিক একমাস পর দেখা হবে। সি ইউ ভেরী সোন!

-বেস্ট অফ লাক, মিস্টার মাহবুব।

বের হয়ে গেলো মাহবুব আলম ও রোকেয়া বেগম। তবে মাহবুব আর রোকেয়া বের হওয়ার আগ মুহুর্তেই মিহিয়াকে নিয়ে শাহানা ইয়াসমিন আড়ালে চলে এলেন। তারপর খুব সাবধানতার সাথে সেখান থেকে সরে নিজেদের গাড়ীতে চড়ে বসলেন। মিহিয়া মাথা নিচু করে বসে রইল। সে ভাবছে, যাকে সে নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষই মনে করতে আজ সে মানুষটাই তাকে খুন করার চিন্তায় মেতে আছে। তাহলে কি পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষই নিজের স্বার্থে এতোটাই অন্ধ যে তার প্রিয় মানুষের প্রাণ নিতে একটুকু পরিমাণ হাত কাঁপে না? তবে কি তার মায়ের হত্যাকারীও তার বাবা? না না কোনো বাবা নয়! সে বাবা হতে পারে না। সে একজন খুনি, স্বার্থলোভী খুনি! তাহলে স্বপ্নটা কি এই রহস্য উদঘাটনে কোনো হেল্প করবে আমায়? কেনই বা এমন বিকৃত স্বপ্ন দেখছি আমি মিস্টার মাহবুবকে নিয়ে? সেই বা কেন এমন করে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হবে?ভাবতে লাগলো মিহি। তবুও সে মনে মনে আওড়াচ্ছে,

-মিস্টার মাহবুব, আ’ল টেক রিভ্যান্জ! আ’ল এভ্যান্জ মাই মম’স ডেথ! ডোন্ট লিভ এনিওয়ান!

মিহিয়াকে কোনো কিছু আওড়াতে দেখে শাহানা ইয়াসমিন মিহিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে ড্রাইভিং এ মন দিলেন। হা, শাহানা ইয়াসমিন নিজেই ড্রাইভ করে এসেছিলেন মিহিয়াকে সাথে নিয়ে। তিনি তো এটাই চেয়েছেন এই নির্লজ্জ, পাষাণ মানুষটার আসলরূপ দেখিয়ে দিতে। পেরেছেন তিনি সেই কাজটা করতে আজ। যেটার জন্যই এতোদিন অপেক্ষায় ছিলেন।
_______________

মিহিয়াদের আসার আগেই আদ্র বাড়ী এসেছিল। অবশ্য এসে প্রথমে মিহিয়ার খোঁজ নেয়ার মুহুর্তে যখন সারভেন্টদের কাছ থেকে জানতো পারলো তারা বের হয়েছে তাই আর কিচ্ছু বলে নি। নাহয় তুলকালাম বাধিয়ে ফেলতো বাড়ীতে!

আজ অনেকদিন পর লাইভে আসবে আদ্র। একদম বাড়ীতে বসেই করবে লাইভ! সেদিন মিহিয়াকে প্রপোজ করার পর আর দেখা যায় নি তাকে। সমস্ত সোশাল মিডিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল সে! কিন্তু আবারও লাইভে আসতে হলো তাকে। তাই আজ সময় পেয়ে চলেও এলো! লাইভে তার ভক্তদের জোয়ার বইছে! একেকজনের একেক মন্তব্য! আর প্রশ্নের প্লাবন! সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলেও কিছু কিছু উত্তর দিয়ে কথা বলা শুরু করলো,,

-হ্যালো গাইজ, অনেকদিন পর চলে এলো তোমাদের সাথে লাইভে! আজ তোমাদের পছন্দের কিছু গান গাইবো। সবগুলোই তোমাদের পছন্দের! আই হোপ, সব গানই পছন্দের হবে তোমাদের! সো, লেটস্ স্টার্টেড! শুরু করলো পছন্দের একটি গান। যেটা মিহিয়ারও পছন্দের তালিকায় সবচেয়ে উর্ধ্বে!
—— মিউজিক স্টার্ট…

তুই আমাকে আগলে রাখ
ঠিক এভাবে সঙ্গে থাক
সারাদিন … সারারাত …
তুই আমাকে আগলে রাখ
ঠিক এভাবে সঙ্গে থাক
সারাদিন … সারারাত …

আমি তোর আয়না হবো আজ
তুই শুধু ইচ্ছে মতো সাঁঝ
আমি তোর আয়না হবো আজ
তুই শুধু ইচ্ছে মতো সাঁঝ
রোদ্দুরে, যায় উড়ে, মন জাহাজ …
তুই আমাকে আগলে রাখ
ঠিক এভাবে সঙ্গে থাক
সারাদিন … সারারাত …
তুই আমাকে আগলে রাখ
ঠিক এভাবে সঙ্গে থাক
সারাদিন … সারারাত …
মেঘলা আকাশে, রংধনু হাসে
তুই এঁকে নে, তুই মেখে নে …
মুখচোরা আলো, রাস্তা হারালো
তুই খুঁজে নে, মন বুঝে নে …
আমি তোর আয়না হবো আজ
তুই শুধু ইচ্ছে মতো সাঁঝ
আমি তোর আয়না হবো আজ
তুই শুধু ইচ্ছে মতো সাঁঝ
রোদ্দুরে, যায় উড়ে, মন জাহাজ …
তুই আমাকে আগলে রাখ
ঠিক এভাবে সঙ্গে থাক
সারাদিন … সারারাত …
তুই আমাকে আগলে রাখ
ঠিক এভাবে সঙ্গে থাক
সারাদিন … সারারাত …

এভাবেই বেশ কয়েকটি গান গেয়েছে সে। প্রতিটা গানই মিহিয়ার পছন্দের। তার কারণও আছে! সে তার রুমের বড় আয়নাতে মিহিয়াকে দেখেছে দড়জার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে! সে জানে মিহি তার গানের প্রচণ্ড রকম ভক্ত! তাই সে প্রতিটি গানই গেলো মিহির পছন্দের! যেগুলি মিহি প্রতিদিনই শোনে। মিহি অবাক হলো যে আদ্র আজ তার পছন্দের সব গান গাইছে। মনে মনে সে আদ্রকে ধন্যবাদ দিলো যে তার মন ভালো করে দেয়ার জন্য। আর আদ্র সে দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কয়েকটা গান গেয়ে দর্শকের উদ্দেশ্যে কিছু বলে দ্রুত লাইভ এন্ড করলো। তারপরে এগিয়ে গেলো দড়জার দিকে যেখানটাই তার প্রিয়সির উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।

মিহিয়া গান শোনায় এতোটাই মত্ত ছিলো যে পারিপার্শ্বিক ভাবনা নিয়ে কোনো হুশ ছিলো না। আদ্র একদম সোজা হয়ে পকেটে দু’হাত গুঁজে দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মিহিয়ার সামনে। হঠাৎ গান বন্ধ হওয়ায় হুশে এলো যে, সে আদ্রের রুমের সামনে দাড়িয়ে আছে! কিন্তু তার সামনে আদ্র কে এমন দাড়াতে দেখবে সে ভাবতে পারে নি! চমকে গেলো সে! তাড়াতাড়ি চলে যেতে নিলে আদ্র মিহিয়ার কোমড় ধরে কাছে টেনে নেয়। আদ্রের এমন ব্যবহারে আশ্চর্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলো মিহি। গোল গোল হয়ে এলে চক্ষুজোড়া। মুহুর্তেই লজ্জায় গালদুটো লাল হয়ে গেলো তার!

#চলবে…

[গল্পটা সম্পুর্ণ কাল্পনিক, দয়া করে কেউ বাস্তবের সাথে মেলাতে যাবেন না। সবশেষে, ভুলত্রুটি মার্জানীয়।]