তোর রঙে রাঙাবো পর্ব-০৯

0
1793

#তোর_রঙে_রাঙাবো
#Part_09
#Writer_NOVA

কালো মেঘে পুরো আকাশ ঢেকে গেছে। পড়ন্ত বিকেলটা দেখতে এখন রাতের মতো লাগছে।আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। সাথে থেকে থেকে বিজলি চমকাচ্ছে। এলোমেলো বাতাসতো আছেই। প্রকৃতি আজ এক ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এই বুঝি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। একটু আগেও বাইরের আবহাওয়াটা ছিলো ঠান্ডা। কিন্তু এখন তান্ডব করছে।

গত কয়েকদিন ধরে এরকম দেখতে দেখতে অভস্ত্য হয়ে গেছে পুষ্প।এখন আর প্রথম দিনের মতো এতটা ভয় করে না।খবরে শুনেছে বঙ্গোপসাগরে নাকি নিম্নচাপ উঠেছে। এখানে তাও অবস্থা বেশ ভালো।কিন্তু দূর্গম অঞ্চলে আবস্থা বেগতিক।কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দিয়েছে। জানালা দিয়ে পাতা,ধূলো,বালি চলে আসছে।তাই উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো।আবার এসে বিছানায় থম মেরে বসে রইলো।

পুষ্পঃ গত কয়েকদিন ধরে ইলেক্ট্রিসিটি নেই।আমাদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে বাতাসে বিদ্যুতের পিলার ভেঙে পরেছে।বাসার সবার মোবাইল বন্ধ। তাসিনকে যে একটা কল করে বলে দিবো তারও সুযোগ নেই।এই দূর্যোগে বাসা থেকে বেরুনো বন্ধ করে দিয়েছে ভাইয়া।নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য। কিন্তু আমার কাছেও তো কোন উপায় নেই। ঘরে বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছি।

বিকট শব্দে আকাশ কাঁপিয়ে বিজলি চমকে উঠলো। বিজলির সাথে সাথে পুষ্পও চমকে উঠেছে। বুকে থু থু দিয়ে বড় করে একটা নিশ্বাস ছারলো।

পুষ্পঃ এই বিজলি বাবাজিও আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। একেকটা বিজলি চমকাচ্ছে না তো মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে পরছে। কবে যে সবকিছু আবার স্বাভাবিক হবে। দেখো কান্ড, বাতাসের বেগটাও বেড়ে গেছে। সাথে ঝুম বৃষ্টি। আকাশের অবস্থা এমন না থাকলে এখন বৃষ্টিতে ভেজা যেতো।

বাতাসের কারণে বারান্দার দরজাটা এদিক সেদিক নড়াচড়া করে শব্দ করতে লাগলো।পুষ্প উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে কি ভেবে যেনো একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। তার চোখ দুটো নিচের রাস্তার দিকে যেতেই সে আৎকে উঠলো।

পুষ্পঃ তাসিন!!!!! (অবাক হয়ে)

তাসিনকে এই সময় দেখে সে বেশ অবাক হলো।ঝুম বৃষ্টির কারণে স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছে না। তারপরেও ছেলেটা যে তাসিন তা বুঝতে পুষ্পর কোন অসুবিধা হয়নি।বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তাসিন।চোখ দুটো মুগ্ধ দৃষ্টিতে এখন পুষ্পর দিকে আবদ্ধ। স্পষ্ট না দেখলেও তাসিন জানে এটা তার পুষ্পরাণী।ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটলো।তার চোখের তৃষ্ণা এতক্ষণে মিটেছে।

তাসিনঃ অবশেষে আমি তোমার দেখা পেলাম।গত তিন দিন ধরে তোমাকে দেখি না।যেখানে একটা দিন তোমাকে চোখের আড়াল করলে নিজেকে আমার পাগল পাগল মনে হয়। সেখানে তিনটা দিন যে আমি কি করে কাটিয়েছি তা শুধুমাত্র আমিই জানি।যদিও তোমাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবুও আমি সিউর বারান্দায় তুমি দাঁড়িয়ে আছো পুষ্প।তোমার অবয়ব দেখে তো আমি চিনবোই।যেখানে তোমার ছায়া আমার চেনা।(বিরবির করে)

পুষ্প অবাক চোখে বারান্দা থেকে উঁকি মেরে তাকিয়ে
দেখছে তাসিনকে।এই ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে এখানে কি করছে সে?সারা শরীর ভিজে একেকার।জামা-কাপড় লেপ্টে আছে শরীরে।

পুষ্পঃ এই ছেলেটার কি কোন আক্কেল জ্ঞান নেই। এই বৃষ্টির মধ্যে এখানে কি করছে।নিজেতো মরবে সাথে আমাকেও মারবে।কিরকম করে বিজলি চমকাচ্ছে। তাও ওর মনের মধ্যে এক ফোঁটা ভয় আছে।ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে একদিন না দেখলে কি মরে যাবে?কিন্তু একদিন এই দূর্যোগের ঝুম বৃষ্টিতে ভিজলে তো ওর জ্বর এসে পরবে।সেটা কেন বুঝে না ও।নাহ্ এই ছেলেটার পাগলামি নিয়ে আমি আর পারি না।

🌺🌺🌺

আকাশ ফাটিয়ে পাশেই একটা বাজ পরলো।সেটার শব্দে পুষ্প দুই কান ধরে চোখ বন্ধ করে জোরে একটা চিৎকার করে উঠলো।বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে।চোখ খুলে দেখলো তাসিন সেভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ অবাক প্লাস ভয় পেলো পুষ্প।

পুষ্পঃ আচ্ছা, এই ছেলেটার কি মৃত্যুর ভয় নেই। বাজ পরলো তারপরেও তার মাঝে কোন ভাবান্তর নেই। নিজেকে কি শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।বাতাসে মনে হচ্ছে গাছপালা উল্টে যাবে তাও সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে।এভাবে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পরবে।

পেছনে শব্দ হতেই চমকে তাকালো পুষ্প।বাতাসে বারান্দায় থাকা ফুলের টব নিচে পরে ভেঙে গেছে। সেটার শব্দে সে ভয় পেয়ে গেছে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তাসিনের দিকে তাকাতেই সে অবাক হয়ে গেলো। সেখানে কেউ নেই। দৌড়ে রুমে ঢুকে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পরলো। বাবা-মা কি জানি নিয়ে কথা বলছিলো তাই ওকে দেখতে পাইনি।সাথে করে একটা টাওয়াল নিতেও ভুললো না সে।সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আশেপাশে খুঁজতে লাগলো। বৃষ্টির বেগটা কমলেও বাতাসের বেগ কমে নি।মনে হচ্ছে পুষ্পকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।এদিক সেদিক তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় তাসিনকে ডাকলো সে।

পুষ্পঃ তাসিন! তাসিন! কোথায় আপনি? জলদী সামনে আসেন।এই অন্ধকারে আমার ভীষণ ভয় করছে।আমি শুধুমাত্র আপনার জন্য নিচে নেমে এসেছি। নয়তো আমি এই অন্ধকারে কখনি আসতাম না।এখানে বেশ কিছু সময় একা থাকলে আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবো।

অপর দিক থেকে কারো সাড়াশব্দ এলো না।ভয়ে পুষ্পর শরীর জমে আসছে।হাত-পা অলরেডি বাতাসের কারণে ঠান্ডা হয়ে গেছে। আশেপাশে গভীরভাবে চোখ বুলাতে লাগলো পুষ্প।একসময় তাসিনকে সে দেখতে পেলো।ওমনি ভয় লেজ গুটিয়ে পালালো।মৃদু হেসে সেদিকে পা টিপে টিপে যেতে লাগলো।দেয়ালের পাশে হাঁটু ভেঙে বসে আছে তাসিন।দৃষ্টি তার মাটির দিকে।উপরে ছাউনি থাকায় বৃষ্টির পানি পরছে না।

পুষ্পঃ বুদ্ধি কি সব লোপ পেয়েছে আপনার?এই বৃষ্টির মধ্যে কি করছেন এখানে?নিজের কোন খেয়াল রাখেন না।আপনাকে না দেখতে পেয়ে কতটা টেনশন হচ্ছিলো আমার জানেন।শেষ পর্যন্ত রুমে থাকতে পারলাম না।আপনার কাছে চলে আসতেই হলো।নিজেকে কি ভাবেন আপনি? সুপারম্যান নাকি? যে বৃষ্টিতে ভিজলে আপনার কিছুই হবে না। আপনার কথা নাহয় বাদই দিলাম।আপনি সুপারম্যান বলে আপনার কিছু হবে না। কিন্তু তাহার কথা তো ভাববেন?আপনার কিছু হলে ওর কি হবে?

পুষ্পর কথা শুনে তাসিন নিচের দিক থেকে চোখ তুলে তাকালো।বিজলির আলোতে তাসিনের মুখটা দেখে পুষ্প ভয় পেয়ে গেলো।চোখ দুটো লাল টুকটুকে হয়ে আছে।চুলগুলো এলোমেলো,মুখে বিষন্নতা,পোশাক কুচঁকে আছে।পুরো বিধ্বস্ত অবস্থা ওর।কিন্তু তাসিনের চোখে ছিলো শান্ত চাহনি।ধীরে সুস্থে সে বসা থেকে উঠে পুষ্পের দিকে এগুতে লাগলো।

পুষ্পঃ তাসিন কি হয়েছে আপনার?এই অবস্থা কেন?আপনাকে এতো অগোছালো দেখাচ্ছে কেন?কোন সমস্যা হয়েছে কি?আমাকে বলতে পারেন।আমি আমার যথাসাধ্য দিয়ে আপনাকে হেল্প করবো।তাহা ঠিক আছে তো?আপনি আমার দিকে এভাবে এগুচ্ছেন কেন?দেখুন, আপনাকে আমার ভীষণ ভয় করছে।উত্তর দিচ্ছেন না কেন?আপনাকে আবার ভূতে ধরলো
না তো🥶!!

🌺🌺🌺

তাসিন ভাবলেশহীন ভাবে পুষ্পর দিকে এগিয়ে আসছে।আর পুষ্প ছাতা ধরে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে পেছনে পেছাতে লাগলো।পা পিছলিয়ে পড়তে নিলে তাসিন হেচকা টানে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মুখ গুঁজে দিলো।ঘটনাটা এতো দ্রুত হয়েছে যে পুষ্পর বুঝতে কিছুটা সময় লেগে যায়।হাতের থেকে ছাতাটাও পরে যায়।যখন বুঝতে পারে তখন সারা শরীর হিম হয়ে আসছে।ওর কাঁধে ঠান্ডা অনুভব পেয়ে বুঝতে পারে তাসিন কাঁদছে। কিন্তু কেন?তাসিন তো খুব সহজে কাঁদার মতো ছেলে নয়।হাজারটা প্রশ্ন এসে উঁকি ঝুঁকি মারছে পুষ্পর মনে।পুষ্প কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

পুষ্পঃ আপনি কান্না করছেন কেন?সত্যি করে বলুন তো কি হয়েছে আপনার? আপনার ব্যবহারগুলো আমার খুব অদ্ভুত লাগছে।কখনো তো আপনি এরকম করেন না।হুট করে কান্না বা করছেন কোন কারণে।(ভয়ে ভয়ে)

তাসিন কোন উত্তর দিলো না।কিন্তু ওর ফোঁপানোর আওয়াজ ঠিক পাচ্ছে পুষ্প। হুট করে ওকে ছেড়ে ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো তাসিন।নাহ্ এবার মনে হয় পুষ্প জ্ঞান হারাবে।এতকিছু একসাথে নিতে পারছে না।এ কোন রূপ তাসিনের।

তাসিনঃ জানো আমি তোমাকে ঠিক কতটা মিস করছিলাম।এই তিনটা দিন আমি যে কি করে কাটিয়েছি তা তোমাকে বুঝাতে পারবো না পুষ্প। তোমার মোবাইলে এই পর্যন্ত না হলেও হাজারবার কল করেছি।মোবাইল বন্ধ পেয়েও বারবার করেছি।যদি তুমি একবার হলেও মোবাইল অন করো।সেই আশায় প্রতি মিনিটে মিনিটে আমি তোমায় কল করেছি।তোমায় এক পলক দেখার জন্য কতটা ছটফট করেছি।তাই আজ না পেরে এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে এখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম।আমার বিশ্বাস ছিলো আমি তোমাকে দেখতে পাবো।আমার বিশ্বাসটা সত্যি হলো।চলেই যেতাম।কিন্তু তোমাকে দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না।অপলক দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।তোমাকে দেখতেই আমার ভালো লাগা কাজ করছিলো। তাই মন ভরে তাকিয়ে দেখছিলাম।জানো পুষ্প, আমি নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে হয়রান হয়ে যাচ্ছি ।তোমাকে আর রাইপরীকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।দয়া করে তোমরা দুজন এমন কোন কাজ করো না যাতে আমি হিংস্র হতে বাধ্য হয়।প্লিজ তোমরা এমন কোন কাজ করো না। আমার একটাই অনুরোধ।

পুষ্পর হাত দুটো নিজের মুঠোয় এনে শেষ অনুরোধটা করলো তাসিন।পুষ্প নিষ্পলক চাহনিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যত দিন যাচ্ছে পুষ্প তাসিনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছে।এই ছেলেটাকে আজও বুঝতে পারলো না সে।করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাসিন।ওকে এই মুহুর্তে অনেক অসহায় দেখাচ্ছে।

পুষ্পঃ আপনার কোন কথাই আজ আমি বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে কি এমন হলো আপনার?আপনি আমার কথার উত্তর কেন দিচ্ছেন না।

তাসিনঃ অপেক্ষা করো, তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর তোমরা পেয়ে যাবে।কিন্তু আমার অনুরোধটা রেখো।সেটা অমান্য করো না।

কথাটা বলে তাসিন আবারো পুষ্পকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।তারপর দ্রুত হেঁটে গেইটের দিকে যেগে লাগলো।পুষ্প ছাতাটা উঠিয়ে কয়েকবার তাসিনকে ডেকে ছাতা নিয়ে যেতে বললো।কিন্তু তাসিন একবারো ফিরে তাকালো না।তাসিন ভেজা কাপড়ে থাকার কারণে পুষ্প অনেকটা ভিজে গেছে।বৃষ্টির বেগ আবারো বেড়ে গেছে। হাতের ছাতাটা উল্টো দিকে থাকায় পুষ্প চুপচুপা ভিজে গেছে।

কিন্তু সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। সে এখনো তাসিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো চুইয়ে চুইয়ে চুল থেকে টপটপ করে পরছে।আজ মায়ের হাতে নিশ্চিত বকুনি খাবো পুষ্প।সেটার কথাও ভাবছে না।সে এখনো তাসিনকে নিয়ে পরে আছে।এই ছেলেটা হুট করে এসে নানা কথা বলে আবার হুট করেই লাপাত্তা হয়ে যায়।কিন্তু সে যাওয়ার পর অপর মানুষটার মনের ভিতর কিরকম ঝড় তুলে তা সে কি আদোও টের পায়?নাকি নিজের মনের কথাগুলো ব্যক্ত করতে পারলেই ভাবে সে জিতে গেছে। পুষ্পর চোখ দুটোও ভিজে আসছে।ঝাপসা চোখে সে এখনো গেইটের দিকে তাকিয়ে আছে। যদি আরেকবার এক পলক তাসিনকে দেখতে পায়।

#চলবে

রিচেইক দেইনি।ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।